জুলিয়ান সিদ্দিকী

ধারাবাহিক উপন্যাস: কালসাপ-১৩

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

হাবিলদার কাশেমের নির্দেশে হোসেন মৃধা দেলু আর ফালুকে নিয়ে সিদ্ধেশ্বরী গ্রামের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে এসেছে। এটা তার প্রশিক্ষণেরই একটি অংশ। তার অজ্ঞাতে আরো তিনজনের একটি দলকেও সেখানে পাঠানো হয়েছে পরে দুগ্রুপের বর্ণনায় কতটা মিল থাকে তারই পরীক্ষা হবে। আর এতে উত্তীর্ণ হতে পারলে সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ দায়ীত্ব পাবে তাদের দলটি।

হোসেন মৃধা সিদ্ধেশ্বরী গ্রামটির উত্তরাংশ দিয়ে মকিমপুর গ্রাম হয়ে খাল পেরিয়ে ঢুকতে গেলে প্রথমেই তার চোখে পড়ে যে, খালের ওপর বাঁশ অথবা কাঠ দিয়ে একটি চওড়া পুল বানানো হয়েছে। আর পুলের গোড়ায় কিছু মানুষের উপস্থিতিও ধরা পড়ছে মনে হলো।

ফালু আর দেলুকে সে জিজ্ঞেস করলো, এইডা কি পুল বানাইছে?

দেলু জানালো, হ। যেদিন পাইক্যারা আইয়া ইস্কুল ঘরে উঠছে হেইদিনই পুল বানাইছে। পুলের দুই মাথায় আবার পাহারা আছে দুই গ্যরামের কিছু মানুষ।

বন্দুক আছে কারো কাছে?

না। বন্দুক-টন্দুক দেহি নাই।

হোসেন মৃধার কিছুটা ভয় ভয় লাগে। করিমপুর গ্রাম থেকে কেউ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে এ পর্যন্ত এমন কথা শোনা যায়নি। তাই নিজেদের যতটা আড়াল রাখা সম্ভব তেমন আড়াল নিয়ে ওরা খাল পেরিয়ে ঢুকে পড়লো সিদ্ধেশ্বরী গ্রামে।

হোসেন মৃধা দুই চোর নিয়ে এলেও তাদের উপর কোনো ভরসা করে আসেনি। এ এলাকা মোটামুটি তার পরিচিত। কোনদিক দিয়ে গেলে কতটা নিরাপত্তা পাওয়া যাবে তা সে ভালোমতই বোঝে। এ গ্রাম এবং আশপাশের গ্রামের মানুষদের দুর্দশার জন্য মূলত মতি মাওলানা আর দেলোয়ার কারিই দায়ী। মনেমনে সে মতি মাওলানা অথবা দেলোয়ার কারিকে লক্ষ্য বানিয়ে এ গ্রামে ঢুকেছে।

মতি মাওলানার বাড়ির সীমানার ভেতর চলে এলেও ওরা কোনো মানুষের সাড়াশব্দ পায় না। তাহলে কি কেউ বাড়িতে নেই? হোসেন মৃধা অবাক হয়ে ভাবলেও তার আরেক মন বলে, রাত বলে হয়তো জায়গা বদলে থাকতে পারে। হাসন আলি বলছিলো যে, মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ কেউ সামনা সামনি আঘাত করার চেয়ে চোরাগোপ্তা হামলা করে বিশেষ বিশেষ শত্রুদের মারছে। কিন্তু কাজটা বেশ কঠিন বলেই অগ্রগতি তেমন একটা হচ্ছে না। ঠিক এমনই একটি উদ্দেশ্য নিয়ে অগ্রসর হলেও সে সুবিধা করে উঠতে পারে না। মতি মাওলানার বাড়ি শূন্য। তারপর দেলোয়ার কারির বাড়িতে গেলে সেখানে কয়েকটি কুকুরের চিৎকারে আগাতে না পেরে ভিন্ন পথ ধরে ওরা। কিন্তু পেছন দিকে টর্চের উজ্জ্বল আলো তাদের আরো বেশি শঙ্কিত করে তোলে। তবে ভরসা খানিকটা হলো এই যে, রাজাকারের বাড়ি বলে লোকজন রাতের বেলা বাড়ির সীমানা ছেড়ে বেশি দূর এগোতে সাহস পায় না। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে পড়লে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুবই কম।

