নেলী পাল

কী কথা তাহার সাথে: হুমায়ূন আহমেদ

কী কথা তাহার সাথে: হুমায়ূন আহমেদ
Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

আজ একটি শেয়ারিং এ হুমায়ুন আহমেদের লিখা একটি পোস্ট পড়লাম। পড়ে খুব ভালো লাগল বলে আমার প্রথম পোস্টে এটি সবার সাথে শেয়ার করলাম।

কী কথা তাহার সাথে?

হুমায়ূন আহমেদ
হুমায়ুন আহমেদ
মিলনের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ১৯৮৩ সনের বাংলা একাডেমী বইমেলায়। তখন আমি সদ্য দেশে ফিরেছি। দীর্ঘ প্রবাস জীবনযাপনের কারণে দেশের সবকিছুই অন্যরকম লাগছে। বইমেলার উড়ন্ত ধূলাবালি, মানুষের ভিড়, চটপটির দোকান থেকে ভেসে আসা বাসি ডালের গন্ধ অসহনীয় মনে হচ্ছে। এমন সময় একটি বিশেষ দৃশ্যে চোখ আটকে গেল। আমি দেখলাম এক তরুণ যুবা পুরুষকে ঘিরে ভিড় জমে আছে। সবাই তার আটোগ্রাফ নিচ্ছে।

উনি কে? নাটক-সিনেমার কোন অভিনেতা? একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি বললেন, উনি ইমদাদুল হক মিলন। নভেলিস্ট। আমি ইমদাদুল হক মিলনের নাম আগে কখনো শুনি নি এবং একজন নভেলিস্টের অটোগ্রাফ নেবার জন্যে ভিড় হতে পারে এই অভিজ্ঞতাও আমার নেই। আমি তাঁর একটা বই কিনলাম। (এই মুহূর্তে নাম মনে পড়ছে না, খুব সম্ভবত ‘ও রাধা ও কৃষ্ণ’)।
ইমদাদুর হক মিলন
বই হাতে এগিয়ে গেলাম লেখকের দিকে। যদি অটোগ্রাফ পাওয়া যায়। মিলন আমার হাত থেকে বই নিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, নাম? আমি বিনীতভাবে আমার নাম বললাম। মিলন খসখস করে অতি দ্রুত লিখল-

হুমায়ূন আহমদকে

অনেক শুভেচ্ছা

ইমদাদুল হক মিলন

মিলন আমার নামের বানান ভুল করল। সেটাই স্বাভাবিক আমাকে সে চেনে না, আমার নামের শুদ্ধ (?) বানান তার জানার কথা না। আমাকে অটোগ্রাফ দেবার এই ঘটনায় সে বেশ লজ্জায় পড়ে গিয়েছিল বলেই আমার ধারণা। কারণ, তার কিছুদিন পরই সে ধামা ভর্তি ফল নিয়ে আমার শ্যামলীর বাসায় উপস্থিত। আমার বড় মেয়ে নোভা বলল, বাবা, উনি কে? (নোভা বলল ইংরেজিতে। কারণ বাংলা ভাষা সে তখনো রপ্ত করতে পারে নি।)

আমি বললাম, উনি একজন লেখক। বাংলা ভাষায় লেখালেখি করেন।

নোভা বলল, লেখকদের মাথা কামানো থাকে? (মিলনের মাথা তখন ক্ষুর দিয়ে মসৃণ করে কামানো। অন্ধকারেও সেই মাথা জ্বলজ্বল করে)

আমি বললাম, সবার মাথা কামানো থাকে না, কারোর কারোর থাকে।

নোভা বলল, উনার মাথায় হাত বুলিয়ে আমার দেখতে ইচ্ছা করছে।

মিলন সঙ্গে সঙ্গে মাথা নিচু করে বলল, হাত বুলাও।

নোভা বলল, I feel shy.

