আলোর চেয়েও বেশি বেগের কণা আবিষ্কার!!!
আইনস্টাইন বলেছিলেন, আলোর চেয়ে বেশি বেগে আর কেউ ছোটে না এই ব্রহ্মাণ্ডে। শূন্যস্থানে আলো এক সেকেন্ডে পাড়ি দেয় ২৯৯,৯৯২,৪৫৮ মিটার। এর চেয়ে বেশি বেগে দৌড়তে পারে না আর কোনও কিছুই। এই দাবি (যা আগে বহু পরীক্ষায় প্রমাণিত) আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের ভিত। বস্তুত ওই গতিসীমার উপর দাঁড়িয়ে আছে গোটা পদার্থবিদ্যার অনেকখানি। কিন্তু ২৩ সেপ্টেম্বর ইটালীয়ান পদার্থবিদদের এক এক্সপেরিমেন্টের কারনে নড়ে গেছে এই ভিত যা চলে আসছে সেই ১৯০৫ সাল থেকে! ইটালির গ্রানসাস্সো ন্যাশনাল রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে ভূগর্ভস্থ ১৪০০ মিটার নিচে পরিচালিত এই বিশেষ পরীক্ষাটিকে বলা হয় অপেরা (Oscillation Project with Emulsion-tRacking Apparatus) এক্সপেরিমেন্ট। ৭৩০ কি.মি. দুরে সুইজারল্যান্ডের জেনেভাতে অবস্থিত ইউরোপের প্রথম হাই-এনার্জি ফিজিক্স ল্যাবে (সিইআরএন) বেরিয়ে আসা নিউট্রিনোর বিচ্ছুরণকে স্টাডি করতে এক্সপেরিমেন্টটি ডিজাইন করা হয়। এই নিউট্রিনোর বিচ্ছুরনের ফলাফলই ধাক্কা দিয়েছে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানকে!
আইনস্টাইনের মতে শূন্যস্থানে আলো এক সেকেন্ডে পাড়ি দেয় ২৯৯,৯৯২,৪৫৮ মিটার। জেনিভার কাছে ভূগর্ভে গবেষণাগার ‘সার্ন’ থেকে কাতারে কাতারে ছোড়া হয়েছিল বিশেষ জাতের কণা ‘নিউট্রিনো’। মাটি ফুঁড়ে সে কণারা গিয়ে পৌঁছয় ৭৩০ কিলোমিটার দূরে ইতালির গ্রান সাসো পাহাড়ে অন্য এক গবেষণাগারে। দেখা যায়, নিউট্রিনো ছুটছে সেকেন্ডে প্রায় ৩০০,০০৬,০০০ মিটার বেগে। ওই দূরত্ব পাড়ি দিতে আলোর লাগত ১ সেকেন্ডের ১০,০০০ ভাগের ২৩ ভাগ সময়। কিন্তু নিউট্রিনো কণাদের লেগেছে তার চেয়ে ১ সেকেন্ডের ১০০,০০০,০০০ ভাগের ৬ ভাগ কম সময়। অর্থাৎ নিউট্রিনোরা ছুটতে পারে আইনস্টাইন-কল্পিত গতিসীমা ছাড়িয়ে।
নিউট্রিনো হল একটি ইলেকট্রিক্যালি নিরপেক্ষ, ক্ষুদ্র এবং শূন্যের কাছাকাছি ভরযুক্ত মৌলিক সাব-এটমিক পার্টিক্যাল যা অন্যান্য ম্যাটারের সাথে কোন রকমের ইন্টারেক্ট করে না বললেই চলে। সূর্যের মধ্যে কিংবা নিউক্লিয়ার রিয়েক্টারে বা কসমিক রে যখন এটমকে আঘাত করে তখন এক বিশেষ ধরনের রেডিওএক্টিভ ডিকে বা নিউক্লিয়ার রিএকশানের কারণে এই পার্টিক্যালটি তৈরি হয়। এটা ইলেকট্রিক্যালি নিরপেক্ষ হওয়ার কারণে কোন রকমের আক্রান্ত হওয়া ছাড়াই সাধারণ ম্যাটারের ভিতর দিয়ে চলে যেতে পারে। নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী উল্ফগাং পাউলি ১৯৩০ সালে প্রথমে এই মৌলিক সাব-এটমিক পার্টিক্যালটির ব্যাপারে ধারনা দেন। বিখ্যাত ভারতীয় পদার্থবিজ্ঞানী এনাক্কাল চণ্ডী জর্জ (ই সি জি) সুদর্শন বহু কাল ধরে বলে আসছেন আলোর চেয়ে দ্রুততর কণার অস্তিত্বের কথা। কিন্তু তা এত কাল তাত্ত্বিক সম্ভাবনা হিসেবেই গণ্য হয়ে এসেছে। এ বার কি আইনস্টাইন ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়ে সমাদর পাবেন সুদর্শন?
