শামান সাত্ত্বিক

এ লে ফ্লে দ্যু মাল ৩

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

এ লে ফ্লে দ্যু মাল ১
এ লে ফ্লে দ্যু মাল ২

সম্বিত ফিরে পায় শায়ান। অদ্ভূদ আঁধার এক জড়িয়ে আছে ঘরটাকে। ঝিম ঝিম মাথা নিয়ে মেঝে থেকে উঠে পড়ে। কেমন টলমল লাগছে সব। প্রজাপতিগুলো তার চোখে পড়ছে না। ছটফট করতে লাগলো সে। কোথায় মিলিয়ে গেল এরা। তাদের ছাড়া সে চলবে কিভাবে? তারাই তো তাকে ঘোরতর এক স্বপ্নলোকে উপনয়ন ঘটিয়েছে। যন্ত্রণাটা সুতীব্র হতে থাকে খুব কলজে জুড়ে। ভেতর থেকে চিৎকার উঠে, “আলিশা”। আলিশা নেই। তার প্রজাপতি নেই। পঙ্গুত্ব তাকে জাপটে ধরে আষ্টেপৃষ্ঠে। তার হৃদপিন্ড টেনে বের করে আনছে কে? হাহ্‌।

হঠাৎ অন্য প্রান্ত থেকেও সে চিৎকার শুনতে পায়, “শায়ান। শায়ান।” আলিশা বিছানার যেখানে শুয়ে ছিল, সেখানে বসে তার বালিশে মাথা উপুড় করে রেখে শায়ান যন্ত্রণাকে সামাল দিচ্ছিল। ডাক শুনে চমকে সে মজনুর মত উদভ্রান্ত দৃষ্টিতে ফাঁকা ঘরে এদিক সেদিক তাকায়। তারপর দীপ্ত উগ্র ভঙ্গিতে শরীরে যতটুকু শক্তি সম্ভব জমা করে বীর্যবানের মত ঘরের মূল দ্বারে উপনীত হয়। ঠিক সে সময় ভোরের সব আলো তার খোলা ঋজু দেহটাকে আনন্দে পরিপূর্ণ গ্রাস করে। সূর্যরশ্মি তার দীপ্ত চেতনাকে বিস্ফোরিত করে। ভেতর থেকে ফুঁসে উঠে শায়ান। সে শরীরে কাপড় জড়িয়ে নিতে দ্রুত ঘরের ভেতর প্রবেশ করে।

ভোরের আলো জলাশয়ের এ ধারে এখনো পৌঁছে নি। পত্র-পত্রালীর আড়ালে গাছ গাছড়ার তলে এখানে নিবিড় প্রকৃতি। শায়ান সেখানে মূহুর্ত খানেক অপেক্ষা করে। গতরাতে তারা তো শূন্যে উড়ে এখানে এসে নেমেছিল। বাম বাহুতে আলিশার নিতম্ব পেঁচিয়ে একেবারে প্যারাসুটে করে নেমে এসেছিল উর্ধ্বলোক থেকে এ নন্দন অঙ্গনে।

