খড়মবাড়ি
১.
আমার আজা মশাইয়ের একজোড়া পাদুকা মাত্র। কাঁঠালকাঠের। একে খড়ম বলে। এই খড়ম পড়লে জগৎ ভ্রমাণো যায়। তখন আকাশে বাতাসে ধ্বনি ওঠে—খট্টাস খট্টাস। লোকে ফট্টাস ফট্টাস করে বুঝতে পারে—মাস্টারবাবু চরাচর ভ্রমাইতে বাহির হইয়াছেন। সন্ধ্যাকালে ফিরিবেন। ফিরিয়া লাভ আছে। কহিবেন, এ জগতে সকলই সবার। ইহার তুল্য বাক্য নাই। এই বাক্য বলিয়া তিনি গাহিতেন, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি। ফিরিলে সোনার বাংলা পাওয়া যায়। ভালবাসা পাওয়া যায়।
কাঁঠালবাড়ির আগে বিদ্যেধর। এই ছোটো গ্রামটিতে বিদ্যে নাই। লোকে মাছ ধরে আর ধান করে। ধান না হলে শালুক চরে। ঢ্যাপ ভাজুক করে। সে ভাজুকের নাম—ঢ্যাপের খই। স্বাদে মধুর—সামান্য তিতা। মুঠি ভরে খেতে গেলে শ্বাসের সঙ্গে নাকের মধ্যে খইগুলো ঢোকে বিনা বাঁধায় —আর বিনা ধাঁধায় নিঃশ্বাসে হাওয়ায় ওড়ে। তারা কড়জোড়ে বলে, হ্যাগো, মাস্টারবাবু—আমগো গাঁয়ে বিদ্যে ধরিবে তো? আমার আজা মশাই ফিকফিক করে হাসেন। থিক থিক করে পলকা খই সাদা দাড়ির মধ্যে আসে আর ভাসে। তিনি তাদেরও বাক্য দেন, বিদ্যে না ধইরা যাইবে কুনহানে বাপা! কওতো, স্বরে অ। স্বরে আ।
মাঝে আন্ধারমানিক। সেখানে রাত্র গাঢ় অন্ধকার নামে। এই অন্ধকারে মানিক বেটা নাই। মানিক নাই বলে তার যুবতী লক্ষ্মী বউটি চিঁচিঁ করে কাঁদে। কেঁদে কেঁদে বলে, হ্যাগো, তুমি কবে আইবারে। আমগো ঘরের চাল দিয়া পানি পড়েরে।
আজা মশাইর খড়ম তার বাড়ি পড়ে। তিনি বাক্য করেন, আইবো মাগো জননী। না আইস্যা আমার বেটা যাইবে কই?
বউটি এখান ওখান থেকে ছন কাড়ে। চালে গাড়ে। মাচান থেকে কুমড়ো পাড়ে। বেপারী নৌকায় তুলে দিয়ে বলে, লগে ইকটু কেরেস ত্যালও দিয়েন বাপারী ভাই।
বেপারী মাঝি জিগায়, কেরেস ত্যাল দিয়া তুমার কাম কি?
–পিদিম জ্বালামু।
–তুমি সোমত্তো বিটি। আন্দারইতো তুমার জৈন্য খাসা।
— উনি আইসবে গো। পিদিম জ্বালাইয়া চাইয়া থাহি।
–উনি কেডা?
–উনিডা মোর উনি।
–নাম নাই?
–উনির নাম—উনি। ফল্লার বাপে।
–অ বুঝছি। মাস্টাবাবু কইছেন– মাইনক্যা অন্ধারমানিকের মাইনকা। দেহা হইলে হ্যারে কমুয়ানে। ডরাইও না ভইন। হ্যায় আইসা পড়বে।
খট্টাস খট্টাস করে জলের পরে খড়ম জাগে। স্থলের পরে খড়ম জাগে। ঘরের চালে কাগ ডেকে যায়। আর তক্ষুণি কলসী খুঁজে গুণে ঘুণে সাতটি চাল ফেলে দেয় কাগের মুখে। এই লক্ষ্মী বউটারে আজ আর কোথাও দেখি না। শুধু রাজহাঁস দেখি।
এইসব কথা বহুদিন আগের। আমার মায়ের মনে আছে। মায়ের মনেই বেঁচে আছে। মাকে বলি, মাগো, তুমার কি মঞ্চায়?
মা হাসে। বলে, কিছু চাইনা রে বাপা।
আজামশাইয়ের সাইজা মেয়ে আমার মা জননী হাসতে হাসতে থেমে যায়। খুক খুক করে একটু কাশে। কেশে গলাটা ঝালিয়ে নেয়। বলে, বাপারে, আর কি চামু। জেবন তো না চাইয়াই গেল রে। তয়—
–তয় কি মা?
–তয় মোর বাপারে দেকবার মঞ্চায়।
–আমার আজা মশাইরে?
–নারে বাপ। ভুল কইছি। বুইড়া হইছিরে বাপ। এই বুইড়াকালে মোর বাপারে পামু কই। শুদু হ্যার খড়মখানা দেখবার মঞ্চায়।
আমার মা ব্যাকুল চোখে চেয়ে থাকে। তার চোখে ছানি। কানে শক্তি কম। বসে বসে মা থরথর করে কাঁপে। মার মুখে বলিরেখায় আলো ঝিলিক দিয়ে ওঠে একবার।
৩.
জগৎ ভ্রমিয়া বলি, অ খড়ম তুমি কই?
খড়ম বলে, আমি নারিকেলবাড়ি নাই।
–অ খড়ম, তুমি গেলা কই?
–আমি আমবাড়িও নাই।
–অ খড়ম, তুমি আছ কনে?
–আমি বটবাড়িও নাই।
–তাইলে, তুমি কইগো খড়ম?
–তালতলায় নাই। তেতুলিয়ায়ও নাই। গাববাড়িও নাই।
–অ খড়ম, তুমি পিঠাবাড়ি কি পিঠা খাইতে আছ?
–আমি পিঠাবাড়িও নাইগো নাতি। কাঁঠালবাড়িও নাই।
–বিদ্যেধরে?
–হেইখানেও নাই।
–আন্ধারমানিকে কি গেইছ খড়ম?
–আন্ধারমানিকে আন্ধার আছে—মানিকও নাই। আমি ক্যামনে সেথায় থাকিগো বাপা নাতি?
–তাইলে খড়মবাড়ি আছ?
–খড়ম না থাকলি খড়মবাড়ি থাকে ক্যামনে?
–তাইলে খড়ম, তুমি কুনহানে?
–আমি কোনহানেও নাই।
–তাইলে নাই থিকাই ফিইরা আইসো গো খড়ম। তুমারে দেখবার মঞ্চায়।
খড়ম নিশ্চুপ। নো খট্টাস—নো ফট্টাস। আজামশাইও থুপ থুপ। তার বাক্য নাই। সাক্ষ্য আছে। সাক্ষ্য বলে, ফিরিয়া লাভ কি? এ জগতে কে কাহার?
7 Responses to খড়মবাড়ি
You must be logged in to post a comment Login