সেজান মাহমুদ

একজন হুমায়ূন আহমেদ এবং হায়রে বাংলাদেশ!

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

humayun-ahmed-bangladesh-file-670হুমায়ূন আহমেদ কে নিয়ে কথা বলতে গেলে বা লিখতে গেলে আমি এক ধরনের আবিস্কারের আনন্দ অনুভব করি। আজকে তাঁর প্রবাদপ্রতিম জনপ্রিয়তা বা খ্যাতির বাইরে এক অন্য ধরনের আবিস্কারের আনন্দ, একজন মানুষকে আবিস্কারের আনন্দ। তাঁর লেখা নিয়ে হয়তো বা সবসময় একরকম মন্তব্য করবো না, কিন্তু আবিস্কারের সুখটুকু চিরকাল তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করবো। কেন করি সেকথা শুনে আমাকে কেউ নার্সিসিস্ট বা আত্নপ্রেমিক বললেও কোন আপত্তি নেই। তবে এই স্বল্প পরিসরের লেখায় হঠাৎ হুমায়ূন আহমেদ কেন? তার কারণ সম্প্রতি প্রথম আলোতে প্রকাশিত এবং যায়যায়দিনে পুনঃপ্রকাশিত তাঁর খুব ছোট্ট একটি লেখা হায়রে বাংলাদেশ। এ বিষয়ে কিছু বলার আগে আমার আবিস্কারের গল্পটি বলে নিই।

ক্লাস এইটে জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায় মেধা তালিকায় স্থান পাওয়ার জন্য স্কুল থেকে একগুচ্ছ বই পুরস্কার দেয়া হলো আমাকে। তার মধ্য অনেকগুলো উল্লেখযোগ্য বই যা আমার জীবনকে পালটে দিতে সাহায্য করেছিল। জামতৈল নামের এক সাধারণ গ্রামের স্কুলে ছিলেন কয়েকজন অসাধারণ শিক্ষক। তাঁদের মধ্যে মুজিবর রহমান বিশ্বাস ছিলেন লেখক-প্রাবন্ধিক। প্রত্যন্ত গ্রামের সাধারণ স্কুলের শিক্ষক হয়েও সেই গ্রামে বসে ’উপনিষদের দার্শনিক মর্ম ও অন্যান্য আলোচনা’র মতো প্রবন্ধগ্রন্থ রচনা করেছেন তিনি। তাঁর বই সিলেকশন যে অন্যরকম হবে তা বলাই বাহুল্য। একসঙ্গে পাওয়া বিশ বাইশ টা বই আমি গোগ্রাসে গিলছি। সেখানে জন রীডের দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন, ম্যাক্সিম গোর্কির মা, চেঙ্গিস আইসমভের গল্প সংকলন। সেই সঙ্গে একজন নতুন লেখকের আনকোরা নতুন বই নন্দিত নরকে। তখন হুমায়ূন আহমেদের নামও শুনিনি। এক নিঃশ্বাসে শেষ করে হু হু করে কাঁদছি। এক অবর্ণনীয় আনন্দের কান্না, কিশোর বয়েসের যুক্তিহীন আবেগের কান্না নয়, বরং এক পরিনত জীবনবোধের, জীবনকে স্পর্শসুখের আনন্দে কান্না। গ্রামের টিনের চালে ঝম ঝম বৃষ্টির শব্দে ঢেকে যাচ্ছিলো সেই কান্নার শব্দ, আর আমি বার বার বলছিলাম, এই লেখককে খুঁজে বের করতেই হবে।
ঢাকায় এলাম ইন্টারমিডিয়েট পড়ার জন্য। অনেকটা জীবিকার জন্যই গান লিখি, বেনামে পত্রিকায় ফিচার আর জিঙ্গল লিখি। জিঙ্গল হলো বিঙ্গাপনের গান। নগদ টাকা, তাছাড়া পরিশ্রমও কম। পাশাপাশি উন্মাদ পত্রিকায় মাঝে মাঝে খবর থেকে ছড়া লিখি। এই বিভাগে প্রকাশিত খবর নিয়ে আমার ব্যঙ্গাত্নক ছড়ার সঙ্গে কার্টুন আঁকেন কার্টুনিস্ট আহসান হাবীব। আহসান হাবীব বন্ধুত্ব্বের সূত্র ধরে একদিন বললেন যে প্রকাশনী ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হতে চান তিনি। আমাকে পান্ডুলিপি দিতে বললেন। তারপর নিজেই তার স্বভাবসুলভ রসিকতায় বললেন,’আপনার বই ছাপলে তো দেউলিয়া হতে হবে, তার চেয়ে এক কাজ করুন কয়েকজন বিখ্যাত লোকের গল্প নিয়ে একটা সংকলন বের করুন। সেটা দিয়ে ব্যবসা হবে। সেই সঙ্গে আপনার একটা মৌলিক বইও ছাপবো। এই বইয়ের লোকসান পুষিয়ে নেয়া যাবে অন্য বইটি দিয়ে।’