আলিশা কালো ভ্রমর হয়ে গুঞ্জন তুলছিল বিয়ে বাড়িতে। শাড়ি পড়া কনের সইয়ের বেশভূষ কনেকে ছাড়িয়ে বিয়ে বাড়ির সব আলো কালো রূপের বন্যায় শুষে নিচ্ছিল প্রতিক্ষণ। যুবকরা তার দিকে তাকিয়ে নিজেদের সংযত করে পরক্ষণ। এক আতঙ্ক তাদের স্তব্ধ করে দেয়। আলিশার আশ-পাশ থেকে তারা দূরে ধাবিত হয়। সব আলোকে নিজের কাছে এনে আলিশা তার চতুর্দিকে শূন্যের এক পরিস্কার বৃত্ত তৈরি করে। বৃত্তের চক্রে এসে কে তার বাকি প্রজাপতিদের উড়িয়ে নেবে সে প্রতীক্ষার অবসান হয়ে গেছে। অপেক্ষা এখন শুধু বৃত্তাবদ্ধ হওয়া। এই বৃত্তে যুগলবন্ধী হয়ে উর্ধ্বমুখী হওয়া। বিয়ের মূল আসনে বর কনের সলাজ আসন। আয়নায় একে অপরকে দর্শন। কনের পেছনে দাঁড়ানো আলিশার চোখের পলক আর পড়ে না। সে এক বড় আয়না দেখে তার চোখে। সে আয়নায় ভাসে একটি মুখ, আত্মীয় অতিথি ভীড়ের শেষ প্রান্তে দাঁড়ানো শায়ান। আলিশা সে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে প্রগাঢ়। সে মুখের চোখের পাতা নড়ে একবার। দেখে মুখটাও গভীর সম্মোহনে উলটো মেরু হতে। সে একই আয়নায় গম্ভীর প্রগাঢ় আলিশার প্রেমময় সুখ। তারপর এক এক করে প্রজাপতিগুলো বেরিয়ে আসতে থাকে আলিশা ও শায়ানের শরীরের সর্বত্র থেকে। আলিশা প্রেরিত শায়ানের প্রজাপতিগুলো নেচে নেচে উর্ধ্বে ধাবিত হয়। তাদেরকে অনুসরণ করে আলিশার কাছে থাকা বাকিগুলো। তারপর রঙীন প্রজাপতিগুলো যুগলে যুগলে উর্ধ্বমুখী হয় ছন্দে তালে।

ঠিক সে মূহুর্তে বিয়ে বাড়ির সব আনন্দ উত্তেজনাকে স্তব্ধ করে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। যুবকরা কেঁপে উঠে। ভীত-সন্ত্রস্থ হয়ে উঠে প্রবীণরা। কিন্তু কোন দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে এক ট্যাঙ্গো নাচের ধ্বনি সুর ছন্দ নেমে আসে সব কিছু ছাপিয়ে। সেই পূর্বের সেই শূন্য প্রান্তর যেখানে সর্বত্র রঙিন প্রজাপতি উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। একদিক থেকে সে প্রান্তরে ছুটে আসে শায়ান ট্যাঙ্গো নাচের প্রস্তুতিতে, অন্য প্রান্তরে হতে আলিশা এসে দাঁড়িয়ে গেছে শরীরে তার সব মুদ্রা তুলে। তুমুল চলতে থাকে নাচ। দূরে দাঁড়িয়ে সেই বিয়ের অতিথি মনুষ্যজন। চরম বিস্ময়ে বিস্ফোরিত হয়ে তাকিয়ে দেখছে। তাদের কষ্ট কল্পনায় এমন দৃশ্য নেই। নাচের শেষ দৃশ্যে আলিশা ধনুর মত তার শরীরকে উর্ধ্বমুখী বাঁকা করে শায়ানের বাঁ বাহুতে লুটিয়ে পড়ে। ঠিক সে মূহুর্তে আরেক অদ্ভূত দৃশ্যের অবতারণা হয়। উর্ধ্বলোক থেকে প্রজাপতি সব দ্রুত নেমে এসে এই যুগল মূর্তিকে সম্পূর্ণ পরিবৃত করে ফেলে। একসময় বিয়ে বাড়ির অতিথিরা এই পরিপূর্ণ আসর হতে আলিশা ও শায়ানকে সম্পূর্ণ উধাও হয়ে যেতে দেখে। এই ঘটনায় প্রবীণরা স্তব্ধ হয়ে পড়ে। আর যুবকরা আতংকে তটস্থ হয়ে এক দুঃসহ আগামীর দেখা পেতে আরম্ভ করে।

