তৌহিদ উল্লাহ শাকিল

কালো থাবা

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

//তৌহিদ উল্লাহ শাকিল//

পথের দিকে আমার খেয়াল থাকে বেশির ভাগ সময় । সেই ছোট বেলা থেকেই । এতে করে  সব কিছু খুব সহজে দৃষ্টি গোচর হয় । যেখানেই যাই সেখানের সকলের খোঁজ খবর নেওয়ার চেষ্টা করি সাধ্যমত।তাই  অনেকে হেবলা বলে , কেউ বাচাল বলে । আমি কারো কথাই গায়ে মাখি না । আমি নিজে পরিশ্রম করি তাতে যা পাই তা দিয়ে আমার চলে যায় । আমি প্রকৃতির প্রতি সবসময় নির্ভরশীল । মাঝে মাঝে সব ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যাই কিছুদিনের জন্য ।এবার ছুটিতে মদিনা চলে গেলাম ।  নিয়মের  বাইরে গেলে ও সেটা দীর্ঘ সময়ের জন্য নয় স্থায়ী হয় না।

প্রতিদিন নামাজ পড়ে মসজিদে নববি থেকে বাইরে বেরুলে একটা লোককে একাকী কাঁদতে দেখি প্রায়ই। পড়নে ময়লা পোশাক । বেশ ভুষায় বাংলাদেশী মনে হয়। কিন্তু সাহস করে জিগ্যেস করতে পারিনি। একে তো ভিন দেশ ,তার উপর কোন বিপদে পড়ি । তাই একদিন হোটেলে এসে রুম বয় কে ডেকে বললাম

তুমি কয়দিন যাবত এখানে আছ?

কেন স্যার ।

না এমনি জিগ্যেস করলাম ।

পাঁচ বছর ।

আচ্ছা এই যে হেরাম শরীফের বাইরে একটি লোককে কাঁদতে দেখলাম আজ কয়েকদিন , তাকে চেন।

জী স্যার। তার একটা করুন কাহিনী আছে । যা শুনলে আপনার ও চোখে জল আসবে ।

তা তোমার সময় হবে বলার ।

ঠিক আছে আজ বিকালে বলব। আপনি রেডি থাকবেন।

বিকালে নজির আহমেদ এলে তাকে নিয়ে বেরুলাম পাহাড় দেখব বলে সেই সাথে শুনব সেই কাহীনি । এরপরের কাহিনী নজির আহমেদের মুখ থেকে

শুনি ।

 ২

লোকটির নাম আলম । তার ঘটনাটা আমি যতটুকু জানি সেটুকু শুরু থেকে বলছি ।

আলম বেশ স্মার্ট এবং সুশ্রী । দুই বছর হল দেশ ছেড়ে প্রবাসে এসেছে । চেহারা এবং কর্মদক্ষতার গুনে পদোন্নতি পেয়ে সাধারন কর্মচারী থেকে আঞ্চলিক সেলসম্যান হয়ে অল্প দিনে। সাথে আসা অন্যান্য বাংলাদেশীরা আলমের সৌভাগ্যে সকলে খুশী। এমন সচরাচর হয় না । আলমদের অনেক বড় কোম্পানি এখানে বেশির ভাগ বাংলাদেশী শ্রমিক হিসাবে কাজ করে। এর মুল কারন হল বাংলাদেশীরা লেখাপড়ায় অন্য দেশের লোকদের চেয়ে অনেক পিছিয়ে।

আলম শিক্ষিত ছেলে । দেশে বিএ পাশ করেছে । নিজের বর্তমান চাকুরীতে সে খুশী। তাই বলে বাংলাদেশীদের থেকে দুরে থাকে না । সুযোগ এবং সময় পেলে ক্যাম্পে থাকা বাংলাদেশীদের সাথে আড্ডা মারে নিয়মিত। নিজের ভাড়া করা বাসায় একা একা থাকতে ভাল লাগে না।

আলমের দেশের বাড়ির অবস্থা ততটা অবস্থা সম্পন্ন নয় । আলমের বাবা গ্রামের হাটে পানসুপারী বিক্রি করে সংসার চালায়। তবে তার দাদার আমলের কিছু ধানী জমি আছে , যে কারনে তাদের সংসার মোটামুটি চলে । আলমের বাবা হাটে পানসুপারীর ব্যাবসা করে ছেলেকে বি এ পাশ করিয়েছেন। তিনি নিজে ও অষ্টম শ্রেনী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। দেশ স্বাধীন হবার পর বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে তার চাকুরী হলে ও তার মায়ের নিষেধের কারনে তা করা হয়নি । সেই চাকুরীর জন্য আজ ও তিনি আপসোস করেন । আর সে কারনে নিজের ছেলেকে তিনি অনেক দূর পর্যন্ত পড়িয়েছেন। গ্রামের সবাই এজন্য তাকে বাহাবা জানায় । তাতে তিনি বেশ খুশী হন মনে মনে ।

