নীল নক্ষত্র

নক্ষত্রের গোধুলি-১

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

[একটি নিবেদনঃ বিশেষ কারণ বশত বিলাতের সাত সতে্র আপাতত দিতে পারছি না, আশা করছি কিছু দিনের মধ্যে পুনঃ আরম্ভ করতে পারব। সাময়িক বিরতির জন্য দুঃখিত। এর পরবর্তী উপন্যাস নক্ষত্রের গোধূলি শুরু করলাম যদিও এটি বেশ দীর্ঘ উপন্যাস, মোটা মুটি ১৫/১৬ পর্ব পর্যন্ত বিস্তৃত এর  ভুমিকা, আশা করি খারাপ লাগবে না।]

[প্রথম অধ্যায়]
রাশেদ সাহেব খাবার টেবিলে বসে ভাবছিলেন। সামনে চায়ের কাপ দিয়ে গেছে একটু আগে। তিনি ভাবছিলেন তার জীবনের কথা, অতীতের কথা, কি পেলাম আর কি পেলাম না, সংসারের কথা, তার তিন মেয়ের পড়া লেখা এবং ভবিষ্যতের কথা, কি হবার ছিল আর কি হলো, কি হতে পারতো, কি হলো না, কেন হলো না, কোন সুক্ষ কারু কাজ তার জীবনে এই সব ঘটাল সেই সব কথা। বাবা মার কথা, ভাই বোনের কথা, সমাজের কথা, তার সেই সব সোনালী দিন গুলির সেই সব স্বপ্নের কথা যার মিছে আশায় পথ চেয়ে আজো বসে আছে।

বাইরে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে, ভ্যাপসা গরম, মাথার উপর ফুল স্পিডে ফ্যান চলছে। চা কখন ঠান্ডা হয়ে গেছে সেদিকে তার খেয়াল নেই। ডাইনিং টেবিলে বসে রান্না ঘরের ওপাশের জানালা দিয়ে পাশের বাড়ির একটা নারকেল গাছ দেখা যায়। গাছটার মাথার দিকে তাকিয়ে আনমনে ভাবছেন। ঠান্ডা চা সে মোটেই সহ্য করতে পারে না কিন্তু আজ তার সেদিকে কোন খেয়াল নেই। এই যে একটু আগে চায়ের কাপটা দিয়ে গেল সে চা কোথা থেকে এসেছে তা সে জানে।

মনিরা হাসান, রাশেদুল হাসানের স্ত্রী। কদিন থেকেই রাশেদ সাহেবের মনটা খারাপ। আজ সকালে আরো খারাপ হলো যখন সে দেখলো মনিরা তার কাজের মেয়েটাকে দিয়ে পাশের দোকান থেকে বাকিতে ঠেঙ্গায় করে কিছু চাল আনাল। রাশেদ সাহেব তাকিয়ে শুধু দেখলেন। কিছু বললেন না। কিই বা বলবে, শুধু চাল কেন ঘরে কিছুই নেই। আসবে কোথা থেকে, আজ কত গুলি দিন যাবত তার কোন রোজগার নেই, লোকসান দিয়ে আর কত দিন ব্যবসা  টিকিয়ে রাখা যায়?সোনার হরিণের আশায় অনেক আগেই চাকরিটা ছেড়েছেন।