১০

ব্রোঙ্কো লন্ডনে। শোনা যায় তার একটা এমবিএ চাই। ল’-তে পড়া সম্ভব হয় নি। মানায় না তার সাথে। বাবার ব্যাবসা-সম্পত্তির দেখাশোনা করতে হবে তাকেই। একদিন সব তারই হবে। বাবা ফয়েজুর রশীদ বোনোর রাজনীতি আর ব্যবসার প্রসার, দু’জন দুজনার। গল্প প্রচলিত আছে এক। সেটা অবশ্য স্বামী-স্ত্রীর জীবন মেলানোর গল্প। গল্পটা এমন। কুরবানীর হাট থেকে একটা খাসী কিনে তাকে হাঁটিয়ে বাড়িতে নিয়ে চলুন। দেখুন খেলাটা জমে কেমন। খাসিটা একসময় ঘাড় ত্যাঁড়া করে খুঁটি গেড়ে বসবে। শত টানাটানিতেও নড়চড় নেই। কিন্তু আরেক সময় ভোঁ দৌঁড়। আর যদি খাসির গলায় বাঁধা দড়িটা আপনার হাতে থাকে, তবে তো কথাই নেই। এবার আপনাকেও তার পিছু পিছু ছুটতে হবে ভোঁ পড়ি-মরি করে, যতক্ষণ পাজিটা না থামে। কেমন গ্যাঁড়াকলে অবস্থা। দেখুন। ফয়েজুর রশীদ বোনোর রাজনীতি যদি ছাগল হয়, এবার বলুন, ব্যবসাটা কখন অচল থাকে। আর কখন ভোঁ দৌঁড় দেয়। ঝানু আদমি ফয়েজুর রশীদ বোনো, রক্তের উত্তরাধিকারী ছেলে আফসার রশীদ ব্রোঙ্কোকে তার রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অর্জনে যোগ্য উত্তরসূরী করে উঠাতে চান। ভালই জানেন, পরিবর্তনশীল এই রাষ্ট্র ও সে সাথে পরিবর্তিত এই সমাজে বিদ্যা অর্জনের চেয়ে ডিগ্রীর মূল্য অনেকখানি। আর সে অর্জন যদি পশ্চিম থেকে ঘটে, তবে তোফা বড়ই।

ব্রোঙ্কো ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল। শৈশব থেকে ভয়ংকর কান্ড ঘটাতেই সে পটু। তার কথার বাইরে সমবয়সীদের যাবার অবকাশ নেই। তাতে হিতে বিপরীত। শত্রুকে মাটিতে ফেলে বুকের উপর পা তুলে দিয়ে মা কালীর লজ্জাটাকে আরো বাড়িয়ে তুলতো। কি রকম দন্ত বিদারী উল্লাস বাবা! বাবাকে হার মানাতো। কে জানি বললো, এ ছেলেটা পারলে, যে কাউকে নরমাংসের স্বাদ ভক্ষণ করাতে জানে। নর রক্ত পান না করেও নিজেকে রক্তপায়ী ভ্যাম্পায়ার থেকে কম দূরে সে ভাবে না। হ্যাঁ, অন্ধকার তার প্রিয়। অন্ধকারে চমৎকার চক্র আছে তার, যাদের দিয়ে গুটি চালা সহজ। ভোর হতেই সে ঘুমে মিলিয়ে যায়। কখনো কখনো ঘুম থেকে উঠে শুনে কিছু ভয়াবহ সংবাদ। শহর জুড়ে অথবা পত্রিকার পাতায় নৃশংসতায় আর্ত চিৎকার। তখন তার চোখের ঢুলু ঢুলু নিদ তিরোহিত। মটর বাইকে করে শহর প্রদক্ষিণ। পেছনে আরো কয়েক জোড়া বাইকে এক তরফের প্রাণের বন্ধুরা, নৃশংসতার সখারা। পুরো শহর সংবাদের ভেতরের সংবাদটা পেয়ে যায়। দোকানপাট, ব্যবসা বাণিজ্য অফিস আদালত চলে তার নিজস্ব গতিতে। কোন কিছুর বন্ধ থাকার কথা নয় আজ। সব নির্মল স্বাভাবিক। শহর জুড়ে ব্রোঙ্কোর টহল সব নিশ্চিত করে যায় । কোথাও কিছুই ঘটেনি। এই শহরে পটকাও ফাটে আবার তার ঘুমিয়ে থাকার সময়। এতে নিদ্রা আরো গাঢ় হয়। বিশেষ করে যখন শহরে চলে ধ্বংস যজ্ঞ ও রক্তের হোলি খেলা বিষন্ন। বন্ধ দোকানপাট ব্যবসা বাণিজ্য, যানবাহন অফিস আদালত। সেদিন ব্রোঙ্কো আর ঘর থেকে বের হয় না। ঘুম থেকে জেগে কার্ড খেলাটাকে বেছে নেয়, একতরফা প্রাণের বন্ধুদের বা তার পিস্তল বন্দুক ছোঁড়ার খেলার সখাদের নিয়ে ধীরে মেতে। অর্জন যা হয়েছে, ভাড়াটে ক্যাডারদের দ্বারা তা হয়ে গেছে। নিজেদের এখন আর বন্ধুক পিস্তল নিয়ে খেলার দরকার পড়ে কি?