ঢাকায় একটা ট্রাভেলসের সহায়তায় আলম বিদেশে চলে আসে সামান্য খরচে। অবশ্য এর জন্য একটি শর্ত তাকে মানতে হয়েছে। ট্রাভেলসের মালিক ছোবহান আলী তাদের গ্রামের । ছোবহান আলী একদিন আলম কে বলেছে বিদেশে যাবে কিনা । জবাবে আলম বলেছিল সুযোগ পেলে যাবে। সেই থেকে ছোবহান আলী ভালো একটা ভিশার তদবির করতে থাকেন এবং একসময় পেয়ে যান । তখন তিনি আলমের বাবা মাজিদ মিয়াকে বলেন । আপনার ছেলে বড় হয়েছে ভালো লেখা পড়া করেছে এখনো তো চাকুরী পায়নাই। তাই বলছিলাম কি বিদেশে যাবার ভালো একটা সুযোগ এসেছে তাকে পাঠালে ভাল হত। জবাবে মাজিদ মিয়া বললেন-

তুমি তো ভাই আমার সব জান , আমার কাছে এত টাকা কোথায় ছেলেকে বিদেশ পাঠাব । ছেলে দেশে কোন চাকুরী বাকুরি করবে ।

” আমি বলি কি , সকল খরচা আমার । আপনে শুধু কুলসুম মায়েরে ঘরে তুলে নিলেই হয় ।

মাজিদ মিয়া যা বুঝার বুজেনিলেন । সে রাতে তিনি ছেলে আলম কে জিগ্যেস করলেন ছোবহান আলীর মেয়ে কুলসুম কে তোর কেমন লাগে ?

আলম বলল – ভালো কেন বাবা।

এরপর সপ্তাহ দুয়েক পাসপোর্ট বানানোর জন্য দৌড় ঝাপ । বিদেশ আসার আগের দিন মাজিদ মিয়া ছেলেকে বলল ছোবহান আলীর শর্ত ।

তার মেয়ে কুলসুম কে বিয়ে করতে হবে । আলম তখন তার বাবাকে জিগ্যেস করল –

” তোমার কি মত”

“আমি রাজি এখন তোর ব্যাপার “

আলম বাবাকে বলে উঠল –”তুমি রাজি হলে আমি ও রাজী। “

দুই দিনের জন্য নববধু কুলসুমকে কাছে পেল আলম । তাতে তার মনে হল কুলসুম বুঝি স্বর্গ থেকে আসা এক নেয়ামত । দুদিনের সম্পর্ক বেশ গভীর ভাবে হৃদয়ে দাগ কেটে গেল । অনেক বিরহ আর একবুক জ্বালা নিয়ে আলম সৌদি আরব আসে । তারপর নিজ যোগ্যতায় সে বেশ ভালো অবস্থানে এসেছে । মালিক পক্ষের অনুমতি নিয়ে আলম স্ত্রী কুলসুমকে আনার জন্য অনেক চেস্টা করতে লাগল। একসময় ভিসা পাওয়া গেল ।

ভিসা পাবার খবর শুনে কুলসুমের খুশী কে দেখে । দুদিনে আলম তার শরীরে যে আগুন জ্বালিয়ে গেছে সেই আগুনের জ্বালায় দিনরাত পার করতে তার অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। ছোবহান আলী মেয়েকে বেশ বুঝিয়ে সুঝিয়ে বিদেশ যাত্রার জন্য তৈরি করতে লাগলেন । তবে তিনি মেয়েকে বিদেশ নিয়ে যাওয়া পছন্দ করছেন না । কিন্তু কাউকে একথা তিনি বলেননি ।