ব্যবসা করে সংসারের টানাটানির ঝামেলা কিছুটা কমিয়ে আনবেন, অভাবের দুয়ার বন্ধ করে সুখের দুয়ার খুলে দিবেন, দেশের উপকার করবেন, বেকারত্বের বোঝা কমিয়ে আনবেন এমন একটা আশা নিয়ে সরকারি প্রথম শ্রেনীর অফিসারের চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে এই ব্যবসা শুরু করেছিলেন। কিন্তু ‘অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকায়’ এই প্রবাদ শুধু তার একার জন্য নয় এতো অনেক পুরনো কথা। সুখ যার নিয়তির পছন্দ নয় চির অভাব যাকে আলিঙ্গন করে রেখেছে সে কেন এই প্রবাদের বিরুদ্ধে জয়ী হবে?তিনিও চাকরী ছেড়ে ব্যবসা শুরু করলেন আর নদীতেও চর পরলো। তিনি আবার যেমন তেমন ব্যবসা দাড় করাননি। অনেক দিন ভেবে, নানা রকম প্রযুক্তি সংগ্রহ করে, চতুর্দিক বিবেচনা করে, নক্সা দাড় করিয়ে সেই অনুযায়ী ব্যবসা আরম্ভ করেছিলেন। দোকানদারি নয়, ঠিকাদারি নয়, দালালি নয় কিংবা শেয়ার বাজারের শেয়ার কেনা বেচা নয় একেবারে উৎপাদন মুখী ব্যবসা। যাকে বলে মরা হাতিরও লাখ টাকা দাম। এই রকম একটা স্বপ্ন  নিয়ে একেবারে শিল্প পতি হতে চেয়েছিলেন। বাবার নাম ছড়াতে চেয়েছিলেন, বংশের হারান গৌরব উদ্ধার করে নিভে যাওয়া প্রদীপ আবার জ্বালাতে চেয়েছিলেন, হৃত ঐতিহ্য উদ্ধার করে আবার কৌলিন্য বহাল করতে চেয়েছিলেন।

নিজের উপর যথেষ্ট আস্থা ছিল। সুন্দর স্বাস্থ্য, কর্মঠ, কাজের প্রতি একাগ্রতা, ধৈর্য, দূর দৃষ্টি, জন সংযোগের আশ্চর্য ক্ষমতা অর্থাৎ সফল ব্যবসায়ীর যে সব যোগ্যতা থাকা উচিত তা তার মধ্যে সবই ছিল। তাহলে আর বাধা কোথায়?ব্যবসা শুরু করলেন। ক্লান্তি হীন ভাবে দিন রাত কাজ করে যাচ্ছেন এদিক ওদিক দৌড়া দৌরি করছেন, কিসে উৎপাদন খরচ কম হবে, উৎপাদন কেমন হচ্ছে, তার মান কোন পর্যায়ের, কর্মচারীরা কে কি করছে সমস্ত কিছুর দিকে তার তীখন দৃষ্টি। কর্মচারীদের যথেষ্ট সুযোগ সুবিধা দিতেন, তাদের যে কোন সমস্যা খুব মনযোগ দিয়ে দূর করার চেষ্টা করতেন। কর্মচারীরাও মন দিয়ে মালিকের জন্য কাজ করতো। কিন্তু হলে কি হবে বিধি যার বাম তারে রুধিবে কে?

স্বামী স্ত্রী দুজনে মিলেই কাজ করতেন। ফার্মের কারিগরী দিক সামাল দিতেন এবং তার সাথে ফার্মের আশে পাশে শাক সব্জী, ফুল, ফল ফলানো নিয়ে ব্যাস্ত থাকতেন রাশেদ সাহেবের স্ত্রী মনিরা হাসান আর বাইরে তাদের উৎপাদিত মালামাল বাজার জাত করা, কর্মচারীদের সুবিধা অসুবিধা ও অন্যান্য যাবতীয় প্রশাসনিক বিষয় সহ জন সংযোগ পরিচালন করতেন রাশেদ সাহেব স্বয়ং।

