ধারাবাহিকঃ নিশিযাত্রা (পর্ব ৩)
তিন
বাথরুম থেকে দূর্গন্ধ ভেসে আসছে। গন্ধে বমি বমি ভাব চলে এসেছে নিলার। কাজের মেয়েটাকে হাঁক দেয় সে।
-শাহীনা? বাথরুমে পানি ঢালত। গন্ধে আমার বমি চলে আসছে।
-যাইতাছি খালাম্মা।
কয়েকদিন ধরে এই সমস্যা চলছে। স্যানিটারী পাইপে কোন গন্ডগোল হয়েছে মনে হয়। নিলার স্বামী তাহেরকে কিছু একটা করার জন্য নিলা পাঁচদিন ধরে বলছে আর তাহের শুক্রবারের বাহানা দিয়ে কিছুই করছে না।
শাহীনা রান্নাঘরে কাজ করছিল। সে নিলাকে ভাল করে চিনে ফেলেছে এই দুই মাসে। এখনি কাজটা সমাধা না করলে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করবে। তাহের পর্যন্ত এই চিৎকার চেঁচামেচি ভীষন ভয় পাই। সেখানে শাহীনা তো নস্যি। শাহীনা হাত ধুয়ে বাথরুমে ঢুকে যায়। সে বাথরুম থেকে বের হতেই নিলা আবার হাঁক ছাড়ে।
-সন্ধ্যা হতে গেল। তোর খালুজান এখনই চলে আসবে। বাথরুমে গরম পানির ব্যবস্থা কর।
-চুলাই দিছি খালাম্মা। খালুজান আইলেই বাথরুমে দিয়া দিমু।
তাহের একটা সরকারী ব্যাংকে চাকরি করে। সেখান থেকে প্রতি মাসে একটা মোটামুটি অংকের মাইনে পায়। দুজনের পরিবার বেশ কেটে যায়। ওদের বিয়েটা অবশ্য বেশদিন হয়নি। এইত দুই বছর হতে চলল মনে হয়। ওদের লাভ ম্যারেজ কিন্তু বিয়েটা হয়েছে একদম সাদামাটা। নিলা একদিন অফিস থেকে বাসায় ফিরলে ওলির বাবা সাখাওয়াত হোসেন মানে ওর বড় ভাই বলল, আজ রাত আটটার দিকে তোর বিয়ে। ছেলের বড় বোন কানাডায় থাকে। কালই চলে যাবে কানাডায় তাই যাওয়ার আগে আজই বিয়ে। নিলার মাথায় আকাশ না পুরো পৃথিবীটাই ভেঙ্গে পড়েছিল। একে তো কোন প্রস্তুতি নাই তার উপর চিনে না জানে না এমন একজন মানুষকে বিয়ে করতে হবে তাও আজই। নিলার বড় ভাই নিলাকে মানুষ করেছে, নিলা কিছু বলতে পারে নাই। জাহানারা ভাবিই তাকে পালিয়ে যাওয়ার রাস্তা করে দিয়েছিল। সেই রাতে এক বান্ধবীর বাসায় থেকে পরেরদিন তাহেরকে তার অফিস থেকে ধরে নিয়ে কাজী অফিসে গিয়ে নিলা তাকে বিয়ে করেছে। তাহের অবশ্য মানুষ হিসেবে বেশ ভাল। নিলার ভাগ্য ভাল বলতে হবে। কিংবা ভাগ্য ভাল তাহেরের, নিলার মত বউ পেয়েছে বলে। কিন্তু বড় ভাইয়ের সাথে সেই রাতের পর আজও দেখা হয়নি নিলার। বড় ভাই বলে দিয়েছে, জীবনে যেন এই মুখ নিয়ে সামনে না যায়। তারপর থেকে যোগাযোগ বলতে হয়ই না। তবে ওলি মাঝে মাঝে আসে, এসে গল্প করে যায়। বেশ মিষ্টি আর সুশ্রী হয়েছে মেয়েটা।
