শাহেন শাহ

গল্প: আলোর দেবী

গল্প: আলোর দেবী
Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

1111সন্ধ্যা শেষ। ইট পাথরের এই নগরে আকাশে চাঁদ খোজা, তার সাথে শরতের এক চিলতে আকাশের শুভ্র জমিন মেলানো, রীতিমত কষ্টসাধ্য ব্যাপার! এই কৃত্রিমতার প্রলেপে আচ্ছাদিত শহরে, আলোর কোনও অভাব নেই! রাজপথ থেকে গলিগুলো, সর্বত্র-ই আলোর জয়জয়কার। শুধু  আলো নেই মানুষের মনে!

চাঁদ-তারার আলো, বহু আলোকবর্ষ পেরিয়ে এসে সহস্র আলোর ভিড়ে থমকে দাড়ায়! পায় না মানুষের হৃদয়ে প্রবেশের সিংহ-দরজার খোজ! যার ফলশ্রুতিতে কোনঅন্ধকার কানা গলির মতই ঘোর অমানিশায় আচ্ছাদিত থাকে মানুষের মনের প্রতিটি কোন। তবু মানুষের চাওয়ার শেষ নেই। সে চায় আলোকিত মানুষ, আলোকিত মন! আলোকিত একজন মানুষ দেখলে আমরা খুব খুশি হই। শুধু নিজেরা আলোকিত হতে-ই আমাদের যত আপত্তি, যত অক্ষমতা! তার কারন প্রকৃতির আলো আমরা মর্মে ধারন করতে ভুলে গেছি!

বারান্দায় দাড়িয়ে বিশাল শপিং-মলটায় আলোর খেলা দেখছিল আর আপনমনে এসব-ই ভাবছিল রাহা। অপেক্ষায় আছে সে, জন্মান্তরের অপেক্ষা! অপেক্ষায় আছে মায়াবীর ফোন কলের জন্য। সন্ধ্যার ফোনটা এখনও করেনি মায়াবী। তাই রাহাও শুরু করতে পারছেনা পড়াশুনা! কেন পারছে না? মায়াবীর ভালবাসার আশ্বাস আর আদর না পেলে যে তার সকাল-সন্ধ্যা কিছুই শুরু হয় না, কিচ্ছু না! এটা ভাবতেই হাসি ফুটে ওঠে রাহার মুখে। তাকিয়ে থাকে প্রযুক্তির দান, মোবাইল ফোনটির দিকে। কত দূরত্ব নিমিষেই ঘুচিয়ে দেয় এই ছোট্ট যন্ত্রটি। কুড়িয়ে আনে তার প্রিয়তমার ভালবাসা, উষ্ণ চুম্বন! এটা না থাকলে……..
মায়াবীর ফোন চলে এসেছে। এখন আর রাহার দুনিয়ার কোন কিছু নিয়ে ভাবার সময় নেই। সমস্ত সময় এখন মায়াবীর, শুধুই মায়াবীর…

ঃ জান, সরি! বাসায় মেহমান ছিল/

ঃ আমি বুঝেছি সোনা, নো টেনশন, ইটস ওকে!
ঃ এই শোন……..

এগিয়ে চলে তাদের কথার খেলা। কথা শেষে দুজন দুজনার একরাশ ভালবাসা আর আদর নিয়ে পড়তে বসে। সামনেই তাদের পরীক্ষা।

ওদের ভালবাসার গল্পটার শুরু, সেই H.S.C তে পড়ার সময়। জীবনের পিচ্ছিল পথে বেশ বড় একটা হোঁচট খেয়েছিল রাহা! বিশ্বাস করেছিল একটি দুশ্চরিত্রা মেয়ে কে। পরে জানতে পেরে আপ্রাণ চেষ্টা করেও তাকে ভাল করতে পারে নি রাহা। রাগে, হতাশায়, কষ্টে নাওয়া-খাওয়া প্রায় ভুলতে বসেছিল। ভেঙ্গে পড়েছিল স্বাস্থ্য, হাতে উঠে এসেছিল সিগারেট নামক ধ্বংসদণ্ড! অন্য বন্ধুরা যখন তার কাছ থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছিল, দূরে না গিয়ে আরও কাছে এসেছিল মায়াবী! সবকিছু জেনে বন্ধুর বিপদে চুপ করে বসে থাকেনি। বাড়িয়ে দিয়েছিল সাহায্যের হাত, হয়ে উঠেছিল রাহার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। হয়ে উঠেছিল সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি রাহার সকল কাজের নিয়ন্ত্রক!

এখন ঘুম থেকে ওঠো, এখন খাও, এখন পড়তে বস, এখন গোসল….  সব বলে দিতে হত মায়াবীকে। রাহা হয়ে ওঠেছিল তার হাতের পুতুল। এমন পুতুল, যে কিনা ইচ্ছে করেই ভুল করতো একটুখানি বকুনি খাওয়ার লোভে!

