নীল নক্ষত্র

নক্ষত্রের গোধূলি পর্ব-৩৬ (অধ্যায় ৩)

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

বাসায় এসে শুনি শাহেদ এয়ারপোর্টে গেছে। কতক্ষণ পরে ও এসেই হই চই, একা চলে এলাম বলে। বাসায় এসেই মনে হোল আজ বুঝি আমার পুনর্জন্ম হল। আমি যে এপর্যন্ত পৌছতে পারব আশা করিনি। সারাটা পথ কি টেনশনে গেছে। একে তো তোমার চিন্তা। কোথায় গেলে কিভাবে গেলে কি করছ তারপরে নিজে কি করবো। সাথে তো দুইটা অমানুষ রয়েছে ওই দুইটা যদি মানুষ হোতো তাহলে আমার এতো কষ্ট হোতো না। যাক আল্লাহর কাছে হাজার শোকর, সহি সালামতে পৌঁছেছি। বাসায় ঢোকার সাথে সাথেই তিন মেয়ে এক সাথে এইযে জড়িয়ে ধরল আর ছাড়ে না।

তোমাকেতো বলে দিয়েছিলাম ঢাকায় নেমে বাসায় ফোন করবে। যাই হোক যা হবার হয়ে গেছে। আচ্ছা মনি শোন, প্রায় আধা ঘণ্টা হয়েছে লাইনে আছি আমার কার্ড প্রায় শেষ। এখন রাখি আজ আমার ছুটি। এখন লাইব্রেরিতে যাচ্ছি ওখান থেকে আমি আমার কথা মেইলে পাঠাচ্ছি তুমি দেখে নিও।
ফোন রেখে রাশেদ সাহেব রুমে এসে বাইরে যাবার শীতের কাপর পরে হ্যান্ড গ্লোভস পকেটে নিয়ে নিচে এসে সেদিন কবিরের দেখিয়ে দেয়া গোপন জায়গা থেকে চাবি নিয়ে বাইরে বের হয়ে দরজায় তালা দিয়ে আবার গোপন জায়গায় চাবিটা রেখে কবিরের দেখানো পথ ধরে হাটতে লাগলেন। বেশ ঠাণ্ডা পরেছে। হ্যান্ড গ্লোভস টা হাতে পরে নিলেন, মাফলারটা আনা দরকার ছিল কানে ঠাণ্ডা লাগছে। আকাশ ভরা রোদ, বিলাতে এরকম আকাশ দেখা নাকি ভাগ্যের ব্যাপার তবুও কি ঠাণ্ডা। একটু এগিয়ে যেতেই দেখে সেদিন বাস থেকে যেখানে নেমেছিল সেই জায়গা। বায়ে ঘুরে দেখে একটা দশ বারো ফুট উঁচু পিলারের মাথায় বিভিন্ন জায়গার নাম লেখা দিক নির্দেশনা। লাইব্রেরি লেখা বোর্ডটা যেদিকে তীর চিহ্ন দিয়ে ঘুরানো রয়েছে সেদিকে হেটে কিছুদূর যেতেই দেখে কবির যেভাবে বলেছে সেই রকমই ডানে সমার ফিল্ড সুপারস্টোর বায়ে লাইব্রেরি। সমারফিল্ডে পরে যাব আগে লাইব্রেরিতে যাই। সামনে এসে দারিয়ে দেখল অনেক পুরানা বিল্ডিং আশে পাশে  অনেক গাছপালা কিন্তু কোনটায় পাতা নেই। সব পাতা শীতে ঝরে গেছে। শুধু ন্যাড়া গাছ দাড়িয়ে আছে। ভিতরে ঢুকে পরল। নিচ তলায় এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে প্রায় সব দরজাই বন্ধ। পাশেই উপরে যাবার কাঠের সিঁড়ি। উপরে উঠেই বাইরের শীতের চেয়ে এখানে উষ্ণতা অনুভব হল। হিটার চলছে। হাতের গ্লোভস খুলে জ্যাকেটের পকেটে রাখলেন। সিকিউরিটি গেট পেরিয়ে বাম পাশে রিসিপন। সমস্ত ঘরটাই নীরব। সুধু রিসিপশনের একজন তার মত অন্য একজনের সাথে ফিস ফিস করে কথা বলছে। একজন বিরাট এক কম্পিউটারে কাজ করছে আর একজনে কম্পিউটারের মনিটর দেখে কিসব গুছিয়ে রাখছে। পাশে দারাতেই একজন মহিলা যিনি গুছিয়ে রাখছিলেন এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো
