ধারাবাহিক উপন্যাস: কালসাপ -২
বোন এবং ভাগ্নির মুখ থেকে টুকরো টুকরো অমূল্য বাণী সংগ্রহ করে মনেমনে জোড়া দিয়ে মতিউর রহমান বুঝতে পারেন যে এখানেই বাঘের ঘরে ঘোগের বাসার মতো ধীরেধীরে হলেও একটি রেডিওকে কেন্দ্র করেই কোনো এক সময় রোপিত হয়ে যাবে বিপ্লবের সেই অবিনাশী রক্তবীজ। আর তখন শত প্রতিরোধেও তিনি রুদ্ধ করতে পারবেন না এ অঞ্চলের মানুষের মনে জেগে ওঠা মুক্তির অমোঘ আহবান। ভেবেছিলেন, এই পাঁচ-দশ গ্রামের ভেতর কেবল তিনিই জানেন যে, কিছু দেশদ্রোহী পাকিস্তান ভেঙে টুকরো করার ষড়যন্ত্রের রূপরেখা সারা পূর্ব-পাকিস্তানে ছড়িয়ে দিতে নানা ফন্দি-ফিকির করছে। জায়গায় জায়গায় মুক্তিযোদ্ধা নামের কিছু বদমাশ পাকিস্তান প্রেমিক আর তার রক্ষীদের চোরাগোপ্তা হামলা করে নাস্তা-নাবুদ করছে। সুযোগ পেলে যাকে পাচ্ছে তাকেই খুন করছে। অথচ তার ধারণাকে মিথ্যে প্রমাণ করে দিয়ে সেই রক্তবীজ মুসলিম লিগের একনিষ্ঠ কর্মী ও ধারক পিতার দ্বিতীয় পক্ষের কন্যার ঘরেই অঙ্কুরিত হচ্ছে বলে মুহূর্তেই নিজের করণীয় স্থির করে ফেললেন তিনি।
নানা কথার বায়নাক্কা সেরে অকস্মাৎ তিনি বলে উঠলেন, বইনরে আসলে যেই কামে আমি এইখানে আইছিলাম কথার মাইর প্যাঁচে পরে কইতে ভুইল্যা যাইতে পারি।
খানিকটা সন্দেহ নিয়ে চান্দভানু বলে, কোন কথা ভাইজান?
মতিউর রহমান খুবই দ্রুত আর সাবধানতায় আসল কথায় চলে আসেন। বললেন, বইন, বিয়ার সময় বাজানে তরে একটা রেডিও দিসিলো না?
হ। কথাটা বলতে পারলেও চান্দভানুর বুকের ভেতরটা কেন যেন দুরুদুরু করে কেঁপে উঠলো হঠাৎ। অদৃশ্যে কোনো এক অশুভ ছায়ার নড়াচড়ায় তার কান দুটো হয়ে ওঠে সতর্ক। দৃষ্টি হয় তীর্যক।
মতিউর রহমান বললেন, ঠিক মত বাজে তো? আন দেখি কেমন চলে?
চান্দভানু বা হোসেন মৃধা কিছু বলার আগেই জুলেখা রেডিও নিয়ে এসে মতিউর রহমানের হাতে তুলে দেয়। আর রেডিওটা হাতে পেয়েই মতিউর রহমান তার দুর্বিনীত জাল বিছাতেই যেন বলে, রেডিওডা কয়দিনের লাইগ্যা আমারে দে। বাইত্যে নিয়া যাই। শহরের গণ্ডগোল মিটলে নিজের লাইগ্যা একটা আনতে যামু। তহন তর রেডিও তুই ফেরত পাইয়া যাবি।
চান্দভানু ঠিকই বুঝতে পারে যে, তার ভাই এই রেডিও ফেরত দেওয়ার জন্য নিতে আসেননি। হাসন আলির কাছে খবর আছে যে, মতিউর রহমান তার আশপাশের এলাকায় একটি শান্তি কমিটি করবেন। পাকিস্তান ঠিক না থাকলে ইসলাম ধর্মও ঠিক থাকবে না। দেশে যাতে শান্তি বজায় থাকে গোলাম আজম না গোলাম রজম নামের কোনো এক নেতা গ্রামে গ্রামে শান্তি কমিটি করে এলাকার শান্তি প্রতিষ্ঠায় দেশপ্রেমিক আর পাকিস্তানের সাচ্চা নাগরিকদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। ঠিকঠাক মত দেশে শান্তি ফিরে এলে তিনি মুসলিম লিগ থেকে ভোটে দাঁড়াবেন। আর মুসলিম লিগ চায় না পূর্ব-পাকিস্তানের বাঙালীরা মাথা তুলে দাঁড়াক। সে সঙ্গে শেখ মুজিব নামের ভারতের দালালটিও যেন ক্ষমতার আশপাশে ভিড়তে না পারে।
দেশের রাজনীতি না বুঝলেও নিজের জন্মভূমিকে বুঝতে কোনো নেতা-মন্ত্রী হতে হয় না। হাসন আলির কথায় চান্দভানু ঠিকই বুঝতে পারে যে, যারা বাঙালীদের তাদের মাতৃভাষায় কথা বলতে দিতে চায় না। নিজের দেশের জিনিসে যাদের অধিকার দিতে চায় না, জন্মভূমিতে মুসলমান হয়েও যারা অন্য মুসলমানের চোখে কাফের আর মালাউন হয়ে যায়, তারা যত ভালো আর মিষ্টি কথাই বলুক না কেন, মানুষ হিসেবে ভালো অন্তত হতে পারে না তারা। যাদের ভাবনায় দিনরাত নাচে স্বার্থের চাঁদতারা। হাসির ভেতর লুকানো থাকে রক্ত লোলুপ ধারালো ছুরি, তাদের কথায় কিছুতেই বিভ্রান্ত হলে চলবে না। লেখাপড়া জানা না থাকলেও এতটুকু বুঝতে কোনো অসুবিধা হয় না চান্দভানুর। তাই সে সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠলো, বাজানের সব তো আপনেই গিল্যা খাইলেন। যাও একটা বাজানের হাতের চিহ্ন আমার কাছে আছে এইডার উপরেও আপনের চোখ পড়লো?