সে শেষ পর্যন্ত মিলনের মাথায় তাহ বুলিয়েছে কি-না আমার মনে নেই, তবে দৃশ্যটি এখনো চোখে ভাসে।

কতকাল আগের কথা।

ঝকঝকে পোশাকে ঝকমকে তরুণ ঔপন্যাসিক ইমদাদুল হক মিলন। নর-নারীর প্রেমকে যিনি অতি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেন। প্রেম নিয়ে লিখতেই যিনি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। তাঁর প্রেমের উপন্যাস সবাই আগ্রহ নিয়ে পড়েন। ‘ও রাধা ও কৃষ্ণ’ বইটি আমিও পড়লাম এবং স্বীকার করতে বাধ্য হলাম-লেখার হাত চমত্কার, গদ্য সহজ সরল কিন্তু বেগবান, লেখায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা করার অলৌকিক ক্ষমতা এই লেখকের আছে। আমার পরিষ্কার মনে আছে, ‘দৈনিক বাংলা’র সাহিত্য পাতায় মিলনের উপন্যাস ‘পরাধীনতা’ নিয়ে আমি একটি উচ্ছ্বাসময় দীর্ঘ প্রবন্ধও লিখেছিলাম।

সেই সময়ে লেখক মিলন এক ধরনের অস্থিরতায় ভুগছিলেন। সেই অস্থিরতার অনেক কারণের একটি মনে হয় হঠাত্ পাওয়া জনপ্রিয়তা। তিনি তখন একটি পত্রিকার সঙ্গেও যুক্ত (রোববার?)। গ্রহের চারদিকে যেমন উপগ্রহ থাকে, তাঁকে ঘিরেও কিছু উপগ্রহ তৈরি হয়েছে। তিনি উপগ্রহদের নিয়ে ঘুরেন, কফি হাউসে আড্ডা দেন। তাঁর পরনে থাকে অতি দামি শার্ট, জিন্সের প্যান্ট। তাঁর গা দিয়ে ভুরভুর করে বিদেশী পারফিউমের গন্ধ বের হয়। তাঁর জুতা সবসময় আয়নার মতো চকমক করে। সেখানে মুখ দেখা যায়। মিলন সমানে বিদেশী সিগারেট টানেন এবং উপগ্রহদের বিতরণ করেন। উপগ্রহরা খুশি। উনিও খুশি। রাতে প্রকাশকরা তাঁর বাড়িতে যান। নতুন বইয়ের জন্যে অগ্রিম টাকা দিয়ে আসেন। বই বাবদ প্রকাশকদের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নেয়ার প্রথা ইমদাদুল হক মিলনই প্রথম শুরু করেছিলেন।

মিলনের জেল্লা (পোশাকে আশাকে এবং চালচলনে) কিছুটা কমে আসার পর তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় বাড়ে। তখন তিনজনের একটা ছোট্ট দল তৈরি হয়। এই দলের প্রধান (টিম লিডার) হলেন ‘দৈনিক বাংলা’র সালেহ চৌধুরী। দু’জন মেম্বার, আমি এবং মিলন। তিনজন মিলে আড্ডা দিতে যাই কবি এবং অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের বাসায়। মাঝে মাঝে আমাদের সঙ্গে যোগ দিতেন কবি শামসুর রাহমান। আমরা মাঝে মাঝে যেতাম ভারতীয় হাইকমিশনের জনৈক কর্মকর্তার বাসায়। সেখানেও কবি শামসুর রাহমান নিয়মিত যেতেন। কেউ যেন আবার মনে না করে বসেন আমরা ভারতীয় হাইকমিশনের কর্মচারীর মাধ্যমে গোয়েন্দা কার্যক্রমে হাতেখড়ি নিচ্ছি। সেখানে যাবার প্রধান কারণ, ঐ ভদ্রলোক কবি শামসুর রাহমানের মহাভক্ত। তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা কবির কবিতা মুখস্থ বলে যেতে পারতেন।

হুমায়ূন আহমেদ এর সাক্ষাত্কার নিচ্ছেন ইমদাদুল হক মিলন

এই আসরগুলিতে মিলনের অন্য একটি পরিচয় পেয়ে মুগ্ধই হলাম। সেটা হলো, তাঁর বাংলা সাহিত্যের পড়াশোনা। বাংলা সাহিত্যের হেন বই নেই যা তাঁর পড়া নেই। আমার ধারণা, বাংলা সাহিত্যের সব গল্প এবং উপন্যাস (কবিতা না) তাঁর একাধিকবার পড়া। একটা উদাহরণ দেই। আমার একবার একটা রেফারেন্সের প্রয়োজন পড়ল। আমি মিলনকে টেলিফোন করলাম, হ্যালো মিলন! কোনো একটা বইয়ে আমি পড়েছি- ‘নারী এবং ঢোলকে সবসময় মারের উপর রাখতে হয়।’ কোথায় পড়েছি বলো তো?