এছাড়া বাইরে বিভিন্ন সভা সমিতি বা সেমিনারে দুজনে এক সাথেই যেতেন। ফিরে এসে কে কি নিয়ে ফিরেছেন তাই নিয়ে দুজনে আলাপ আলোচনা করে নিজেদের জন্য তা কোথায় কি ভাবে প্রয়োগ করা যায় তা সিদ্ধান্ত নিতেন বা তারা কোথায় কি ভুল করছেন তা সংশোধন করে নিতেন। যত পরিশ্রমই হোক না কেন তাদেরকে যে উন্নতি করতেই হবে সফল হতেই হবে এমন একটা প্রবল ইচ্ছা তাদের মনে ছিল। বাইরে বেশ যথেষ্ট সুনাম বা গুডউইল যাকে বলে তাও পেয়েছিলেন। খুবই অল্প সময়ে তাদের এক নামে সবাই চিনে ফেলত। কিন্তু এই সব দেখে উপর থেকে যিনি রিমোট কন্ট্রোল পরিচালন করতেন তিনি বোধ হয় হাসছিলেন। রাশেদ, তুমি যতই কর না কেন সুখ আমি তোমার জন্য বরাদ্দ করিনি এর নাগাল তুমি কোন দিনই পাবে না।

তাদের তিন মেয়ে। যাদের জন্য এই সব সেই মেয়েদের শিক্ষা, যত্ন আত্তি বা অসুখ বিসুখের দিকে আপাতঃ কোন দৃষ্টি দেবার মত সময় ছিল না। আগে যে ভাবেই হোক দাড়াতে হবে, টিকে থাকা নিশ্চিত করতে হবে তারপর অন্য কিছু। মোবাইল ফোনে ছোট মেয়ে জানাল যে আব্বু বা আম্মু বড় আপুর ভীষন জ্বর। ওরা বলে দিত এখন কিছু খাইয়ে দিয়ে দুইটা প্যারাসিটামল খাইয়ে শুয়ে থাকতে বল কাল ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেও। তার বিনিময়ে কি এই?এমন কেন হোল?এ যে ভাবাই যায় না।
সরকারের অদূরদর্শিতার ফলে পাশের বিশাল দেশ থেকে সদর বা অন্দর পথে যখন কম দামে বিস্কুট পর্যন্ত এদেশে আমদানি হতে শুরু হলো তাদের উৎপাদিত মালের দাম উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে অর্ধেকে নেমে এলো তখন রাশেদ সাহেবের স্বপ্ন সৌধ ভেঙ্গে চুরমার। শুধু রাশেদ সাহেব নন তার মত সবারই একই অবস্থা। এই ধরনের উৎপাদন মুখি ব্যবসা গুলি একে একে সবই প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অথচ সরকারের সেদিকে কোন খেয়াল নেই। এমনও হচ্ছে যে কারো উৎপাদিত মাল বিক্রিও হচ্ছে না। লোকসান থেকে দেনায় চলে যাচ্ছে, কত সামাল দেয়া যায়?কতক্ষণ টিকে থাকা যায় টাকার মাল ষাট সত্তর পয়সায় বিক্রি করে? সবাই ভাবে এইতো আজ না হলে কাল ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু দিনকে দিন তা আরো ভয়াবহ হচ্ছে, ক্রমে শুধু ফুল এক্সিলারেনে অবনতির দিকেই যাচ্ছে। সাভারের এক বন্ধু অ্যাডভোকেট রফিক সাহেবেরও একই অবস্থা। তারা দুজনেই এক সাথে একই মাপের ফার্ম শুরু করেছিলেন, তবে রফিক সাহেব যেহেতু তার এলাকার একজন ধনি পরিবারের সন্তান যাদের প্রায় ষাট একর জমির উপর বাশ বাগান থেকে দৈনিক চার পাচ হাজার টাকার বাশ কেটে বিক্রি না করলে বাশ ঝার নষ্ট হয়ে যাবার ভয় থাকে সে যে ভাবেই হোক সামাল দিয়ে নিতে পারে তার সাথে রাশেদ সাহেবের তুলনা নেই। রাশেদ সাহেবের যে দিন আনতে পানতা ফুরায় এমন অবস্থা এমনকি তাকে সামাল দেবার মত কেউ নেই।

