রাবেয়া রব্বানি

গল্প-একলা (পর্ব-২)

গল্প-একলা (পর্ব-২)
Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

বুবুনের দাদা ইয়াসিন খান আর বুবুনের মার্সিক সাক্ষাৎ পর্ব চলছে।বহুদিন ধরে একি রকম কথোপকথনে যা রিহার্সালকৃত নাটকের মতই দেখায়। ছোট থেকেই বুবুনকে এই সম্ভাব্য সংলাপের প্রতিউত্তর যথাসম্ভব শিখিয়ে রাখতে রাখতে  ইদানিং আর শিখাতে হয় না ।তাই রেহানা বেগম আর বুবুনের নানা হেমায়েতউল্লাহর উপস্থিতি এখানে অন্যমন্সক প্রহরীর মতই ঝিমানো।দুজনেই এই অনাকাঙ্খিত আতিথেয়তা এড়াতে চিন্তার পিছু নিয়ে ইতিমধ্যে এই ঘরে থেকেও অন্যকোথাও।

ইয়াসিন সাহেব বুবুনের পিঠে একটা হাত দিয়ে আছেন।বুবুন তার মাথাটা একটু ঝুকিয়ে হাত দুটো হাটুর উপর দিয়ে বসে আছে।তার মুখ হাসিহাসি।

কথাবার্তার এই পর্যায়ে প্রতিবারের মত ইয়াসিন সাহেব বললেন,

-দাদু, তুমি আমার লগে বেড়াইতে যাইবা?

বুবুন মুখ হাসিহাসি করে তার দাদার দিকে তাকাল কিন্তু বরাবর থেকে একটু বেশি সময় নিয়ে ভিন্ন সংলাপে বলে উঠল

-হুম যাব।

রেহানা বেগম আর হেমায়েত সাহেব যেন ভাবনার সমুদ্র সাতরে ছিটকে পড়লেন তীরে। ইয়াসিন সাহেব কিছুটা চমকে গেলেও একগাল জয়ী হাসিতে তাদের উদ্দেশ্যে বললেন,

-পোলাতো যাইতে চায়।

হেমায়াত সাহেব যেন শুনতে পেলেন না কিছু।তিনি চশমার ময়লা পর্যবেক্ষণ করে বাসি পত্রিকাটা আবার টেনে নিলেন কিন্তু রেহানা বেগম প্রায় হাহাকার করে উঠলেন,

-আরে না না ওর তো ঠান্ডা।

ইয়াসিন সাহবের একগাল হাসিটা এবার দুইগাল হল।তিনি পকেট হাতড়ে একটি কার্ড বের করে নাতির হাতে দিয়ে বললেন,

-ঠান্ডা ভাল হইলে ফোন কইরা কইও আমি আইয়া লইয়া যামু।

বুবুন সম্মতিসূচক ঘাড় কাৎ করে। মনে মনে দাদার আঞ্চলিক কথাগুলো নিজেও উচ্চারন করে একবার। লইয়া , কইও ,আইয়া এই শব্দগুলো নিয়ে মনটা যেন লোফালোফি করে তার।দাদার প্রতি তার কৌতুহল আর দরজাবন্ধি ভাললাগাটা আজ জানালা ভেঙ্গেই প্রকাশিত হল।

-বুবুনরে একটু ভিতরে পাঠান কিছু কথা কই।

ইয়াসিন সাহেবের এই কথাতে স্বামী স্ত্রীতে দ্বিতীয়বার চমকে গিয়ে চিন্তিত চোখাচোখি করলেন।হেমায়েত সাহেব বুবুনকে নিয়ে ভেতরে গেলেন।রেহানা বেগম তার শাড়ির আঁচল টেনে আঁচলের এক প্রান্ত দলা পাকিয়ে চেপে ধরলেন যেন তার চিন্তিত, সংকিত মনকেই মুঠোবন্ধি করছেন। কখন কি ফন্দি এটে কার রূপ নিয়ে দুর্ভাগ্য আসে তা যে আন্দাজ করা যায় না তা পোড় খাওয়া রেহানা বেগম ভালোই জানেন ।এছাড়া তার স্বামী দ্বিতীয় স্ট্রোক করে ফেলেছেন তাকে কোন উত্তেজনায় যেতে দেয়া মানে খারাপ কিছু।আর কিই বা বলার থাকতে পারে লোকটার? এইসব ভেবে উদ্বেগে সে স্বামী আসার আগেই আগ কাটেন,

-কি বলবেন বলেন?