যদি তাই হয়, তা হলে অন্তত তত্ত্বে হলেও সম্ভব হবে অতীতে পৌঁছে যাওয়া। টাইম ট্রাভেল ইনটু দ্য পাস্ট। নিজের শৈশবে ফেরত যাওয়ার মতো টাইম মেশিন এক্ষুনি না-ই বা তৈরি করা গেল, তাতে কী-ই বা যায়-আসে? তেমন সম্ভাবনার দরজা যদি খোলে, তাতেই বা মন্দ কী? প্রশ্ন এবং সম্ভাবনাগুলো নিয়ে তোলপাড় পদার্থবিদ্যার জগৎ। টুইটার, ফেসবুক, ব্লগ মন্তব্যে ছয়লাব।
নিউট্রিনো দৌড় পরীক্ষা করছিলেন যে সব বিজ্ঞানীরা তাঁদের মুখপাত্র এবং বার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আন্তোনিও এরিদিতাতো বলেছেন, “ফলাফল দেখে আমরা স্তম্ভিত। আমরা পরীক্ষা করেছি বহু মাস ধরে। খতিয়ে দেখেছি নানা দিক থেকে নানা ভাবে। এমন কোনও যান্ত্রিক ত্রুটি শনাক্ত করতে পারিনি, যা ব্যাখ্যা করতে পারে পরীক্ষার আশ্চর্য ফলাফল। আমরা তো আমাদের পরীক্ষা চালিয়ে যাবই। সেই সঙ্গে আমরা তাকিয়ে থাকব অন্যান্য দলের নিরপেক্ষ পরীক্ষার দিকে। জানতে চাইব আমাদের পর্যবেক্ষণ ঠিক কিনা।”
নিউট্রিনো পরীক্ষার অবিশ্বাস্য ফলাফল নিয়ে মন্তব্য করেছেন বিখ্যাত ব্রিটিশ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং। সাংবাদিকরা এ ব্যাপারে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেছেন, “এখনও মন্তব্য করার সময় আসেনি। আরও পরীক্ষা ও পর্যালোচনা দরকার।” আর এক ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী এবং রয়্যাল সোসাইটির প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট স্যর মার্টিন রিস বলেছেন, “অত্যাশ্চর্য দাবির সপক্ষে অত্যাশ্চর্য প্রমাণ প্রয়োজন। এটুকু বলতে পারি, এ দাবিটি অত্যাশ্চর্য।”
সার্নের যে বিজ্ঞানী দল নিউট্রিনোর ঝাঁক পাঠিয়েছিলেন সান গ্রাসো পাহাড়ের গবেষণাগার লক্ষ্য করে, তাঁদের নেতা সার্জিও বার্তোলুচি বলেছেন, “যখন কোনও পরীক্ষায় আপাত-অবিশ্বাস্য ফলাফল বেরিয়ে আসে এবং যার পিছনে কোনও যান্ত্রিক বা মাপজোখের ত্রুটি খুঁজে পাওয়া যায় না, তখন সাধারণ নিয়মেই ফলাফল পেশ করা হয় ব্যাপকতর যাচাইয়ের জন্য। গবেষকরা তাই করেছেন। এটা চমৎকার বৈজ্ঞানিক পদক্ষেপ। ফলাফল যদি চূড়ান্ত ভাবে প্রমাণিত হয়, তা হলে হয়-তো বদলে যাবে পদার্থবিদ্যা সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী। কিন্তু তার আগে আমাদের নিশ্চিত হতে হবে যে, গবেষকদের পরীক্ষায় কোনও ত্রুটি ছিল না, অথবা আর কোনও ভাবে নিউট্রিনোর অবিশ্বাস্য বেগ ব্যাখ্যা করা যায় না।”