আমি কি ভাবে সাহায্য করতে পারি?
আমি একটু ইন্টারনেট ব্যাবহার করবো।
আগে বুকিং করেছ?
না।
কার্ড আছে?
না।
মহিলা একটা ফরম দিয়ে পূরণ করতে বলল, একটা কলম বের করে দিলো সাথে। ফরম পূরণ করে দিতেই সেটা নিয়ে কম্পিউটারে কি কি এন্ট্রি করে বলল
কতক্ষণ ব্যাবহার করবে?
কতক্ষণ করা যায়?
একদিনে এক ঘণ্টা, এর বেশী করতে হলে ঘণ্টা প্রতি এক পাউন্ড।
ঠিক আছে তাহলে একঘণ্টা।
আচ্ছা ঐযে তিন নম্বর কম্পিউটার আর এই হোল তোমার পিন নম্বর
একটা ছোট্ট কাগজ এগিয়ে দিলো। কাগজটা নিয়ে ওখান থেকে সরে এলো। এতক্ষণে চারিদিকে তাকিয়ে দেখে বেশ বড় হল রুম অনেক পুরাতন অনেক কিছু আছে। দেখবো সব কিছু ঘুরে দেখবো আগে মেইলটা পাঠিয়ে নেই, বারিতে সবাই ভাবছে। টেবিলে বসে পিন নম্বর দিয়ে লগ ইন করেই সরা সরি ইয়াহু পেজ পেয়ে সাইন অন করে মেইল লিখতে শুরু করলো। মনির দেশে ফিরে যাবার সময় পথের বিবরণ শুনে তার মনের অবস্থা কি সেসব লেখার পর সেদিন হিথরো এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে আসার পর থেকে আজ পর্যন্ত সব কিছু সংক্ষেপে লিখল প্রায় দুই পাতা ভরে। ঘড়িতে দেখে তার আর মাত্র দশ মিনিট বাকি রয়েছে। এবার রেস্টুরেন্টের ঠিকানাটা লিখেই শেষ করলো। মেইল পাঠিয়ে দিয়ে রিসিপশনে এসে জানালো আমার শেষ কিন্তু আমি কি লাইব্রেরিতে অন্য কিছু দেখতে পারি?
ধন্যবাদ জানিয়ে বলল হ্যাঁ তুমি ইচ্ছা করলে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত থাকতে পারো কোন নিষেধ নেই।
দৈনিক সংবাদপত্র, কয়েকটা সাময়িকী, এই শহরের পত্তন কাহিনী, বর্তমান বিবরণ, শহরের ম্যাপ, বাসের শিডিউল, এই শহরে কোথায় কি ঘটছে ঘটবে এধরনের যাবতীয় তথ্য। বিভিন্ন রকমের বই, কয়েকটা হাই স্পিড ব্রডব্যান্ড লাইন সংযুক্ত কম্পিউটার ইত্যাদি নানান কিছুতে ভরা এই লাইব্রেরি। এদেশের ছোট বড় সব শহরেই নাকি এই রকম একটা লাইব্রেরি আছে। কার কোথায় কি প্রয়োজন জানো না যাও লাইব্রেরি থেকে জেনে আস। কে কোন কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চাও সেখানে কি আছে কি নেই জানো না জানতে চাও তবে যাও লাইব্রেরি থেকে জেনে আস। বর্তমান প্রজন্মকে যুগোপযোগী করে গড়ে তোলার জন্যে যা প্রয়োজন তার সবই পাবে এখানে। শুধু বর্তমান প্রজন্ম নয় আবাল বৃদ্ধ বনিতা সবাই এখানে আসতে পারে। কোথাও কোথাও লাইব্রেরিই তাদের মিলন কেন্দ্র। দিনের বেলা লাইব্রেরি আর রাতে পাব এদের সামাজিক মিলন কেন্দ্র। আহারে অর্থ! হায়রে পাউন্ড! তুমি এদেশের জন্যে কি করেছ আর আমাদের দেশের জন্যে কি করছ? এরকম একটা লাইব্রেরির সুযোগ আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা পেলে কোথায় এগিয়ে যেতো।

