তাহমিদুর রহমান

ধারাবাহিকঃ নিশিযাত্রা (পর্ব ১২)

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

বার

কোডিটল ও ফ্রোক্সিবেল দুটোই ফেনসিডিলের গ্রুপ। সবাই ফেনসিডিল এক নামে চিনে কিন্তু এই দুই নামে সকলে চিনে না। আজকাল অনেক ফার্মেসীতেই অহরহ বিক্রি হচ্ছে এসব। বাংলাদেশের যুব সমাজ খুব সহজেই হাতে পেয়ে যাচ্ছে, তাই মাদকাসক্ত হওয়াও সাধারন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছেলেগুলোর হাত দিয়ে এখন মেয়েদের হাতেও গিয়ে পৌঁছেছে। ওলির অবশ্য এসব সম্পর্কে তেমন ধারনা নেই। সে লিপির হোস্টেলের বিছানায় বসে আছে। বালিশ সরাতেই কোডিটল নামে ওষুধের ফাইল দেখতে পেল ও। লিপি ওকে বসিয়ে রেখে বাথরুমে গিয়েছে। ওষুধগুলো হাতে নিয়ে ওলি ভাবে, লিপির হঠাৎ কি হল? কিসের অসুখ হল? ও তো সবকিছুই ওলিকে জানায়, এমনকি মেয়েদের মাসে একবার যে ব্যাপারটা হয় সেটা পর্যন্ত। ওলি ওষুধগুলো আবার বালিশের নিচে রেখে দেয়। লিপি বাথরুম থেকে ফিরলেই সে জিজ্ঞেস করে,

-কিরে তোর কি হয়েছে?

-কই কিছু নাতো।

-তাহলে ওষুধ খাচ্ছিস যে।

-কই?

-তোর বালিশের নিচে দেখলাম।

-ওখানে কেন হাত দিয়েছিস?

ওলি অবাক হয়, লিপি তো কখনো এভাবে বলে না।

-না মানে হঠাৎ বালিশটা কোলের উপর নিলাম তো তাই।

-তাই বলে আমার যেখানে সেখানে হাতিয়ে বেড়াবি? প্রাইভেসি বলে কি কিছু নাই?

ওলি এবার আরো অবাক হয়। লিপির আজ কি হল? এরকম করছে কেন? তবু সে তেমন পাত্তা দিল না।

-আচ্ছা যা দোস্ত, মাফ দে। ভুল হয়ে গিয়েছে।

তবু লিপিকে খুশি হতে দেখা গেল না। বরং আরো গম্ভীর হয়ে যায়। জোরে জোরে টেবিলের উপর শব্দ করে বইপত্র গোছাতে থাকে। ওলি এবার বিছানা থেকে উঠে প্রিয় বান্ধবীকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে।

-বললাম তোরে বাবা, মাফ দে।

লিপি তবু কথা বলে না, দৈনন্দিন জিনিসপত্র গোছাতে থাকে। ওলি এবার প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করে।

-তানভীর ছেলেটা নিশ্চিত তোকে পছন্দ করে।

লিপি এবার ওলির দিকে ঘুরে তাকায়।

-মানে? কোন তানভীর?

-অ্যারে ওই যে বোকা বোকা ছেলেটা।

-মানুষকে হুদাই বোকা বলবি না। রফিক মিয়া এমন কোন চালাক মিয়া না।

-তুই রেগে যাচ্ছিস কেনরে?

ওলি চোখ মুখ আঁকা বাঁকা করে বলে। একটু দুষ্টুমি করার চেষ্টা করে। কিন্তু লিপি কাঁটা কাঁটা উত্তর দেয়।

-রেগে যাব কেন? কিন্তু ফ্যাজলেমী করবি না আমার সাথে।

ওলি দমে যায় বান্ধবীর ব্যবহারে, কষ্ট পায়; তবু আরেক প্রসঙ্গ টেনে আনে।

-চল, ক্লাসে যাই।

-না, তুই যা।

-কেন? শরীর খারাপ?