ব্রোঙ্কোর এই মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়া অশান্ত অবস্থা কিন্তু বাবা বোনোর মেনে নেয়া সম্ভব হয় না। তার অনুপস্থিতে ব্রোঙ্কোকে টিকে থাকতে হলে, নতুন সময়ের নতুন ফর্মূলাতে পদার্পণ করতে হবে। নিজের অর্জিত বিদ্যা ও প্রতিষ্ঠা দিয়ে এখনই তাকে হিমসিম খেতে হচ্ছে। ব্রোঙ্কোর চাই নতুন ডাইমেনশান। নতুন সময়ে খেলতে জুয়া একটা শিক্ষা, জ্ঞান এবং গর্বের আবরণ চাই, যা হবে ব্রোঙ্কোর নিতান্ত নিজস্ব অর্জন। অস্থিরমতি ব্রোঙ্কোকে এই দেশে রেখে কোনক্রমে শান্ত মনে, বেঁধে রেখে জ্ঞানার্জনে নিয়োজিত রাখা সম্ভব নয়। সে বাস্তবতা অনেক আগেই তিরোহিত এই দেশে। এখন প্রয়োজন তাকে তার পরিচিত শেকড় এবং পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করা। যে আতঙ্কের এক সাক্ষাৎ ইমেজ ব্রোঙ্কো, তাকে যে দিনে দিনে উর্ধ্বমুখী করছে সে, তাকে থামাতে হবে, মানুষের বোধ বুদ্ধি বিবেচনার অন্তরে ব্রোঙ্কোকে এবার জায়গা করে নিতে হবে। ব্রোঙ্কোর বিদ্যা শিক্ষায় নিয়োজিত না হলে, তার আর কোন বিকল্প ফয়েজুর রশীদ বোনো খুঁজে বের করতে পাচ্ছেন না। এখনকার এবং আগামীদিনের তরুণ প্রজন্মের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতাকে প্রতিষ্ঠা করতে, সুশীল শিক্ষায় পশ্চিমী চিন্তাধারায় আলোকিত হয়ে উঠুক ব্রোঙ্কো, পঞ্চাশোর্ধ্ব বোনো ঠিকই উপলব্ধি করছেন। ব্রোঙ্কোর যে আতঙ্কের মূর্তি সারা শহরে জেগে আছে, তার পাশে পশ্চিমী বিদ্যা অর্জন হবে, পরিপূর্ণ সোহায় সোহাগা। শেষমেশ ব্রোঙ্কোকে তাই লন্ডন যেতেই হয় কাঁচা অংকের বিনিময়ে। শোনা গেছে, প্রচুর অর্থের শ্রাদ্ধ করছে ব্রোঙ্কো। কিন্তু পড়াশুনা কতদূর এগিয়েছে, তা কারো তেমন জানা নেই।

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


5 Responses to এ লে ফ্লে দ্যু মাল ৩

You must be logged in to post a comment Login