গল্প: ভালবাসায় লোডশেডিং………..
গভীর রাত। ছাদের কোনায় ছোট্ট ব্যালকনীর দেয়ালের উপর বসে আছে অয়ন। অসংখ্য তারা উঠেছে আজ। অয়ন মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে আকাশের তারার দিকে। এ এক অদ্ভুত ভাল লাগা। তবে এক বিশেষ কারনে অয়নের মনে আজ এক অদ্ভুত শিহরন বয়ে যাচ্ছে সারা শরীরে। শরীরের প্রতিটি লোহিতকনিকা যেন তীব্রভাবে উত্তেজিত হয়ে রক্তনালিকা ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইছে প্রবল আবেগিকতায়।। যে মেয়েটার সাথে গত ছয়মাস ধরে ফেসবুকে/ফোনে চুটিয়ে প্রেম করে যাচ্ছে, সেই মেয়ের সাথে কালই প্রথম দেখা করতে যাচ্ছে অয়ন। তারা গুলোর ফাঁকে এক ফালি চাঁদ ভেসে উঠেছে এখন। হিমেল বাতাস আলতো অনুভব করছে অয়ন। এমনসময় ফোনটা তার স্বভাবজাত স্বরে বেজে উঠল।
“কি করছ?”“কে? সাদিয়া”?“হমম”।“জান, আমি আনন্দে কাঁপছি”।“কিন্তু, আমার যে খুব ভয় ভয় করছে”!“কেন”?“তুমি যদি আমাকে দেখে পছন্দ না কর। আমি যদি তোমার মনের মত না হই। তখন তুমি যদি আর আমার না থাক”।“এভাবে বল না প্লিজ, মাধবী। তুমি আমার সব, আমার আত্মা। আর আত্মা ছাড়া কারো কি অস্বিত্ব থাকে”?“এত ভালবাস আমাকে”?“হুমম, এত”।“তুমি কাল কি গায়ে দিয়ে আসবে”?
“নীল টি-শার্ট, সাথে কালো প্যান্ট। আর তুমি সবুজ শাড়ী পড়বে, মাথায় থাকবে রজনীগন্ধা, আর হাতে বেনারসি চুড়ি। ওকে”?“ওকে, ডান”।“এই, একটু ছাদে উঠনা, প্লিজ। দেখনা কি সুন্দর জোৎস্না উঠেছে আজ। উঠনা একটু, প্লিজ”।“এই এখন না, এত রাতে ছাদে উঠলে বাবা সন্দেহ করবে”।“প্লিজজজজজজজ”।“ওহ, উঠছি বাবা। তুমি না, একটা পাগল”।“হুমম, পাগল”।
অনেক রাত পর্যন্ত কথা বলেছিল তারা। যার কারনে আজ ঘুম থেকে এত দেরি করে উঠা অয়নের। তাড়াহুড়ো করে রেডি হয়ে চুলে হালকা জেল দিয়ে গায়ে পারফিউম মাখিয়ে বেরিয়ে পড়ল অয়ন। সানগ্লাসটা হাতে নিতে ভুলল না। সাদিয়ার পাঁচটার সময় শাহবাগের মোড়ে থাকার কথা। এখন বাজে তিনটা। উত্তেজনা তাড়িত করছে আজ। অনিচ্ছাকৃতভাবে এত আগে বেরিয়ে পড়ার এটাই হয়তো কারন। “ফ্লোরা এন্ড ফাউনা” দোকান থেকে এক তোড়া লাল গোলাপ কিনল অয়ন। হাটার ফাঁকে ফুলের সুবাস নিল। আহ। শাহবাগের মোড়ের কাছাকাছি এসে দাড়িয়ে আছে অয়ন। প্রতিক্ষার প্রতিটি মুহুর্ত যেন এক একটি বছর মনে হচ্ছে অয়নেরকাছে আজ। অবশেষে এল সেই প্রতিক্ষিত সময়, সেই প্রতিক্ষিত মুহুর্ত। যে মুহুর্তটির জন্য মনের অজান্তে বছর বছর অপেক্ষা করছিল অয়ন। একটি রিকশার হুড খুলে অল্প তাকাল মেয়েটি। সবুজ শাড়িতে ওকে একটি সবুজ পরীর মত লাগছে দেখতে। কপালে লাল টিপ। মাথায় রজনীগন্ধার ডালি গাঁথা। বিধাতা কি মনের মাধুরী মিশিয়ে গড়েছিল এই নারীমূর্তিকে। অন্যরকম উত্তেজনায় অয়নের হৃদস্পন্দন বাড়তে লাগল ক্রমশ।
