তাহমিদুর রহমান

ধারাবাহিকঃ নিশিযাত্রা (পর্ব ১১)

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

এগার

বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছার ঠিক আগের মুহূর্তে বাসের একটা ট্রিপ ছেড়ে চলে যেতে দেখল তাহের। ঘড়িতে কেবল সাতটার আশে পাশে বাজে এরকম সময়ের সকালবেলা, বেশ সুন্দর আবহাওয়া; সূর্য উঠি উঠি করছে। এরকম সময়েই সে অফিসে যাওয়ার জন্যে বের হয়েছে। এই সুন্দর সকালে দৌড় দিয়েও ট্রিপটা ধরতে পারল না বলে রাস্তার উপরে একটা ফাঁকা লাথি চালাল। বাসস্ট্যান্ডে বাকি পথটা অতিক্রম করার সময়ই বুকটা ধরে হাঁপাতে লাগল কিন্তু হাঁটা থামাল না।। বেশ কিছুদিন ধরে বুকে একটা ব্যাথা অনুভব করছে কিন্তু ডাক্তারের কাছে যাওয়া হচ্ছে না। এইদিন যাব, সেইদিন যাব করে আর যাওয়া হয় না, যেতে হলে পকেটে মোটা অংকের টাকার যোগান থাকতে হবে। তাহের ভাবে, ওর এক কলিগের শালা নাকি ডাক্তার; তাকেই একবার দেখিয়ে নিবে। আজকালের ডাক্তারগুলো একেবারে ডাকাত হয়ে গিয়েছে। সে এত টাকা কোথায় পাবে? তার উপর আবার সামনে নতুন মানুষ আসছে ঘরে। ঢাকা শহরে সন্তান জন্ম দেওয়াও অনেক কষ্টের তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে সে। পৃথিবীতে আসার আগেই জ্বালাতন শুরু করে দিয়েছে। তাছাড়া সন্তানসম্ভবা নিলার জন্যে আলাদা খরচ তো আছেই। সে সৃষ্টিকর্তাকে প্রায়ই একটা কথা বলে মনে মনে, “হয় খুব ধনী করে দিতে না হয় একেবারে নিঃস্ব, মাঝে ফেলে কেন এই কষ্ট দেওয়া”।

ফুটপাতের উপরে কিছুদূর পর পর ড্রেনের উপর দেওয়ার জন্য নতুন কংক্রিটের স্লাব বানানো হয়েছে। তাহের সেগুলোর একটাতে হোঁচট খেল এবং কোন রকমে টাল সামলাল। যেখানে হোঁচট খেল সেই জায়গাটা একবার তাকিয়ে দেখল যেন চোখ দিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করল, কেন এই নিষ্ঠুরতা করলে আমার সাথে? হাঁপাতে হাঁপাতে ভাসমান টিকেট কাউন্টারের সামনে এসে পড়ে। লোকগুলো টিকিট বিক্রির জন্যে বসে আছে টুল নিয়ে। রোদ উঠেনি তারপরও একটা ছাতা টেবিলের সাথে বেঁধে দেওয়া, বিভিন্ন দামের টিকিট সাজানো সামনে। তাহের কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে হাঁপাতে থাকে কিন্তু শ্বাস-প্রশ্বাস কিছুতেই ওর কথা শুনতে চাইছে না। বুকটা এসময় যেন আরও বেশি ব্যাথা করে উঠে। সে এবার ফুটপাতে বসে পড়ল, ঘড়ঘড় করে কাশল কিছুক্ষন; প্যান্টটা রাস্তার ধুলাবালিতে নোংরা হতে থাকল। হঠাৎ এটুকু দৌড়েই কেন এত কাহিল হয়ে পড়ল বুঝতে পারে না সে। সকালে খাওয়া রুটির অংশবিশেষ পাশের ড্রেনে উগলে ফেলে দিল। বমির মধ্যে যেন রক্ত আছে, কেমন লাল দেখাচ্ছে। চোখগুলো অবাধ্যের মত পানিতে ঝাপসা হওয়ায় সে সবকিছু অস্পষ্ট দেখল তার উপর নর্দমার পানি ঘন কাল; সেখানে লাল রঙও কাল দেখায়। তাহের রাস্তায় থুতু ফেলে, এবার পরিষ্কার দেখা যায় লাল অংশ; সেটা রক্ত। এবার একটা লোক এগিয়ে আসে তার দিকে, এসব দরদী লোক মাঝে মাঝে দেখা যায়।

