নীল নক্ষত্র

নক্ষত্রের গোধূলি-১৬

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page


চেক ইন, ইমিগ্রেশনের ঝামেলা সেরে ওয়েটিং লাউঞ্জ। কিছুক্ষণ বসেই রাশেদ সাহেব পাশে বসা মনির হাত ধরে আবার গেয়ে উঠলেন ‘তরে লইয়া যাইমু আমি লন্ডনে—–,। মনিরা শুকনো কাঠের মত একটু হেসে হাতটা ছাড়িয়ে উঠে গিয়ে বাসায় ফোন করে খবর নিয়ে এলো গাড়ি পৌচেছে কি না। ওদের পৌছার খবর পেয়ে নিশ্চিন্ত হোল। মাইকে নারী কণ্ঠের ঘোষনা ভেসে এলো, উঠে প্লেনে উঠার গ্যাং ওয়ের গেটের কাছে এসে কিউতে দাঁড়ালেন। বোর্ডিং কার্ড চেক হবার পর শেষ বারের মত সিকিউরিটি চেক সেরে আস্তে আস্তে গ্যাং ওয়ে দিয়ে প্লেনের ভিতর এসে সীট নম্বর খুঁজে বসে পরলো।

মনিরা জানালার পাশে তার পাশে রাশেদ সাহেব। রাশেদ সাহেব আবার সেই গান গাইছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে সব যাত্রী ওঠা হলে মাইকে বিমান বালার কন্ঠ ভেসে এলো, যাত্রী দের সীট বেল্ট বাধার অনুরোধ এবং ঢাকা বিমান বন্দর ছেড়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই কুয়ালালামপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবে জানিয়ে দিল। একটু পরেই প্লেন টারমাক ছেড়ে এসে রান ওয়ে দিয়ে ছুটে চলে এক সময় ঢাকা বিমান বন্দরের মাটি ছেড়ে আকাশে উড়ে গেল। নিচে রাতের ঢাকা শহরের ঝকমকে নানা রঙের বাতি পরে রইলো।

রাশেদ সাহেবের মুখটা মলিন হয়ে গেল। এই ঢাকা শহর আমাকে একটু জায়গা দিতে রাজী হোল না। আমার নিজের শহর, নিজের দেশ ছেড়ে আমাকে যেতে হচ্ছে ভিন্ন দেশের ভিন্ন শহরে। মনি রাশেদ সাহেবের এই পরিবর্তন দেখে তার মাথাটা নিজের বুকে টেনে নিয়ে বললো মন খারাপ কোরনা, এইতো কদিন দেখতে দেখতে চলে যাবে তার পরে তো আবার আসবে। তত ক্ষনে প্লেন অনেক উপরে উঠে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর শহরের দিকে উড়ে চলেছে। নিচে তখন কিছু কিছু ছিটে ফোটা আলোর বিন্দু দেখা যাচ্ছে। রাশেদ সাহেব মনির বুক থেকে মাথা উঠিয়ে জানালা দিয়ে নিজ দেশের শেষ বিন্দুটা দেখে নিতে চাইলেন কিন্তু আর সে সময় পেলেন না। প্লেন তত ক্ষনে বাংলাদেশের স্থল সীমা পেরিয়ে বঙ্গোপসাগরের উপর দিয়ে এগিয়ে চলছে।

রাশেদ সাহেব অনন্তের উদ্দেশ্যে যাত্রার শেষ মুহুর্তে নিজ দেশের শেষ কণা টা দেখতে না পেরে মনটা বিষণ্নতায় ভরে গেল, মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল। মনিরা দেখতে পেয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখে তার নিজ মনের বিষণ্নতা, যাতনা কষ্ট সব চেপে রেখে হেসে ফেলল, কি হয়েছে তাই, এমন মন খারাপ করছ কেন?
মানুষটা এইতো এতো ক্ষন কি আনন্দে ছিল। হঠাত্ করেই কেমন নিভে গেল। মনি সব বুঝতে পারল। বুঝেও না বোঝার ভান করে তার কাঁধে স্বামীর মাথা টেনে নিয়ে বলল দেখ একটু ঘুমাতে পার কি না। রাশেদ সাহেব কিছু না বলে সুবোধ বালকের মত স্ত্রীর কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে রইল। কখন যেন একটু তন্দ্রার মত এসেছিল বুঝতে পারেনি। মনির কথার শব্দে তন্দ্রা ভাব কেটে মনির দিকে তাকিয়ে দেখে মনি কার সাথে কথা বলছে। এ পাশে চেয়ে দেখে মালয়েশিয়ান এয়ার হোস্টেস খাবার মেনু নিয়ে এসেছে, তারা কি খাবে মনি তাই বলে দিচ্ছে। রাশেদ সাহেব মনির হাত চেপে ধরে আবার গেয়ে উঠলো সেই গানটা। মনি আবার একটু হাসল। এই হাসির আড়ালে কত কষ্ট চেপে রেখেছে তা শুধু মনিই জানে। স্বামীকে বুঝতে দেয়নি। কত দিন পরে সে তার স্বামীকে একটু হাসি খুশি দেখছে, তার ভাল লাগা দেখছে। তাকে আর বিব্রত করা কেন, থাক না তার কষ্ট চাপাই থাক, ওকে আর জানাবার কি এমন দরকার। তার ভাল লাগায় বিঘ্ন ঘটাবার কোন ইচ্ছা হোল না, যে ভাবে চলছে চলুক। নিয়তি যে দিকে নিয়ে যায় সেদিকেই চলুক।