সাদিয়া ইশারা করল, “এই, রিকশায় উঠো, বৃষ্টি আসছে”।কথা শুনে অয়ন সম্বিত ফিরে পেল। অয়ন আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল। আকাশে ঘন কালো মেঘ জমেছে। ধেয়ে বৃষ্টি আসছে কিছুক্ষনের মধ্যেই।অয়ন তাড়াতাড়ি রিকশায় কাছাকাছি গেল।“কেমন আছ রাজকন্যা?”“হুমম, রিকশায় উঠো, প্লিজ। বৃষ্টি আসছে এখনি”।
অয়ন লাফ দিয়ে রিকশায় উঠল। অয়নের গা এই ঝড়ো বাতাসেও ঘামছে। এক অদ্ভুদ আনন্দে সে কথা খুজে পাচ্ছে না। তার গলা আটকে যাচ্ছে বারবার। সাদিয়াও কোন এক রহস্যজনক কারনে তার সহজাত কথার ফুলঝুরি হারিয়ে ফেলেছে এখন। যে মেয়েটি রাতের পর রাত, ঘন্টার পর ঘন্টা এই ছেলেটার সাথে অদেখা কথা বলে যেত ক্লান্তিহীনভাবে, সেও আজ কোন কথা বলতে পারছে না। আসার আগেও অনেক কথা সাজিয়ে নিয়ে এসেছিল বলবে বলে। এখন সব ভুলে গেছে। কিছুই আর মনে আসছে না। হঠাৎ অঝোড় ধারায় বৃষ্টি আসল। রিকশা থামল। অয়ন আঁচলঢাকা সাদিয়াকে নিয়ে রিকশা থেকে নেমে একটি আম গাছের নিচে গিয়ে দাড়াল। দুজনেই ইচ্ছে করে বৃষ্টিতে ভিজতে লাগল তখন। দুজন এখনও চুপচাপ। সাদিয়াই নীরবতা ভাঙ্গল প্রথম।“এ্যাই, কিছু বলছ না যে?”“কি বলব, বুঝতে পারছি না”।
অয়ন সাদিয়ার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিযে থাকল আবার। সবুজ শাড়িটি সাদিয়ার সারা শরীর লেপ্টে আছে বৃষ্টির পানিতে। কপালের লাল টিপটি অনেকটা সরে পড়েছে কপালের মধ্যস্থান থেকে। দেখতে কি অপূর্বই না লাগছে মেয়েটিকে। মানুষ এত সুন্দর হয়? একেই কি অসহ্য সুন্দর বলা হয়? যা দেখে বেশিক্ষন তাকিয়ে থাকা যায় না।
অয়ন ধরা গলায় বলল, “এ্যাই, তোমার হাতটা একটু ধরতে দিবে?”সাদিয়া নীরবে এগিয়ে দিল তার হাতটি। সাদিয়ার হাতে হাত রাখল অয়ন। এই কোমল ছোঁয়া অয়নের পুরো শরীরকে অদ্ভতভাবে ক্ষনিকের জন্য কাঁপিয়ে দিচ্ছিল। সাদিয়ার আঙ্গুলের খাঁজে খাঁজে আঙ্গুল মিলিয়ে অয়ন ওর হাতকে শক্ত করে ধরে থাকল। সাদিয়া আলতো করে অয়নের কাঁধে মাথা রাখল। দুজনেই দুর আকাশ পানে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষন। আকাশের কালো মেঘ আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে দিগন্ত সীমানায়।সাদিয়া হঠাৎ তীব্র আবেগে বলে উঠল, “কথা দাও, কখনও ছেড়ে যাবে না আমাকে?”
