মুহাম্মদ সাঈদ আরমান

আইল্যা দাদার বিদায়

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

এক
আমাদের গ্রামের আলী দাদা। সবাই ডাকত ‘আইল্যা দাদা’ । মা-বাবা,ছেলে-মেয়ে সবার দাদা। সকালে বাজারের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুর করে পৌঁছতেন বিকালে। বাড়ি ফিরতেন রাতে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে। গ্রাম থেকে বাজারের দুরত্ব মাত্র দেড় কিলোমিটার।

দাদাকে রাস্তায় দেখলেই দূর থেকে কেউ ‘খা ভাজা ইলিশ খা’ বললেই শুরু করে দিতেন অকথ্য ভাষায় গালাগাল। সামনে যা পেতেন তা দিয়ে তাড়িয়ে নিয়ে যেতেন। একজনকে তাড়িয়ে নিলে, পেছন থেকে অন্যজন বলত ‘খা ভাজা ইলিশ খা’। ব্যস্ত হয়ে পড়তেন কাকে রেখে কাকে দৌড়ানি দিবেন। আশে-পাশের বাড়ি ঘরের বৌ-ঝি সহ সবাই বুঝত ‘আইল্যা দাদা’ বাজারে যাচ্ছে। কেউ কেউ উক্ত্যক্ত কারীদের ভর্ৎসনা করত। গুরুত্ব দিয়ে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসত না কেউ। আমি বুঝতে পারতাম না, বুড়া মানুষটাকে নিয়ে এ কেমন মস্করা!

একবার এক ছেলেকে মেরে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিলেন। ভুলে আমাকে মেরেছিলেন একবার। আমি একবারের জন্য ও দাদাকে ঐ কথা বলে বিরক্ত করিনি। পরে তিনি ভুল বুঝতে পেরে আদর করে দিয়েছিলেন । বাজার থেকে ফেরার পথে বাদাম আর গজা নিয়ে আমাকে দেখে গিয়েছিলেন। দাদার জন্য আমার মায়া হতো। কষ্ট করেও তাকে রক্ষা করতে পারতাম না। ভাবতাম আমার যদি শক্তি থাকতো দুষ্ট মানুষ গুলোকে কঠিন শাস্তি দিতাম।
একটু ক্ষান্ত হয়ে যাত্রা শুরু করে কিছু দূর গেলেই অন্য কেউ আড়াল থেকে বলত ‘খা ভাজা ইলিশ খা’। আবার শুরু গালাগাল আর দৌড়ানি। এই ভাবে দাদার বাজারে পৌঁছতে দেরী হয়ে যেত। বাজারে বিক্রির জন্য যা কিছু নিয়ে যেতেন তা কেউ কেউ ঝোপ-ঝাড়ে লুকিয়ে রাখত। খাবার জাতীয় কিছু হলে দুষ্ট ছেলেরা খেয়ে ফেলত।
আমি দাদাকে বোঝানোর চেষ্টা করতাম। দাদা, তুমি দুষ্টদের কথায় কান দাও কেন? যে যাই বলুক, তুমি পাত্তা না দিলে ওরা বিরক্ত করে মজা পাবে না। তিনি আমার কথা শুনে হাসতেন। কী সুন্দর ছিল দাদার নিষ্পাপ হাসি! আমার খুব ভালো লাগত। বুঝতাম আমার সাথে একমত। ঐ বাক্যটা শুনলে আবার সব ভুলে যেতেন।

কথিত আছে দাদার তিন মাসের নব বধু ইলিশ ভাজি করতে গিয়ে শাড়িতে আগুন লাগায়। সেই আগুনেই নব বধু মারা যান। স্ত্রীর মৃত্যুর জন্য দাদা নিজেকে দায়ী করে গাছে মাথা ঠুকিয়ে আক্ষেপ করে কাঁদছিলেন আর বলছিলেন ‘খা ভাজা ইলিশ খা’। সেদিন থেকেই গ্রামের মানুষ বাক্যটি লালন করে স্মরণীয় করে রেখেছে।
স্ত্রীর শোকে আর বিয়ে করেন নি তিনি। বিধবা বোনকে সাথে নিয়ে জীবন কাটিয়েছেন । বিধবা-বিপত্নীক ভাই-বোনকে নিয়ে কেউ কেউ বিদ্রুপ করে। তাদের কুলক্ষণে বলে মন্তব্য করে।
দাদা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজি ছিলেন। মাঝে-মধ্যে মসজিদে আজান ও দিতেন। দাদাই এই গ্রামের নবজাতকদের কানে আজানের ধ্বনি পৌঁছাতেন। দায়িত্বটা তিনি আগ্রহের সাথে পালন করতেন। কোন বাড়িতে শিশু জন্ম হয়েছে শুনলেই দাদা ছুটে যেতেন। এ যেন দাদার মহান কর্তব্য। সদ্যোজাত শিশুটির একটি নামও তিনি দিতেন কিন্তু নামটি কেউ আমলে নিত না।

