ইরতিয়ায দস্তগীর

বৃষ্টি আমার চোখের পাতা ছুঁয়ো না

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

“আমার গল্পটি হয়তো পরকীয়ার কোপানলে দগ্ধীভূত হতে পারে। হতে পারে কোনো কুলবালা নাক সিঁটকিয়ে বলে উঠবেন, মর জ্বালা! ছেনালির গল্প শুনবার সময় নাই! কিংবা কোনো কট্টরপন্থী বলে উঠতে পারেন, এভাবেই আমাদের মেয়েগুলো নষ্ট হচ্ছে। বেশরম! কিন্তু প্রিয় পাঠক, আমাকে যে এ গল্প বলতেই হবে! আমার কপালে বেশরম বা ছেনাল তকমা জুটলেও আমাকে কেউ মুখ চাপা দিয়ে নির্বাক করে দিতে পারবে না। বাংলাদেশই শুধু নয়, বিশ্বের লক্ষ লক্ষ নারী আছেন স্বজন অথবা বাইরে কটু কথা শুনতে হবে বলে নানাবিধ অত্যাচার মুখ বুজে সয়ে যান বছরের পর বছর। যদিও মেয়েরাই মেয়েদের এমন অবস্থার ভেতর থাকতে বাধ্য করছেন পরিবার থেকেই, আর সে অবস্থার যদি…। “

যাহ, লেখাটাও বুঝি গেলো! আর কখন যে বিদ্যুৎ ফিরে আসবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। মনে মনে নিজের অদৃষ্টকে গালি দিতে দিতে কম্পিউটারের সামনে থেকে উঠে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়ায় তমা।

বলতে গেলে আজ পুরোটা দিনই বিদ্যুতের আসা-যাওয়ার খেলায় বেশ বিরক্ত ছিলো সে। তবে দিনটির বেজায় একটা ভালো দিকও ছিলো, আর তা হলো, পুরোটা দিনই ছিলো থেমে থেমে বৃষ্টি। কখনো মুষল ধারে, কখনো বা টিপটিপ, ঝিরঝির। মায়ের চোখ এড়িয়ে একবার ছাদে গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে এসেছে সে। তখন থেকেই খুক খুক করে কাশি আরম্ভ হয়েছিলো। মা যাতে শুনতে না পান তাই ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলো তখন। কাশি উঠলেই মুখের ওপর টাওয়েল চেপে ধরছিলো। ঘণ্টা খানেকের ভেতর কাশির পরিমাণ কমে যেতেই সে আবার ছাদের দিকে যাচ্ছিলো একই উদ্দেশ্যে। কিন্তু তখনই কেমন করে যেন মা টের পেয়ে গেলেন। তমা, ‘ছাদে যাস না! বৃষ্টি হচ্ছে দেখছিস না?’

মায়ের কাছে ধরা পড়ে গেলেও তা প্রকাশ না করে সে বললো, ‘ছাতা নিয়ে যাবো তো!’

‘কী আছে ছাদে? বল, আমি এনে দিচ্ছি!’ বলতে বলতে হাতের কাজ ফেলে উঠে এলেন তিনি।

হঠাত করে কিসের কথা বলবে তা ভেবে না পেয়ে কেমন বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকালো মায়ের দিকে। তখনই মা হেসে উঠে বললেন, ‘আচ্ছা মেয়ে, তুই কি নিজের ভালো-মন্দ বুঝবি না? বড় হচ্ছিস না তুই?’

