আজিজুল

আমার সপ্নের ইষ্কুল

আমার সপ্নের ইষ্কুল
Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

“স্যার, তুমি কবে আসবে? শুনেছি, তুমি নাকি আমার দিনে কাজ করার যে কারখানায় বড় বড় চাই করা বরফ বানাই,এগুলির মাঝে দিন যাপন কর-একেই নাকি কানাডা বলে? আমিও আছি একরকম, ইশকুল বন্ধ। স্যারেরা বল্লে-ইস্কুল চালাতে টাকা নাই-তাই গ্রীস্মের আম কাঠাল পাকার সময়টাকে আরো লম্বা বানিয়ে “গ্রীস্মকালীন ভ্যাকাশন” দিয়ে দিলে-জানিনা কবে আবারো যাবো ইশকুলে।”

-১-

আজকালকার সময় আবারো দ্রুত কেটে যাচ্ছে। কিছু বুঝে উঠবার আগেই দেখি হাত পা কেমনে জানি কাজখানা করে দিচ্ছে। মেয়র ইলেকশন হলো এই সেদিন- মহিউদ্দিন সাহেব এর বিরুদ্ধে মতি মিয়া’র পত্রিকা’র সাথে আরও গোটা দুই “সরকার এর ভেতরে ছারখার” এর চালকদের পত্রিকাগুলি লিখে যাচ্ছিলো সমানে- প্রতিবাদ করবার চিন্তা মাথায় আসবার আগেই দেখি ইলেকশন এর বানানো রেজাল্ট হয়ে গেছে।

চীনা সরকার ছারখারকে বেশ কিছু নগদ অর্থ দিয়েছে। খালেদা খালাও তাই তত্তাবধায়ক সরকার এর সময়ে কেনা এক্কালের মহিউদ্দিন এর ডান হাত ডিজিএফাই এর লোকটাকে দাড় করিয়ে দিলে। অগত্যা যা হবার হলোও তাই।

সরকার যিদি নিজেকে নিজেই unpopular করবার চায় -বাকী আনলাকি 13 এর কীই বা করার আছে?

সত্যি বলতে কি- আপনি যখন জুয়া খেলতে যাবেন- বোর্ড কিন্তু আপনার হয়ে কথা কবে না।

সারমর্ম এই যে, পাবলিকের হাতে ডিসেম্বর ২০০৮ এ অপশন ছিলো- “মন্দ” নতুবা “মন্দের মন্দ” কে বেছে নিতে।

তাই বলে আপাময় পাবলিকেরা কি সেক্সপিয়ারের “ওথেলো” ট্রাজেডির দিনলিপি লিখে যেতে থাকবে? অবশ্যই না।

হাত আছে-মুখ আছে, সর্বোপরি আমাদের সুন্দর একখানা বাংলা ভাষা আছে-গব’ করবার মতন ইতিহাস আছে- যদিও সেই সঠিক ইতিহাসটাই আমাদের পাঠ্যবই এ ছিলোনা। যা ছিলো- একরাশ পরাধীনতা আর মাথা হেট করা বিশাসঘাতকেদের রাজ-রাজত্তের ইতিহাস।

-২-

একেবারে সাধারন দিনযাপনকারী একদল দেশপ্রেমী তাই আর ঘরে বসে থাকলো না। শুরু করে দিলো তারা আহমেদ সফা আর শিল্পী এস এম সুলতান এর গড়া “শিক্ষানিলয়” নামক সপ্নের ইশকুল। সামরিক এরশাদ সরকারের শাষনামলে প্রগতিশীল ও সৃজনশীল ব্যাক্তিদের গলা টিপে হত্যার নিদর্শনস্বরূপ স্কুলটিকে বন্ধ করে দেয়া হয়।