বলতে না বলতেই হেমায়েত সাহেব ফিরে এসে গলা খাকড়ি দিয়ে নিজের চিন্তিত প্রস্তুতি জানালেন।

-শুনলাম মেয়ের বিয়া দিতাছেন?খুব বড় ভুল করতাছেন।ঘুম ভাঙ্গা মানুষের মতই হাল্কা বসে যাওয়া কন্ঠ  ইয়াসিন সাহেবর।তার মুখ নিচু।

বিয়ের খবর ঘটা করে কাউকে জানানো হুয়নি নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত এই খবর কিভাবে গেল ভেবে হেমায়েত সাহেবে আর রেহানা বেগম দুইজনই চেহারায় বিস্ময় লুকাতে পারলেন না। বিস্ময় ধামাচাপা দিতেই হয়ত প্রয়োজনের চেয়ে বেশি উচ্চ হেমায়েত সাহেব স্বর,

-জি বিয়ে দিতেছি।কম বয়সের ভুলের বোঝা তো আর ওকে সারাজীবন বইতে দিতে পারি না।কিন্তু আপনি এই ব্যাপারে কথা কেন বলচতেছেন বুঝতে পারছি না।

-আমি অন্য কোন পক্ষ না।আমার আপনের পক্ষ কিন্তু একটাই সেইটা হইল বুবুন।আমি বুবুনের পক্ষ লইয়াই কইতাছি।

-তো আপনি বলতে চাইতেছেন বিয়েটা না দেই!আপনাদের মত স্বার্থপর মানুষেই দুনিয়াটা গেল।ইয়াসিন সাহেবের স্পর্ধায় বিস্মিত হেমায়েত সাহেবের মুখ আলগা হয়ে গেল।তিনি যথারীতি উত্তেজিত।

ইয়াসিন সাহেবের নিচু মাথা আরো নিচু হল যেন সে মাটির সাথেই  কথাগুলো বলছেন,

-আমি জানি আপনেরা আমার পোলারে ঘৃন্না করেন।কিন্তু ভুল আমার পোলার লগে আপনার মাইয়াও করছিল।রুমাই নিজ থেইক্কা আপনেগো ছাইড়া আমার বাসায় গিয়ে উঠছিল।তাইলে আপনের মাইয়ারে ঘৃনা করেন না কেন?স্বার্থপর আমরা কম বেশি সবাই।

উত্তেজনা সামলাতে না পেরে হেমায়েত সাহেব দাঁড়িয়ে পড়লেন।

আপনি কি চাইতেছেন আপনাকে যেতে বলি?হেমায়েত সাহেবে ভারী নিঃশ্বাস চেপে চেপে কথাটা বললেন

রেহানা বেগম দৌড়ে এসে তার স্বামীকে ধরে বসালেন।তিনি ইয়াসিন সাহেবকে বেশ ঝাঁঝালো কন্ঠেই বললেন,

আপনি কেন শুধু শুধু অসুস্থ মানুষকে রাগাইতেছেন।আপনার যা বলার সোজাসোজি বলেন।বাকিটা আমাদের ব্যাপার।

বৃদ্ধ যেন কিছু শুনতে পায় নি। মাটি থেকে এবার তার চোখ জানালার পরদায় থেমে গেল।পরদাটার হালকা দোদুল্যগতি আর তার ভাবনার সাথে তাল রেখেই ধোঁয়াটে উচ্চারনে সে বলতে লাগল।

-আমার পোলাডা প্রায়ই কইত ‘বাবা আমি ভাল হইয়া যাব’।কয়েকবার তাকে চিকিৎসা কইরা ভাল করলাম কিন্তু কয়েকদিন যাইতে না যাইতে যেই সেই।আস্তে আস্তে আমি আর তার কথায় বিশ্বাস করতাম না।বিয়ের ছয়মাস পর যহন রুমা পাকাপাকি ভাবে আপনাগো কাছে আইয়া পড়ল আমি তহন খুশিই হইছিলাম যে এইবার পোলাডার বুঝি শিক্ষা হয়।আর এই মাইয়া এই কুলাঙ্গারের ঘর করবই বা কে?আপনারা রুমারে আর দিলেন না, বুবুন যে হইব এইটাও গোপন করলেন।আমার পোলা এই ভাল হয় এই খারাপ হয়।যেদিন বুবুন হইব সেইদিন কি মনে কইরা জানি আপনেগো মাইয়া লুকাইয়া আমার পোলারে ফোন দেয়।আমার পোলা আইয়া কাইন্দা কইল,’আব্বা আমি ভাল হইয়া যাব এইবার’।আমি তার চোক্ষের পানির দাম দিলাম না ভাবলাম নেশা করা মানুষের চোক্ষের সস্তা পানি।তারে সাথে কইরা বুবুনরে দেখতে নিয়া গেলাম না,সাহস দিলাম না।নিজের নেশাখোড় পোলার উপর অন্যের ঘৃন্না সহ্য হইত না আর হের লেইজ্ঞা আমি আর বেইজ্জত হইতে রাজিও আছিলাম না।পোলাডা সারাদিন এইঘর অইঘর করল, আমারে আইয়া বার বার কইতে সাহস পাইল না। নেশা তার সাহস আর শক্তি দুই কাইড়া নিছিল।পরদিন সকালে দেখি আমার একমাত্র পোলা লাশ হইয়া রইছে।