খানিকটা দূর থেকেই ঘন পাটক্ষেতের আড়াল থেকে স্কুল ঘরের কেরসিনের হ্যাজাক বাতির আলোতে মানুষের নড়াচড়া দেখতে পাওয়া যায়। তবে তাদের আকৃতিতে পাকি বলেই মনে হয়। স্কুলের মাঠেও বেশ কিছু আড়াল চোখে পড়েছে। শোনা যায় ওগুলো মাটি ভর্তি চটের বস্তা। চারদিক প্রাচীরের মত করে মাটিভর্তি বস্তা দিয়ে নিজদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করেছে পাকিগুলো। যাতে করে হঠাৎ আক্রান্ত হলেও নিজেদের সামাল দিতে পারে।

এমন পরিস্থিতিতে গুলি করার চেয়ে হাতবোমা বেশি কার্যকর বলেই মনে হয় হোসেন মৃধার কাছে। স্কুল মাঠের উত্তরাংশে প্রায় সবগুলো জমিই পাটক্ষেত বলে আড়াল পাওয়া যাবে। আর পেছনের দিকে অনেকটা খাড়া হয়ে জমিগুলো নিচের দিকে নেমে গেছে বলে সেখানেও ভালো আড়াল পাওয়া যাবে।

হঠাৎ করেই একটি নারী কণ্ঠের আর্ত চিৎকার হোসেন মৃধাকে সচকিত করে তোলে। সে স্কুলঘরের দিকে ভালো করে তাকায়। সেই সঙ্গে দেলু আর ফালুও কিছুটা নড়েচড়ে ওঠে। কিন্তু যেদিক থেকে চিৎকারটি ভেসে এসেছে সেদিকে কোনো আলো নেই। অথবা স্কুলের কোনো একটি দালান ঘরের বদ্ধ জানালার আড়ালেই চিৎকারটির সৃষ্টি।

হোসেন মৃধা ব্যাপারটি হৃদয়ঙ্গম করার আগেই দেলু ফিসফিস স্বরে বলে উঠলো, মনে কয় কোনো মাইয়া মানুষ ধইরা আইন্যা দালান ঘরের ভিতরে আটকায় থুইছে!

ব্যাপারটি জানা ছিলো না হোসেন মৃধার। কিছুক্ষণ পরই আরো তীব্রভাবে আর্তচিৎকার ধ্বণিত হয়। ব্যাপারটি কল্পনা করতে গিয়ে পুরো শরীর থরথর করে কেঁপে ওঠে তার। মানস পর্দায় ভেসে ওঠে জুলেখা, মমতা আর চান্দভানুর মুখ।

তার বারবার ইচ্ছে হচ্ছিলো এখনি ছুটে গিয়ে পাকিদের টুঁটি চেপে ধরতে। তাই এখানে আর এক মুহূর্তও তার থাকতে সাহস হচ্ছিলো না। বলা যায় না, নারী কণ্ঠের চিৎকারে কখন বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে নির্বোধের মত কিছু একটা করে বসতে পারে। আসার সময় হাবিলদার কাশেম পইপই করে বলে দিয়েছেন, এমন কিছু করা যাবে না যে, পাকি অথবা রাজাকারকারদের হাতে ধরা পড়তে হয়। প্রাণ থাকতে তাদের হাতে ধরা দেয়া যাবে না। ধরা পড়লে তারা তাদের নিশিন্দার জঙ্গলের কথা জানার জন্য নানারকম অত্যাচার করবে। অত্যাচারের মুখে অনেক কঠিন মানুষও গোপন কথা ফাঁস করে দিতে বাধ্য হয়েছে। সুতরাং যা করার সবই ঠাণ্ডা মাথায় করতে হবে।

হোসেন মৃধা হঠাৎ বলে উঠলো, চল ফিরা যাই!

