নীল নক্ষত্র

নক্ষত্রের গোধূলি-১২,১৩

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

[দ্বিতীয় অধ্যায়]
চিটাগাং থেকে ফিরে আসার পর কি করবেন ভেবে কোন কুল কিনারা পাচ্ছিলেন না। এমন সময় একদিন ছোট ভাই বলল
দাদা, আপনি যদি লন্ডন যেতে চান তাহলে চলে যান। আজ মেঝ ভাইয়ের সাথে কথা হয়েছে, আপনি ওখানে যেতে চাইলে যেতে বলেছেন। তবে কথা হচ্ছে উনি যে শহরে থাকে সেখানে থাকতে পারবেন না এবং যাবার ভাড়া আপনাকে ব্যবস্থা করতে হবে। আর আমি বলছি যদি যান তাহলে অন্তত চার বছর থাকবেন এমন মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে যাবেন। এখন ভেবে দেখেন কি করবেন, চার বছর কিন্তু একেবারে কম না। যাওয়া হলে এখানে এখন যেমন রেখে যাবেন এসে তেমন পাবেন না। হয়ত এসে দেখবেন আপনার অবর্তমানে ই মেয়ের বিয়ে দেয়া হয়েছে, ছোট মেয়ে স্কুল কলেজ সেরে ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে বা আরো কত পরিবর্তন হতে পারে যা এখন ভাবা যাচ্ছে না। এর আগে যেমন গিয়েছিলাম এবার কিন্তু তেমন নয়। যদিও এক বার ভিসা পেলে পরের বার ভিসার জন্য সমস্যা হয় না। ভেবে দেখেন কি করবেন।

মনি পাশেই বসে ছিল।
রাশেদ সাহেব মনির দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন।
মনি বলল তাই কর, অনেকেই এমন কত প্রয়োজনে কত কি করছে কত জায়গায় যাচ্ছে, চেষ্টা তো কম করা হোল না।
যেতে বলছ কিন্তু যাবার ভাড়ার টাকা পাব কোথায়?
সে দেখা যাবে, তুমি মত দিলেই ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
ঠিক আছে তাহলে ভাড়ার টাকা জোগার করে নিই পরে ভিসার জন্য এপ্লাই করি, এটাই তাহলে ফাইনাল।
রাতে শুয়ে মনিরাকে জড়িয়ে ধরে ভাবছে একা একা এভাবে চারটা বত্সর মনিকে না দেখে থাকবো কি করে আর মনিই বা থাকবে কি করে, সিদ্ধান্ত তো নিয়ে ফেললাম!

সিদ্ধান্ত নেয়া আর তা বাস্তবায়ন করা এক নয়। তাদের বিয়ে হয়েছে আজ ছাব্বিশ বছর, বিয়ের পর থেকে বিগত ছাব্বিশ বত্সরের নানা স্মৃতি ভেসে এলো মাথায়। ঘরে তিন মেয়ে, মেয়েদের স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে যাতায়াত। তাদের পোষাক আশাক, চিকিৎসা, বই পত্র কত কি। মেয়েদের হাতে কোন রকম দশটা টাকা দিয়ে বলা যায় না যে বাসে করে ঝুলে গিয়ে ক্লাস করে এসো, ঢাকা শহরে বাসে চেপে মেয়েদের স্কুল কলেজে যাতায়াত ভাবাই যায় না।

দেশের জন্য, দশের জন্য বড় কিছু করার স্বপ্ন তার ধুলায় মিলিয়ে কোথায় চলে গেছে এখন বাঁচবে কি করে এই চিন্তায় অস্থির। শেষ পর্যন্ত ভাবল অনেকেই তো নানা রকম অপরাধ করে জেলে বা হাজতে বাস করছে, তাদেরও তো দিন চলে যাচ্ছে, না হয় সে ভেবে নিবে সেও এমন কোন অপরাধ করেছে যার শাস্তি হিসেবে তাকে অজ্ঞাত বাসে বা নির্বাসনে যেতে হবে, সে তো এমনই অপরাধ করেছে।

ওই তো, তার সহকর্মী নির্বাহী প্রকৌশলী শফিক সাহেবের কি হোল?আহা বেচারা নির্দোষী সহজ সরল মানুষটা। অফিস থেকে ট্রেনিং এর জন্য বাইরে পাঠাল আর ফিরে আসতে না আসতেই তেল চুরির অপরাধে চাকরিটাই চলে গেল। তারও তার মেয়েদের বয়সি তিন মেয়ে। মেয়েগুলোর দিকে তাকান যায় না। বিভাগীয় চুড়ান্ত নির্দেশের প্রেক্ষিতে তা মওকুফের আবেদন নাকচ হবার পর শফিক সাহেব আদালতে মামলা করল, আপীল করল কোন লাভ হোল না। তার স্টোর কিপার পঁয়ত্রিশ লিটার তেলের ইন্ডেন্ট বানিয়ে শফিক সাহেবের স্বাক্ষর নিয়ে সেটাকে তিন শত পঁয়ত্রিশ করে তেল উঠিয়ে বিক্রি করে দিত। যে জাহাজ ডকে রয়েছে তার নামে ভুয়া ইন্ডেন্টে শফিক সাহেবের স্বাক্ষর জাল করে দশ হাজার লিটার ডিজেল উঠিয়ে বিক্রী করে দিত এই ভাবে নানা ফন্দি ফিকির করে টাকা কামিয়ে এক দিনেই তিনটা হিনো বাস কিনে রাস্তায় চালু করে দিয়েছে তার আয় দিয়েই সে চলছে, তারও চাকরী গেছে, কিন্তু সে তো বাসের আয় দিয়ে চলে যাবে।