-ভাইজানের কি অসুখ নাকি?

-এ্যাঁ?

-আফনের কি অসুখ?

-হুম। ভাই ওইযে চা বিক্রি করছে, ওখান থেকে এক গ্লাস পানি এনে দেন না। তাহলে খুব ভাল হয়।

-খাড়ান আইতাছি।

লোকটি পানি নিয়ে এলে তাহের কুলিকুচা করে আর মুখটা ভিজিয়ে নেয়। এখন কিছুটা ভাল লাগছে তার। নাহ, এবার ডাক্তার দেখানো জরুরী হয়ে পড়েছে, ভাবে সে। নিলা জানতে পারলে নির্ঘাত রাগারাগি করবে, ঠিক মত আর খাবে না; ওর একটা কথাও আর ঠিকমত শুনবে না। এই নিলাকে নিয়েও ভয়ে থাকে সে, এতটা জেদি আর একগুঁয়ে; মরে যাবে তবু কোন কিছু এদিক ওদিক করতে দিবে না। কিছুক্ষন পর উঠে দাঁড়াল তাহের, পানি এনে দেওয়া লোকটাকে ধন্যবাদ জানাল; এক হাতে গ্লাস নিয়ে প্যান্টের ময়লা পরিষ্কার করল। তারপর যে দোকান থেকে লোকটা পানি নিয়ে এসেছিল সে সেই দোকানে গিয়ে গ্লাসটা রেখে পানির দামের সাথে একটা নেভি সিগারেটের টাকাও দিল দোকানদারকে। দোকানে ঝুলিয়ে রাখা লাইটারটা দিয়ে সিগারেটটা ধরিয়ে সে ফুটপাত আর রাস্তার সংযোগস্থলে এসে দাঁড়ায়। ঠিক ভাবে সিগারেটটা ধরে রাখতে পারছে না, হাত কাঁপছে তার। আলগাভাবে ঠোঁটে লাগিয়েই সিগারেট টান দেয়, ধোঁয়া ছাড়ার সাথে সাথে কাশতে থাকে আবার। তাঁর চোখে পানি এসে যায়, ব্যাথায় না জীবনের পরিস্থিতিতে তা বুঝা শক্ত। নিলাকে সে অনেক ভালবাসে, কিন্তু সে কি পেরেছে তাকে খুশি করতে? পেরেছে কি তার সকল ইচ্ছে-আকাংখা পূরণ করতে? তাহেরের মনে হয় সে পারেনি, যখন তার যৌবনকালের শুরু তখন ভাবত জীবনে ভালবাসায় মনে হয় সবকিছু; আসলে কি তাই? জীবন যুদ্ধে সে হেরে গিয়েছে, তার কোন ভবিষ্যত নেই; বেঁচে থাকার ইচ্ছাটাও তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছে। তার প্রায়ই ইচ্ছা করে একদিন হঠাৎ করে কাউকে কিছু না বলে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া। তাহলে সে হয়ত বাঁচত আরো কিছুদিন, পৃথিবীটা মনে হয় তাকে জেলখানায় বন্দি করে ফেলেছে। সে কিছুতেই সেই জেলেখানা থেকে বের হতে পারছে না যেন এটাই নিয়তি।