আকাশে সূর্য উঠে গেছে, পাখিরা ডাকছে, আড়মোড়া ভাঙছে কর্মব্যস্ত নগরী….. তবু রাহার জন্য সেটা সকাল নয়! রাহার সকাল তখনই হবে, যখন মায়াবী ফোন করে বলবে, “এখন ওঠো… সকাল হয়ে গেছে তো… আর কত ঘুমাবে?”

এভাবেই রাহা বেরিয়ে এসেছিল তার জীবনের অন্ধকার বাঁকটি থেকে একজন আলোর দেবীর হাত ধরে, মায়াবী!

রাহার সমস্ত মনজুড়ে ধীরে ধীরে মায়াবীর জন্য জমে উঠেছিল পাহাড় প্রমান কৃতজ্ঞতা। সেই কৃতজ্ঞতা কখন যে ভালবাসায় পরিনত হল, তা সে নিজে ও জানে না! তাই এক সন্ধ্যায় যখন মায়াবী বলল, “ভালবাসি”, জবাব দিতে এক সেকেন্ড ও দেরি হয়নি রাহার। সমস্ত মন-প্রান জুড়ে সুখের যে পরশ অনুভব করেছিল, তা কখনও ভুলবার নয়। পরে জেনেছিল, মায়াবী তাকে ভালবাসে সেই ক্লাশ টেন থেকে! শুনে চরম আফসোস হয়েছিল রাহার। এত লক্ষ্মী মেয়েটাকে কিনা এতদিন এতটা কাছে থেকেও চিনতে পারে নি! বঞ্চিত হয়েছে এতটা সময়…….

মায়াবী-রাহা দুটি দেহে একটি প্রান। একসাথে পাশাপাশি থেকে হাতে হাত রেখে পাড়ি দিয়েছে অনেকটা পথ। কখনও শহরের কোলাহল পিছনে ফেলে দূরে সবুজের বুকে হারিয়ে যাওয়া, কখনও নরম ঘাসের গালিচায় শুয়ে আকাশ দেখা, কখনও লেকের ধারে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জলের খেলা দেখা…  সবই হয়েছে। বাদ যায়নি ভ্রমর-ফুলের মিতালী কিংবা বুনো পাখিদের গান শোনা ও! কতদিন যে ডিঙ্গি নৌকায় করে নদীর বুকে ভেসে বেড়িয়েছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। এভাবে চলতে চলতে কখন যে একজন আরেকজনের অবলম্বন হয়ে উঠেছে তা তারা নিজেরাও জানে না! দুজন দুজনকে এত্ত ভালবাসে, ভেবে নিজেরাই অবাক হয়! শুধুই বলতে ইচ্ছে করে হৃদয়ের গভীর থেকে উচ্চারিত একটি শব্দ, “ভালবাসি”।

ক্যাম্পাসে ওদের খুব পছন্দ করে। বন্ধুরা মিলে আড্ডায় বসলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায় চোখের পলকে। ওদের মধ্যে জুয়েল খুব ভাল গান করে, হাতে একটা গিটার থাকবেই থাকবে। স্যারদের কাছে বকা শুনেও কোন লাভ হয়নি! তাই মাঝে মাঝে-ই গানের আসর বসে। রাহার কথায়, খালেদের সুরে, জীবন্ত হয়ে ওঠে গানগুলো জুয়েলের গলায়। তারপর চলে কতশত খুনসুটি-দুষ্টুমি।

হঠাত-ই হয়তো কেউ বলে উঠল, “আচ্ছা মায়াবী, তোরা বিয়ে করছিস না কেন?”

– কি বলিস? বিয়ে করেছিত! না করলে দুটো পিচ্চি আসলো কোথা থেকে!!!
– সত্যি???
আর গম্ভীর থাকা হয় না মায়াবীর, রাহাকে সঙ্গী করে দুজনায় হেসে ওঠে প্রাণ খুলে।
যদিও পিচ্চি দুটোর কথা একেবারে মিথ্যে নয়! রাহা-মায়াবীর ভাবনার জগতে আসলেই ওরা বাস করে, এমনকি নামও ঠিক করা আছে পিচ্চি দুটোর!

দেখতে দেখতে বেশ কয়েকটি বছর পেরিয়ে গেল। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে ওরা দুজনই মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছে। সাথে সাথে চলছে উচ্চশিক্ষাটাও।

এক রাতে কাজ শেষে বাসায় ফেরার পথে অনেকগুলো লাল গোলাপ কিনল রাহা। কাল সকালেই মায়াবীকে দেবে। কাল তাদের টানা দুইদিন পর দেখা হবে! দুজনের আলাদা অফিস, তাই প্রতিদিনের দেখাটা হয়না এখন। তাছাড়া সামনেই ওরা বিয়ে করবে, তাই ক্যারিয়ারটাকে গুছিয়ে নিতে চাচ্ছে যথাসাধ্য।