নিলার সাত মাস চলছে, হাঁটা চলা প্রায়ই বন্ধ। সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকতে ভাল লাগে না ওর কিন্তু ডাক্তারের বারন আছে। ওর শরীরটা নাকি খুব দূর্বল। মাঝে মাঝে সত্যি দূর্বল লাগে খুব। তাই শুয়ে থাকে, শুয়ে থাকতে থাকতে রাজ্যের চিন্তা ভীড় করে ওর মনে। বাচ্চা কি হবে? ছেলে না মেয়ে, ওর মন বলে ছেলে হবে কিন্তু তাহের বলে মেয়ে। ছেলে হলে নাম কি রাখবে, মেয়ে হলে নাম কি রাখবে? মনে মনে ভেবে ঠিক করে রাখে, অফিস থেকে ফিরলে নিলা তাহেরকে শুনায়। তারপর ছেলে মেয়েকে কি বানাবে? তাহের শুনে আর হাসে, নিলা মিথ্যা রাগ দেখায় তাহেরকে সেজন্যে।
তাহেরের সাথে নিলার প্রথম দেখা হয় ধানমন্ডি লেকের পাড়ে। ও আর ওর এক বান্ধবী বেড়াতে গিয়েছিল। আসলে তাহেরের বন্ধু আর নিলার বান্ধবীর মধ্যে প্রেম ছিল। সেদিন দুজনেই এসেছিল বন্ধুকে সংগ দিতে। কে জানত এখানেই মনের মানুষের সাথে দেখা হয়ে যাবে। ওদের বন্ধু বান্ধবীর সম্পর্ক টিকেনি ঠিকই কিন্তু ওদেরটা বেশ মিলে গিয়েছিল।
খয়েরি রংয়ের একটা শার্ট আর কালো প্যান্ট পড়ে ছিল তাহের। আর নিলা পড়েছিল গোলাপী রঙের সালোয়ার কামিজ। প্রথম দেখাতেই দুজনকে দুজনার ভাল লেগে যায়। তাহের তার বন্ধুর কাছ থেকে নিলার বান্ধবীর মাধ্যমে নিলার মোবাইল নাম্বারটা যোগাড় করে এবং ঠিক একই রকম করে নিলা। তারপর কি থেকে যে কি হয়ে গেল। ওরা যখন বুঝল, তখন জানল ওরা একে অপরকে ছাড়া বাঁচবে না।
নিলার অনেকক্ষন ধরেই বাথরুম পেয়েছে কিন্তু ওর উঠতে ইচ্ছে করছে না। তাহেরটা এখনো কেন যে আসছে না। আমাকে ফেলে রেখে বাইরে গিয়ে নিজে মজা করে বেড়াচ্ছে, ভাবে নিলা। আজকে আসুক, খাটিয়ে মারব একদম। নিলা ভিতরে ভিতরে খুশি হয় এবার।
নিলা যখন ভাবে এবার বাথরুম না গেলেই নয়, বিছানা থেকে উঠতে যাবে ঠিক তখন কলিংবেল বেজে উঠে। তাহের এসেছে মনে হয়, নিলা হাঁক দেয়,
-শাহীনা দেখত কে এল?
-দেখতাছি খালাম্মা।
তাহের ঘরে ঢুকতেই জেরা শুরু করে নিলা।
-দেরি কেন হল তোমার?
-এই আর কি।
-কেন দেরি হল সেটা বল।
-না মানে, দুইটা টিউশনি শুরু করলাম।
-টিউশনি? আবার? কোথায়?
-এইত বাসার কাছেই।
-আইসক্রিম এনেছ?
-হুম। এনেছি।
এবার তাহের জেরা শুরু করে।
-দুধ খেয়েছ?
-নাহ।
-কেন?
-আমার ইচ্ছা।
-মানে?
-আমার ইচ্ছা হয়নি তাই খাইনি। বমি বমি লাগে।
-ডাক্তার খেতে বলেছে শুন নাই?