দূরে বাসের নেক্সট ট্রিপটা আসতে দেখল তাহের তখন ঘড়িতে সাতটা সতের। সে নিজেকে টেনে টেনে টিকিট কাউন্টারের কাছে নিয়ে যায় যেন ওর কাঁধে ভারী বস্তা রয়েছে। টিকেট কেটে রাস্তায় প্রবেশ করতেই সাখাওয়াত সাহেবকে দেখতে পেল সে। বিয়ের পর উনাকে একবারই দেখেছে সে তবু ঠিকই চিনেছে। বিয়ের পরের দিন নিলা নিয়ে গিয়েছিল সাখাওয়াত সাহেবের বাসায়, সেদিন তিনি যে ব্যবহারটা করেছিলেন তাতে সে কোন আঘাত পায়নি কিন্তু নিলা খুব আঘাত পেয়েছিল। নিলার বিশ্বাস ছিল বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর বড় ভাই না মেনে নিয়ে থাকতে পারবেন না। কিন্তু হয়েছে তার উলটো, এ নিয়ে নিলা তাহেরের কাছে অসংখ্যবার মাফ চেয়েছে। নিলা প্রায়ই বলে, “আমি সেদিন তোমাকে ওখানে নিয়ে গিয়ে ভুল করে ফেলেছি, তোমার খুব খারাপ লেগেছে না?” তাহের অনেকবার নিলাকে বলেছে যে সে কিছু মনে করেনি তবু নিলার বিশ্বাস হয়নি। নিলার সেই বড় ভাইকে গাড়ি নিয়ে যেতে দেখছে সে, গাড়িটা বেশ সুদৃশ্য। এত সকালে তিনি কোথায় যাচ্ছেন উনি তাও আবার মিরপুরে, ভাবে সে। সাখাওয়াত সাহেবকে দেখেও না দেখার ভান করে মুখ ঘুরিয়ে নিল। সে কিছুতেই নিজেকে প্রকাশ করতে চাই না উনার সামনে। তারপরেই হৈ হৈ টাইপের শব্দে বাস চলে এল। তাহের দৌড় দিল বাসের দিকে, বাসের পাদানিতে উঠতে গিয়ে পড়ে গেল সে; তারপর আর উঠল না। কোন পরিচিত মানুষ তাহেরের এই পড়ে যাওয়া দেখল না। সে পড়ে গিয়ে শুয়েই রইল।

সাখাওয়াত সাহেব দূর থেকে তাহেরকে ঠিকই দেখেছেন। ছেলেটা অনেক রোগা হয়ে গিয়েছে আগের চেয়ে, দেখে অসুস্থ মনে হচ্ছে; তিনি ভাবেন একবার গিয়ে কথা বলেন তারপরই তার সেই দাম্ভিকতা তাকে যেতে দেয় না। পিছন থেকে ড্রাইভারকে থামার কথা বলতে গিয়েও বললেন না। মিরপুর বারতে এক জায়গায় মাটি বিক্রি হবে সেটা দেখতেই তিনি এত সকালবেলা বের হয়েছেন। মালিককে নয়টার পর পাওয়া যাবে না এইটাই এত সকালে বের হওয়ার মূল কারন। উনার ঢাকা শহরে চার পাঁচ জায়গায় ফ্ল্যাট ছাড়াও দু’তিন জায়গায় প্লটও কিনে ফেলেছেন। কিন্তু তবু তিনি তার সাম্রাজ্য বাড়াতে ইচ্ছুক। জমি বা ফ্ল্যাট কেনা উনার নেশার পর্যায়ে চলে গিয়েছে। এই স্বভাব তিনি পেয়েছেন তার বাবার কাছে থেকে, গ্রামে একসময় তাদের কয়েকশ একর জমি ছিল; জমিদার বলতে যা বুঝায়। এখনো যা অবস্থা তাতে মাঝে মাঝে উনার নিজেকে রাজার মত লাগে, এটা এমন এক ধরনের অনুভূতি যা উনাকে তৃপ্তি এনে দেয়।