ঠাট্টা করে বললেও কথাটা তো তখন সত্যি ছিল। আমি ঝাঁপিয়ে পড়লাম কিশোর রহস্য গল্প সংকলনের কাজে। আমার উৎসাহ আরো বেশী, কারণ আমার মৌলিক ছড়াগ্রন্থ হাবিজাবি বের হবে একই সঙ্গে। তাছাড়া সেই প্রথম জানলাম লেখক হুমায়ুন আহমেদ এবং মুহম্মদ জাফর ইকবাল তার সহোদর। যাকে সেই ছোটবেলায় খুঁজে বের করার পণ করেছিলাম তিনি হাতের নাগালে, এতো সহজে। আহসান হাবীব সাবধান করে দিয়ে বললেন,’আপনি সম্পাদক, আপনার দায়িত্ব আমার ভাইয়ের কাছে থেকে গল্প আদায় করা। এই কাজে সফল হওয়া অনেকটা পুলসেরাত পার হওয়ার সমান।’ পুলসেরাত পার হলাম। উননব্বই এর বইমেলায় শওকত ওসমান, শওকত আলী, রাহাত খান, হুমায়ুন আহমেদ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ইমদাদুল হক মিলন সহ দশজন গল্পকারের দশটি আনকোরা গল্প নিয়ে বের হলো কিশোর রহস্য গল্প। সেই সঙ্গে অনেক চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে আমার ছড়াগ্রন্থ হাবিজাবি।

রহস্য গল্প সংকলনটি একেবারে ব্যবসা-সফল প্রকাশনা হিসেবে বাজারে স্থান করে নিলো। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র আয়োজিত সারা বাংলাদেশ জুড়ে যে বই পড়া যে প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতো সেখানেও নির্বাচিত হলো বইটি। সেই সঙ্গে আমার প্রথম বই হাবিজাবি পেলো শিশু একাডেমী থেকে পুরস্কার। জন্ম হলো আজকের একটি সফল প্রকাশনী সংস্থা দিনরাত্রি প্রকাশনী। কিন্তু আমার কাছে এগুলোর চেয়েও বড় পুরস্কার কিশোর বয়েসের আবিস্কার করা সেই প্রিয় লেখকের পারিবারিক বন্ধুত্ব।
হুমায়ুন আহমেদ এবং মুহম্মদ জাফর ইকবাল যখন আমেরিকায় তখন প্রায়ই আহসান হাবীবের সঙ্গে তার কল্যানপুরের বাসায় যেতাম। সেখানে তার সঙ্গে থাকতেন এই ত্রিরত্নের মা। নিজের ছেলের মতো খাবারের পাতে কই মাছ তুলে দিতে দিতে আক্ষেপ করতেন, তাঁর বড় শখ ছিলো একটি ছেলে ডাক্তার হোক। আমি বলতাম খালাম্মা, ’আমরা চাই আর না চাই দেশে প্রতি বছর অন্তত বারশো ডাক্তার তৈরি হবে। সেটারও দরকার আছে, কিন্তু প্রতি বছর দেশ তো বারজন লেখকের জন্মও দিতে পারে না। ভালো লেখক জন্মায় যুগে যুগে।’ তিনি স্নেহ-মাখা শাসনের সুরে বলতেন এইজন্য লেখক হওয়ার আশায় মেডিক্যালের পরীক্ষা বাদ দিয়া বইমেলার কাজ করো, না?গল্প করতে করতে কখনও তিনি ’শাহীনের বাবার’ কথা বলতেন। শাহীন আহসান হাবীবের ডাক নাম। একজন সৎ, নিষ্ঠাবান, দেশপ্রেমিক পিতার কথা বলতেন। একজন মুক্তিযুদ্ধের শহীদের কথা বলতেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমার বুকে গভীর, বিশাল এক ক্ষত আছে। কোন নিকটজন হারাবার বেদনার চেয়েও গভীর। নিকটজন হারানো এক ধরনের কষ্ট। তাতে কষ্টের নিষ্পত্তি হয়ে যায়। এই কষ্টও বিশাল। কিন্তু কিছু