ফাতেমা প্রমি

চন্দ্রাহত রুদ্রাক্ষর

চন্দ্রাহত রুদ্রাক্ষর
Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

634782069625083743-rest-in-peaceশুরু’র কাহন

প্রথমেই ধন্যবাদ আমার লেখাটি নিয়ে বসেছেন সময় বের করে,অনেক থাঙ্কস! এবার সময় নষ্ট না করে আমার সাদামাটা গল্পটা শুরু করা যাক। আমি হঠাৎ একদিন পরদস্তুর লেখক হয়ে গেলাম। কিভাবে? বলছি। ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন,কয়েক বড় ভাই আর বন্ধুরা মিলে দেয়াল পত্রিকা বের করবে, আমাকে বলা হল লেখা দিতে। কোনদিন লেখিনি,সেই আমি মান বাঁচাতে রীতিমত কাগজ কলম নিয়ে লিখতে বসে গেলাম। পত্রিকা ঘাঁটাঘাঁটি করে ‘অলিম্পিক ২০০০’ নিয়ে লিখে ফেললাম চমৎকার একটা ফিচার।

একেবারে হঠাৎ করেই-কোন রকম জানান দেয়া ছাড়াই রোল নাম্বার ওয়ান, ক্লাস ক্যাপ্টেন রামিম হাসান লেখক হয়ে গেল । তারপর দেয়াল পত্রিকা,স্কুল ম্যাগাজিন,পাড়ার পত্রিকা,এমনকি জাতীয় দৈনিকেও ছেপে ফেললাম নিজের নাম। পড়াশোনাতেও পিছিয়ে পড়িনি আমি-এভাবেই ধীরে ধীরে একদিন আমি লেখক রামিম হাসান নটরডেমের ছাত্রও হয়ে গেলাম।

এই সময় আমার মনে হত পৃথিবীর সব জ্ঞান,সব রহস্য আমার জানা। আমি হকিং-এর ব্ল্যাক হোল যেমন পড়ি,তেমনি শিখে নিয়েছি কবিতা লেখার শুদ্ধ গ্রামার। বন্ধুরা আমার গল্পের জন্য ‘ফিদা’- খাঁটি বাংলায় দিউয়ানা।

তখন আমি ঘন ঘন প্রেমে পড়ি- নারী বাদে আমি প্রায় সব কিছুর প্রেমে পড়েছি। শুধু এই ব্যাপারে ছিলাম স্রোতের বিপরীতের মানুষ। তাছাড়া লেখালেখির এমন এক জগতের সন্ধান পেয়েছি তখন,যা ছিল রূপবতী প্রেয়সীর চেয়ে অনেক বেশী আকর্ষণীয়।

খুব ভালো গীটার বাজাতে পারতাম আবার ফিজিক্স ল্যাবে আমিই ছিলাম সেরা। বইএর পোকা ছিলাম,প্রচুর পড়তাম। পড়তে পড়তে একসময় আমার হাতে এলো মার্কস,চে গুএভারা। গুএভারার সৌম্য বদনের প্রেমে হাবুডুবু খাওয়াও শুরু করে দিয়েছি এইসময়।

এমনি সময়ের এক বিকেলে কবি শহিদুল্লাহ’র একটা বই আমার হাতে চলে এলো কিভাবে জানি না। আহা কি চমৎকার কাব্য সেসব। মুগ্ধ করা সব কবিতা,আমার মনের কথা যেন। দেখতেও সে অনেকটা গুএভারার মতই- সৌম্য শান্ত স্নাশ্রু মণ্ডিত এই কবি রুদ্র মুহম্মদের প্রেমেও পড়ে গেলাম আমি। তার প্রতি আবেগটা একটু বাড়াবাড়ি রকম বেড়ে গেল,এতটাই যে আমি পত্রিকাগুলিতে আমার লেখা দিতে শুরু করলাম ‘রুদ্রাক্ষর রুদ্র’ ছদ্ম নামে-প্রিয় কবির নামের সাথে কিছুটা মিলিয়ে।

 

উপভোগ্য খ্যাতির বিড়ম্বনা

নিয়মিত লেখক,কবি রুদ্রাক্ষর রুদ্র’র চমৎকার সব লেখা বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হত-বিষয়বস্ত আর লেখকের নামের কারণে একটা ভারিক্কি চাল এসেছিল। আমার অবস্থা তখন ছোট্ট বালক রামিম হাসানের মত না- ব্যাপার পুরো অন্যরকম।