জমিটা একটা গলির শেষ প্রান্তে। পাশে ঘেষাঘেষি করে বিল্ডিং উঠেছে নির্বোধের মত, এই একটিই প্লট বাকি রয়েছে। প্লটটা উনার পছন্দ হল না। উনার মনটা খারাপ হয়ে গেল। পরিষ্কার ধারনা ছাড়া এখানে আসা একদমই ঠিক হয় নাই। প্রথমে অন্য কাউকে দিয়ে খবর নিতে হত, ভাবেন তিনি। জমির মালিকের সাথে দেখা না করেই ফেরত যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। প্লটের মালিক আবার পাশের প্লটেই এক ডেভেলপার দিয়ে করা ছয়তলা বাড়িতে থাকেন। তিনি সেদিকে একবার তাকিয়ে গাড়ির ভেতর উঠে বসলেন। বাসা না অফিসে যাবেন এই দোটানায় ভুগে শেষপর্যন্ত অফিসের পথে ড্রাইভারকে যেতে বললেন।

অফিসে তেমন লোকজন আসেনি। পিয়ন রজব আলী টেবিল-চেয়ার ন্যাকড়া দিয়ে পরিষ্কার করছে। সাখাওয়াত সাহেবকে এত সকালে দেখে সে হকচকিয়ে গেল। কি এমন ঘটল যে স্যার এ সময় অফিসে?

-ছেলাম ছ্যার।

-হুম।

রজম আলী স্যারকে এত সকালে দেখে সত্যিই ভয় পেয়েছে। সে ভয়েই জিজ্ঞেসও করতে পারল না, স্যার কেন এত সকালে এসেছে? স্যারের ঘর তো এখনো মোছামুছি করা হয় নাই। সে স্যারের আগেই সেই রুমে দৌড় দিয়ে পৌঁছাবে কিনা ভাবে। তারপর ধীরে সুস্থে স্যারের সাথে সাথে রুমে ঢুকে।

-ছ্যার, একটু খাড়ান; মুইচ্ছা লই।

সাখাওয়াত সাহেব কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে রইলেন। উনার চিন্তায় এবার ছোট বোন নিলা এসে পড়েছে। একমাত্র বোনকে নিজ মেয়ের মত মানুষ করেছিলেন কিন্তু সে এখন কত পর। আগে এক মিনিট কথা না বলে থাকতে পারতেন না আর এখন দু’দুটো বছর কেটে গেল, দেখা পর্যন্ত নেই। তিনি না হয় বড়, নিজে থেকে যেতে পারেন না; নিলা কি একবারও দেখা দিয়ে যেতে পারে না? সে কি এখনো অভিমান করে বসে থাকবে? তাহের ছেলেটাকে দেখে আজ বড় কষ্ট হল, চেহারায় যেন দৈনতার ছাপ পড়ে গিয়েছে। তিনি কি পারতেন না তাদের মেনে নিয়ে তাহেরকে একটা সুযোগ করে দিতে? উনার সম্মানে বাঁধে, এখন নিজে থেকে আর যাওয়া যায় না; হাজার হলেও উনি বড়।

-ছ্যার হইয়া গ্যাছে, বয়েন।

তিনি চেয়ারে বসতেই পিওনটা আবার বলে,

-ছ্যার, কপি দিমু?

-হুম, দাও।

পিওনটা চলে গেল। তিনি চুপচাপ চেয়ারে বসে চোখ বুজলেন। এ কথা, সে কথা ভাবতে ভাবতে কখন জানি ঘুমিয়ে পড়লেন। তবে ঘুমটা হল ছোট। রজব আলী কফি নিয়ে এসেছে। তিনি ঘড়ির দিকে তাকালেন, বাজে নটা দশ। অফিসের সবার চলে আসার কথা। তিনি ফোনের রিসিভার কানে নিয়ে রিসিপসিনিস্টকে কল দিলেন।

-নবী এসেছে?