এইটুকু বলে তিনি থেমে বড় বড় কয়েকটা শ্বাস নিলেন। হেমায়েত সাহেব আর রেহানা বেগম সহানুভূতির ধারের কাছেও যেতে পারলেন না।অল্প বয়সে এলোমেলো হয়ে যাওয়া মেয়ের জীবনের সাথে জড়িত এই নেশাগ্রস্থ ছেলেটিকে তারা অনিচ্ছাকৃতভাবেই যার পর নাই ঘৃনা করেন।অস্থির হেমায়েত সাহেব নড়েচড়ে উঠলেন।কিছু বলে উঠতে যাচ্ছেন এমন সময় কাঁধের কাছে স্ত্রীর হাতের চাপ অনুভব করলেন যা তাকে  একি সাথে সাহস আর ধৈর্যর অনুরোধ করল।ইয়াসিন সাহেব আবার বলে চললেন,

-আমি আছিলাম আমার বাপের প্রথম ঘরের সন্তান। সৎ মার ঘরে আমার খুব কষ্ট হইছে। টাকার না মনের।মনে মনে কইতাম আল্লাহ আমার পোলাপান হইলে অগো এমুন দিন দেহাইও না।আমার স্ত্রীও কম বয়সে মইরা গেল কিন্তু আমি ওইকারনে আর বিয়াই করলাম না।ব্যবসার কামে বিভিন্ন জায়গায় ছুটাছুটি করতাম ছেলেটা নষ্ট হইয়া গেল।আবার মইরাও গেল।আল্লার কাছে কইলাম আমগো ভাগের যে সুখটা দেওয়ার আছিল তা দেও নাই আমার নাতিডারেই তা ফিরাইয়া দিও।কিন্তু এহন দেখতাছি হেও আমগো ধারাই পাইল।আল্লাহর কাছে চাওয়ার কি আছে আর তার কি দেওয়ার আছে এখন বুঝতে পারি না।পাঁচ  ওয়াক্ত নামাজ পড়ি কিন্তু অনেকদিন ধইরাই ঈমান লইয়া টানাটানি চলতাছে।হা! হা!

কথার মোড় আবার বিয়ের দিকে ঘুরতেই রেহানা বেগম হেমায়েত সাহেবকে উঠিয়ে প্রায় ঠেলে ঘরের ভেতরে পাঠিয়ে দিলেন।ইয়াসিন সাহেব আরো কিছু বলার আগেই রেহানা বেগম একটু বাড়তি আত্মবিশ্বাসের সাথে এবার আওয়াজ উঠালেন,

-নষ্ট আমাদের একমাত্র মেয়ের জীবনও হইছে।আমরাও চাই আমাদের নাতি ভাল থাকুক।সন্তানের চেয়ে কম আদরে তাকে বড় করি নাই।নাতি যে সন্তানের চেয়ে কম প্রিয় হয় না এটা আপনার বুঝারই তো কথা। বিয়েও এমন যায়গায়ই দেওয়া হইতেছে যে তার কোন অবহেলা হবে না।রুমা রোজ আসতে পারবে।আপনি এই বিষয়ে আর কথা না বলাই ভালো ।

ইয়াসিন সাহেব রেহানা বেগমের চোখের দিকে তাকিয়ে হাসলেন।তার চোখের কৌতুকে রেহানা বেগমের আত্মবিশ্বাসি মূর্তি বেঢপ দেখাল।

-পোলাডা আপনাগো লগেই তো থাকবো?রাহেন সেইটাই ভালো।সংসার বড় হারামজাদা।একবার হইয়া গেলে এরে পালতে গিয়া অনেক কিছুই ভুলতে  অয়।বিয়ার পর আস্তে আস্তে আরো সন্তান হইব।তহন সবচেয়ে ঠকব আমার নাতি।এইটা আপনারাও জানেন। আর আমারে ভয় পাওয়ার কিছু নাই আমার অর্থ থাকলেও বয়স একেবারেই নাই।আসি ভাল থাকবেন।বুবুনের বড় হওয়া পর্যন্ত আপনাগো ভাল থাকাটাই এহন বেশি জরুরী।

ইয়াসিন সাহেব বেড়িয়ে যেতে লাগলেন। রেহানা বেগমের মন প্রতিউত্তরে বলার জন্য কোন কথা খুজলো না আর।লোকটার শেষ কথাটার ইঙ্গিত তাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে।তার বুকে বসা সেদিনের কাটাটা এখন আবার অনুভব করছে্ন তিনি।ইয়াসিন সাহেব চলে যেতেই হেমায়েত সাহেব ফিরে এসে জিজ্ঞাসু চোখে স্ত্রীর দিকে তাকালো।রেহানা বেগম কিছু বলল না।তিনি ড্রইং রুম থেকে বের হয়ে মেয়ের রুমের ভেজানো দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন।রুমা আর বুবুন দুজনে জড়াজড়ি করে খুব হাসছে।দুজনকে একসাথে দেখে তার চোখ জুড়িয়ে গেল।তাদের খিলখিল হাসির পরশ রেহানা বেগমের গুমোট মনটাতেও কিছু দোলা দিল।তিনি কাছে গিয়ে আদরের ছলে বুবুনের মাথায় হাত রাখলেন।

(চলবে….)

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


40 Responses to গল্প-একলা (পর্ব-২)

You must be logged in to post a comment Login