দুই
ঈদুল ফিতরের সকাল। আকাশ কালো মেঘে ঢেকে আছে। আমরা সবাই ঈদগাহে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছি। ঈদগাহের মাঠের মাইকে ঘোষণা করা হচ্ছে ‘জনাব আলী চাঁন মিঞা’ ইন্তেকাল করেছেন। ‘আলী চাঁন মিঞা’ নামের কেউ এই গ্রামে আছে আমার জানা নেই। ঈদের দিনে মৃত্যুর খবর শুনে ভাল লাগছিল না। পরে জানতে পারি আমাদের ‘আইল্যা দাদা’ মারা গেছেন। দাদার মৃত্যুর দিনে দাদার সুন্দর নামটা জানা হল। সাথে সাথেই আমার ঈদের খুশি ম্লান হয়ে গেল । বয়স্কদের মাঝে ঈদের চেয়ে মৃত্যু সংবাদই বেশী গুরুত্ব পাচ্ছে। কেউ কেউ কবরস্থানে চলে গেছেন। বলা যাচ্ছে ঈদের জামাতের পর জানাজা হবে। করব তৈরী সহ সব ব্যবস্থা ঈদের আগেই করতে হবে। যারা দাদাকে বেশী বিরক্ত করত সেই যুবকরাই বেশী কর্ম তৎপর ।
ঈদের নামাজ শেষ। ইমাম সাহেব বলছেন, আগে দাফন সম্পন্ন করেই তার পর ঈদের খুশি। দাদার খাটিয়া আনা হলো। সবাই জানাজার আগে শেষ বারের মত দাদাকে দেখতে চায়। ইমাম সাহেব বাঁধা দিচ্ছেন। যে কোন সময় বৃষ্টি নামতে পারে। জানাজা আর দাফন যত দ্রুত সারা যায় ভালো। জানাজা শেষ হবার আগেই আকাশ ভাঙ্গা বৃষ্টি। সাদা পোশাক পরে খাটিয়ায় শুইয়ে দাদা ভিজছেন। সাথে আমরাও । কেউ নিজেকে বৃষ্টি থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে না। সবাই দাদাকে বৃষ্টি থেকে বাঁচাতে ব্যস্ত।

ইমাম সাহেব কাঁদছেন আর বলছেন ‘মৃতের সম্মানে সবাই ভিজবো’। ইমাম সাহেবের কান্না সবার চোখে অশ্রু এনে দিয়েছে। খাটিয়া কান্দে যুবক দল সবার আগে চলছে। আমরা সবাই চলছি দাদার পিছনে। আজ কেউ খেপাচ্ছে না দাদাকে। সবার চোখে অশ্রু আর মুখে দোয়া। অশ্রু আর বৃষ্টির পানি একাকার হয়ে যাওয়াতে বুঝা যাচ্ছে না। কালিমা শাহাদাতের কোরাস ধ্বনিকে মনে হচ্ছে মৌমাছির গুঞ্জন। মনে হচ্ছে আলী দাদার মৃত্যুতে আকাশ আমাদের চেয়ে বেশী দুঃখ পেয়েছে; কারণ আকাশের অশ্রু পরিমানে আমাদের চেয়ে বেশী।
আলী দাদা আমাদের সাথে ঈদ করে সবার চোখে অশ্রু দিয়ে চলে গেলেন। এই অশ্রু অনুতপ্তের না ভালোবাসার বলতে পারবো না। সবার মুখে একটি কথা ‘আলী চাঁন মিঞার জানাজাই এই গ্রামের সর্ববৃহৎ জানাজা’ ।

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


12 Responses to আইল্যা দাদার বিদায়

You must be logged in to post a comment Login