কষ্ট, কিছু ক্ষত নিষ্পত্তিহীন। কী এমন কষ্ট যা নিকটজন হারানোর বেদনার চেয়েও গভীর, বিশাল ক্ষত সৃষ্টি করে মনে? তার উত্তর আজ দিতে পারবো না। কেউ জিগ্যেস করলেও বলতে পারবো না। বলবো কোন একদিন সময় হলে। অন্যদিকে আজকাল এই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নানান রকমের ব্যবসা; মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের ভন্ডামি, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখক-বুদ্ধিজীবীদের পন্যের পসরা, মুক্তিযুদ্ধের আবেগকে তুলে ফেলা হয় মুৎসুদ্দি মুদির দোকানদারি আর দালালদের ঝোলাতে। এই ক্ষত নিয়ে তাই যখনই কোন মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধাহত বা শহীদ পরিবারের সামনে দাঁড়িয়েছি তখনই অপরিসীম বেদনায় ছেয়ে গেছে মন। এজন্য বোধকরি কিশোর বয়েসে আবিস্কার করা লেখক লেখকের অধিক হয়ে ধরা দিতেন আমার মনে।
কাউকে ভালোবাসলেই একধরনের অধিকারবোধের জন্ম হয়। এই অধিকারবোধের কারণেই মনে হয় বার বার ছুটে গেছি হুমায়ুন আহমেদের কাছে। প্রশয়ও পেয়েছি তার কাছে। সেই শহীদুল্লাহ হলের হাউস টিউটরের এ্যাপার্টমেন্ট, হাতির পুল বাজারের অপেক্ষাকৃত বড় এ্যাপার্টমেন্ট থেকে আজকের ধানমন্ডির প্রাসাদোপম বাড়ি, সবর্ত্রই অবাধ প্রবেশাধিকারের প্রিভিলেজ পেয়েছিলাম। প্রিয় লেখক, প্রিয় মানুষ বলেই তার কাছে থেকে আশা করতাম আরও বেশী। কিন্তু কখনও তাবেদার স্তুতিকারকে পরিনত হইনি। বরং প্রয়োজনে অন্য সবার চেয়ে সমালোচনায় উচ্চকিত হতাম তার সামনেই। অন্য সবার কাছে থেকে শুনতাম তিনি সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না, তিনি অহংকারী ইত্যাদি। আমার অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। কয়েকটা ঘটনা উল্লেখ করিঃ
তার মেফ্লাওয়ার সদ্য প্রকাশিত হয়েছে। একদিন তার বাসায় গিয়েছি, ঠিক তখনই প্রকাশক লেখক কপি পৌছে দিলেন বাসায়। সেখান থেকে একটি কপি দিলেন তিনি । তখন হস্টেলে থাকি। বইটি পড়েই পেলাম একটি বড় তথ্যগত ভুল। লেখা আছে আমেরিকায় ডঃ ক্লার্কের বাসায় অনেক দূর্লভ জিনিসের মধ্যে দু’হাজার বছরের পুরনো কোরান শরিফের পাতা। হস্টেলের কয়েন বক্স থেকেই সাথে সাথে ফোন করলাম। কোরান শরিফের বয়সই তখন দুহাজার বছর হয়নি। তিনি বললেন ভালো বলেছো, এক্ষুনি পাবলিশারকে ফরমাটা নতুন করে ছাপতে বলি। কিম্বা কোথাও কেউ নেই নাটকের রিহার্সেল হচ্ছে বিটিভির একটি কক্ষে। হঠাৎ তুমুল বিতর্ক শুরু হলো। একপক্ষে অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর, হুমায়ুন ফরীদি, সূবর্ণা মুস্তাফা অন্যদিকে হুমায়ুন আহমেদ। অভিনেতাদের বক্তব্য হলো টিভির বাংলা নাটকের একটি স্ট্যান্ডার্ড, শুদ্ধ ভাষা থাকা উচিত। হুমায়ুন আহমেদের বক্তব্য না, নাটকের ভাষা হবে আমাদের মুখের ভাষা। কথ্য ভাষা। দু’পক্ষেরই অকাট্য যুক্তি। কিন্তু কেউ মনে হচ্ছিল আসল কথাটা বলে নাট্যকারকে চটাতে চাচ্ছিলেন না। আমি সেখানে দর্শকমাত্র। আমার স্ত্রী, তৃষ্ণা মাহমুদ একজন