আহমদ সফা’র বড় গুন ছিল-তিনি কখনোই দম ফুরাবার যাবার পাত্র নন-তাই ঢাবি’র অদুরেই পার্কের মাঝে পাতাকুড়ানিদের দলের আদর্শিক নেতা হয়ে গেলেন কিছুদুনের মধ্যেই। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আবারো ইস্কুলটির যাত্রা শুরু হয়-কিন্তু ততকালীন ‘সফা-সুলতান পাঠশালা’ বারংবার অর্থসংকটে পড়ে গেল। কিছু এনজিও বিভিন্ন শর্তের বেড়াজালে নগদ অর্থ সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে স্কুলটিকে নিয়ে যাবার কোন অভিপ্রায় দাতা গোষ্ঠিদের ছিলোনা-পাছে বিদেশী অর্থ এর নয় ছয় করবার পথ বন্ধ হয়ে যায়! স্কুলটির প্রধান শিক্ষক এর প্রানপন চেষ্ঠায় বর্তমানে রাজধানী ঢাকার ইস্কাটনে দুশতাধিক সমাজের অবহেলিত- বঞ্ছিতদের নিয়ে বুক আগলে একে টিকিয়ে রেখেছেন। সাথে আছে একদল হার না মানা চিরতরুনের দল। সংখ্যায় নিতান্তই কম হলেও অজস্র বাধা পেরুবার শক্তি অলবৎ এদের আছে। আছে -ট্রাডিশনাল লিখাপড়ার থেকে সম্পুর্ণ ভিন্ন এক ধরন- যার মূল রচয়িতা ড. এ. এইচ. মঈনউদ্দিন আহমেদ।

আসলে এদের সবার নেশায় ধরেছে। কারো গানের নেশা- কারো আনমনা হয়ে থাকবার নেশা। তাইতো এই ক্ষুদ্র প্রয়াসের মাঝে সঙ্গিত চর্চায় মনের গহিনের আনন্দ কথামালাকে ভুবনে নামায়ে আনতেই গানের ইশকুলও জুড়িয়ে দেয়া। দিনের আলোতে জ্ঞানে আলকিত করবার পরপরই শুরু হয় পড়ন্ত বিকেলে গানের আসর। সে আসরে সুর মেলায় আশেপাশে’র ছোট্ট ছোট্ট কিশোর-কিশোরীরাও।বাংলার বিভিন্নত উতসবে ‘সুরভারতী’ নামের এই সঙ্গিতালয় থেকেই আয়োজন করা হয় মনোজ্ঞ অনুষ্ঠান্মালা। আছে ছবি আকিয়ে- ইংরেজী শিক্ষা’র আলাদা দল। প্রতিনিয়ত রাজনৈতিক-সামাজিক বাধা বিপত্তি ব্যাক্তিজীবনে মোকাবেলা করবার জন্যে সমাধানমালা- যা ঢাকার আর কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আছে বলে আমার জানা নাই। সপ্তাহের শেষ সন্ধ্যায় সব শিক্ষক-তরুন আর উদ্যক্তাদের গুরুগম্ভীর আলোচনায় উঠে আসে সমাজের পরাধীনতা আর অসহায়ত্তের থেকে মুক্তির পথ-সবার যুক্তি আর বিশ্লেষনের মাধ্যমে। কি বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে সবাই এক কাতারে বসে প্রানের আলোচনা চলে ঘুমিয়ে পড়া রাত শেষ হবার আগ পর্যন্ত।

-৩-

লোকে বকছে- আমার কবিতা’র খরা চলছে-কাজের নেশাতেও ইদানিং আকাল ধরেছে। বলুকগে, গোটা দুই হাততালির পরিবর্তে  আজ কাউকে যদি শিক্ষার আলোয় আনতে পারি-সপ্নের রঙ্গে সাজাতে পারি- তো এই ডের আমার জন্যি। আবশ্য কাজটা মোটেও সহজ না। আমাদের লক্ষ্য সুদুরপ্রাসারী। এই একই আলো আস্তে আস্তে গ্রামের পর গ্রামে ছড়ায়ে দিবো-এই আমাদের প্রত্যাশা।

আর আমাদের ইস্কুলের ছেলে-মেয়েগুলি কি বলে-শুনতে চান? একজন লিখেছে-

“স্যার, তুমি কবে আসবে? শুনেছি, তুমি নাকি আমার দিনে কাজ করার যে কারখানায় বড় বড় চাই করা বরফ বানাই, এগুলির মাঝে দিনযাপন কর-একেই নাকি কানাডা বলে? আমিও আছি একরকম। ইশকুল বন্ধ।

স্যারেরা বল্লে-ইস্কুল চালাতে টাকা নাই, তাই গ্রীস্মের আম কাঠাল পাকার সময়টাকে আরো লম্বা বানিয়ে “গ্রীস্মকালীন ভ্যাকাশন” দিয়ে দিলে, জানিনা কবে আবারো যাবো ইশকুলে।”