একদিন সকালে সৌদি আরবের এক বিমানে করে কুলসুম সৌদির উদ্দ্যেশ্য দেশ ছাড়ল। বিমানে উঠে তার মনে খুব খুশী লাগছে । আর কয়েক ঘন্টা পরে প্রিয়তম স্বামী আলমকে কাছে পাবে । এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছে কুলসুম সেদিকে খেয়াল নাই । বিমানবালার মৃদু ধাক্কায় তার ঘুম ভাঙ্গে ।ছয় ঘণ্টার দীর্ঘ জার্নি শেষে বিমান থেকে নামে কুলসুম। অন্যান্য যাত্রীদের সহায়তায় ইমিগ্রেশন পেরিয়ে আলম কে দেখতে পায় । আলমকে দেখে তার সকল ক্লান্তি দূর হয়ে যায় । দুজন দুজনকে আলিঙ্গন করে সামান্য সময়ের জন্য । এরপর সেখান থেকেবেরিয়ে আসে দুইজন। এয়ারপোর্টের বাইরে অপেক্ষমাণ ট্যাক্সি থেকে একটি ট্যাক্সি নেয় আলম ।

ট্যাক্সি ড্রাইভার সৌদি বয়স আনুমানি পঞ্চাশের উপরে হবে । সৌদি কথায় কথায় আলম কে জিগ্যেস করে সাথে কে ( আরবী ভাষায়)। আলম বলে তার স্ত্রী। এরপর সৌদি বলে তোমরা কিছু খেয়েছ। আলম বলে না খাইনি । সৌদি আলমের প্রতি বেশ বিরক্ত হয় এবং সামনের বাগালা ( ডিপারটমেন্টাল স্টোর ) থেকে জুস নিয়ে আসতে বলে । সৌদি তার জীপ বাগালার পাশে দাড় করিয়ে আলমকে পঞ্চাশ রিয়েলের নোট দিয়ে বলে যাও আসির (জুস) নিয়ে আস। আলম বলে

-“টাকা দিতে হবে না , আমি আনছি “

কিন্তু সৌদি জেদ করে দেয় । আলম স্ত্রী কে সৌদির জীপে রেখে জুস কেনার জন্য বাগালায় প্রবেশ করে । জুস কিনে ফিরে এসে দেখে সৌদির জীপ নেই । তার স্ত্রী কুলসুম ও কোথাও নেই।

আলম দিশেহারা হয়ে যায় । আশে পাশের বাংলাদেশীরা এসে বিস্তারিত শুনে পুলিশে খবর দেয় ।  পুলিশ এসে সারা শহর তল্লাশি করে কিন্তু সেই সৌদির এবং কুলসুমের কোন হদিস কেউ দিতে পারে না । আলম একেবারে পাগলের মত হয়ে পড়ে ।

পুলিশ এবং সৌদি কতপক্ষ আলমকে অনেক শান্তনা দেয় । কিন্তু আলম একেবারে ভেঙ্গে পড়ে । এদিকে দেশ থেকে ফোন আসছে আলম কোন জবাব দিচ্ছে না । সে কি জবাব দেবে , কুলসুমের বাবার কাছে , নিজের বাবার কাছে। আধাপাগল আলম মদিনায় চলে আসে। মাঝে তাকে দেখা যায় নামজ পড়ছে । আবার দেখা যায় একা একা বসে কাদছে । আবার দেখা যায় হাত পেতে কারো কাছে ভিক্ষা করছে। দিনের পর দিন আলমের এভাবে কাটছে ।

 

পরিশিষ্ট

মদিনায় অবস্থানের সময় শেষ করে কর্মস্থল জেদ্দায় চলে এলাম । একদিন সকালে দৈনিক পত্রিকার পাতায় এককোনে দেখলাম , “রোড অ্যাক্সিডেন্টে এক পাগল বাংলাদেশীর মৃত্য”। সাথে সাথে খবরটি পড়ে জানতে পারি আমার দেখা সেই আলম মারা গেছে রাস্তা ক্রস করার সময় । আর তার স্ত্রী কে আজো খুজে পাওয়া যায়নি । সে আদৌ বেঁচে আছে কিনা আমি জানিনা । আর বেঁচে থাকলে ও কেমন আছে তা কি করে বলব । আলমের জীবনে সৌদির  কালো থাবা থেকে মুক্তি পেতে তাকে সৌদির মাটিতেই মৃত্য বরন করতে হয়েছে ।

বিঃদ্রঃএই কাহিনীটি আমি মদিনায় এক হোটেলে কর্মরত বাংলাদেশীর কাছে শুনে লিখেছি । সত্য  মিথ্যা জানিনা। সকল প্রকার ভুল পাঠক ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন ।

( ২৬.১০.২০১১ সৌদি আরব । )

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


10 Responses to কালো থাবা

You must be logged in to post a comment Login