আমার কাছের ক’জন বন্ধু ছাড়া অন্যরা এটা জানতই না; ব্যাপারটা পুরোপুরি এড়িয়ে গেলাম। পরিচিত অনেকেই এমনকি টেনিস কোর্টে, ডিবেটিং ক্লাবে, সুইমিং পুলে কবি রুদ্রাক্ষর রুদ্র’র কাব্য প্রতিভা বিষয়ে বিদগ্ধ আলাপ পর্যন্ত জুড়ে দিত আমার সাথে। বিভিন্ন ভাবে পরিচিত/অপরিচিত প্রচুর ভক্তের চিঠি এসে আমাকে আরও বেশী আনন্দময় পরিস্থিতি’র সাথে পরিচয় করিয়ে দিল।

কবি-সম্পাদক-ছোট-বড়-বাচ্চা কত রকম মানুষ যে লিখত আমাকে! ছেলে ভক্ত তো ছিলই, সাথে প্রচুর মেয়েদের চিঠিও আসত,তার কিছু কিছু আবার অত্যন্ত প্রেমপূর্ণ। বন্ধুরা যারা জানত ওরা আগ্রহ নিয়ে প্রেমপত্র গুলো পড়ত আর হাসাহাসি করত। আমি ব্যক্তিগতভাবে মানুষের আবেগ নিয়ে হিউমারের পক্ষে না। কিন্তু মাঝে মাঝে যখন ইউনিভার্সিটি পড়া আপুদের ভুল বানানে লেখা চিঠি আসত তখন ওদের সাথে সাথে আমিও একচোট হাসতাম।

চিঠিগুলির বেশীরভাগই থাকত একইরকমের। ন্যাকামি বা জেলাসি ভরা-আর কিছু থাকত প্রফেশনাল। এরই মধ্যে একজন ভক্তের চিঠি ছিল বেশ আলাদা। ‘কবি রুদ্র’, সম্বোধনের এই চিঠিটি- খুব গোছান লেখা, পরিচ্ছন্ন মানসিকতার; নাম বা নিজের কোন তথ্য সেখানে অবশ্য ছিল না। পড়ে তেল বা অত্যুক্তি মনে হত না-আবার তিরস্কারও মনে হত না। আমার লেখা নিয়ে,সমকালীন সাহিত্য নিয়ে আরও হাজারটা বিষয় নিয়ে তার সাথে লাইভলি ডিসকাশন হত। এভাবে কখন যেন অনেকটাই বন্ধুর মত কাছের মানুষ হয়ে গেলাম তার সাথে।

এই সময় একদিন জানলাম আমার এই ভক্তটি সৌভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্য যে কোন ক্রমেই হোক-সে একজন মেয়ে। অবাক করা ব্যাপারটি ছিল মাত্র ও লেভেলে পড়া এই মেয়েটির সাহিত্য বোধ, জীবনবোধ আর মানসিকতা। কোটিপতি বাবার কন্যা হয়েও তার মধ্যে একটা অদ্ভুত সরলতা,নম্রতা ছিল-যেটা আজকাল চোখেই পড়ে না। আমি রীতিমত দুর্বল হয়ে পড়ছিলাম মেয়েটার প্রতি,অথচ আমার চরিত্রের সাথে ব্যাপারটা একেবারেই যায় না।

 

তাহার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ

তারপরের গল্পটা অতি চিরাচরিত। চিঠি থেকে ফোন,ফেসবুক। তারপর একদিন সরাসরি দেখা করা। কথা বলে যে দুর্বলতার বীজ আমার মধ্যে ঢুকেছিল সেটা তার দুর্গাপ্রতিমা’র মত চোখে তাকিয়ে পুরোপুরি প্রেমে রুপ নিল। আমি ওকে ইমপ্রেস করার জন্য হড়বড় করে একগাদা কিসব বলেছি তার ঠিক নেই। এমন কিছু কাণ্ড শুরু করেছিলাম নিজেরই ভাবতে এখন ভাঁড়ামো মনে হয়।

একদিনের কথা বলিঃ-

-“হুম,তোমার নাম তাহলে রেবতী। সৌরমণ্ডলের দ্বিতীয় প্রভার নক্ষত্র তুমি।।”

-“তুমি কি আমাকে ইম্প্রেস করার চেষ্টা করছ? আমার মনে হয় সৌর জগত নিয়ে এই ভুয়া কচকচানি পুরোটাই তুমি এইমাত্র বানিয়েছ আমাকে মুগ্ধ করার জন্য,তাইনা?”

