আমার বই-দাদু : ধীরেন্দ্রনাথ সরকার
আমার শহর জলের ভিতর থেকে একদিন উঠে এসেছিল। মানুষগুলোও জলের মত ঘুরে ঘুরে কথা কয়। মাঝে মাঝে ভাবি–এই জলমগ্ন ছোট্ট শহর আমার কাছে একটি শাপলার ফুলের মত ফুটে আছে। আর আমার বই-দাদুটি এখনো হেঁটে চলেছেন মধুমতি নদীর পাড়ে। ভোরবেলা জানালায় উঁকি দিয়ে বলছেন–কী পড়লি রে।
তিনি এসেছিলেন ঝড়ের পরে। সাতাত্তরের এপ্রিলে। মাত্র তিন মিনিটে একটি শহর লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল। আমাদের টিউকলটি একটি নারিকেল গাছে স্প্রিংএর মতো পেঁচিয়ে গিয়েছিল। টিনের ঘরগুলো কাগজের মতো হাওয়ায় উড়েছিল। আর অনেকের মতো আমাদের হারুনকাকুকে পাওয়া গিয়েছিল নদীর অন্যপাড়ে। সকালে তিনি গাছপালা-ঘরবাড়ি উজিয়ে এলেন। আমরা দুভাই, মেঝ বোনটি আর বাবা—নিঃসহায়ের মত বসে আছি। মা গেছে মামাবাড়ি। তার কোনো সংবাদ তখনো পাইনি। তিনি এলেন আর বাবা উঠে দাঁড়াল।
তিনি হাত ধরে নিয়ে গেলেন সারা শহরে। ঘুরে ঘুরে দেখালেন—প্রবল ঝড়ের পরে মানুষ জেগে ওঠেছে। আবার দাঁড়িয়ে যাচ্ছে মানুষের ঘরবাড়ি আর ঠিকানা। তার কাছে আঁক কষি। এর ফাঁকে ফাঁকে পড়ে শোনাতে হয় মহাভারত আর তিনি শোনান রবীন্দ্রনাথ স্মরণ থেকে। তিনি বলেন আর লিখি বড় বড় কাগজে শাপলার অপার গুণের কথা। মোড়ে মোড়ে দেওয়ালে দুজনে আঠা দিয়ে লাগিয়ে দেই। মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শহরের হাটে হাটে বলতে হয় শুষণি শাকের কথা। মাঝে মাঝে শেলফ থেকে বের করে আনেন একটি ছোট ডাইরি। লিখেছেন তার ছোট ছেলে।এই ছেলেটি রবীন্দ্রনাথ হবেন এই শুধু আশা। তার একটি কবিতার বই বেরিয়েছে— যুগশিখা। তিনি রবীন্দ্রনাথ হলে আমাদের মন খুশি হবে।
আমার নিজের দাদু বছর দুয়েক আগে নাই হয়ে গিয়েছেন। তাই এই দাদুটির সঙ্গে আমার দিন কাটে। বিকেলে গরুটি নিয়ে বের হন নদীর পাড়ে। শুভ্র চুল—ওড়ে শ্মশ্রুদল।এক হাতে চোখের সামনে খোলা বই। পড়ছেন। আর অন্য হাতে গাভিটির দড়ি—নিরবে ঘাস খাচ্ছে। প্রতিদিন লোকজন দেখছেন—ধুতি পাঞ্জাবী পরা ধীরেণ মাস্টার ক্রমশ দেবপ্রতিম। দূর থেকে তাকে সালাম জানিয়ে যাচ্ছেন নিরবে। কে একজন বুড়ি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছেন–ঈশ্বর মানুষের বেশে হেঁটে বেড়ান। এখানকার হাওয়া মধুময়। এই হাওয়ায় আমি ঘুমিয়ে পড়ি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার আগে আমরা দুজনে মিলে বাড়ি ফিরি।
মাঝে মাঝে তিনি বলছেন আর একটি খাতায় লিখছি বাংলা বাগধারার ইতিবৃত্তটি। সহজ সরল গদ্য। বলেন, যা বলতে চাও তা সহজ করে বল হে। পড়ে প্রাণ টানে। খাতাটি ভরে গেলে তিনি উপরে বড় বড় করে লিখলেন—মণিকোষ। বের হল বাংলা একাডেমী থেকে।
যেদিন স্কুল থেকে অবসরে গেলেন—তারপর থেকে তিনি বলছেন আর আমি লিখছি চিঠি। মাজেদ—তোমাদের কাছে কখনো গুরু দক্ষিণা চাইনি। কিন্তু কিছু বই চাই। প্রাপক মাজেদ অথবা আলী নূর। কোন এক মোসাব্বির পাঠিয়ে দিচ্ছেন ডাকে কিছু টাকা। আমরা দুজনে মিলে বুক লিস্টি বানাতে লেগে যাই। আর চিঠি লিখি মুক্তধারায়, বাংলা একাডেমীতে—জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনীতে। কাউকে লিখি—ভিক্টর হুগোর অমনিবাস আমাদের দরকার। একদিন লিখতে দেওয়া হল একটি সাইনবোর্ড –সুভদ্রা স্মৃতি গ্রন্থাগার।
একদিন সাতপাড়ের আগে নৌকা চলে গেল আরও ভিতরের গ্রামে। টুঠামান্দ্রা– অজ পাড়াগাঁ। একটি স্কুলঘরের পাশে একটি টিনের ঘর উঠেছে। ভেতরে কয়েকটি ঝকঝকে আলমারী। কাঁচের ভিতরে হাসছে আমাদের দুজনের বুক লিস্ট থেকে উঠে আসা বইগুলি। এই তাঁর জীবনের স্বপ্ন পূরণ।
সুভদ্রা তাঁর মা। এককালে তার মা ছিলেন এই গ্রামে। তাকে শাপলা রেঁধে খাইয়েছিলেন কতবার আর তালের পিঠে। তার জন্য এই বুড়ো ছেলেটি চাকরীর সব টাকা আর দক্ষিণা খরচ করে মায়ের গ্রামে গড়েছেন গ্রন্থাগার। সেদিন তৃপ্তি ভরে আমাকে ধরে হেসে উঠেছিলেন। কিরে—ভাল লাগছে না!
ভাল না লেগে পারে! এই ভাল লাগা নিয়ে আজো বেড়ে উঠি।
আহা, এই বই-দাদুর নির্মল হাসিটি মাঝে মাঝে দেখা যায় ঈশ্বরের মুখে।
5 Responses to আমার বই-দাদু : ধীরেন্দ্রনাথ সরকার
You must be logged in to post a comment Login