মায়ের কথা শুনে তখনই তার ভীষণ কান্না পায়। তার মা’টা কেন এত ভালো? এ পর্যন্ত রাগতে দেখেনি কখনো, মারপিট তো দূরের কথা। দেখতে কেমন সুন্দর! মুখটা দেখলেই মনের ভেতরটা গলতে আরম্ভ করে। ইচ্ছে হয় তখনই মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলে- মা একটু আদর করে দাও। কিন্তু ছেলেবেলার মতো করে এমন কথা বলতে সে পারে না। কথাটা ভাবলেই ভীষণ লজ্জা এসে তার দু চোখের পাতাকে জোর করে নামিয়ে দেয়। মায়ের দিকে তাকাতে পারে না। মনে হয় চোখ দুটো দেখলেই তিনি মনের কথাটা বুঝে ফেলবেন। অবশ্য মাঝে মধ্যে কড়া কড়া কথা বলার ভান করেন, কিন্তু কণ্ঠস্বরে তা ফোটে না ভালো মতো। যদিও টিভিতে বা মঞ্চে মা’র অভিনয়ের যথেষ্ট সুনাম আছে, তবু মেয়ের সঙ্গে অভিনয়টা ভালো পারেন না। ঠিক যেন বৃষ্টির মতোই এক ধরণের স্নিগ্ধতা তাকে জড়িয়ে রাখে সারাক্ষণ। যত জোরেই বৃষ্টি হোক না কেন, বৃষ্টির প্রতি যেমন তার বিরক্তি আসে না কখনো, তেমনি মায়ের প্রতি তার মনটা ভালোবাসায় টুবু টুবু হয়ে থাকে সব সময়। এমন মাকে সে কোন প্রাণে ছেড়ে যাবে?

পৃথিবীর সব কিছুই কোনো না কোনো নিয়ম মেনে চললেও মাঝে মাঝে অনেক অনিয়মও ঘটে। আর সেই অনিয়মের সূত্র ধরেই তাকে ছেড়ে চলে যেতে হবে এই সুন্দর পৃথিবী। পৃথিবীর সুন্দরতম জননীকে। ছেড়ে যেতে হবে প্রিয় শহর ঢাকাকে। যে শহরে সে প্রথম দেখা পেয়েছিলো তার জীবনে দেখা সুন্দরতম পুরুষটিকে। যাকে অবলম্বন করে নতুন করে বাঁচার স্বপ্নে বিভোর হয়ে গিয়েছিলো। তার আবাল্য স্বপ্নের মানুষটিকে ঘিরে লতিয়ে ওঠা তার বিভিন্ন ছোট্ট ছোট্ট চাওয়া আবিদের মাঝে এমন কানায় কানায় পরিপূর্ণ দেখতে পাবে, তা কখনো ভাবেনি। সব জেনে শুনে, অসুখের কারণে কঠিন নিয়মানুগ জীবনের কথা জেনেও তাকে ভালোবাসতে ভয় পায়নি যে। অন্য কোনো ছেলে হলে হয়তো বলতো, ‘এত এত নিয়ম-কানুন ভালো লাগে না। বোরিং!’

আবিদ কী একটা কথায় একবার বলে উঠেছিলো, ‘ভালো বাসলে দোষ-গুণ দুটোকেই ভালো বাসতে হয়। নির্দোষ কিছু পৃথিবীতে আছে নাকি?’

সেই আবিদ। সরল রেখার মতোই ছিলো যার ভাবনাগুলো। এমনটি তার প্রত্যাশিত থাকলেও ততটা আশা করেনি। কিন্তু তার ক্ষেত্রে ব্যাপারটি সত্যিই ঘটেছিলো। আর সব ঘটনাই এক সময় ইতিহাস হয়ে যাওয়ার মতোই আবিদও তার জীবনে এখন ইতিহাস। তার বেশি কিছু নয়।

ভাবতে ভাবতে কখন তার চোখের জল আর বৃষ্টির ছাট এসে লাগা চোখের কোল অশ্রু আর বৃষ্টিতে মাখামাখি হয়ে যায় বুঝতে পারে না। মায়ের ডাক শুনতে পেলেও তার ইচ্ছে করছিলো না বারান্দা থেকে সরে যেতে। কিন্তু আর খানিকটা দেরি হলেই মা দরজায় এসে দাঁড়াবেন। যতক্ষণ সে দরজা না খুলবে ততক্ষণ তিনি ক্রমাগত নক করে যেতে থাকবেন।

মায়ের আরেকটি ডাক ভেসে আসতেই তমা বারান্দা থেকে বলে উঠলো, ‘কারেন্ট আসুক মা!’

আজ হয়তো আর আসবে না। এক্ষুনি চলে আয়!