অভিনয় শিল্পী ঐ নাটকে। আমি তার ড্রাইভার বলা যায়। সুযোগ বুঝে ঝাঁপিয়ে পড়লাম বিতর্কে। হুমায়ুন আহমেদকে উদ্দেশ করে বললাম, ’নাটকে কথ্য ভাষা থাকবে ভালো, কিন্তু একেকজন একেকরকম কথ্য ভাষা ব্যবহার করতে থাকলে একসময় ভাষাটাই একটা জগাখিচুরিতে পরিনত হয়। সাহিত্যের একটি বড় দায়িত্ব ভাষাকে পরিকল্পিতভাবে অগ্রসর হতে দেয়া। তাছাড়া লোকভাষারও শুদ্ধ রূপ আছে। অথচ আমরা লোকভাষার নামে আঞ্চলিকতাদুষ্ট ভাষা ব্যবহার করছি। যেমন আপনার লেখায় শুনা, উঠা, পুড়ানো ইত্যাদি, সমাপিকা আর অসমাপিকা ক্রিয়ার উলটো ব্যবহার দেখা যায়।’হল ভর্তি লোক স্তম্ভিত আমার স্পর্ধা দেখে। আমি বুঝতে পারছি না বাসায় যতই হুমায়ুন ভাই বলি না কেন, এতো লোকের সামনে এভাবে বলাটা ঠিক হলো কি না। তিনি সবাইকে অবাক করে দিয়ে বললেন, হ্যা, সেজান ঠিকই বলেছো। আমার লেখার এটা ময়মনসিংহের আঞ্চলিকতার দোষ। সেদিন থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গেলো।
তার কাছে অন্যায় আবদারও করেছি কখনও। যেমন কোথাও কেউ নেই নাটকে আমার স্ত্রী তৃষ্ণা তিন কন্যার একটি চরিত্র রূপায়ন করছিলেন। একবার পত্রিকায় খবর বের হলো যে এই চরিত্রটি বাকের ভাইয়ের বিরুদ্ধে মিথ্যা স্বাক্ষ্য দেবে। এখবর বের হবার পর হাসপাতালের গাইনী বিভাগের রোগীরা পর্যন্ত বেঁকে বসলো। তৃষ্ণা তখন মিটফোর্ড হাসপাতালের গাইনী বিভাগে ইন্টার্নি করছিল। তাদের সোজা বক্তব্য, ’আপা আপনে যদি মিথ্যা স্বাক্ষী দেন তাহলে আপনার হাতের চিকিৎসা নিবো না’। মহা মুশকিল! সেটা এমন পর্যায়ে গড়ালো যে একদিন তৃষ্ণা এসে কাঁদো কাঁদো হয়ে আমাকে বললো, তুমি হুমায়ুন ভাইকে বলো যেন আমার চরিত্রটিকে দিয়ে স্বাক্ষ্য না দেয়া হয়। আমি ভীষণ অবাক। কারণ ওর মনের জোর আমি জানি। বাংলাদেশের মতো সামাজিক অবস্থায় টিভি নাটকে একজন কলগার্লের ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য যে কি ধরনের অবস্থার সন্মুখিন হতে হয় তাও জানি। এমনকি মেডিকেলে পড়া ক্লাসমেটরা যখন সিটি বাজিয়ে বলতো, রেট কতো? তখনও ওকে বিচলিত হতে দেখিনি। বরং বলতো, ওদের জন্য আমার করুনা হয়। দেশের সবচেয়ে শিক্ষিত লোকগুলোর যদি এই মেন্টালিটি, তাহলে রিক্সাওয়ালাদের কি দোষ? সেই মানুষ এতোটা ভেঙ্গে পরেছে। বললাম, তুমি তো জানো এটা বলাটা উচিত না। তুমি গ্রুপ থিয়েটার করা মানুষ হয়ে কীভাবে এটা বলতে বলছো? উত্তরে বললো, আমি জানি, আমি অভিনয়ের চেয়ে ডাক্তারি করাই বোধহয় বেশী ভালোবাসি। দুজনে সোজা হুমায়ুন আহমেদের বাসায় হাজির হলাম। সব শুনে তিনি বললেন, তুমি ডাক্তার না হলে হয়তো এটা করতাম না। গরীব দেশ, অশিক্ষার দেশ, এখানে অনেক কিছুই মেনে নিতে হয়। তিনি স্ক্রীপ্ট পালটে দিলেন। অন্যায় আবদার করার জন্য যে ভার বুকে চেপে ছিলো মুহূর্তেই তা নামিয়ে দিলেন তিনি।