“না, যাব না”। অয়ন সাদিয়ার চোখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। সাদিয়াও তাই। চোখে চোখ রাখা। অয়নের গভীর ঘনকালো চোখ দুটো যেন আরও দূর্বল করে দিচ্ছিল সাদিয়াকে।
অয়নের চোখে অশ্রু। তীব্র আনন্দের অশ্রু। দেখা যাচ্ছে না। বৃষ্টির পানির সাথে অয়নের অশ্রু মিশে যাচ্ছে বারবার। অয়ন সাদিয়ার ভেজা কপালে আলতো চুমু খেল। অয়ন মনে মনে ভাবল, “এত সুখ কি তার কপালে সইবে ককনও”? অয়ন এক হাত দিয়ে আরো্ শক্ত করে সাদিয়ার হাত দুটি ধরল। আরেক হাত দিয়ে সাদিয়ার ভেজা শরীর তার শরীরের সাথে চেপে ধরল। দুজন মুখোমুখি। আবীর ধীরে ধীরে তার তপ্ত ঠোঁটটি সাদিয়ার রক্তলাল ঠোঁটের দিকে এগিয়ে নিতে থাকল। সাদিয়ার গরম নিশ্বাস স্পস্ট অনুভব করতে পারছে অয়ন।
তীব্র আনন্দ অনুভুতিতে শির শির করে উঠল দুটি শরীর। দুটি শরীর, দুটি মন যেন এক হয়ে মিশে যাচ্ছে ভালবাসার অন্তহীন গভীরতায়।
দুই বছর পর।-
“অয়ন, তোমার মনে আছে? ঠিক দুই বছর আগে, আমরা সুন্দর একটা দিনে বিয়ে করব বলে ঠিক করেছিলাম। আজ তোমার জন্মদিন।”“মনে আছে”।“আর আজ আমরা বিয়ে করতে যাচ্ছি ঠিক এখানটায় এসেই। আমাদের ভালবাসার চূড়ান্ত রূপ দিতে যাচ্ছি আজ, এখানটায়ই।““হুমম, অয়ন অন্যমনস্কভাবে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। কিছুক্ষন পর বলল,“ওইদিনের মত আজও তোমাকে আমি সবুজ শাড়ি পরে আসতে বলেছি, আর চুলে রজনীগন্ধা”।সাদিয়া ফ্যাকাশে হাসি হেসে বলল, “তুমিও তাই”।“হুমম”।“এ্যাঁই, আমার কেমন যেন লাগছে, আজ”, সাদিয়া কাঁপা কাঁপা গলায় বলল।“কেন”?“আমার মনে হচ্ছে, আমার বাবা ঠিকই আমাদের খুজে বের করে নিবে। কাল পালিয়ে আসার আগমুহুর্তে কিরকমভাবে জানি তাকাচ্ছিলেন বাবা। খুব ভয় করছে আমার, অয়ন। বাবা, আমার জন্য পারেন না, এমন কোন কাজ নেই আবীর। এখানে যদি বাবা তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে আসেন। তোমাকে যদি ওরা মেরে ফেলে। তোমার যদি কিছু হয়, আমি বাঁচব না। আমাকে একটু জড়িয়ে ধরে থাকবে, অয়ন”।অয়ন জড়িয়ে ধরল সাদিয়াকে, “ভেব না লক্ষী, কিছু হবে না। সব ঠিক হয়ে যাবে, আমার উপর ভরসা রাখ”।
হঠাৎ ভোঁ ভোঁ করে কেঁদে উঠল সাদিয়া। সাদিয়া প্রবল আবেগে আরও জড়িয়ে ধরল অয়নকে। এমন সময় চেনা স্বর শুনে চমকে উঠল সাদিয়া।
“শুয়োরের বাচ্চা, তুই ই আমার মেয়েকে…..। এই ধর”।
পেছনে ফিরে তাকিয়ে সাদিয়ার পিলে চমকে উঠল। মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। গলার স্বর আটকে যেতে থাকল। সামনে বাবা দাড়িয়ে। সাথে তার সসস্ত্র গুন্ডাদল।অয়ন করুন চোখে সাদিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষন। আসন্ন করুন পরিণতি মোকাবিলায় শক্তি অর্জনের চেষ্টা করতে লাগল অয়ন মুহুর্তেই। সাদিয়া আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে থাকল অয়নকে। সাদিয়ার বাবা এগিয়ে আসতে লাগল তীব্র বেগে তার সসস্ত্র বাহিনী নিয়ে।
—— ধ্যাৎ, এমন সময় কারেন্ট চলে গেল। শালার লোডশেডিং। বিদ্যুৎমন্ত্রির গোষ্টি গিলাই।
পুনশ্চ: মাননীয় প্রধানমন্ত্রি, “ডিজিটাল বাংলাদেশ উইথ নো ইলেকট্রিসিটি” দরকার নাই আমাদের। ওয়াদা নিয়ে রাজনীতি আর কত! নাটক-সিনেমা তো কিছুই দেখতে পারতেছি না। অন্তত ভালবাসায় লোডশেডিং তো কোনভাবেই মানা যায় না!
3 Responses to গল্প: ভালবাসায় লোডশেডিং………..
You must be logged in to post a comment Login