খাবার টেবিলে হঠাত বাবাকে দেখতে পেয়ে অকারণেই যেন বুকের ভেতরটা দুরু দুরু করে উঠলো তমার। ভেতরে ভেতরে বিস্ময়ের খাবি খেলেও কোনো রকমে বলে, ‘কেমন আছ বাবা?’ ছ মাসের ভেতর বাবার সঙ্গে এক টেবিলে বসেছিলো কি না মনে করতে পারে না তমা। ভেতরে ভেতরে বাবার সঙ্গ পেতে বেশ কিছুদিন ধরেই ছটফট করছিলো। ইচ্ছে করছিলো এক্ষুনি ছুটে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু ছোটোবেলা থেকেই অন্যদের সামনে নিজের আবেগ জনিত দুর্বলতাকে লুকিয়ে রাখতে অভ্যস্ত সে। তাই নির্বিকার ভাবে চেয়ার টেনে বসতে বসতে সে আবার বললো, ‘অনেক দিন পর আমাদের সঙ্গে খেতে বসলে।‘

মিটি মিটি হাসিতে নিজের চেহারাটা উজ্জ্বল করে তুলে বাবা হঠাত বলে উঠলেন, ‘তোর জন্যে একটু ভালো খবর আছে। তাই খানিকটা সময় চুরি করলাম তোর জন্যে!‘

এত কষ্টের ভেতরও বাবার কথায় না হেসে পারে না তমা। ‘ভালো একটু হয় কী করে? একটু আর একটাতে কোনো পার্থক্য নেই?’

‘পার্থক্যটাও তো আপেক্ষিক। যেমন পার্থক্য ক্যাপ্টেন আর ল্যাপ্টেনে।‘

বাবার কথাটা শুনেই কান কেমন খাড়া হয়ে উঠলো তমার। মনে হলো পুরো শরীরটা কোনো এক আকস্মিক সংবাদ গ্রহণের আগাম সতর্কতা হিসেবে খানিকটা ঋজু হয়ে উঠলো যেন। বাবা কি ইঙ্গিতে কিছু বোঝাতে চাচ্ছেন? আবিদকে কেন যেন তিনি পছন্দ করতে পারতেন না। অবশ্য তার সঙ্গে মিশতে কখনো বাধাও দেননি। বিচক্ষণ আর মেয়েকে ভালোবাসেন বলে আবিদের প্রতি নিজের অপছন্দ প্রকাশে লেফট্যান্যান্ট না বলে বলতেন ল্যাপ্টেন।

খেতে খেতে বাবা হঠাত তমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, ‘আজ তো বেশ বৃষ্টি হয়েছে, ক’বার ভিজেছিস?’

তমা কিছু বলার আগেই মা তমার পাতে কালিজিরা শাকের ভর্তা তুলে দিতে দিতে বললেন, ‘সোনামনি আজ সেই চান্সটা পায়নি। একবার দেখলাম গুটগুট করে ছাদের দিকে যাচ্ছে। তখনই দিলাম এক ধমক! তার আগে দু’বার কাশতে শুনেছিলাম।‘

মায়ের কথা শেষ হতেই বাবা বললেন, ‘তাহলে দ্বিতীয় বার যাওয়ার সময় তুমি ধরতে পেরেছিলে।‘

‘মানে?’ অবাক হয়ে মা মুখ তুললেন।

বাবার মুখে আবার সেই মিটিমিটি হাসিটা ফিরে এলো। ‘বৃষ্টির পানি মাথায় না পড়লে কাশি হওয়ার কথা নয়। কথাটা তুমিও জানো।‘

মা আবাক বিস্ময়ে তমার দিকে তাকালে সে হাসি চাপতে পারলো না। তখনই মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘তোমার চোর মেয়েকে কেন যে পেটে ধরেছিলাম!’

‘মা, মিনিট পাঁচেকের বেশি ভিজিনি!’

‘আমি কোথায় ছিলাম?’

‘স্ক্রিপ্ট হাতে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছিলে।‘

‘শুনলে তো?’

বাবার কাছে নালিশের মত করে প্রশ্ন রাখতেই তমা বলে উঠলো, সরি মা!’

তমার কথা শুনে মা রেগে উঠার মত করে বললেন, ‘গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ে সরি বললে লাভ নেই!’

