আল মামুন খান

অ্যানালগ রূপবান ও ডিজিটাল রোমিও – ১

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

[সেই ছেলেবেলায় সাদা-কালোর যুগে ‘রুপবান’ সিনেমাটি দেখেছিলাম। এরপর নানা-নানীর কাছে গল্পাকারে অনেক শুনেছি। এই কাহিনীটি বেশ অনেক বছর আমাদের ছেলেবেলায় চিন্তা-জগতে ঘুরপাক খেয়েছে। এরপর রুপালী পর্দার জগতে ‘রঙিন’ শব্দটি যোগ হয়ে পুরনো সিনেমাগুলোর জাত মেরে দিতে নব-উদ্যমে সচেষ্ট হল। আর এখন তো ডিজিটাল যুগ।

দুজন অসম বয়সী নর-নারীর ভিতরের এক সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং এর দ্বারা সৃষ্ট সামাজিক ও পারিবারিক বিড়ম্বনা নিয়ে অনেকদিন ধরে একটা লেখা ব্রেইনে উঁকি দিচ্ছিল। অবশেষে ‘তাকে’ দৃশ্যপটে আনার ব্যবস্থা করলাম। আমার স্বাভাবিক লেখার রীতিকে সামান্য পরিবর্তন করে এই লিখাটি লিখবার চেস্টা করেছি। তিন পর্বের লেখাটি নিয়ে সামান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার এই অপচেষ্টার লোভটা সামলাতে পারলাম না। একটু বড় হয়ে গেলেও আশা করছি পাঠক বিরক্ত হবেন না।]

এক.

শান্ত ভোরের নিরব প্রার্থনাকে ঢেকে দেয় পাখির ব্যস্ত ডাকাডাকি । দিনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কী নিয়ে এতো ব্যস্ত পাখিগুলি? ‘ মানুষ আমি আমার কেন পাখির মতো মন … ? ধ্যান মগ্ন মন …অদৃশ্য ডানা মেলে …বোধের আকাশ জুড়ে উড়ে চলে … বোধের বৃক্ষশাখায় বিশ্রাম করে … কখনো দীর্ঘ অবসরে বাসা বাঁধে । সমুদ্রের স্বভাব পাখির চাইতে ভিন্ন । মন যখন সমুদ্র হয়ে যায় তখন মানুষের সুখ দুঃখের অনুভুতিগুলি কেমন হয় ? পাহাড়ের চরিত্র সমুদ্র থেকে আলাদা । মন যখন পাহাড় হয় মানুষের জীবনটা কিভাবে কাটে ? কিম্বা যখন নদী হয়ে বয়ে যায় , তখন ? কেন এতো বদলায় মন ? কী চায় ? যা কিছুই চায় পাওয়া কি খুব জরুরি ? যখন আমি ছোট্ট একটা বাবু ছিলাম , কী চেয়েছিলাম ? মায়ের বুক … বাবার কোল … অনেক অনেক আদর …… খেলনা … খেলার সাথী …… চেনা ঘর …… বারান্দায় ছুটাছুটি … আকাশের পাখি … মেঘ … রোদ … বৃষ্টি … ঝড়…… আর, বড় হওয়া …… কত বড় হতে চায় মানুষ ? কাঁথা জড়ানো বাবুটা সুখী ছিলো ? ফ্রক পরা মেয়েটা সুখী ছিলো ? ওড়না নিতে নিতেও ফেলে দিয়ে প্রতিশোধের স্বাদ নিয়ে কিশোরী কি সুখী ছিলো ? এক পরত দুই পরত বয়সের খোলস ছাড়াতে ছাড়াতে পরিণত হতে থাকা নাগিনী কি সুখী ? নাগিনী কি দুঃখী ? কত বিষ মানুষকে বিষধরে পরিণত করে ? কষ্টগুলি কবিতা হতে হতে বিষ কেন হয়ে যায় ?