মিলন সঙ্গে সঙ্গে বলল, সতীনাথ ভাদুড়ির ঢোড়াই চরিত মানসে পড়েছেন।

তুমি কি নিশ্চিত?

মিলন বলল, অবশ্যই।

আড্ডার সঙ্গী হিসেবে মিলনের তুলনা নেই। আড্ডায় সে গভীর আগ্রহে অন্যদের কথা শোনে। কারো সঙ্গে বিরোধে যায় না। যে যা বলে তাঁর পছন্দ না হলেও মনে মনে মেনে নেয় এবং মাঝে মাঝে চমৎকার সব রসিকতা করে। (খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার, তাঁর লেখালেখিতে রসবোধের এই ব্যাপারটি নেই বললেই চলে। মানুষ মিলন রসিক কিন্তু লেখক মিলন রসিক না, এই রহস্যের অর্থ কী? মিলনের লেখক সত্তা মানুষ সত্তার চেয়ে আলাদা?-

হুমায়ুন আজাদ, হুমায়ূন আহমেদ, শামসুর রাহমান, ইমদাদুল হক মিলন ও সালেহ চৌধুরী

মিলনের অর্থনৈতিক অবস্থা তখন বেশ খারাপ। একদিনের কথা। রাত এগারোটা বেজে গেল। হালকা বৃষ্টি পড়ছে। অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের বাসা থেকে আমরা বের হয়েছি। যে যার বাসায় চলে যাব। আমি যাব শ্যামলীতে। মিলন আমাকে বাসে উঠিয়ে দিত এলো (তখন আমার পাবলিক বাসই ভরসা, রিক্সায় চলাফেরার সামর্থ্য নেই।) মিলনকে কেমন যেন বিষণ্ন, ক্লান্ত এবং করুণ দেখাচ্ছে। আমি বললাম, মিলন, কোনো সমস্যা?

মিলন বলল, হুমায়ূন ভাই, আমার মানিব্যাগ খালি থাকলে মনটা খুব খারাপ থাকে। মানিব্যাগ খালি। একটা টাকাও নেই।

দারিদ্র্য শুধু যে গুণনাশিনী তাই না। দারিদ্র্য প্রতিভানাশিনী। টাকা-পয়সার টানাটানি, প্রকাশকদের চাপ, চিন্তা এবং পরিকল্পনা ছাড়া লাইনের পর লাইন লিখে মিলন নিজের সর্বনাশের বাঁশি নিজেই বাজাতে লাগল। তাঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগও কমে গেল। আমি বাইরের আড্ডা পুরোপুরি বন্ধ করে দিলাম। দিনের পর দিন একই বিষয় নিয়ে আলোচনা শুনতে ভালোও লাগে না। এরচে’ নিজের বৃত্তের ভেতরে থেকে পছন্দের একটা বই পড়া অনেক আনন্দের।

মিলন মাঝে মধ্যে আসে। হুট করে এসে হুট করে চলে যায়। তার কাছে লেখালেখি বিষয়ক নানা পরিকল্পনার কথা শুনি। যেমন হালকা প্রেমের উপন্যাস সে আর লিখবে না, এখন থেকে সিরিয়াস লেখালেখি। তাঁর কোনো পরিকল্পনাই কাজ করে না।

সে তখন পত্রিকার চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। লেখালেখি থেকে উপার্জনই একমাত্র ভরসা। টিভিতে নাটক লিখলে বাড়তি আয় হবে। এই বিষয়েও সে পরামর্শ করেত আসে। আমার দায়িত্ব তাঁকে BTV’i কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া। আমি দায়িত্ব পালন করি। সে শুরু করে নাটক লেখা। তখন তাকে মনে হয় দিশেহারা মানুষের মতো। আমার ভারী মায়া লাগে। ও আল্লাহ্‌ হঠাত্ কী করে জানি সে সমস্যা কাটিয়ে উঠল। তাঁর চেহারায় আগের চাকচিক্য ফিরে এলো।