যে পথে এসেছিলো, সে পথে না গিয়ে তারা অনেকটা ঘুরপথ দিয়ে চলতে থাকে। চলতে চলতে দেলু আর ফালু জানায় নানা ধরনের বিচিত্র কাহিনী।

স্কুল মাঠের পাশ দিয়ে খালের যে অংশটা আছে, তার পাশেই আছে বিরাট এক গর্ত। প্রতিদিনই মানুষ মেরে মেরে সে গর্তে ফেলে। আশপাশের গ্রামগুলো থেকে অনেক মেয়েকে ধরে এনেছে তারা। যাদের অনেকই তাদের অত্যচার থেকে বাঁচতে গলায় ফাঁস দিয়ে মরেছে। কেউ কেউ এমনিতেই অত্যাচারে অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে মারা গেছে।

দেলু আর ফালুর বর্ণনা শুনতে শুনতে বারবারই শিউড়ে উঠছিলো হোসেন মৃধা। সে বললো, তরা এত কথা জানলি ক্যামতে?

ইস্কুলের দপ্তরি মন্নান কইছে। হ্যায়তো পাইক্যাগোরে খাওয়ায়। যেই মাইয়ালোকগুলারে ধইরা আনছে তাগোরেও দুই বেলা খাওন দেয়!

হোসেন মৃধা আর কিছু শুনতে চায় না। ইচ্ছে হয় দুহাতে কান চেপে ধরে। আর তখনই তার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে মতিউর রহমান আর দেলোয়ার কারির উপর। ওরা যদি পাকিদের পথ না দেখাতো তাহলে তাদের হাতে নিরীহ মানুষগুলো মারা পড়তো না। মেয়েরা নির্যাতিত হতো না। মানুষের ঘরবাড়িও হয়তো আগুনে পুড়তো না।

নিশিন্দার জঙ্গলে ফিরে এলে হাবিলদার কাশেম তাকে বললেন, কি দেইখ্যা আইলা মিরধা?

তার পর্যবেক্ষণ বর্ণনা দিতে দিতে স্কুল ঘরের বর্ণনা দিতে গিয়ে এক সময় ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে হোসেন মৃধা! বলে, রাজাকার শুয়োরের বাচ্চাগুলান যদি পাইক্যাগোরে পথ না দেখাইতো তাইলে বুঝি আমাগ দেশের এমন অবস্থা হইতো না! মাইয়া মানষ্যের কাইলজা ফডাইন্যা চিক্কুর হুনলে আপনেও ঠিক থাকতে পারবেন না ওস্তাদ! যত তাড়াতাড়ি পারেন কিছু একটা করেন!

যাও তুমি! বিশ্রাম লও গিয়া!

হোসেন মৃধা তবুও নড়ে না। আর তা দেখে হাবিলদার কাশেম বললেন, আমিও এই খবর পাইছি। আর তার লাইগ্যাই আমরা ঠিক করছি তাড়াতাড়ি অপারেনশনে যামু। পান্তার বাজারে দুইদিন পরেই দুইশ জন মুক্তিবাহিনী যাইতাছে। আমরাও সিদ্ধেশ্বরী ইস্কুলে দুইদিন পরেই অ্যাটাক করমু ঠিক করছি! আইজ কিছু অ্যামুনিশান আইতাছে। চিন্তার কোনো কারণ নাই। মন শক্ত কর!

হোসেন মৃধা হুঁকা টানতে টানতে গভীর ভাবনায় তলিয়ে গেলে ব্যাপারটা দেখতে পেলেও চান্দভানু কিছু বলে না। তবে বুঝতে পারে যে, খুব কঠিন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই কেবল মানুষটি এরকমভাবে ক্রমাগত হুঁকে টানতে থাকে। মনেমনে চান্দভানু ঠিক করে রেখেছে, যে করেই হোক তার মতি ভাইকে প্রাণে মারতে দেবে না কাউকে। প্রয়োজনে যুদ্ধের নিয়ম উপেক্ষা করে হলেও কাজটি সে করবে। হোক না একই মায়ের পেটের ভাই নয়। কিন্তু তার পিতার সন্তান। তার শরীরেও বইছে একই রক্ত।

(চলবে)

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


6 Responses to ধারাবাহিক উপন্যাস: কালসাপ-১৩

You must be logged in to post a comment Login