জুলিয়ান সিদ্দিকী

ধারাবাহিক উপন্যাস: কালসাপ-৫

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

ক্ষত শুকিয়ে গেলেও তার দাগ অনেক দিন পর্যন্ত থেকে যায়। তেমনি এতদিন যারা যারা রেডিওতে বিভিন্ন সংবাদ আর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নানা অনুষ্ঠান শুনতে আসতো, হোসেন মিয়ার রেডিও না থাকলেও সবাই আগের অভ্যাস মত একই সময়ে চলে আসে।

এখানে আসার পর যে যেমন সংবাদ শুনেছে তা গুজব হোক আর সত্য হোক সবই একে অন্যের সঙ্গে বিনিময় করে। তবে তাদের আলোচনায় প্রাধান্য পায় মতিউর রহমানের বিভিন্ন কার্যকলাপ আর পান্তার বাজার। সে সঙ্গে নিয়ম মত চান্দভানু আর জুলেখাও উৎকর্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আলতা বেড়ার অন্ধকার আড়ালে।

উপস্থিত লোকজনের আলোচনা থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে ফুটে ওঠে যে, মতিউর রহমান শান্তি কমিটির সদস্য তালিকা বানিয়ে তুলে দিয়েছেন তার ওস্তাদ মাওলানা মান্নান দেওবন্দির হাতে। সে তালিকায় আছে হোসেন মৃধার নাম। আছে হাসন আলির নাম। এমন কি মজিবর মাস্টারের নামও বাদ পড়েনি। কিন্তু খবরের সত্যতা নিয়ে হোসেন মৃধার মনে সন্দেহ দেখা দিলে হরি ঘোষ জানায়, খবর পাক্কা। কোনো ভুল নাই!

এই খবর পাইলা কেমনে? হোসেন মিয়ার অস্থির কণ্ঠস্বরেই হয়তো অনেককে খানিকটা নড়েচড়ে বসতে দেখা যায়।

হরি ঘোষ একই পশুর চিকিৎসা করলেও খুব দায়ে না পড়লে মানুষের চিকিৎসা করে না। কিন্তু আলতাব মুহুরি বেশ ক’দিন ধরে বাতের ব্যাথায় প্রায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়লে বাধ্য হয়ে যেতে হয় হরি ঘোষকে। দিনে দু’বেলা অবস্থা পর্যবেক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে এলাকার পরিস্থিতি আর নানাবিধ সংকট নিয়েও কথাবার্তা চলে। আর সে কথাবার্তার এক ফাঁকেই মুহুরি জানিয়েছে যে, শান্তি কমিটির তালিকা তাকে দিয়ে লিখিয়েছেন মতিউর রহমান।

হরি ঘোষের কথায় মনে হয় খুব একটা খারাপ না। ব্যাপারটা তাহলে মোটামুটি বিশ্বাসযোগ্য। তাই হোসেন মৃধার মুখ থেকেও যেন কথাটি বেরিয়ে আসে, তাইলে খুব একটা মন্দ না! কি কন আপনেরা?

হরি ঘোষ তখনই বলে ওঠে, মিরধা, কাজডা খুব একটা ভালা হইছে বইল্যা আমি মনে করি না। মুক্তিরা আইলে সবতের আগে তোমারেও ধরতে পারে। গুল্লিও কইরা দিতে পারে ঠিক নাই! আইজগা তো হুনলা যে, আট-দশদিনের ভিতরেই পান্তার বাজার দখল নিতে মুক্তিরা আইতাছে!

নিজের বিপদ নিয়ে তেমন একটা ভাবে না হোসেন মৃধা। তার যত ভাবনা স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে। তাই হয়তো সে অনায়াসেই বলতে পারে, আমারে যহন গুল্লি দিতে আইবো তহন দেখা যাইবো!

এমন ধরনের আলাপ আলোচনায় আসরটা প্রতিদিনই গমগম করতে থাকে। কখনো কখনো তাদের এও আক্ষেপ করতে শোনা যায় যে, তারা দেশের বা মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো উপকারেই লাগতে পারছে না!

তবে তারা প্রতিদিনই এমন মনখুলে আলাপ করতে পারে না। মাঝে মধ্যে দু’একটা অচেনা মুখ ভেসে উঠতে দেখা যায়, যারা কোনো কথাই বলে না। চুপচাপ কথা শোনে। নাম-ধাম-পরিচয় জিজ্ঞেস করলে যে উত্তর দেয়, তা অনেকের কাছেই পরিষ্কার মনে হয় না।

মজিবর মাস্টার প্রায় মাঝরাতের দিকে এসে হোসেন মৃধাকে জানালো যে, মতিউর রহমান, কারি দেলোয়ার আর তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা মিলে গিয়েছিলো পান্তার বাজারে। অপারেশন অফিসার ইকবালের সঙ্গে দেখা করে নাকি তারা তাদের কমিটির কথা আর হিজবুল্লার কথা জানিয়েছে। অস্ত্রপাতির অভাবে তারা কাফের আর মালাউনদের শায়েস্তা করতে পারছে না।

মেজর ইকবাল খুশি হয়ে জানতে চেয়েছিলো যে, মমিনউদ্দিন মেমোরিয়াল স্কুলে ঘাঁটি বানালে মাঝে মধ্যে ডাল আর হাঁস-মুরগি বা গরু-ছাগলের ব্যবস্থা করতে পারবে কি না।

মতিউর রহমান দীর্ঘদিন মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেছেন বলে, বেশ উর্দু বলতে পারেন। তাই মেজর ইকবালও নাকি তার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলেছিলো, তোমারা উর্দু জবান সহি হ্যায়!

