নীল নক্ষত্র

নক্ষত্রের গোধূলি, পর্ব-৪৭ (চতুর্থ অধ্যায়)

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

পূর্ব প্রকাশের পর-
কিছু দিন পর রাশেদ একদিন স্বপ্নে দেখে আকাশে বিশাল এক চাদের জোছনায় সমস্ত পৃথিবী আলোয় ভড়ে গেছে আর মাটিতে যত দূর দৃষ্টি যায় শুধু ফুল আর ফুল। রাশেদ মনির হাত ধরে একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে দেখছে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই মনিকে বলল মনি আমি আজ সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখলাম।
কি দেখেছ?
সব বলল। শুনে মনিও বলল
আমিও ঠিক এই স্বপ্নটাই দেখেছি, এমন সুন্দর চাদের জোছনা আর বাগান আমি কখনো দেখিনি।
হ্যাঁ মনি, কি জানি কি দেখলাম।
ভালোই দেখেছ। তখন ওরা কেউ এর কোন মানে বুঝেনি। রাশেদমনি বাগানে নতুন কুড়ির আবির্ভাব হচ্ছে এটা যে তারই আভাষ। এর প্রায় মাস দেড়েক পরে হঠাৎ করে মনি ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠেই বমি। একবার দুইবার কয়েকবার। রাশেদ ভয় পেয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি স্যালাইন গুলিয়ে খাওয়াচ্ছে তবুও কিছু হচ্ছেনা। এমনিতে মনি খুব ভোরে উঠে মায়ের নামাজ শেষ হলেই জায়নামাজে চা নিয়ে দেয়। সেদিন বৌকে না দেখে মা জিজ্ঞেস করলেন
বৌ কোথায়?
শুয়ে আছে।
কেন কি ব্যাপার, ও তো এতক্ষণ শুয়ে থাকেনা, কি হয়েছে?
আমার মনে হয় ডায়রিয়া, ভোর থেকেই বমি করছে।
শুধু বমি?
হ্যাঁ।
শুনে মা একটু হাসলেন, আহ্লাদের হাসি। মায়ের হাসি দেখে রাশেদ একটু বিরক্ত হল, মনি ভুগছে আর মা হাসছে। মা উঠে মনিকে দেখতে গেলেন। মাথায়, মুখে, পিঠে আদর করছেন, হাত ধরে বসে আছেন। আবার বমি, এবার মা সাথে করে বাথরুমে নিয়ে গেলেন। বমির মাত্রা অস্বাভাবিক, অতিরিক্ত, পর পর কয়েক বার হল। বমির জন্য বিছানার পাশে বালতি রাখা হল। মা একটু চিন্তিত মনে হল।
মা বললেন উঠ, উঠে দেখ কিছু খেতে পার কিনা, না পারলে বল কি খাবে বানিয়ে দেই। সুপ টুপ এটা সেটা অনেক কিছু জিগ্যেস করলেন কিন্তু কোন কিছুই চাইছে না। বাবার কানে কানে কি যেন বললেন। শুনে বাবাও খুশি এবং সেই সাথে চিন্তিত মনে হোল। সেদিন মা আর মনির জন্য বসে নেই। রাশেদকে ডেকে বৌর কাছে বসিয়ে রেখে নিজেই সবার জন্য নাস্তা বানালেন। রাশেদকে ডেকে বললেন,
নে নাস্তা খা। বৌর জন্য ভাবার কিছু নেই, এমন হয় ঠিক হয়ে যাবে।
বাবা নাস্তা খেয়ে অফিসে যাবার আগে কোথায় যেন গেলেন, প্রায় আধা ঘণ্টা পরে সাথে ডাক্তার নিয়ে এলেন। রুগীর পাশে বসে হাতের পালস দেখে ডাক্তারও মায়ের মত একটু হেসে জিগ্যেস করলেন,
ইনি কি হয়?
মা বললেন আমার ছেলের বৌ।
খুশির খবর, মিষ্টি আনেন, আপনি দাদি হতে চলেছেন।
ভালো কথা, কিন্তু এতো বমি হচ্ছে কেন?
হয়, এরকম কেস দুই একটা হয়, চার পাঁচ মাস পর্যন্ত থাকে এরকম। আমি ওষুধ দিচ্ছি নিয়ম করে খাওয়াবেন কমে যাবে।
সাথে আরও কিছু উপদেশ দিয়ে চলে গেলেন। দেখতে দেখতে সারা পাড়া আর আত্মীয় মহলে ছড়িয়ে গেল। একে একে সবাই দেখতে আসছে। মনি ক্রমেই বিছানার সাথে মিশে যাচ্ছে, কিছুতেই বমি কমছে না, কিছু খেতে পারছেনা। শুধু ডাব, আখের রস, ফলের রস, সুপ এই জাতিয় তরল খাবারের উপর টিকে আছে। কিছুই খেতে চায় না, পারেও না। ওদিকে আবার রাশেদ কাছে গেলে নাক বন্ধ করে মুখ ঘুড়িয়ে রাখে। রাশেদের মন ছটফট করে, কি হোল মনি এমন করছে কেন? মনিও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেনা। একদিন মা ব্যাপারটা লক্ষ করে রাশেদকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বুঝিয়ে বললেন, ও এখন তোর গায়ের গন্ধ সইতে পারবেনা, কিছু দিন পর ঠিক হয়ে যাবে, মন খারাপ করিস না বাবা। এটা প্রকৃতির নিয়ম, এমন হয়। মনি একটু একা হলে মনির কাছে গিয়ে একটু দূরে বসে মনিকেই সরাসরি জিগ্যেস করলো। মনি, তুমি কি আমাকে সইতে পারছ না? এক হাতে রাশেদকে শক্ত করে ধরে আর এক হাতে নাক চেপে সেই আগের মত মুখ ঘুড়িয়ে রেখে মনি কেঁদে ফেললো,