অনেক সময় নিয়ে খাওয়া শেষ করলেও বাবার মুখ থেকে আর কোনো কথা বের হলো না। কিন্তু তার মনে হলো বাবার কথাতেই যাবতীয় রহস্য লুকিয়ে আছে। তখনই তার মনে পড়লো খবরটাতে পদবী জনিত কোনো ত্রুটি ছিলো না তো? এক্ষুনি ছুটে গিয়ে আবিদ সংক্রান্ত পত্রিকার সংবাদের কাটিংগুলো বের করে দেখতে ইচ্ছে করছিলো। হুট করে বাবার সামনে থেকে উঠে যেতে ইচ্ছে না করলেও ভেতরকার ছটফটে ভাবটা গোপন করতে পারছিলো না সে।

একমাত্র মায়ের চোখেই হয়তো সন্তানের মনের অস্থিরতা গোপন থাকে না। তাই হয়তো তিনি বলে উঠলেন, ‘যা তো, বাবার সামনে বসে থাকতে হবে না! দরজা জানালা খুলে রাখিস না কিন্তু!’

তমা বাবার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘দেখলে বাবা?’

তিনি হেসে বললেন, ‘যাও আম্মু! শুয়ে পড় গিয়ে!’

তমা ইচ্ছে করেই খানিকটা সময় নেয় নিজের রুমে ঢুকতে। আর প্রায় নিঃশব্দে দরজা বন্ধ করে দিয়ে চার্জ লাইট জ্বালায়। পত্রিকার কাটিংগুলো বের করে একটি ব্যাপার আবিষ্কার করে কাঁপতে কাঁপতে বিছানায় গড়িয়ে পড়ে। আর তা হলো, শুধু লেফট্যান্যান্ট আর ফ্লাইট লেফট্যান্যান্ট-এর মাঝে বিস্তর ব্যবধান। একজন ভূমিতে আরেকজন আকাশে। তাহলে তার আবিদ ভালোই আছে।

প্রায় এক সপ্তাহ পর হঠাত করেই সেল ফোনটা বেজে উঠলো। যে নাম্বারটা কেবল আবিদই জানে। দুরু দুরু বুকে কলটা রিসিভ করেই কান্না আরম্ভ করলো সে। ওপাশ থেকে আবিদের কণ্ঠে শুনতে পেলো, ‘তমা আমি ল্যাংড়া হইয়া প্রমাণ করিলাম যে, এখনো বাঁচিয়া আছি। শীঘ্রই খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে ক্র্যাচে ভর দিয়া তোমার সম্মুখে উপস্থিত হইবো প্রত্যাশা করি!’

গভীর রাতে বিদ্যুৎ এলেও সে অন্ধকারেই বসে থাকে বারান্দায়। জগতের যাবতীয় ভালো লাগা যেন তাকে আজ জাপটে ধরে রেখেছে আষ্টেপৃষ্ঠে। বৃষ্টি থেমে গেছে অনেকক্ষণ। পরিষ্কার মেঘমুক্ত আকাশে সুন্দর চাঁদ উঠেছে। চাঁদের দিকে তাকাতেই তার মনে পড়ে, আবিদ একবার বলেছিলো, “আকাশে চাঁদ যেদিন সুন্দর দেখবে, সেদিন তোমার সুন্দর দুটি চোখে কাজলের টান দিয়ে চাঁদের দিকে তাকাবে আর আমার কথা ভাববে।“

কথাটা হেয়ালী হলেও এখন যেন তমার জন্য তা-ই অনিবার্য হয়ে উঠলো। সে তার ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে লাইট জ্বালালো। বেশ কিছুটা সময় নিয়ে চোখে কাজল লাগায়। ঠোঁটে গাঢ় করে লিপস্টিক ঘষে। চুলগুলো সুন্দর করে আঁচড়ে বড় করে খোঁপা বাঁধে। তারপর আবিদের কথা ভাবতে ভাবতে বারান্দায় গিয়ে চাঁদের পানে মুখ তুলে তাকায়। আর তখনই হঠাত কোথাও লুকিয়ে থাকা দুষ্টু বৃষ্টি তার চোখের কাজল মুছে দিতেই যেন আড়াল থেকে ছুটে আসে ঝর ঝর করে।

(সমাপ্ত)

১১জুলাই ২০১১।

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


4 Responses to বৃষ্টি আমার চোখের পাতা ছুঁয়ো না

You must be logged in to post a comment Login