হাসিমুখে মতিউর রহমান বললেন, কইলাম না ফেরত দিয়া দিমু!
মতিউর রহমান রেডিও হাতে উঠে দাঁড়ালে চান্দভানু কেমন ক্ষেপে উঠে বললো, রেডিও আমি দিমু না! আর এ কথা বলেই সে মতিউর রহমানের হাতে ধরা রেডিওর দিকে হাত বাড়ালেও সেটার নাগাল পায় না। এ নিয়ে দু’ভাইবোনে কিছুক্ষণ কাড়াকাড়ি চললে মতিউর রহমান অকস্মাৎ রেডিওটিকে মেঝের উপর আছড়ে ফেলেন। রেডিওটার প্রতিটি অংশই যেন ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। তবুও যেন প্রবল আক্রোশে মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা যন্ত্রাংশগুলোকে জুতোর তলায় আরো চূর্ন করতে করতে বলেন, আমার কথার কোনো ইজ্জত যখন তর কাছে নাই, তাইলে বাজানের কোনো চিহ্নও তর থাকনের কাম নাই! মনে করিস বাজানের লগে আমার লগে তর আর কোনো সমন্ধ নাই!
ঘটনা এতটা দ্রুত ঘটলো যে হোসেন মৃধা বা জুলেখা কিছু বুঝে উঠবার আগেই রেডিওটার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। চান্দভানু গুঁড়িয়ে ফেলা রেডিওর যন্ত্রাংশ কুড়োতে কুড়োতে বাচ্চাদের মত ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলো।
মতিউর রহমান কোনোদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে মাথা উঁচু করে ঘর থেকে বেরিয়ে দরাজ কণ্ঠে বলে উঠলেন, আজম কইরে! চল যাই!
চোখের উপর পুটলির মত করে গামছাটা চেপে ধরে যন্ত্রণা লাঘবে সচেষ্ট ছিলো আজম। কিন্তু মতিউর রহমানের কণ্ঠস্বরে তার যন্ত্রণাকে না লুকিয়ে উপায় থাকে না। যে কারণে মতিউর রহমানের সামনে সে আহত চোখের ওপর হাতও রাখতে পারছিলো না। কিন্তু নিদারুণ যন্ত্রণায় আপনা আপিনিই তার ডান চোখ বুঁজে এলে সে অবস্থাতেই সে লগি হাতে নৌকায় উঠে গলুইয়ে দাঁড়ায়।
মতিউর রহমান তার মিশন শেষ করে মনেমনে আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলতে তুলতে নৌকায় এসে বসে ভাবছিলেন যে, মালাউন আর কাফের শেখ মুজিব আর তার চেলা-চামুণ্ডাদের কোনো অপকর্মের সংবাদ আশপাশের গ্রামগুলোর কেউ আর জানতে পারবে না।
চোখের ব্যথার কারণে যে গতিতে নৌকা চালিয়ে এসেছিলো, তার অর্ধেক গতিতেও ফিরতে পারে না আজম। কিছুক্ষণ পরপর এক হাতে ডানচোখের ওপর চাপ দিয়ে যন্ত্রণা প্রশমিত করার কারণে নৌকা প্রায় থেমে থেমে যাচ্ছিলো। এমন অবস্থা দেখে মতিউর রহমান বলে উঠলেন, তর হইলো কি?
তড়িৎ আজম জানায়, ডাইন চক্ষে কি জানি পড়ছে। খুবই যন্ত্রণা হইতাছে।
যন্ত্রণা কি বেশি?
হুঁ। চোখ মেইল্যা রাখতে পারতাছি না।
তাইলে লগি আমারে দিয়া তুই বয়।
আজম মতিউর রহমানের হাতে লগি তুলে দিয়ে এতক্ষণ মতিউর রহমান যেখানটায় বসেছিলেন সেখানে গিয়ে বসলো আজম।
আত্মতৃপ্ত মতিউর রহমান নৌকা বাইতে বাইতে ভেতরে ভেতরে বেশ কিছুটা উত্তেজনা বোধ করেন। তার মনে ভাবনা উথাল-পাথাল করছে যে, কোনোক্রমে যদি ভোটে জিতে যেতে পারেন তো চান্দভানু আর তার স্বামী-সন্তানকে ভিটাছাড়া করবেন আগে।
(চলবে)
9 Responses to ধারাবাহিক উপন্যাস: কালসাপ -২
You must be logged in to post a comment Login