জবাবে আমি হাসলাম,আতেল টাইপের হাসি। যে হাসি বুঝিয়ে দেয়

-“তোমার ধারনাই ঠিক।আমি ঠিক এই কাজটাই করেছি।”, মুখে কথা যোগালো না। ও লাজুক হেসে বললঃ

-“যে ইতিমধ্যে মুগ্ধ হয়ে নিজেকে সঁপে দিয়ে বসে আছে,তাকে নতুন করে মুগ্ধ করার কিছুই নেই।”

আমি এত খুশি হলাম সেটা আর বলে বোঝাবার না। আমি ঠিক এই পজিটিভ সাড়াটাই আশা করছিলাম।

-“ঠিক আছে মুগ্ধ করার চেষ্টা বাদ দিব,কিন্ত একটা শর্ত আছে।”

-“তথাস্ত। কি শর্ত? বল।”

-“যত সমস্যাই আসুক,রেবতী আমাকে ছেড়ে যাবে না তুমি।”

-“না,রুদ্র। আমি কখনই তোমাকে ছেড়ে যাবনা। কিন্তু আমারও শর্ত আছে,যাই ঘটুক আমার সাথে প্রতিদিন কথা বলবে তুমি,প্লিয কবি।”

এভাবে অল্প পরিচয়ের একজনকে ভালোভাবে না জেনেশুনেই ভালবেসে ফেলব, ভাবিনি কখনো। কোন কিছু বিবেচনা না করেই আমার চারপাশ এলোমেলো করে হুট করে প্রেমে পড়ে গেলামকবিগুরুর মতই তাহার চোখে দেখে ফেললাম আমার সর্বনাশ।

তারপর কত দিনের কত কাব্য। প্রেম মানুষকে সাইক্লপসের মত একচোখা বানিয়ে দেয়। আমিও  বোকা আর ছেলেমানুষি ভরা একটা মানুষ হয়ে গেলাম এই প্রেমের কারনেই। এরই মধ্যে কবি রুদ্রাক্ষরের কবিতা নিয়ে নামকরা এক গায়কের গানের সিডি বাজারে এলো, প্রথম প্রফেশনাল কাজ-আমার আনন্দ দেখে কে? মনে হল রেবতী’র জন্যই এটা হয়েছে। আমার তুচ্ছ জীবনে আশীর্বাদ হয়ে এসেছে মেয়েটা।

‘শেষের কবিতা’র পরের কাব্য

এরই মধ্যে আমার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে,দুএকটা ল্যাব পরীক্ষা বাদ ছিল। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতই এই সময় আমার বাবা মারা গেলেন। আঘাতটা অনেক বড়  ছিল। আর্থিক ভাবে অনেক বেশী না হলেও বেশ সচ্ছল ছিলাম আমরা।

বাবাকে হারানোর ব্যাথার সাথে মোটামুটি একরকম অর্থকষ্টেও পরে গেলাম। ছোট ভাই আর আম্মুকে নিয়ে আমাদের ছোট্ট পরিবারে এই প্রথম অভাব দোলা দিল। তারপরও বাবার স্বপ্ন পূরণ করার জন্য কষ্ট-ক্লেশে আম্মু আমাকে বুয়েট ভর্তি কোচিংএ পাঠাল। এই সব ঝামেলা আর পড়াশোনার ব্যস্ততায় লেখালেখি আর রেবতীকে সময় দেয়া কমে গেল। তবে এই সময় বই হিসেবে ছাপতে সস্তা টাইপের কিছু লেখা লিখলাম,কারণ লেখক-কবি রুদ্রাক্ষরের কাছে তখন কিছু টাকার মূল্য পৃথিবীর যে কোন কিছুর চেয়েই অনেক বেশী।

একদিন একথা সেকথায় বাবার প্রসঙ্গ আসল। বাবার মৃত্যু সংবাদে মনে হল রেবতী আমার মতই দুঃখ পেয়েছে। তাই বলে ও অন্য বন্ধুদের মত একইরকম সান্ত্বনার বানী শোনালো না, আবার পাশের এপার্টমেন্টের আন্টিদের মত আমাদের এখন কিভাবে চলবে তা নিয়ে হা-হুতাশ বা প্রশ্নবাণও ছুড়ল না দেখে স্বস্তি লাগল। রেবতী বলল এরকম একটা মুহূর্তে সে অবশ্যই আমার আম্মুর সাথে দেখা করতে চায়। আমি খুব একটা রাজি না হলেও একরকম বাধ্য হয়েই ওকে নিয়ে এলাম আমাদের বাসায়।

অনেকটা সময় ও আমাদের বাসায় কাটাল। খুব একটা মধুর বা আলাদা কেটেছে দিনটা,এরকম না। বেশ সাধারণ একটা দিনই ছিল সেটা। কিন্তু দিনটা আর সাধারণ থাকল না,যখন আমাদের বাসা থেকে ফিরে রেবতী ফোন করলঃ