শফিক সাহেবের যে সে উপায় নেই। সে তো চুরি করেনি বা চুরির ভাগও পায় নি। ওহ! কি কষ্টে যে তার দিন যাচ্ছে সে না দেখলে বোঝার উপায় নেই। মেয়েদের মামা বাড়ি থেকে কিছু দেয়, চাচারা কিছু দেয় এই দিয়েই মেয়েদের লেখাপড়া চলছে। কোন ভাবে দিন যাচ্ছে।

কাজেই সন্ধ্যায় নেয়া ছোট ভাইয়ের দেখান সিদ্ধান্ত মেনে না নিয়ে আর কি করবে?কিন্তু তার পরেও একটা কাটার খোঁচা তার মনে বিঁধেই রইলো। মনি। মনিকে ছাড়া সে থাকবে কি ভাবে, আর মনিই বা থাকবে কি ভাবে?হঠাৎ একটা বুদ্ধি এলো। আচ্ছা মনিকে যদি সে এবার সাথে নিয়ে যায় তাহলে তো মনি অন্তত বছরে একবার করে যেতে পারলেও এতটা অসহ্য মনে হবে না। ওর সাথে যদি মনির ভিসার জন্য এপ্লাই করে তা হলে কোন সমস্যা নেই, ভিসা পেয়ে যাবে।

হ্যা, তাইতো এই কথাই ঠিক। কিন্তু, এতো টাকা পাবে কোথায়?তার নিজের ভাড়ার টাকার কোন হদিশ নেই, মনির জন্য কোথায় পাবে?তাছাড়া বাড়ির সবাই ভাববে, ভাত জোটে না আবার বুড়ো বয়সে হানিমুন করতে বিলাত যাচ্ছে। কিন্তু কিন্তু করতে করতেই রাশেদ সাহেব ভেবে নিয়েছে, এই করতে হবে। মনি যদি বৎসরে এক বারও যেতে পারে তা হলেও অন্তত এই দীর্ঘ চার বৎসরের বিচ্ছিন্নতার যন্ত্রণা পোয়াতে হবে না। আর একটা কথা হচ্ছে এখন মনে হছে চার বৎসর আসলে যে এর চেয়ে বেশি হবে না তাই বা কে জানে।

মনি, ঘুমিয়েছ?
না, তুমি যেভাবে ধরে রেখেছ তাতে ঘুম আসে?
এই সংলাপ আবার কবে আমদানি করলে, আমি কি এই নতুন ধরে রাখলাম, ধরে তো রয়েছি আজ ছাব্বিশ বছর ধরে।
কিছু বলবে?
হ্যা, বলছিলাম কি, একটু আমতা আমতা করে বলেই ফেললো, তুমিও চলনা আমার সাথে।
মনিরা কিছু না বুঝে বললো সাধে কি আর আমি পাগল বলি?
না সাধে বলবে কেন আমি তো পাগল, আর এজন্য তো তুমিই দায়ী, তুমিই আমাকে পাগল বানিয়েছ। আচ্ছা ঠিক আছে এজন্য যে শাস্তি দিতে চাও কাল দিও এখন ঘুমাও।
বলেই শোয়া থেকে উঠে বিছানায় বসে স্বামীর গায়ে মাথায় চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে ঘুম পারিয়ে দিল।
সকালে উঠে আবার মনিকে কাছে ডেকে নিয়ে বলল তুমি তো পাগল বলেই খালাস, আমার কথাটা একটু মন দিয়ে শোন।
বল।

নক্ষত্রের গোধূলি-১৩
রাশেদ সাহেব রাতের ভাবনা গুলি আবার বুঝিয়ে খুলে বললো। আরও বললো যে নয়া মামারতো অনেকের সাথে জানা শোনা আছে তাদের কারো ট্রাভেল এজেন্সি আছে, তাকে বলে দেখি যদি বাকিতে বা অন্য কোন ভাবে দুইটা টিকেটের ব্যবস্থা করতে পারে।
শুনে মনিরা একটু অবাক হয়ে জেজ্ঞেস করল টিকেট দুইটা কেন?
বারে, রাতে কি বললাম আর এতক্ষণে বা কি বললাম?
না, না, তা হবার নয়। তুমি এভাবে ভেবো না, এসব এই মুহুর্ত সম্ভব নয়, সবাই বলবে কি?
সবার কথা বাদ দাও, আমি তো তোমাক নিয়ে হানিমুন করতে বা রং ঢং করতে যাচ্ছি না, শুধু তোমার ভিসার একটা ব্যবস্থা হয় এই জন্য। তুমি যেয়ে অন্তত এক সপ্তাহ থেকে এলেও হবে। এবার আমার সাথে গেলে যত সহজে ভিসা হবে পরে এমন সহজে আর হবে না। দেখ এক নাগার এতো দিন আমি আমার মনিকে ছাড়া কিছুতেই থাকতে পারবো না।
থাকতে কি আমিও পারবো?
তাহলে আর এমন করে বলছ কেন?
মনিরা অনেক বোঝাবার চেষ্টা করলো কিন্তু কোন লাভ হোল না।