এলোমেলো ভাবছিলো সে অনেক ক্ষণ ধরে । চোখ জ্বলছিলো । বইয়ের দিকে আর তাকাতে পারছিলো না । সকাল সাড়ে এগারোটার কাছাকাছি । দুপুরে আজকেও খাওয়া হবে না। পাবলিক লাইব্রেরীর আশ পাশে খাবারের দোকান নাই । চট্টগ্রামের মানুষের সংগ্রামী ইতিহাস আর বছরের পর বছর প্রায় পরিবর্তনহীন এই অবস্থা বড় বেশি বিপরীত । কিন্তু সত্য । কণার মনটাও খারাপ ছিলো । সকাল থেকে ভালো লাগছিলো না। আসলে কবে থেকে ভালো লাগছিলো না ? কবে কিছু ভালো লেগেছিলো? কিছুই কি কখনো ভালো লেগেছিলো ? মার্ক্স , আলাউদ্দিন আযাদ আর মেটামরফসিস এর বিশৃঙ্খল একটা কম্বিনেশনের উপর মাথা রেখে চোখ বন্ধ করলো সে । বইগুলি শক্ত ।ধুলাবালির গন্ধ । ওড়নাটা বইয়ের উপর থাকাতে হাঁচি শুরু হলো না , কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পরেই খারাপ লাগা তৈরি করলো । এতো বড় রুম । এতগুলি মানুষ । তবু ঠাণ্ডা । ঘুম তাড়াতে একটু মুখ ধুয়ে আসা দরকার । কনা মাথা তুললেন । একটু হেঁটে এসে আবার বসতে হবে । লেখাটা যন্ত্রণা করছে । একটা কিছু দাঁড় না করানো পর্যন্ত শান্তি হচ্ছে না … পৃথিবীর আর সবাই কত শান্তিতে আছে । যে যার মতো ।

……………… ওয়াশ রুম থেকে ফিরে কণা কিছুটা ভালো বোধ করলেন । কোনো কলেজ এর কিছু ছেলেমেয়ে এক সাথে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছিলো । ওদের মধ্যে থেকে একটা ছেলে কী কারণে হঠাৎ কণার দিকে তাকিয়ে কিছু বললো । সবাই এক সাথে হেসে উঠলো । এখানে শব্দ করা নিষেধ । নৈশব্দের মধ্যে হঠাৎ এক টুকরা কোলাহল একটু কেমন লাগলো । অস্বস্তিতে কণার কান গরম হয়ে উঠলো । একটা শব্দ কানে এসেছিলো । গালের ওপর রাগের আঁচ বাড়ছে বুঝতে পেরে আগের জায়গায় ফিরে চললেন তিনি । পিছন থেকে আরও দু একটা মন্তব্য কানে আসলো । এতো রাগের মধ্যেও তিনি ভেবে পাচ্ছিলেন না , ছেলেগুলির এই মন্তব্যগুলি শুনে কি ভাবে মেয়েগুলি হাসছে ! কারো মনে হচ্ছে না ওরাও মেয়ে ! একজন মহিলাকে নিয়ে বিশ্রী কৌতুকে যে ছেলেগুলি মজা পাচ্ছে তাদেরকে পছন্দ করছে মেয়েগুলি! এই ধরণের চিন্তার মানুষের মধ্যে বন্ধুত্বের মতো সুন্দর সম্পর্ক সম্ভব ! রাগের মাথায় বসতে গিয়ে নিজের বইগুলি যে টেবিলটাতে রেখেছিলেন তাতে না বসে তার আগের টেবিলের একটা চেয়ারে গিয়ে বসে গেলেন । হাইস্কুলের কয়েকটা ছেলে কিছু নোট করছিলো । প্রায় সবাই একসাথে তাকালো । কণা একটু অপ্রস্তুত হয়ে উঠে গেলেন । টেবিল থেকে ব্যাগটা তুলে নিতে গিয়ে পাশের ছেলেটার হাতের কলমটা ফেলে দিলেন । ছেলেটা হেসে কলমটা তুলে নিলো । আর , ছোট্ট একটা ভুল করলো । নিয়তি । নিয়তির নির্ধারিত ভুল । ভুল?

……………………………. সন্ধ্যায় চা খেতে খেতে ভাবছিলেন কণা । মৃদু হাসলেন । সেকেন্ডের ও অনেক কম সময়ে হঠাৎ পাওয়া অনুভুতি তার গালে লাল আভা ছড়ালো । কান গরম হয়ে গেলো । তিনি চায়ের কাপের দিকে তাকিয়ে লাজুক হাসলেন । তাহলে এখনো এই অনুভুতি বাকি আছে !? অথচ জীবন গিয়াছে চলি কুড়ি কুড়ি বছরের পার !