-না।

-তাহলে কি?

-তোকে বলতে হবে? সবকিছু এত জানতে চাস কেন?

ওলি বান্ধবীর ব্যবহারে এবার সত্যি কষ্ট পায়।

-তুই এভাবে কথা বলছিস কেন?

-কিভাবে কথা বলতে হবে তোর সাথে? নবাবজাদি এসেছিস?

-ছিঃ লিপি, তুই এভাবে কথা বলিস না।

-প্যাঁচাল মারিস না, তুই বালিশে হাত দিয়েছিলে কেন?

ওলি এবার ভিতর ভিতর রেগে উঠে।

-হাত দিয়েছি, বেশ করেছি।

-বেশ করেছিস?

-হ্যাঁ করেছি তো?

-চলে যা এখান থেকে, আর কখনো আসবি না এখানে।

ওলি কারো সাথে তেমন ঝগড়া করতে পারে না। ওর চোখে জল আসতে শুরু করেছে।

-ছিঃ লিপি, তুই আমার সাথে এরকম করলি?

-কথা বলবি না। লজ্জা করে না তোর এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছিস?

ওলি আর কথা বলতে পারে না। চোখে জল নিয়ে লিপির ঘর থেকে বের হয়ে আসে। লিপির রুমমেটগুলো এমনভাবে দুজনকে দেখছিল যেন তামাশা দেখছে। ওলিও আজকে ক্লাস করবে না। বাসায় যাবে? বাসায় গিয়ে কি করবে? রফিকের কাছে যাবে? সে তো রফিকের মেস চিনে না। তবু রফিকের কাছে যাওয়ার সিন্ধান্ত নেয়। একবার চিন্তাও করল না এসময় রফিক ঘরে থাকবে কিনা? কিংবা ও জানল না ওর প্রিয় বান্ধবী কোন পথে পা দিয়েছে? সে গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে মগবাজার যাওয়ার নির্দেশ দেয়।

মাহের আজ অফিসে যায় নাই, শরীরটা তেমন ভাল নেই। ডাক্তারের কাছে গিয়ে ওষুধও কিনে এনেছে সে। অনেকদিন হয়ে গেল তবু চাকরিস্থলের আবহাওয়ার সাথে মানিয়ে নিতে পারে নাই। মাঝে মাঝে সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে চলে যেতে ইচ্ছে হয় তার। বিছানা থেকে উঠে বসে, নাস্তা করা দরকার ওর, খিদে পেয়েছে; বুয়া আসেনি বলে পাউরুটি আর জেলিই ওর সকালের নাস্তা। ধীরে সুস্থে উঠে চায়ের জন্যে গরম পানি করতে দিয়ে দেয় হিটারে।

কাল রাতের কথা মনে পড়লেই মনটা উদাস হয়ে যায় ওর। পাউরুটি খেতে খেতে সুমাইয়ার কথা ভাবতে থাকে ও। কাল রাতে অবশেষে কথা বলেছে তার সাথে। কাল কি মনে করে উপজেলার ক্লাবে ঘুরতে গিয়েছিল সে। এমনিতে সে কখনোই সেখানে যায় না। মনেহয় ওর মনটাকে নিঃসঙ্গতা কষ্ট দিচ্ছিল। মনেহয় ওর মনটা সংগ খুঁজছিল। ব্যাপারটা কালতালীঁয় কিনা জানে না সে। উপস্থিত হয়েই ক্লাম রুমে এক টেবিলে বসে থাকতে দেখল সুমাইয়াকে। প্রথমদিন দেখাতে মাহের সুমাইয়ার ভিতর কোন স্পন্দন খুঁজে পাই নাই। তবে কাল রাতে চোখাচোখি হল, চোখাচোখি হতেই একে অন্যের ভাষা বুঝে ফেলে, কতদিন পর। সুযোগ বুঝে দুজনে ক্লাবের দরজা থেকে একটু দূরে এসে দাঁড়ায়। জায়গাটায় আলো কম, অন্ধকার হলেও মানুষের অবয়ব ঠিকই দেখতে পাওয়া যায়। মাহের জিজ্ঞেস করে সুমাইয়াকে,

-অবশেষে চিনতে পারলে?