দেখ মনি, আমি যদি এতো দিন তোমাকে ছাড়াথাকি তাহলে আর আমাকে সুস্থ ফেরত পাবে না, নিশ্চয়ই আমি পাগল হয়ে যাব। তুমি কি বাকী জীবন এক জন পাগলকে নিয়ে চলতে পারবে?
শেষ পর্যন্ত মনিরাকে হার মানতেই হোল।
নাশতা খেয়ে রাশেদ সাহেব বের হয়ে সোজা মামার অফিসে গিয়ে সব খুলে বললেন।
শুনে মামা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন ঠিক বুদ্ধি করেছিস। তুই তোদের ভিসার জন্য প্রসেস কর আমি টিকেটের ব্যবস্থা করে দিব, আজ রাতেই তোকে ফোনে জানাব, টিকেট নিয়ে তুই ভাবিস না। এখনই বাসায় গিয়ে ওয়েব সাইট থেকে ভিসা ফর্ম নিয়ে ফিল আপ করে কালই দিয়ে আসবি। এপ্লাই করার টাকা আছে?
না।
তাহলে সে কথা বলছিস না কেন?একটু অপেক্ষা কর, টাকা নিয়ে যা।
একমাত্র মামাই তার যন্ত্রনা বুঝতে পারলেন। মামা হলেও প্রায় সম বয়সি, এক সাথে বিড়ি সিগারেট খায়। মামাই পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে দেয়, নে। এজন্যেই মামা বুঝতে পেরেছেন। মামার অফিস থেকেই ফোন করে মনিকে জানালেন। মামার প্রতি কৃতজ্ঞতায় মন ভরে গেল। সবাই যখন তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তখন একমাত্র এই মামাই তাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন।
কিছু খাবি?
না, এইতো নাশতা করে এসেছি।
তা হলে একটু চা খা এই ফাকে আমি কবিরকে ব্যাংকে পাঠাই?
তা করা যায়।কলিং বেল টিপে কবিরকে চা দিতে বলে ব্রিফ কেস থেকে চেক বই বের করে লিখে রাখলেন। কবির চা নিয়ে এলে তার হাতে চেকটা দিয়ে দিলেন। চা খেতে খেতেই কবির টাকা নিয়ে এলো।

টাকা নিয়ে খুশি মনে মামার অফিস থেকে বের হয়ে সোজা বাড়িতে এসে ছোট ভাইয়ের কম্পিউটার অন করে বৃটিশ হাই কমিশনের ওয়েব সাইটে খুঁজে খুঁজে ভিসার ফর্ম বের করে প্রিন্ট করে তা পুরন করে মনিরাকে ডেকে সই স্বাক্ষর দিতে বললো।
মনি ইতস্তত করছে দেখে রাশেদ সাহেব বললো নাও সই কর, ভয় কিসের তোমার সতীন আনতে যাচ্ছি না তোমাকে নিয়েই রংগ লীলা করতে যাচ্ছি ভয় পেয়ো না।
আমি সে ভয় পাচ্ছি না। আমি জানি আমাকে আল্লাহর রহমতে সতীনের মুখ দেখতে হবে না, সে ব্যপারে আমার কোন ভয় নেই। আমি ভয় পাচ্ছি অন্য কারনে।
আহা সই করতো, ভয়ের কোন কারন নেই, যা হবার হোক। কাল সকালে চল এগুলি জমা দিয়ে আসি।
না কাল না।
তাহলে? বুধবারে চল।
মানে আজ সম বার, তুমি পরশুর কথা বলছ?
হ্যা, তোমার সব শুভ কাজ বুধ বারেই হয়, এ যাবত তাই দেখে আসছি।
আচ্ছা বুঝেছি, তাহলে তাই হবে পরশুই চল।
রাতে মামা ফোন করে রাশেদকে চাইলেন, রাশেদ ফোন ধরতেই ও পাশ থেকে মামা বললেন হাইকমিশনে গিয়েছিলি?
না।
কেন?
মনি রেডি ছিলনা তাই কাল যাব।
আচ্ছা ঠিক আছে। টিকেটের ব্যাপারে কথা বলেছি। মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসে  পাওয়া যাবে কিন্তু শর্ত হচ্ছে এক মাসের মধ্যেই টাকা দিতে হবে। কি করবি, পারবি?
হ্যা তা পারা যাবে।
তাহলে তোরা কালই ওখানে যা, দেখ কি হয়, আমাকে জানাবি।[চলবে]

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


2 Responses to নক্ষত্রের গোধূলি-১২,১৩

You must be logged in to post a comment Login