এভাবেই আবিস্কার আর ভালোবাসার দাবিতে, কখনও একপাক্ষিকভাবেই তার কাছে অধিকার ফলিয়েছি। কখনও লেখা পড়ে আশাহত হলে চিৎকার করে বলেছি ’হেকনিক প্লট’। কিন্তু কখনও বিশ্বাস হারাইনি তার ওপর থেকে। একবার সেরকম হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। আমার এক ঘনিষ্ঠবন্ধু এসে বললো ’যে হুমায়ুন আহমেদকে নিয়ে বড় বড় কথা বলিস তিনি তো ঢাকা ভার্সিটিতে জামাতের হয়ে ইলেকশন করছেন’। আমি ইউনিভার্সিটির এইসব রাজনীতি বুঝি না। তাই কথাটাকে তাৎক্ষিনিকভাবে বিচার করতে পারছিলাম না। সে বছরই বইমেলায় প্রকাশিত আমার কিশোর উপন্যাস তুষার মানব উৎসর্গ করেছি হুমায়ূন আহমেদকে। উৎসর্গপত্রে লিখেছিলাম ’ কথাশিল্পী হুমায়ুন আহমেদ, যাঁর নিঃশঙ্ক হাত ধরে পৌছে যাই আমাদের নন্দিত নরকে’। একজন লেখক জানেন একজন লেখকের উৎসর্গ কতখানি গভীর অনুভব থেকে উৎসৃত। এই বইয়ের একটা কপি নিয়ে সোজা তার বাসায় হাজির হলাম। তাকে দিলাম বইটি। নেড়ে চেড়ে দেখে বললেন,
-থ্যাঙ্ক ইউ। খুব ভালো প্রোডাকশন। বিক্রী-টিক্রী হয়?
বললাম,
-বেশ হয়। কিন্তু আমি শুধু এ বইটি দিতে আসিনি। আজকে আমার একটা প্রশ্ন আছে। এই প্রশ্নের উত্তর আমার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
-বলো কি প্রশ্ন।
সোজা তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম,
-শুনেছি আপনি নাকি ভার্সিটিতে জামায়াতের হয়ে ইলেকশনে দাড়িয়েছেন? কথাটা ঠিক কি না? তাকে উত্তর দেবার সুযোগ না দিয়েই বললাম, আমার বইটি উৎসর্গ করেছি আপনাকে। আপনি বড় লেখক। এরকম উৎসর্গপত্র শত শত পেতে পারেন। কিন্তু এটা আমার কাছে অনেক বড়। আপনার উত্তর যদি ’হ্যাঁ’ হয় তাহলে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটা নতুন ঘটনা ঘটবে। আমি প্রেস ক্লাবে গিয়ে প্রেস কনফারেনস করে আমার উৎসর্গপত্রটি তুলে নেবো। মানুষ জানবে একজন ক্ষুদ্র লেখক তার প্রতিবাদ জানিয়েছে তার উৎসর্গপত্র তুলে নিয়ে।
তিনি আমার দিকে তাকিয়ে সোজা উত্তর দিলেন, বললেন -না।
আমি আবার ভারমুক্ত হলাম। একজন স্পর্শকাতর মানুষের জন্য সবচেয়ে কষ্টের কাজ হলো কাউকে শ্রদ্ধার আসন থেকে টেনে নামানো। আমাকে তা করতে হয়নি। আমাকে হারাতে হয়নি তার প্রতি আমার বিশ্বাস।
সেদিন ভাবী বললেন রাতের খাবার খেয়ে যেতে। খাওয়ার পর সবাই গল্পে মশগুল। খেয়াল করি অনেকক্ষণ তার কোন সাড়া-শব্দ নেই। আমি ড্রয়িং রুমে এসে দেখি কেউ নেই। সেই রুমে কোন ফার্নিচার ছিল না। অনেকগুলো কুশন ছড়ানো, আর নিচু একটা টেবিলে তার লেখার কম্পিউটার। মেঝেতে বসেই লিখতেন তিনি। কাঁচের স্লাইডিং ডোর খুলে দেখি রাতের ব্যস্ত ঢাকা, হাতিরপুল বাজারের শোরগোল, আর এরমধ্যেই অন্ধকার বারান্দার এককোনে হাঁটু ভাজ করে গুটিশুটি মেরে বসে আছেন তিনি, দূরে কোথাও তাকিয়ে। চারপাশের আলোর আভায় পাশে থেকে দেখতে পাই তার চোখ ভেজা। কাঁদছেন হুমায়ুন আহমেদ। আমাকে দেখার আগেই আমি নিঃশব্দে সরে আসি। একজন লেখকের কতরকম যন্ত্রণা থাকে! অসংখ্য মানুষের জীবনের কষ্টকে বুকে ধারণ করে, নিজেকে দুমড়ে মুচড়ে তুলে আনতে হয় শিল্পের হীরকখন্ড, নিজেকে ভাঙতে হয়, গড়তে হয় কত না অজানা বেদনায়। কারো কি চোখে পরে সেই অদৃশ্য রক্তক্ষরণ?