-আমি প্রথমদিনই তোমায় দেখেছি।

-তাহলে কথা বলনি যে।

-আমি চাইনি সবাই জানুক যে তুমি আমার পরিচিত।

-হুম। এখন কথা বলছ যে?

-দেখছ না, সবাই তাস খেলায় মত্ত, কে খেয়াল করবে।

-হুম। তারপর কেমন আছ?

-আছি।

-ইউএনো স্যার তোমার কে হন?

-দুলাভাই।

-দুলাভাই? তাহলে তোমার…

-বিদেশে থাকে ও।

-ও আচ্ছা।

-জীবনটা কেন এমন হল বলত?

-আমি গিয়েছিলাম তোমাদের বাড়িতে। তুমি ছিলে না।

-জানি।

-তাহলে জীবন নিয়ে প্রশ্ন কেন?

-আমি তো এমন চাইনি। আমার বিয়ের এক মাসের মাথায় ও বিদেশে চলে যায়। তারপর আর কোন খোঁজ বলতে গেলে নেই। বলতে পার ও আমার নামে মাত্র স্বামী। শুনেছি বিদেশে গিয়ে আবার বিয়ে করেছে। সত্যি মিথ্যা জানিনা।

মাহের শুনে একটু অবাক হয়। বলে,

-সেটা তো পরের কথা সুমাইয়া। তুমি বিয়ে করতে গেলে কেন?

সুমাইয়া চুপ থাকে কিছুক্ষন। তারপর বলে,

-সেবার বাড়ি যাবার দুদিন পরেই বাবা অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হয়। হঠাৎ বাবা আমার বিয়ের কথা বলেন। বাবার শারীরিক অবস্থা দেখে আমি কিছু বলতে পারিনি। বিশ্বাস কর মাহের।

মাহের কথা বলে না, সুমাইয়া আবার বলে,

-তোমাকে আমি ভুলতে পারিনি মাহের, যখন সত্যিকারেই ভুলতে চেয়েছি তখন আবার আমার চোখে এসে ধরা দিলে।

-সুমাইয়া, আমি আজও তোমায় ভালবাসি।

ফিক করে হেসে ফেলে সুমাইয়া। মাহের বলে,

-হাসছ কেন?

-না মানে তোমার কথা শুনে মনে হল তুমিই আদর্শ প্রেমিক পুরুষ। আমি আর আগের মত নেই মাহের।

হঠাৎ করেই আবার সুমাইয়ার মুখটা অন্ধকার হয়ে যায়। মাহের বলে,

-চল, আবার নতুন করে শুরু করি।

সুমাইয়ার মুখে আবার হাসির রেখা দেখা যায়। বলে,

-বাংলা নাটকের ডায়লগ হয়ে গেল না?

-জানিনা। আমি আজও চাই তোমাকে।

এরপরই ঘরের ভেতর শোরগোল উঠে। ওরা বুঝতে পারে, অনেকে খেলা ভঙ্গ করেছে। দুজন দুদিকে সরে যায়।