…………আকাশের সাথে সাথে তার মুখটাও ম্লান হয়ে এলো । রাত নামছে । আজকে রাতে কি ঘুম হবে ? কী করবে সে এই অনুভুতি দিয়ে ? আকাশের সাথে সাথে তার মুখটাও ম্লান হয়ে এলো । রাত নামছে । আজকে রাতে কি ঘুম হবে ?।

‘চায়ে চিনি দাও নাই ‘ পেপার থেকে মুখ তুলে বললেন রেজা । তার পাশ থেকে চায়ের কাপটা তুলে নিলেন কণা ।সামান্য অন্যমনস্ক ভাবে কাপটা তুলে নিলেন। উ -ম্ ম্ ,চিনি !!’ চেহারা ঠিক রাখতে পারলেন না রেজা । কণা সম্ভবত প্রথমবারে চিনি দিয়েছিলেন, কিন্তু নাড়তে ভুলে গিয়েছিলেন । আবার চিনি দেয়াতে আর মুখে দেয়া যাচ্ছে না । বারান্দায় শীতের নরম দাঁড়ানো কণাকে দেখে রেজার কেন যেন আর কিছু বলতে ইচ্ছে হলোনা । কাপটা ডাইনিং টেবিলে রেখে পেপারটা ভাঁজ করে রেখে পানির গ্লাসটা টেনে নিলেন। যখন তখন আনমনা হয়ে যাওয়া কণার স্বভাব । একা থাকতে পছন্দ করে । দুই চারজন প্রিয় মানুষের বাইরে কারো সাথে তেমন লেনদেন নাই তার । ভদ্রতা রক্ষা করে চলেন । আত্মকেন্দ্রিক । মনের ভিতর সবার জন্য ভালোবাসার একটা নদী কত উচ্ছ্বাস নিয়ে দু কূল ছাপিয়ে বইত এক সময় । তার ক্ষীণতম ধারাটির অস্তিত্ব সহজে স্বীকার কিম্বা প্রকাশ করেন না আজকাল। ভালোবাসার নদীটার সব নদীর মতো দুই পাড় । বিশ্বাস , আশা , আনন্দ এক পাড় । অন্য পাড়ে কষ্ট । নানা রকম কষ্ট । তার নদীটার বিশ্বাসের পাড় ভেঙ্গে কষ্টের বিস্তীর্ণ চর গড়েছে। প্রতিদিন ধ্বসে পড়তে থাকা পাড়টাকে চর থেকে আকাশের বুকে কালো একটা দানব রেখার মতো লাগে ।দানবই তো। বিশ্বাস, সুখ ,আশা এসব কি ফাঁদ নয় ? এখানেই কি বাঁধা পড়ে না মানুষ ? এখান থেকেই কি অবধারিত ভাবে অপমান , অবিশ্বাস আর অক্ষমতার দুঃসহ যন্ত্রণাময় নিরাশার ধু ধু চরে আটকা পড়ে না ? কণার যে লেখাটা কিছুতেই কোন নির্দিষ্ট ফর্মে আসছিলো না , তা এই নদীটার চরিত্র নিয়েই । সমস্যা হলো , মানুষকে নিরাশার কথা বলতেও তার ইচ্ছা হচ্ছিলো না , আবার আশা দিতেও বিবেক সায় দিচ্ছিলো না। তিনি শেষ পর্যন্ত বাসা থেকে একটু দূরে একটা পাহাড়ে কিছুক্ষণ সময় কাটানোর চিন্তা করলেন । মাথাটা একটু স্বস্তি পেলে কিছু নতুন করে ভাবতে পারা যেতে পারে । পরিচিত একটা জায়গার কথা মনে আসলো । লালখান বাজার । জিলাপী পাহাড় । দশটা এগারোটার দিকে কিছুটা নির্জন থাকে । একটু ভয় ও লাগছিলো । তবু প্ল্যান মতো বের হলেন তিনি ।

(ক্রমশঃ)

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


2 Responses to অ্যানালগ রূপবান ও ডিজিটাল রোমিও – ১

You must be logged in to post a comment Login