-“রামিম আমি তোমার সাথে রিলেশানটা আর বইতে চাইছি না। ”

-“আশ্চর্য,এসব তুমি কি বলছ? সম্পর্ক কি একটা কথায় হুট করে রাখা না রাখার মত তুচ্ছ কোন ব্যাপার? সমস্যা কিছু হলে খুলে বল আমাকে।”

-“আলোচনা করে সমাধানের কোন কারণ দেখছি না,রামিম। আমি তো বলেইছি যে আমি ব্রেক-আপ চাই।”

-“আমি তো অন্তত কারণটা জানার অধিকার রাখি,তাইনা?ইদানিং বাধ্য হয়ে মানহীন কিছু লেখা লিখছি,তুমি কি সেজন্য ভুল বুঝেছ?”

-“এত জানতে চেও না, কষ্ট হয়তো বাড়বে তোমার।”

-“আমি অবশ্যই জানতে চাইব। আমার ট্রু লাভ নিশ্চয়ই অপাত্রে দেইনি আমি। তুমি সেই মেয়ে যে বলেছিল কোনদিন কবি রুদ্র’কে সে ছেড়ে যাবে না,তাইনা? ”,বেশ রাগের সাথেই বললাম।

-“হ্যা,অপাত্রেই দিয়েছ তোমার ‘অতি মূল্যবান’(!) ভালোবাসা।”, ওর কণ্ঠে স্পষ্ট বিদ্রুপ,

“আমি কাছে থেকে একজন লেখককে পর্যবেক্ষণ করতে চেয়েছিলাম, সে ইচ্ছা আমার পূর্ণ হয়েছে,ব্যস। আমার প্রয়োজন এখন শেষ।”

আমি অবিশ্বাসে মাথা নাড়ছি,অপর প্রান্তে রেবতী বলে চলেছেঃ-

“তোমার উত্তর তো পেলে, এখন কথা হল আমাকে লোকেট করার চেষ্টা করোনা কখনো, আমি না চাইলে সেটা তুমি পারবেও না অবশ্য। এখন রাখছি।”

সারাবেলা বন্ধ-জানালা

বন্ধুদের দেয়া নতুন ম্যাথের সুত্রঃ

– “পুরো ব্যাপারটা এই ডিজিটাল যুগের সাধারণ এক ‘ওয়ান বাই কস=ছ্যাঁক’(1/cos = sec)।”

কারো আবার ধারণা  – “আমাদের সস্তার এপার্টমেন্ট বাড়ি দেখে রাজকন্যা ভয় পাইছে।”

কেউবা দার্শনিকের মত বলে বসলঃ

– “দোস্ত,মাইয়ারা সব এক কিসিম, অকারণেই ব্রেক-আপ করে দেয়; ব্যাপার না। এক রেবতী গেছে গা,আরো দশটা মাইয়া তোর জন্য দেখবি রেডি আছে।”

বন্ধুদের ধারণা কিংবা ওর দর্শানো কারণ কোনটাই আমার সত্য মনে হয়নি।

কে জানে হয়তো আমার সস্তাদরের ঐসব বস্তাপচা লেখা কিংবা ছদ্মনামে লেখা হয়ত একটা কারণ হতে পারে-তবে কারণ হলেও সেটা যে প্রধান কারণ না তা বেশ বুঝতে পারতাম।

আমার অনেক কথা বলার-জানার ছিল;তা হয়নি আর। কারণ তারপর আর কোন মাধ্যমেই খুঁজে পাইনি ওকে। টানা দুই মাস পাগলের মত এ গলী, ও রাস্তা হেঁটে বেড়িয়েছি। খাওয়া,ঘুমেরই কোন ঠিক ছিল না। লেখালেখি, পড়াশোনা’র তো প্রশ্নই আসে না। পদব্রজে শুধু ওকে খুঁজেছি; আর খুঁজেছি এই নিষ্ঠুরতার পেছনের সঠিক জবাব।

তারপর শুরু হল আমার মৌন ব্রত। সারাবেলা বন্ধ দরজার এপাশে একা রামিমের কত যে নিঃসঙ্গ,মৌন দিন কেটেছে!