-জ্বী স্যার।

-করিম সাহেব?

-না স্যার, উনি এখনো আসেননি।

-আসেনি? আচ্ছা কে কে নয়টার আগে এসেছে আর কে কে নয়টার পরে এসেছে রিপোর্ট কর আমাকে। সাথে একটা পার্সেন্টেজের হিসাব দিও।

-জ্বী স্যার, আমি এখনি তৈ্রি করছি।

-আর নবীকে একটু পরে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও।

-ওকে স্যার।

তিনি রিসিভার নামিয়ে রেখে কফিতে চুমুক দিলেন। এসির রিমোর্টটা হাতে নিয়ে ঠান্ড বাড়িয়ে দিলেন, শীত কিংবা গ্রীষ্ম; উনার ঘরে এসি চালু থাকে। ঠিক এসময়ই ফোনটা বেজে উঠে।

-সাখাওয়াত বলছিস?

-হ্যাঁ বলছিলাম। আপনি?

-আমি রেজওয়ান।

-রেজওয়ান? কবে আসলি দেশে?

-আজই ভোররাতে।

-জানাসনি কেন?

-জানায়নি তবে তোর কাছেই এসেছি।

-আমার কাছে?

-হ্যাঁ, তোর কাছে। গতবার দেশে এসে যখন তোর মেয়েকে দেখলাম তখনই মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম তোর মেয়েকেই আমার পুত্রবধূ করব। তুই রাজি আছিস তো?

সাখাওয়াত সাহেব মনে মনে খুশি হয়ে উঠেন।

-রেজওয়ান, তুই যে আমাকে কি চিন্তা থেকে বাঁচালি যে বলার মত না।

রেজওয়ান সাহেব হাসেন।

-হাসিস না, তুই আজই সন্ধ্যায় আমার বাসায় চলে আয়। তোর ছেলে এসেছে তো সাথে?

-হ্যাঁ এসেছে। তবে আজ যাব নারে। খুব টায়ার্ড, আজ শুধুই বিশ্রাম। তুই কি আমার ছেলেকে দেখেছিলে কখনো?

-হুম, চার পাঁচ বছর আগে মনে হয়।

-আচ্ছা তোকে ওর এখনকার একটা ছবি মেইল করে দিচ্ছি। আর কাল সন্ধ্যায় রেডি থাকিস।

-ওকে।

-ওকে, তাহলে রাখি এখন।

-ওকে।

রিসিভার রাখার সাথে সাথেই নবী এসে ঢুকে রুমে।

-আসতে পারি স্যার?

-হুম, আস নবী।

-স্লামালাইকুম স্যার।

-হুম, ওলাইকুম।

নবী সামনে চেয়ার টেনে বসে।

-বল, কি খবর।

-স্যার আমি আপনার মেয়েকে কয়েকদিন ফলো করে দেখেছি। উনি একটাই ছেলের সাথে মেলামেশা করেন। যতদূর খবর পেয়েছি ছেলেটা তেমন কিছু করে না। টিউশনি করে চালিয়ে নেই, তেমন কোন ভবিষ্যত নেই।

-আর বাবা-মা, ভাই-বোন?

-বাবা-মা নেই ছেলেটার, এতিম। আর একটা বোন আছে। ঢাকাতেই থাকে, তবে…

-তবে?

-মেয়েটা ভাল না স্যার। বাকিটা আপনি ধরে নেন স্যার, আমি বলতে পারব না আপনার সামনে।

সাখাওয়াত সাহেব এবার গম্ভীর হয়ে যান। ওলিও একই ভুল করতে চলেছে। ওকে যে করেই হোক, থামাতে হবে।

-কিন্তু ওলি কিন্তু তোমাকে দেখেছে।

-আমাকে?

