আলো আধারের ঘর বসতি
আজ বাড়িতে একটু উৎসবের আমেজ থাকবে এটাই স্বাভাবিক; হচ্ছেও তাই। মকবুল সাহেবের ছোট ছেলের বিয়ে আজ। বেলা বারোটার দিকে বর যাত্রী নিয়ে বারুবার কথা। ছোট ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষ্যে মকবুল সাহেবের বড় ছেলে ঢাকা থেকে সপরিবারে চলে এসেছে দু’দিন আগেই, তার বড় ছেলে মঞ্জু এয়ারফোর্সে চাকরি করে, মোটা অঙ্কের টাকা পায়, সেই টাকা দিয়েই ছোট ভাইয়ের বিয়ে দিচ্ছে সে। মকবুল সাহেব ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুঁয়ে বসে আছেন, এখনো তার নাস্তা করা হয়নি; বাড়িতে একজন মানুষ না খেয়ে বসে আছে সে দিকে কারোই খেয়াল নেই; যে যার কাজে ব্যাস্ত। রিটায়ের্টের পর থেকে এই এক অবস্থা, কেউ আর তার দিকে তাকায় না। মাঝে মাঝে তার মনে হয় সবার কাছে তার প্রয়োজন যেন ফুরিয়ে গেছে। নিজের ছেলের বিয়ে; বিয়ের জন্য পাত্রী দেখা; বিয়ের যাবতীয় দায়-দায়ত্ব নিয়ে কার অবস্থান কোন জায়গায় তার কিছুই জানলেন না তিনি। শুধু জানলেন সামনের মাসের ১৩ তারিখে ছেলের বিয়ে। এ সব নিয়ে যে মকবুল সাহেব অভিমান করেন তা না, তিনি একটু নির্লীপ্ত স্বভাবের মানুষ, কারো কথাতেই তিনি তেমন একটা রাঁ করেন না। আজ ছেলের বিয়ে অথচ তাকে না জানিয়েই বিয়ের সব আয়োজন প্রায় শেষ, এটাকেও তিনি সহজ ভাবে নিলেন।বেলা বারোটার দিকে বর যাত্রীর জন্য সবাই তৈরী হয়েগেলো। মকবুল সাহেব তখনো তার ঘরে, এখনোও তার খাওয়া হয়নি। আস্তে আস্তে হৈ-হল্লা করতে করতে বাড়ি থেকে সবাই বেরিয়ে গেল; বাড়িতে রইলো কেবল তার স্ত্রী, কয়েকজন প্রতিবেশী আর কাজের মেয়েটি, তারা সবাই ব্যাস্ত বউ বরণের আয়োজন সম্পন্ন করার জন্য। মকবুল সাহেব নির্বিকার বসে রইলেন। ছেলের বিয়ে অথচ বর যাত্রীতে সামিল হওয়ার জন্য একবারও কেউ তাকে বলেনি। বাইরে শীতের নিস্তেজ রোদ ওঠেছে। মকবুল নিজের জুবথুব শরীরটাকে টনে নিয়ে চললেন সেই দিকে। বাড়ির সামনেই একটু খলি জায়গা। সেখানে এসে দাড়ালেন। রোদটা গায়ে লাগায় বেশ চনমনে একটা আমেজ পেলেন তিনি। বাম হাতটা চোখের সামনে নিয়ে সূর্যের আলোটাকে আড়াল করার চেষ্টা করে বিস্তির্ণ ধান ক্ষেতের দিকে তাকালেন, কিন্তু তেমন বেশি কিছু দেখতে পারলেন না; ইদানিং দৃষ্টিটা আরো বেশি ঝ্বাপসা হয়ে ওঠছে। তিনি বুঝতে পারছেন শুধু দৃষ্টিটাই নয়, তার সমগ্র জগতটাই ঝ্বাপসা হয়ে যাচ্ছে, আর বেশিদিন সময় নেই, স্টেশন মাষ্টার ঘন্টা বাঁজিয়ে দিয়েছে, এখন শুধু ট্রেন আসার অপেক্ষা।