আমি এ কথা কি করে তোমাকে বলি।
কেন মনি বললে কি হয়?
আম্মা আমাকে বলেছে, আমি বুঝেছি। আমিতো আকাশ পাতাল কত কি ভাবছিলাম। তুমি এনিয়ে কিচ্ছু ভেবো না, কয়েক দিন পরেই নাকি ঠিক হয়ে যাবে। এখন বল তোমার কি খেতে ইচ্ছা হয়।
অনেকক্ষণ পর মনি আস্তে করে বলল
পেয়ারা আনতে পারবে?
পারবো।
তখন দেশে পেয়ারার সিজন না। মনিকে তো বললাম পারবো কিন্তু এখন কোথায় পাই? সারা ঢাকা শহর খুঁজে দেখেছে কোথাও নেই। শাহিনের সাথে কথা বলেছে সেও সন্ধান দিতে পারেনি। ঢাকার বাইরে যেসব বন্ধু আছে তাদের কাছে ফোন করে জেনেছে কোথাও নেই। তবুও সবাইকে বলে দিয়েছে পেয়ারার সন্ধান পেলে সঙ্গে সঙ্গে শাহিনের কাছে ফোন করে আমাকে জানাবে। দুই দিন পর চিটাগাং থেকে রফিক শাহিনকে ফোনে জানিয়েছে, রাশেদ ভাই পেয়ারা খুঁজছিল। পেয়েছি, এখানে পাহাড়ি এলাকা থেকে ম্যানেজ করেছি। আপনি রাশেদ ভাইকে তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দিবেন। বিকেলেই শাহিন এসে খবরটা জানিয়ে গেল।
মনি আমি একটু চিটাগাং যাব, কালই চলে আসবো।
কেন, এখন আবার চিটাগাং কেন?
ওখানে তোমার জন্য পেয়ারার সন্ধান পেয়েছি তাই আনতে যাবো।
আমার জন্য পেয়ারা আনতে তুমি চিটাগাং যাবে? থাক আমার ওই পেয়ারা লাগবেনা বলেই কেঁদে ফেললো।
পাগলামি করেনা মনি, আমি এই আজ রাতের মেইলে যাবো, সকালে পৌঁছে কাল পেয়ারা নিয়ে কর্ণফুলী এক্সপ্রেসে ফিরে আসবো, বিকেলের মধ্যেই আমাকে তোমার কাছে পাবে।
মনি যেতে দিতেই চায়না তবুও একরকম জোড় করেই সেই রাতের চিটাগাং মেইলে চিটাগাং রওয়ানা হয়ে পেয়ারা নিয়ে ঢাকা ফিরে এসেছিল। কিন্তু সে পেয়ারাও মনি দুই কামড়ের বেশি খেতে পারেনি। কিছু দিন পর যখন মনি একটু ভাল বোধ করছে রাশেদ জিগ্যেস করলো, আচ্ছা মনি, তুমি কি পছন্দ কর ছেলে না মেয়ে? তুমি বল তোমার কি পছন্দ। না আমি আগে জিগ্যেস করেছি। না তুমি বল না আগে, আগে জিগ্যেস করেছ তাই কি হয়েছে, বল তুমিই আগে বল। না মনি তোমার যে অবস্থা যাচ্ছে তাতে আমি খুবই আতঙ্কিত, আমার তুমি ঠিক থাকলেই যথেষ্ট। আমার কাছে ছেলে বা মেয়ে বলে কোন চাহিদা নেই শুধু আল্লাহর কাছে বলছি ছেলে দাও আর মেয়ে দাও যাই দাও সুস্থ আর সুন্দর যেন হয়, আর আমার মনি যেন ভাল থাকে আর কিছু না। হ্যাঁ পাগল, আমারও তাই মনে হয়, তোমার কথাই আমার কথা। যাই হোক এই ভাবে অনেক ঝড় ঝাপটা সয়ে মনি একদিন এক কন্যা সন্তান প্রসব করল। বাবা ডাক নাম রাখলেন তিথি। সময়ের সাথে প্রকৃতির নিয়মে সবার আদর যত্ন নিয়ে তিথি আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে, রাশেদ সোহাগ করে খুকু বলে ডাকে। মনি রাশেদের কেন্দ্রবিন্দুতে ঢুকে যাচ্ছে, যেন রাশেদ ছাড়া পৃথিবীতে আর কিছু নেই। মনির ভালোবাসার কোন মাপকাঠি নেই, কোন সীমা পরিসীমা নেই। রাশেদ তাকে যে কিসের সাথে তুলনা করবে তাই খুঁজে পায় না। এ ভালোবাসা কি প্রশান্ত মহাসাগরের মত, নাকি আকাশের মত, না কিসের মত কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। ঠিক তেমনি মনির প্রতিও রাশেদের নির্ভরতাও ক্রমেই বাড়ছে, যেন মনিই তার জিয়ন কাঠি, মনি ছাড়া রাশেদ যেন হতেই পারে না, যেন এক জন আরেক জনের জন্যেই তৈরি হয়েছে। কেও কাওকে চোখের আড়াল করতে পারেনা।  [চলবে]

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


You must be logged in to post a comment Login