কয়েকদিন আগে বাংলাদেশ সরকারের একজন মন্ত্রী, যিনি তার গাড়িতে বাংলাদেশের রক্ত খচিত পতাকা উড়িয়ে প্রতাপের সঙ্গে ঘুরে বেড়ান, সেই ব্যরিস্টার নাজমুল হুদা বীরদর্পে ছাত্র শিবিরের সম্মেলনে বললেন একাত্তরে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে কোন ভুল করেনি। বিদেশের মাটিতে বসে এই সংবাদ পড়ে রাগে-দুঃখে স্তব্দ হয়ে বসেছিলাম। বাংলাদেশে থাকলে হয়তো বা ছুটে যেতাম তার কাছে। আপনার মতো শক্তিশালী লেখক, শহীদের সন্তানও কি নিশ্চুপ থাকবে? তাহলে দেশের বিবেকেরা কোথায়? কিছুদিন আগে যখন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ছাত্রীদের ওপর নির্বিচারে লাঠি চালিয়ে ছিলো পুলিশবাহিনী, সেদিন সবচাইতে শক্তিশালী লেখাটি লিখেছিলেন মুহম্মদ জাফর ইকবাল। আজকে এদের কেউই কি জেগে নেই? এরকম ভাবতে ভাবতে, বিদেশ বিভূঁইয়ে বসে কিছুই করতে না পারার কষ্টে লেখার জন্য কম্পিউটার টেনে নিয়েছি। ঠিক তখনই চোখে পড়লো প্রথম আলোতে তার লেখা ’হায়রে বাংলাদেশ’। ছোট্ট, ধারালো, তীব্র একটি লেখা। তিনি আবারও বাড়িয়ে দিলেন তার নিঃশঙ্ক হাত, আবারও জাগিয়ে দিলেন জাতির বিবেক। একজন সত্যিকারের লেখক কখনও পারেন না বিবেকের দায়ভাগ এড়াতে। এক হতভাগা দেশ, হতভাগ্য জনগোষ্ঠীর স্বাধীনতার জন্য আপনার এই বিবেক যেন চিরকাল জাগ্রত থাকে, এ আমার ভালোবাসার দাবী। হুমায়ুন আহমেদ, আপনাকে ধন্যবাদ, বহু ধন্যবাদ।
*লেখাটি সাপ্তাহিক যায় যায় দিন এ পূর্ব প্রকাশিত
পুনশ্চঃ লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার পর পর অনেক পাঠক ইমেইল করে জানতে চেয়েছিলেন সেদিন হুমায়ূন আহমেদ কে কাঁদতে দেখা মানে কি তিনি আসলে অপরাধবোধ থেকে কেদেছিলেন কি না। আমার উত্তর, না। আমিও তা বলতে চাই নি। আমি শুধু একজন লেখকের কষ্টকে ইঙ্গিত করেছিলাম, সৃষ্টির পেছনের যন্ত্রণাকে নির্দেশ করেছিলাম।
সে. মা.
কোথাও কেউ নেই নাটকের লিংকঃ
http://www.youtube.com/watch?v=2iz7kTt9wDQ&feature=related

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


You must be logged in to post a comment Login