এদেশে এখনকার প্রজন্ম তাদের পুর্ব পুরুষদের কৃত কর্মের ফল ভোগ করছে। তারা ছিল কর্মঠ, উচ্চাভিলাষী। সুদূর প্রসারী দৃষ্টি সম্পন্ন ওরা সারা বিশ্ব জুরে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে। সারা বিশ্বের সম্পদ এনে নিজের দেশ গড়েছে। এদের বাড়িঘরের কাঠামো, চলাচলের রাস্তা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আয়োজন দেখেই বোঝা যায়। প্রচণ্ড শীতের মধ্যে যেখানে বৎসরের অর্ধেকই থাকে সংকুচিত হয়ে, কোন কাজ করা যায়না তার মধ্যেও ওরা কিভাবে এসব গড়ে তুলেছে। কি ধরনের পরিকল্পনা করেছে কি রকম গঠন মূলক চিন্তাভাবনা ছিল তা না দেখলে বোঝা কঠিন। আর আমাদের পুর্ব পুরুষেরা ছিল আয়েশি, ভোগ বিলাসী। কোন রকম মাছে ভাতে দিন গেলেই খুশী ছিল। সাথে যদি একটু নাচগানের আয়োজন থাকে তাহলে তো কথাই নেই আর কিচ্ছু চাই না। কিন্তু আশ্চর্য হোল মাত্র কয়েকজন মানুষ এই এতো বড় লাইব্রেরি ব্যাবহার করছে। দুই তিন জন বুড়া বুড়ি পত্রিকা পরছে, একজন কম্পিউটারে রয়েছে আর একজন মধ্যবয়সী মহিলা বই পরছে। এখানে ইংলিশ শেখার জন্যে অডিও ক্যাসেট, ভিডিও ক্যাসেট, বই, গানের সিডি, সিনেমার ডিভিডি নানান কিছু রয়েছে যা নাম মাত্র ভাড়া দিয়ে দুই সপ্তাহের জন্যে বাসায় নেয়া যায়। যাদের মাতৃভাষা ইংলিশ তারাও শিখছে আবার যাদের মাতৃভাষা ইংলিশ নয় তারাও শিখছে। এই লাইব্রেরি দেখে মনে হয় হ্যাঁ সত্যিই জ্ঞান ভাণ্ডার। জ্ঞানের বিশাল ভাণ্ডার এখানে নিশ্চুপ হয়ে দাড়িয়ে রয়েছে। জ্ঞানের মশাল জ্বেলে তার এলাকা আলোকিত করে রেখেছে অনেক দিন ধরে। তার এলাকার নাগরিকদেরকে মানুষ করে গড়ে তোলার জন্যে, সুপথে চলতে শেখানোর জন্য। এগুলি তো আর একদিনে হয়নি। রাশেদ সাহেব অবাক হয়ে দেখেন আর ভাবেন এ কোথায় এলাম? এখানে না এলে তো এসবের কিছুই জানতে পারতাম না। কিছুই দেখতে পেতাম না। আমার দেশের সাথে তুলনা করতে পারতাম না। টাকা আর পাউন্ডের তফাত কি তা জানতে পারতাম না। গোলা ভরা ধান গোয়াল ভরা গরু আর এই লাইব্রেরির তফাতটা কোথায় কিছুক্ষণ ভাবলেন। না এক দিনে এই লাইব্রেরি দেখা সম্ভব না। পরের অফ ডেতে আবার আসব। একটু আফসোস হল একটু পরে যদি মেইলটা পাঠাতাম তাহলে তো এ সম্পর্কে কিছু লেখা যেতো। কি আর করা যাবে পরের বার যখন আসব তখন লিখবো মনে মনে ভাবতে ভাবতে বেরিয়ে এলেন।(চলবে)

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


You must be logged in to post a comment Login