কাল রাতে কথা হওয়ার পর সুমাইয়ার উপর মাহেরের প্রথম দিনের রাগটা নেই, বরং সেখানে আবার হতাশায় গ্রাস করে নিয়েছে। পাউরুটি খাওয়া শেষ করে চা বানিয়ে টিভির সামনে বসে ও। কিছুদিন হল ও একটা চোদ্দ ইঞ্চি রঙ্গিন টিভি কিনে এনেছে। রিমোর্ট হাতে টিভিটা ছেড়ে দেয়্, ডিশের লাইনটা বেশ ডিস্টার্ব দিচ্ছে কাল থেকে, এক ভারতীয় নায়িকার চিকন কোমরের দোলা দেখতে থাকে। চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে উঠে পড়ে টিভির সামনে থেকে, টিভি দর্শকবিহীন চলতে থাকে। শরীরটা খারাপ হলেও গোসল করার সিদ্ধান্ত নেয় ও, প্রতিদিনের অভ্যাস, তার আগে দাড়ি কাটা দরকার। দাড়িতে ফোম লাগানোর সাথে সাথে কলিংবেল বেজে উঠে। নিশ্চয় বুয়া, এতক্ষন পরে এসে লাভটা কি, কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিবে বলে মনস্থির করে ও। কিন্তু দরজা খুলে সে অবাক হয়, সুমাইয়া দাঁড়িয়ে আছে।

-তুমি?

-হুম। ভূত সেজে রয়েছ যে।

-হুম। দাড়ি কাটছিলাম।

-ভিতরে আস্তে দিবে না?

মাহের দরজা থেকে সরে দাঁড়ায়।

-ওহ। এস।

-এখানে একা থাক?

-হুম।

-আবার কোন মেয়ে টেয়ে আসে নাতো।

মাহের এ রসিকতায় হাসে না। বরং এই বাসায় সুমাইয়াকে একা পেয়ে হঠাৎ তার লোভ জেগে উঠে। বলে,

-তুমি বস। আমি দাড়িটা কেটে আসছি।

-আচ্ছা।

সুমাইয়া ঘর ঘর ঘুরতে থাকে। ঘুরে ঘুরে সে মাহেরের পিছনে এসে দাঁড়ায়। তখনো দাড়ি কাটছে মাহের। হঠাৎ সুমাইয়ার কি যেন হল, সেই পুরনো দিনে হারিয়ে গেল, পিছন থেকে থুতনিটা মাহেরের ঘাড়ের একটু নিচে রাখল। সাথে সাথে মাহেরের মনোযোগ দাড়ি কাটা থেকে ঘাড়ের নিচে চলে যায়। সুমাইয়ার দুবুক মাহেরকে কোমড়ের একটু উপরে ছ্যাঁকা মারতে থাকে। সুমাইয়া একটু পরেই নিজের ভুল বুঝতে পারে।

-ওহ সরি, তুমি দাড়ি কাট।

মাহের কিছু বলে না। সুমাইয়া বসার ঘরে চলে গেলে সে বাথরুমে ঢুকে যায় গোসল করতে। ঢুকে বেসিনের আয়নার সামনে দাঁড়ায়। একটা সুতীব্র ইচ্ছা ওকে গ্রাস করে ফেলেছে, বাথরুমের দরজা খুলে ছুটে যায় সুমাইয়ার কাছে। সুমাইয়া মাহেরকে এভাবে ছুটে আসতে দেখে অবাক হয়। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায় সে। বলে,

-কি হয়েছে মাহের?

মাহের কথা বলে না এবং সুমাইয়া কিছু বুঝা আগেই ওর ঝাপিয়ে পড়ে, মুখে মুখ ঘষতে থাকে অবিরাম। মাহেরের হাত সুমাইয়ার বুকে যেতেই সুমাইয়া বলে উঠে,

-ছেড়ে দাও মাহের, এ হয় না।

মাহের তবু সুমাইয়ার এক বুক হাতের তালুতে চেপে ধরে। সুমাইয়া এবার হাত দিয়ে মাহেরের গালে চড় মারে। এবার মাহের থেমে যায়, তার সুতীব্র ইচ্ছা হঠাৎই উবে যায়, সুমাইয়াকে ছেড়ে দূরে সরে আসে।

-অ্যাই…অ্যাই এ্যাম সরি সুমাইয়া। হঠাৎ…

-কিছু বলার দরকার নেই মাহের। আমারই দোষ…

দুজন দুজনের দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে।

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


10 Responses to ধারাবাহিকঃ নিশিযাত্রা (পর্ব ১২)

You must be logged in to post a comment Login