হোসেন মৃধা মজিবর মাস্টারের কথায় খুব বিচলিত বোধ করলেও তা প্রকাশ করে না। সে বলে, তাইলে তো বিপদ আরো বাড়বো।

মজিবর মাস্টার বললো, তাইলে যাই। আর হোনো, আমি যদি দুই চাইরদিন না আইতে পারি বেশি চিন্তা কইরো না। আর যার তার লগে সব কথা কইয়ো না। এহন গ্যারামে গ্যারামে অনেক ফেউ বাইর হইছে। মানুষের লগে খাতির কইরা পেটের কথা বাইর কইরা নিয়া যায়।

খানিক পরই মজিবর মাস্টার অন্ধকারে হারিয়ে যায়। পেছন থেকে চান্দভানু বললো, মাস্টরে কইলো কি?

ইস্কুলে পাইক্যারা আস্তানা বানাইলে হ্যাগো গোস্তের আর ডাইলের যোগান মানুষের বাড়ি থাইক্যাই নাকি দিতে হইবো।

চান্দভানু কি বলবে ভেবে পায় না। তার খোঁয়ারে হাঁস-মুরগির সংখ্যা খুব একটা বেশি না। মাঝে মধ্যে রাতের অন্ধকারে হাসন আলি এলাকা ঘুরে অবস্থা জানতে আসে। তখন সুযোগ মত একবার এসে তার সঙ্গে দেখা করে যায়। কথাটা সে হোসেন মৃধাকে জানাতে নিষেধ করেছে। আগামী কাল রাতে আসার কথা হাসন আলির। তাই সে মনে মনে ঠিক করে তার পোষা হাঁস-মুরগি কেন খারাপ লোকেদের আহার হবে। প্রতিদিন একটি করে নিজেরাই খেয়ে নেবে। আর হাসন আলির বন্ধুদের জন্য রান্না করে হাঁড়িতে করে দিয়ে দিলেই হবে।

পরদিন সকালের দিকে উঠোনে তিনটি হাঁস বাঁধা অবস্থায় দেখতে পেয়ে হোসেন মৃধা চান্দভানুকে বললো, তিনডা হাঁস বাইন্ধা রাখলি যে?

আয়েন এডিরে জবাই দেইবলেই চান্দভানু জুলেখাকে ডাকে, জোলেখা, দাওডা আন দেহি!

হোসেন মৃধা অবাক হয়ে বলে, তিনডা হাঁস খাইবি কয়দিনে?

হেই চিন্তা আপনের করতে হইবো না। বলতে বলতে ঘর থেকে দা এনে হোসেন মৃধার হাতে তুলে দেয় চান্দভানু।

পাখা সমেত ঠ্যাং দুটো একহাতের মুঠিতে ধরে আরেক হাতে হাঁসের গলার শিরা সহ চামড়া চেপে ধরে চান্দভানু বললো, গরু দুইডা কি ব্যাচন যাইবো?

হোসেন মৃধা অবাক হয়ে বললো, গরু ব্যাচনের কথা উঠতাছে ক্যান?

বিপদ আপদের কথা কওন যায় না। পাইক্যারা যদি ইস্কুলে আইয়া উডে আর আমরা কোনো কারণে বাইত্যে থাকতে না পারি তাইলে গরু দুইডারে কে না কে নিয়া যায় ঠিক ঠিকানা আছে?

হাঁসের গলায় দায়ের পোচ দিতে দিতে হোসেন মৃধা বললো, চাইরো দিগের যা অবস্থা গরু কিননের মানুষ পামু কই? আর অহন তো জমিতে পানি মানুষ গরু কিনতে চাইবো?

রক্ত যাতে গায়ে এসে না পড়ে সে সাবধানতা অবলম্বন করে চান্দভানু ফের বলে উঠলো, দাম যাই পান তাতেই বেইচ্যা দিয়েন। জন্তু দুইডা তো আমাগো চউক্ষের সামনে পাইক্যাগ হাতে পড়ন থাইক্যা বাঁইচ্যা যাইবো!

হোসেন মৃধা গরু বিক্রির কথা ভাবতে পারে না। কোনো রকমে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিতে পারলেও একটা কাজের কাজ হবে। ট্রেনিং অবস্থায় এখনই তাদের পুষ্টির প্রয়োজন আরো বেশি।

হোসেন মৃধাকে চুপ থাকতে দেখে চান্দভানু ফের বলে, কিছু কন না যে?

দেহি সময় সুযোগ পাইলে নিয়া যামু।

(চলবে)

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


15 Responses to ধারাবাহিক উপন্যাস: কালসাপ-৫

You must be logged in to post a comment Login