-বয়ে গেল।
-তুমি এরকম করলে তো আমি যা ইচ্ছা করে বেড়াব।
-ধুর। আমাকে ধর। আমি বাথরুম যাব।
তাহের এগিয়ে গিয়ে নিলাকে ধরে ধরে বাথরুমের কাছে নিয়ে যায়। নিলা এমনিতে এরকম করে না, অন্যের খোঁজ নেওয়া কিংবা সেবা করাই ওর কাজ। কিন্তু এখন অবস্থা ভিন্ন। নতুন সমস্যা বলতে আজকাল হঠাৎ হঠাৎ নতুন কিছুর জন্যে আবদার করে বসে। সেটা সে মূহুর্তে না দিলেই নয়, বাসা মাথায় করে ফেলে। এই যেমন আইসক্রিম, চকলেট ইত্যাদি। তাহের যা আয় করে তাতে দামি কিছু আনা দুষ্কর হয়ে পড়ে। তবু আনে তাহের, দরকার হলে অফিস যাওয়ার সময় রিক্সা নেয়না কিংবা দুপুরে লাঞ্চ করে না।
নিলা বাথরুম থেকে বের হলে তাহের গোসল করার জন্যে বাথরুমে ঢুকে। এটা তাহেরের রোগ বলা যায়, হাজার শীতেও সে অফিস থেকে ফিরে গোসল করবেই। এমনকি গরমের দিনেও গরম পানি দিয়ে গোসল করবে। অফিস থেকে ফিরে গোসল করলে তাহেরের অনেক ঝরঝরে মনে হয়। ঢাকা শহরের সব ময়লা নিমিষেই ঝেড়ে ফেলা যায়। আজকাল শহরটার যা অবস্থা।
বাথরুম থেকে ফিরে তাহের নিলাকে বলে,
-চল খাবে।
-আমার খেতে একদম ইচ্ছে করে না।
-তাও খেতে হবে। ডাক্তার বলেছে।
-ছাই ডাক্তার।
-কাল একবার চেকাপ করার জন্যে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব তোমাকে।
-কাল কিন্তু শুক্রবার। বাথরুমের সমস্যাটা ঠিক কর। গন্ধে থাকা যায় না।
-বাড়িওয়ালাকে বলেছিলাম। আমাকেই ঠিক করতে হবে।
-বাড়িওয়ালা বজ্জাত। তোমাকে তখনই বলেছিলাম। চল এ বাসায় থাকব না।
-এ অবস্থায়। তোমার মাথা খারাপ হয়েছে।
-হুম।
-চল খাবে।
তাহের নিলার এ অবস্থায় সাধারনত সংসারের কথা আলোচনা করতে চাই না। তবু নিলার জন্যে করা হয়ে যায়। বাচ্চা হওয়ার জন্য নিলার চাকরিটা ছেড়ে দিতে হল। বেসরকারী কোম্পানী। মাতৃকালীন ছুটি দিবে না। কেস করা দেওয়া উচিত ছিল, ভাবে তাহের। এখন সংসারটা চলে তাহেরের একার আয়ে। বাড়ি ভাড়া দিয়ে খুব সামান্যই বাকি থাকে সংসার চালানোর জন্যে। টিউশানি দিয়ে সেটা পুষিয়ে দেওয়ার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে তাহের। এখন তাদের সব কিছুর শুরুতেই নতুন মানুষের আগমনের চিন্তা। পৃথিবীর নিয়মটাই যে তাই, ভাবে তাহের। নিলাকে তাড়াতাড়ি রাতের খাবার দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়ার চিন্তা করে তাহের। ও কিছুক্ষন জেগে থাকবে, রাতে ওর কিছু কাজ আছে; সেগুলো শেষ করেই ঘুমুতে যাবে সে।
6 Responses to ধারাবাহিকঃ নিশিযাত্রা (পর্ব ৩)
You must be logged in to post a comment Login