-হুম, ও বলছিল কে যেন তাকে ফলো করছে।

-তাহলে আমি সরি স্যার, আমি সাবধানতার সাথে করার চেষ্টা করেছি।

-ইটস ওকে। আমি বরং এটাই কাজে লাগিয়েছি, ওর যখন তখন বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি।

নবী নিরব থাকে।

-তুমি ভালই কাজ করেছ, আমি খুশি হয়েছি।

-থ্যাঙ্কস স্যার।

-ঠিক আছে, তুমি এস।

নবী আবার সালাম জানিয়ে চলে যায়। সাখাওয়াত সাহেব এবার কাজে মনোযোগ দেন, চিন্তা যখন চলে গিয়েছে তখন কিছু কাজ করে নেওয়া যাক। তিনি রাত নটা পর্যন্ত অফিস করে বাড়ি ফিরলেন। রাতের খাবার শেষে অনেকদিন পর জাহানারার সাথে শুয়ে শুয়ে গল্প করবেন বলে ঠিক করলেন।

-কি ব্যাপার? তোমাকে আজ খুশি খুশি লাগছে?

ঘরের লাইট বন্ধ, তার বদলে বিছানার পাশে একটা টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে। সাখাওয়াত সাহেবের পাশে শুয়ে জাহানারা জিজ্ঞেস করলেন তাকে।

-হুম, অবশ্যই খুশি। কাল তোমার মেয়েকে দেখতে আসবে।

জাহানারা অবাক হন এ কথা শুনে।

-হঠাৎ?

-হুম একটু হঠাতই। আজ রেজওয়ান ফোন দিয়েছিল। তারই ছেলে সেজান।

-কোন রেজওয়ান?

-রেজওয়ান আবার কয়টা আছে?

-তোমার সেই প্রবাসী বন্ধুর ছেলে?

-হুম।

-ঐ লম্বা লম্বা চুল নিয়ে এসেছিল একবার সেই ছেলে?

সাখাওয়াত সাহেব এবার বিরক্ত হন।

-এটা আবার কেমন কথা। তরুন বয়সে ছেলেরা খেয়ালে কত কিছু করে।

-না মানে…

-কাল সন্ধ্যায় আসবে। তোমার মেয়েকে ঠিকঠাক করে রেখ। ছেলের ছবি আছে আমার কাছে কাল সকালে তোমাকে দেখাব।

-একবার ওলিকে জিজ্ঞেস করলে হত না?

-জিজ্ঞেস করার কি আছে? ওকে বলে দিও ওরা দেখতে আসবে।

-তারপরও একটা মতামত।

-মতামত? জান ওলি যে ছেলেটার সাথে মেলামেশা করছে সেই ছেলেটার বোন একটা বেশ্যা?

-কি বলছ এগুলো?

-আমি ঠিকই বলছি। মেয়েকে কেটে নদীতে ভাসিয়ে দিব তবু এবার কোন ভুল নয়।

-হুম।

জাহানারা আর কিছু বলেন না। সাখাওয়াত সাহেব স্ত্রীর সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেন। একটা পা উঠিয়ে দেন স্ত্রীর উরুর উপর দিয়ে। আজ উনার মনটা ভাল। একটু পরেই স্ত্রীর ব্লাউজের বোতাম খুলতে থাকেন। বিয়ের এতদিন পরও তাকেই এসব করে দিতে হয়।

এদিকে নিলা দশটার দিকে তাহেরের উপর রাগ করল, বারটার দিকে অভিমান এবং একটার পরে অস্থির হয়ে পড়ল। তাহের এখনো ফেরেনি। সে অফিসে, পরিচিত সবাইকে কল দিয়ে দেখেছে; তাহের কোথাও নাই। তার ইচ্ছা করে দরজা খুলে দৌড় দেয়। কিন্তু সে চুপচাপ শুয়ে থাকে, চোখে জল নিয়ে।

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


3 Responses to ধারাবাহিকঃ নিশিযাত্রা (পর্ব ১১)

You must be logged in to post a comment Login