নিরুপায় হয়ে ব্যাঙ্ক এর সাথে আলাপ করলেন তারা সিসি লোন দিতে রাজী হলেন, বাবাকে এসে জানালেন যে এই অবস্থা চলছে আপাততঃ কিছু সিসি লোন নিয়ে এই দুর্যোগ মোকাবিলা করি বাবা শুনলেন কিন্তু কোন মন্তব্য করলেন না। রাশেদ সাহেব ভাবলেন বাবা বুঝি সম্মত আছে তাই লোনের আবেদন পত্র এনে দিলেন স্বাক্ষর করে দেবার জন্য। কিন্তু বাবা সম্মত হলেন না। তার এক কথা আমি লোন রেখে মরতে পারবো না। রাশেদ সাহেব হতাশ হয়ে ভেঙ্গে পরলেন। সে যে নিরূপায়, সব যে বাবার হাতে তার কিছুই করার নেই। এই দুর্দিনে উচ্চ শিক্ষিত সব ভাই বোন কারো কাছেই কোন নৈতিক সহযোগিতা পেলেন না  তারা কেউই এগিয়ে আসার কোন তাগিদ অনুভব করেনি

এমনিতে ছোট ভাইয়েরা এই ব্যবসায় সম্মত ছিল না, এতে নাকি পরিবারের মান মর্যাদা ক্ষুন্ন হবে। ওদিকে বাবা হয়ত ভেবেছিলেন এর আগে জাহাজে চাকরী করেছে, ষোল বছর ধরে সরকারি চাকরী করেছে সেখান থেকে টাকার পাহাড় না হোক অন্তত টিলা তো সঞ্চয় করেছে তাই দিয়ে রক্ষা করুক, শুধু শুধু আমি কেন ঋণের বোঝা নিতে যাই। রাশেদ সাহেব জানে সে তো কোন দিন ঘুষ খায় নি, পরের টাকা দিয়ে সৌধ গড়ার স্বপ্ন দেখেনি দেশের একজন সরকারি চাকুরে কত টাকাই বা বেতন পায় এ দিয়ে সংসার চালানো যেখানে সামাল সামাল অবস্থা সেখানে তার সঞ্চয় আসবে কোথা থেকে। নিজেরা দুজনে কত কঠিন হিসেব নিকেশ করে আজে বাজে অহেতুক ব্যয় না করে মোটা মুটি চতুর্দিক রক্ষা করে সুন্দর সংসার চালিয়েছে।

মেয়েদের পোষাক বানাতে দর্জির টাকা বাচিয়ে মনিরা নিজে হাতে তা সেলাই করে দিয়েছে আর ওই দর্জির মজুরী বাবদ যে টাকা প্রয়োজন হতো তার কিছু যোগ করে একটু ভালো কাপড় পরিয়েছে, নিজেরা নানা রকম হাতের কারু কাজ দিয়ে ঘর দোর সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতেন আর এই সব উপকরণ সংগ্রহ করতেন মনিরা কাপড়ে ফ্যাব্রিক্স পেইন্ট করে যা পেত তাই দিয়ে। একটা শাড়িতে পেইন্ট করলেই ডিজাইন অনুযায়ী দেড় থেকে দুশ টাকা পর্যন্ত পেত অথচ একটা শাড়ি পেইন্ট করতে সংসারের সব কাজ সেরেও তার ৩/৪ দিনের বেশি লাগে না, টিভির সামনে বসে না থেকে বা ফালতু আড্ডা না দিয়ে একটা কিছু করে যদি কিছু বাড়তি আয় করা যায় তাহলে ক্ষতি কি? এই হচ্ছে তার প্রতি সন্দেহের উৎপত্তি। এতো সুন্দর ভাবে চলছে তাহলে নিশ্চয়ই দু হাতে টাকা কামাচ্ছে। এই হচ্ছে তার প্রতি অনেকের ঈর্ষার কারন(চলবে)

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


15 Responses to নক্ষত্রের গোধুলি-১

You must be logged in to post a comment Login