তারপর আমি চাইলেও আর লিখতে পারছিলাম না,পড়তেও না- রাইটার্স ব্লক জাতীয় একটা কিছু হয়েছিল বোধহয়। একটা অস্বাভাবিক জীবন সেটা একজন ছাত্রের জন্য- একজন লেখকের জন্য।

শেষের কথা – কিংবা এটাই শুরু

সত্যি বলছি ছ্যাঁকা খেয়ে আমি এরকম হয়ে গেছি, বন্ধুদের এই অভিযোগ একেবারেই সত্যি না। আসলে সেদিন রেবতী চলে যাবার পর থেকে আমি অনেক ভেবেছি। ওর বলা কারণটা সত্যি না বুঝতে পেরেছি,তাই উত্তর খুঁজেছি কেন আমার সাথে ও এমন করল? ভেবে একটা কারণ বের করেছি,এখন চেষ্টা করছি একটা উপন্যাস লিখতে- লা নুই বেঙ্গলি’র মত। ব্যর্থ প্রেমের গল্প।

ব্যর্থ হলেও সে গল্পে আমার নির্মম পরাজয় হবে না বাস্তবের মত। আমার উপাখ্যান আমি লিখব। মৈত্রেয়ী দেবীর মত আমার জন্য উপন্যাসের 2’nd version তো আর রেবতী এসে লিখে দেবে না,তাই আমি নিজেই দ্বিতীয় ভার্সান ওর হয়ে লিখব। সেখানে রেবতী লিখবে কেন সে আমাকে ছেড়ে গেল।

কল্পনার এই রেবতী মোটেও নির্দয় ভাবে কবি রুদ্রাক্ষর কে ছেড়ে যাবে না। ছেড়ে যাবে সম্পূর্ণ ডিপ্লোম্যাটিক একটা কারণে। উপন্যাসে রেবতী বলবেঃ সে যেদিন কবি রুদ্রাক্ষরের বাসায় যায় সেদিনই কবির বাবার সৎকারের গল্প এবং মায়ের ‘রামিম’ ডাক শুনে সে জানতে পারে রুদ্রাক্ষর আসলে মুসলিম। যেহেতু রেবতী নিজে ব্রাহ্মনের মেয়ে তাই রামিম হাসান কে বিয়ে করা তো জীবন্ত দুঃস্বপ্নের নাম,আর এজন্যই সেদিনের পর থেকে রেবতী আর  রুদ্রাক্ষরের সাথে যোগাযোগ রাখেনি।

আমি জানি আমার এই গাঁজাখুরি কল্পনা সত্য হবার সম্ভাবনা অনেক বেশীই ক্ষীণ, কারণ  রেবতীর বাবা এই সমাজে অনেক উঁচুমাপের একজন শিল্পপতি- আমাদের দেশগুলোতে সংখ্যালঘুদের ওরকম পর্যায়ে যাওয়াটা খুব অহরহ ঘটে না, এক্ষেত্রে ঘটে থাকলে বলতে হবে তা অনেক বেশি-ই কাকতালীয়।

তারপরও এটাই আমি ভাবতে থাকি, কারণ রেবতী শুধুই আমার ছিল-থাকবে; এই ভাবনাটা অনেক স্বস্তির,শান্তির।

উপন্যাসটা লেখায় হাত দিয়েছি। এখন আমার টেবিলে অবহেলায় গড়াগড়ি খায় আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব, নিউটনের তৃতীয় সূত্র- ধুলো জমেছে বুয়েট ভর্তি গাইডে। আর সেই টেবিলের এককোণে বসে উদাসী বাতাসে আমি একমনে লিখছি আমার উপন্যাস। পাশের ঘর থেকে একশ’ তিন জ্বর নিয়ে পরে থাকা মায়ের পুরনো কাশির শব্দটা মধ্যরাতের নীরবতাকে ভেঙ্গে খান খান করে দিলেও আমাকে বিহ্বল করে তুলতে পারছিল না-আমি এক ঘোরের মাঝে বসে লিখছি আমার দুই পর্বের “লা নুই বেঙ্গলি”; “নহন্নতে” ধরণের উপন্যাসটি। হঠাৎ লোডশেডিং-এর কারণে আমার লেখার খাতায় এসে পড়ল ভরা পূর্ণিমার জোস্না । সেই অবাক জোস্নাতে ভেসে যাওয়া চন্দ্রাহত আমি লিখে চলি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রেমের উপাখ্যান- উচ্ছল তরুণ রামিমের লাশের উপর আবার নতুন করে গড়ে তুলতে থাকি একজন চন্দ্রগ্রস্ত, আঘাতপ্রাপ্ত লেখক রুদ্রাক্ষরকে।

­­­           _____________________****** _____________________

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


13 Responses to চন্দ্রাহত রুদ্রাক্ষর

You must be logged in to post a comment Login