সে নতুন একটা চযধংব-এ ঢুকে গেল। তখন পশ্চিমবঙ্গ থেকে ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার আমাদের দেশে আসতে শুরু করেছেন। এ দেশে তাঁদেরকে নিয়ে বিপুল মাতামাতি। মিলনের সঙ্গে তাঁদের খুবই খাতির হয়ে গেল। বয়সে মিলন তাঁদের চেয়ে অনেক ছোট হলেও মিলন তাঁদেরকে তুমি তুমি করে বলে। তাঁরা তাতে মোটেই অখুশি না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং মিলনের যৌথ সম্পাদনায় পশ্চিমবঙ্গ থেকে একের পর এক সংকলন বের হতে লাগল। এই সময় মিলন দামি একটা হোটেলের রুম ভাড়া করে ফেলল। দিনে সে হোটেলে থাকে। লেখালেখি করে। বাসায় নানান উপদ্রূপ, মন মিশিয়ে লিখতে না-কি অসুবিধা। আমি মিলনের কর্মকাণ্ডে মুগ্ধ।

আমার মুগ্ধতা আরো বাড়ল যখন দেখলাম অর্থনৈতিক সমস্যা সে কীভাবে কীভাবে যেন দূর করে ফেলেছে। বিশাল এক ফ্ল্যাট বাড়ির দুটি তলা সে ভাড়া করে ফেলেছে। এক তলায় তার অফিস আর আরেক তলায় শুটিং স্পট। নাটকের সেট হিসেবে ভাড়া দেয়া হয়। আমি একদিন আগ্রহ নিয়ে তার অফিস দেখতে গেলাম। হুলস্থূল ব্যাপার। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির অফিসের মতো কাচের দেয়ালে ঘেরা ঘরে মিলনের একেক কর্মচারী কম্পিউটার নিয়ে বসেছে। মিলনের নিজের অফিসে এসি আছে। ফ্রিজ আছে। মেঝেতে সুন্দর কার্পেট। দেয়ালে পেইন্টিং।

মিলন আনন্দিত গলায় বলল, আসুন আমরা জম্পেশ আড্ডা দেই। রেড লাইট জ্বেলে দিয়েছি।

রেড লাইট ব্যাপারটা কী?

আমার ঘরের দরজায় লাল বাতি জ্বললে কেউ ঢুকবে না। সবুজ বাতি জ্বললে ঢুকবে। কিছুদিনের মধ্যেই মিলনের অফিসে চিরস্থায়ী লালবাতি জ্বলে গেল। অফিস, শুটিং স্পট সব উঠে গেল। মিলন শুকনা মুখে ঘুরে বেড়াতে লাগল। তবে তখনো তার গায়ে ছয় হাজার টাকা দামের শার্ট। শার্ট থেকে বের হচ্ছে ফরাসি পারফিউমের মিষ্টি সৌরভ।

কয়েকদিন আগে মিলন আমার দখিন হাওয়ার বাসায় এসেছে। নানান কথাবার্তার এক ফাঁকে বললাম, মিলন, তোমার অনেক কিছু আমার কাছে রহস্যময় মনে হয়। নিজেকে আলাদা করে Project করার যে প্রবল মোহ তোমার মধ্যে দেখি এর কারণটা কী?

মিলন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমরা ছিলাম দশ ভাইবোন। বাবার কোনো টাকা পয়সা ছিল না। আমাদের খেয়ে না খেয়ে থাকতে হতো। এক শীতের রাতে মা আমাদের দুই ভাইকে আমাদের দূরসম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাড়িতে ঘুমাতে পাঠালেন। নিজের বাড়িতে সবার ঘুমানোর মতো অবস্থাও ছিল না। শীত বস্ত্রও ছিল না। আমরা দুই ভাই যে ঘরে ঘুমাচ্ছি সেই ঘরেই আমার এক মামা খেতে বসেছেন। মামা খাচ্ছেন আর আমি কাঁদছি। কারণ আমরা দুই ভাই ঘুমাতে এসেছি না খেয়ে। আমি সেই রাতে ক্ষুধায় দুঃখে এবং প্রচণ্ড অভিমানে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়েছি। সেই অভিমান এখনো আমার বুকে রয়ে গেছে হুমায়ূন ভাই। আমি যখনই টাকা পাই, দামি শার্ট কিনি, পারফিউম কিনি। আমার সবাইকে দেখাতে ভালো লাগে-আমি এখন অভাবে নাই। আমি এখন না খেয়ে রাতে ঘুমাতে যাই না।

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


3 Responses to কী কথা তাহার সাথে: হুমায়ূন আহমেদ

You must be logged in to post a comment Login