বাড়ির ভেতর থেকে বেশ হৈ-চৈ এর শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। অনেকক্ষন ধরে দাঁড়িয়ে থাকার কারনে তার হাঁফ ধরে গেছে, তিনি বাড়ির দিকে পা বাড়ালেন। উঠোনে একটি চেয়ার পাতা ছিল সেখানেই থপ করে বসে গেলেন। কাজের মেয়েটি পাশ দিয়েই যাচ্ছিল তাকে ডেকে কিছু খাবার চাইলেন; মেয়েটি চেচিয়ে উঠলো-“ সক্কাল বেলা না একবার খাইলেন; অহন আবার খাওয়ন চান! অহন কোন খাওয়ন দিবার পারতাম না, আমি অহন অনেক বেজি ”। মেয়েটি থপাস থপাস পা ফেলে চলে গেলো; অথচ তিনি বললেন না যে তার সকালের নাস্তা করা হয়নি, কেউ তাকে খেতে দেয়নি। তার স্ত্রী তার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, তাকে দেখে থেমে গিয়ে বললো- “ কি গো, তুমি এই অসময়ে এইখানে বসে আছো কেন? এখনি ওরা বউ নিয়ে আসবে আর তুমি ময়লা কাপোড়-চোপোড় পড়ে এখনে বসে আসো, ছিঃ ছিঃ যাও যাও ঘরে যাও”।মকবুল সাহেব কোন কথা বললেন না। নিরবে নিজের ঘরে চলে এলেন। আজ শরীরটা বিশেষ ভালো ঠেকছে না তার কাছে; বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিলেন, একটু যেন ঘুম ঘুম পাচ্ছে। অল্প কিছুক্ষনের মধ্যে ঘুমিয়েও পড়লেন তিনি। ইতোমধ্যে দুপুরের খাবারের সময় পেরিয়ে গেছে বাড়িতে যারা ছিল তাদের খাওয়া দাওয়া শেষ কিন্তু কেউ মকবুল সাহেব কে ডাকলো না।ঘুমের ঘোরে মকবুল সাহেব দেখলেন, তার ছোট ছেলে বউ নিয়ে বাড়ি ফিরেছে আর হাসি হাসি মুখ করে তিনি উঠোনের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন। ছেলে তার বউকে নিয়ে সোজা তার কাছে চলে এলো নিচু হয়ে দুজন একসাথে তার পা-ছুঁয়ে সালাম করলো। এই পর্যন্ত স্বপ্নটা বেশ ভালোই কিন্তু তারপরের অংশগুলো বেশ এলোমেলো।মকবুল সাহেবের ঘুম ভেঙ্গে গেলো, তিনি ক্ষুধার প্রচন্ডতায় কুঁকড়ে যেতে লাগলেন, বিছানা থেকে উঠার জন্য দুই হাতে ভর দেয়ে শরীরটাকে কিছুটা উচুঁ করলেন; কিন্তু হায়ঃ বার্ধক্যের কাছে পরাজিত হতে হলো তাকে। তার বিশ্বস্ত হাত দুটি তাকে উচুঁ করে রাখতে পারলো না। তিনি পাট-খড়ির মত খাটের উপর ধ্বপাস করে পরে গেলেন; মাথাটা গিয়ে আঘাত করলো খাটের থামে। তার চারপাশটা যেন হঠাৎ করেই দুলে ওঠলো, চোখের সামনে সব কিছু অন্ধকার হয়ে গেল, কি ঘটতে যাচ্ছে তার কিছুই বুঝতে পারলেন না মকবুল।
সন্ধ্যার দিকে বউ নিয়ে হাজির হলো বর যাত্রী। সবাই খুব হৈ-চৈ করে বরণ করছে বউ। কিন্তু একটি বারের জন্যও কেউ জানতে পারলো না পাশের ঘরে একটি মৃতদেহ পড়ে আছে।
2 Responses to আলো আধারের ঘর বসতি
You must be logged in to post a comment Login