ব্রিটেনে ম্যাঞ্চেস্টার ইউনিভার্সিটিতে কণা-পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক জেফ ফোরশ জানিয়েছেন, তিনিও তাকিয়ে থাকবেন অন্য পরীক্ষার ফলাফলের দিকে। এর তাৎপর্যের কথা ভেবেই। এক সংবাদসংস্থাকে তিনি বলেছেন, “আলোর বেগ শুধু ব্রহ্মাণ্ডে গতির ঊর্ধ্বসীমাই নয়, এর মধ্যে বাঁধা আছে কার্য-কারণ সম্পর্কও। এর জন্যই আগে কারণ না থাকলে কার্য হয় না। আলো যদি সর্বোচ্চ গতিশীল না হয়, তা হলে ভেঙে যাবে ওই সম্পর্ক। তখন আগে কার্য পরে কারণ।” অর্থাৎ ফোরশ বলতে চাইছেন, মৃত্যুর পরে গুলি বার হবে বন্দুক থেকে। ফোরশ-র কথায়, “নিউট্রিনো যদি সত্যি-সত্যিই আলোর চেয়ে বেশি বেগে দৌড়য়, তা হলে আজকের তথ্য পাঠিয়ে দেওয়া যাবে গত কালের কাছে। অন্য ভাবে বললে, টাইম মেশিনে চড়ে অতীতে ফিরে যাওয়ার যে বর্ণনা কল্পবিজ্ঞানে আখছার মেলে, তার কাছাকাছি। যদিও এর মানে এই নয় যে, আমরা খুব শিগগিরই বানিয়ে ফেলতে পারব অতীতযাত্রার টাইম মেশিন।”
সার সংক্ষেপঃ
জানা গিয়েছে, নিউট্রিনো কণার গতি সেকেন্ডে ৩ লক্ষ ৬ কিমি, যা আলোর চেয়ে বেশি।
সমস্যাটা কোথায়?
আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের সঙ্গে মেলে না। এত দিন জানা ছিল, ফোটন বা
আলোক-কণার ভর নেই, কারও বেগ তার চেয়ে বেশি হতে পারে না। সার্ন বলছে, আলোর
চেয়ে বেশি গতিসম্পন্ন কণা আছে, সামান্য ভরও আছে তার ।
ফল কী দাঁড়াবে?
ব্ল্যাক হোল থেকে বিগ ব্যাং, বিশ্বের নিয়মকানুন ব্যাখ্যার যাবতীয় তত্ত্ব
ও পদার্থবিদ্যার সূত্র নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।
সার্নের তথ্য কি প্রামাণ্য?
প্রথমে ঘাবড়ে গিয়েছিলেন সার্নের বিজ্ঞানীরাও। গত ক’মাস সমস্ত ফলাফল পরীক্ষার পরেই এই ঘোষণা।
আমেরিকা ও জাপান আরও পরীক্ষা করবে। ইন্টারনেটেও সার্নের তথ্য খতিয়ে দেখতে পারে বাকি বিশ্ব।
E = MC2 কি নির্ভুল?
আলোর চেয়ে বেশি গতি নেই ধরে নিয়েই বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব থেকে তৈরি হয়েছে এই সূত্র।
একে এখনই ‘বাতিল’ বলা না গেলেও, গতিসীমার ধারণাটাকে আর নির্ভুল বলা যাচ্ছে না।
যাই হোক, বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস অপেরা এক্সপেরিমেন্টের রেজাল্ট সূত্রপাত করতে যাচ্ছে এক নয়া দিগন্ত। কারণ, আপনি যদি আলোর গতিকে ত্যাগ করেন তাহলে ভেঙ্গে পড়বে স্পেশাল রিলেটিভিটির ভিত্তি। এখন আরকী!! অপেক্ষা তবে টাইম মেশিনে চড়বো চড়বো কবে…
সৌজন্যেঃ Hello-Today
11 Responses to আলোর চেয়েও বেশি বেগের কণা আবিষ্কার!!!
You must be logged in to post a comment Login