ভোরবেলায় উঠেই শেইভ করে নিল রাহা। গায়ে পড়ল মায়াবীর উপহার দেয়া নীল রঙের শার্টটা। আয়নায় নিজেকে দেখে মুচকি একটু হাসল, আজ মায়াবী কি নিয়ে কমপ্লেইন করবে? প্রতিবারই মায়াবী কিছু না কিছু নিয়ে খুত ধরবে-ই। আর ওটা নিয়ে পার করে দেবে প্রথম আধা ঘণ্টা। এসব ভাবতে ভাবতে গোলাপ গুলো হাতে নিয়ে পথে নামলো ও। ঠিক তখনই মায়াবীর ফোন আসলো। খুশি মনে কথা বলতে বলতে এগুলো রাহা। গলির মুখ থেকে এ রিকশা নেবে, তাদের পছন্দের রেস্টুরেন্টটাও খুব একটা দূরে না।
কিন্তু বিধাতা বুঝি পাশার ছক নতুন করে সাজিয়েছিলেন! তাইতো যমদূতরূপী মাইক্রোবাস টাকে চাপা দেবার আগমুহূর্ত পর্যন্ত খেয়াল করেনি রাহা। হাসপাতালে নেবার পথেই মারা যায় ও। রক্তে লাল হয় প্রিয়তমার দেয়া নীল শার্ট। শুধু হাতে ধরা থাকে একগুচ্ছ লাল গোলাপ। ও যে তার মনের মানুষের জন্য কিনেছিল, না দিয়ে ফেলে দেয় কেমন করে!

রাহার লাশ দেখে একটুও কাঁদে নি মায়াবী। শুধু হাত থেকে গোলাপ গুলো নিয়েছিল। ঠোঁট বুলিয়ে দিয়েছিল রক্তে ভেজা দুই ঠোঁটে।

সেদিন থেকে একদম চুপ হয়ে যায় মায়াবী, কারো সাথেই কোনও কথা বলে নি আর ও। ডাক্তার পরামর্শ দিলেন বিয়ে দেবার। হয়তো এতে শোক কাটিয়ে ওঠা সহজ হবে।

মায়াবীর বাবা মেয়ের বিয়ের আয়োজন করলেন। সব স্বজনদের ই আশা, বিয়ে হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। শুধু যার জন্য এত আয়োজন, সেই মায়াবী নিশ্ছুপ। মা এসে ওকে বলেন, একটু কাঁদ না মা….  কেঁদে হালকা হ…

মায়াবী ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। যেন কথা বলা ভুলেই গেছে ও।

আজ মায়াবীর গায়ে হলুদ। সবার ধারনা ই ঠিক প্রমানিত হল। সময় সবকিছু ঠিক করে দেয়! আজ সকাল থেকে ই নিজেকে অপরূপ করে সাজিয়েছে ও। ওকে এতটা সুন্দর বোধকরি আগে কখনও লাগেনি। ঘরে সোনা-রূপার পানি ছিটান হল, যেন কারো নজর না লাগে!

বহুদিন পর আজ মায়াবীর মুখে হাসি ফুটেছে। সেই হাসি সংক্রমিত হয়েছে সবার মাঝে। সবাই বুঝে গেছে, কেটে গেছে দুশ্চিন্তার মেঘ, উকি দিয়েছে খুশির সূর্য।

অন্য জগত থেকে রাহাও বুঝি হাসছিল! আর হাসছিল স্বয়ং বিধাতা!

একটু পরই অনুষ্ঠান শুরু হবে। ছাদে সামিয়ানা টানানো হয়েছে। এক কোণে তৈরি করা হয়েছে ফুলেল মঞ্চ। সারা বাড়িতে একটা সাঁজ সাঁজ রব পরে গেছে। সর্বত্রই একটা খুশির আমেজ। সবাই অনুষ্ঠানের জন্য নিজেকে সাজাতে মেতে আছে। আয়নার দখল নিয়ে কম বয়সী মেয়েদের রীতিমত লড়াই চলছে। কারো দিকে কারো নজর নেই। কার আগে কে সাজবে, এটাই মুখ্য বিষয়।

পায়ে পায়ে ছাদে উঠে এল মায়াবী। আস্তে করে লাগিয়ে দিল ছাদের সিঁড়ির দরজাটা। ছাদের কিনারায় এসে রেলিং পেরিয়ে কার্নিশে এসে দাঁড়ালো ও। দশতলার নিচের রাস্তায় অগনিত যানবাহনের চলাচল। একবার ফিরে তাকাল মায়াবী। শুন্য চেয়ার গুলোর সাথে চোখাচোখি হল কিনা কে জানে! তারপর মুখ তুলে আকাশ দেখল। চঞ্চল চোখ গুলো কি যেন খুজে বেরাল গুধুলির আকাশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে!

অবশেষে কি এক অপার্থিব হাসিতে উদ্ভাসিত হল মায়াবীর মুখ। বলল, “আমি আসছি রাহা, আমি আসছি। আমাকে বধুবেশে আপন করবে বলেছিলে না? বউ সেজেই আসছি তোমার বুকে।”

মায়াবীর দাফন হল পরদিন বিকেলে। বৃহস্পতিবার, বাদ আসর!

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


9 Responses to গল্প: আলোর দেবী

You must be logged in to post a comment Login