গ্রীষ্মের তীব্রতায় আম-কাঠাল পাকবে কবে, আমি এই প্রত্যাশায় আছি।

-৪-

শেষ করছি শ্রদ্ধেয় মহসিন ঢালী রচিত একখানা গল্প দিয়েঃ

“সার্কাসের লোকজন একটি শিশু হাতিকে ধরে আনলো। শিকলের বেড়াজালে বেষ্টিত শিশু হাতিটি। লোকগুলো শিশু হাতিটির আকুল আকুতির কোনই মূল্য দিল না। একটি উঠানে ত‍াকে টেনে হিচরে নিয়ে আসা হচ্ছে। কেউ একজন উঠোনের মাঝখানে একটি বৃত্ত আঁকলেন। ৬ ফুট ব্যাসের বৃত্তের কেন্দ্র বিন্দুতে বেশ গভীর করে খুঁটি হিসেবে দেয়া হলো একটি মোটা ও শক্ত লৌহ দন্ড। এবার সেই শিশু হাতিটির চার পায়ের একপায়ে  একটি ৬ফুট দৈঘ্যেরে শিকল আটকিয়ে দেয়া হলো। শিশু হাতিটি এই বৃত্ত থেকে মুক্তির জন্য প্রানপন চেষ্টা করে যেতে লাগলেন। কিন্ত ৬ ফুট বৃত্তের বাইরে যেতে পারছে না। ৬ ফুট শিকলের টান বারবার শিশু হাতিটির পা রক্তাক্ত করে দিচ্ছে। কষ্ট পেতে লাগলো শিশু হাতিটি। ধীরে ধীরে তার মুক্তির চেষ্টা ক্ষুদ্রতম পর্যায় চলে এলো। ধীরে ধীরে হাতিটি বড় হতে লাগলো ।

যুবক হাতিটি বিশ্বাস করতে শুরু করলো এই ৬ফুট বৃত্তকে। এই ৬ফুট বৃত্তই তার নিয়তি। এখন আর তার পায়ে শিকল পড়াতে হয় না। যুবক হাতিটি ৬ফুট বৃত্তকে আর ‍অতিক্রম করে না। ইতিমধ্যে এই ৬ফুট বৃত্তের মধ্যে থেকেই প্রভুর কাছ থেকে সে অনেক জ্ঞান রপ্ত করলো। তার ৬ফুট বৃত্তের বিশ্বাস ধীরে ধীরে প্রশান্তির ভূবন তৈরী করতে লাগল। এই বৃত্তই তার অস্তিত ও প্রশান্তি। এই বৃত্ত ছাড়া সবকিছ‍ুই মায়া। বৃত্তের মধ্যে দাড়িয়েই প্রভুকে প্রণাম জানায়। মানুষও তাকে প্রণামি দেয়।

একদিন সারকাস পাটিতে আগুন লেলিহান শিখা ধাউ ধাউ করে জ্বলে উঠলো। সারকাস পাটির লোকগুলো সবাই দৌড়ে প্রান বাঁচালেন। কিন্তু কি এক প্রশান্তি নিয়ে হাতিটি ৬ফুট বৃত্তের মধ্যেই দাড়িয়ে রইল। বৃত্তের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করলো না। কারন সে জানে তার নিয়তী এই ৬ফুট বৃত্ত। আগুনের উত্তাপে তার চর্ম ভস্মীভূত হলো। কষ্ট পেতে শুরু করলো। কিন্তু তার এই ৬ফুট বৃত্তের প্রশান্তিই যে তার  নিয়তী। তাকে কি অতিক্রম করা যায়!

-শেষ হইয়াও হইলো না শেষ-

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যখন কোমলমতি শিশুদের এভাবেই কূপমুন্ডুক বানায়, তখন এদের দেখে এই হাতির গল্পটা বারবার মনে পড়ে। একারনেই আমাদের তৈরি পাঠশালাকে এমনভাবে গড়ছি যেন চারা অবস্থায় কোন ডালপালাকে কেটে কেটে তাকে দূর্বল গাছে পরিনত করা না হয়। আমাদের বাচ্চাদের কোনভাবেই আমরা শেকল পড়া বস্তু বানিয়ে রাখতে চাইনা।

আমাদের হাতিরা কি বনে কি শহরে- সবখানেই মুক্তচিন্তায় যেন বিরাজ করতে পারে-এই আমাদের লক্ষ্য। সকলের শুভকামনা প্রত্যাশা করছি।

(লিখিতঃ পয়লা জুলাই, ২০১০)

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


11 Responses to আমার সপ্নের ইষ্কুল

You must be logged in to post a comment Login