খাবার পরে চা খেয়ে রাশেদ সাহেব আবার মনির কাঁধে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে একটু চোখ বুজে রইলো। কতক্ষণ এভাবে ছিল তা বুঝতে পারেনি। হঠাত্ মাইকে  কুয়ালালামপুর বিমান বন্দরে নামার ঘোষনা শুনেই চমকে উঠলেন।
একি মনি, তুমি আমাকে একটু ডাকবে না? তুমি একটু চোখ বন্ধ করতে পারতে। এভাবে সারা রাত জেগে রইলে কেন?
কেন আবার, দেখলাম তোমার নাক ডাকছে, কত দিন পর তুমি একটু ঘুমিয়েছ তাই আর ডাকিনি। বেয়াই এক বার এসেছিল খোজ নিতে। উনার সিট সামনের দিকে, তোমাকে ঘুমে দেখে কিছু বলেনি চলে গেছে। আমারও চোখ বন্ধ হয়ে এসেছিল।
নাও রেডি হয়ে নাও। জানালা দিয়ে দেখলেন মালয়েশিয়ার আকাশে ভোরের আলো ফুটে উঠছে। নিচে পাম বাগানের সারি দেখা যাচ্ছে। পাহাড়ি লাল মাটির বুকে পাম গাছ গুলি দেখতে বেশ লাগছিল। দেখ মনি একে বারে ঠিক আমাদের সাভারের মত তাই না?
মনি জানালা দিয়ে দেখে বললো হ্যা তাইতো।
একটু পরেই প্লেন নেমে মাটি স্পর্শ করে মটরিং করে ধীরে ধীরে টারমাকের দিকে এগিয়ে এসে থেমে গেল। দরজা খুলে দেয়ার পর যাত্রীরা সীট বেল্ট খুলে একে একে যার যার সীট ছেড়ে নেমে গেল। রাশেদ সাহেবরাও নেমে এসে ট্রান্সফার ডেস্ক খুঁজে তাদের টিকেট দেখিয়ে বসার যায়গা এবং পরবর্তী ফ্লাইটের ডিপারচার গেট জেনে নিয়ে বসে পরল। কায়সার বেয়াই এলো একটু পরেই।
আসেন বেয়াই।
আমি এখানে দুই দিন থাকবো, আপনারা চলে যান লন্ডনে গিয়ে দেখা হবে।
লন্ডনে আপনি কোথায় থাকবেন ফোন নম্বরটা দিয়ে যান।
ফোন নম্বর নিয়ে সে যেখানে থাকবে সে বাসার ঠিকানা দিয়ে বলল
তাহলে আসি, লন্ডনে দেখা হচ্ছে।
এখানে পাচ ঘন্টা বসে থাকতে হবে।

চলনা মনি বাইরে যেয়ে কুয়ালালামপুরে একটু বেড়িয়ে আসি। তুমি ভয় পেয়ো না, আমি এখানে সব চিনি। এয়ারপোর্টে এই পাচ ঘন্টা কি করবো?
মনি খরচের কথা ভেবে বলল, না আমার ভাল লাগছে না। তার চেয়ে চল ভেতরেই হাঁটা হাটি করি। চারিদিকে তো কাচের দেয়াল সবকিছুই তো দেখা যায়। বাইরে গিয়ে আবার কি দেখবে? তারপরে আবার তো চৌদ্দ ঘন্টার জার্নি রয়েছে, শুধু শুধু ক্লান্তি বাড়ানোর কি দরকার?চল একটু হেটে দেখি।
বলেই মনিরা উঠে গিয়ে একটা ট্রলি নিয়ে এসে তাদের হাতের ব্যাগ গুলি ট্রলিতে নিয়ে এগিয়ে বলল এসো, ঘুরে দেখি। রাশেদ সাহেব মনির পিছনে উঠে গেলেন। এ মাথা থেকে ও মাথায় যত দোকান পাট যা আছে সব ঘুরে ঘুরে দেখে এক সময় ক্লান্ত হয়ে আবার এসে বসলেন তাদের লন্ডনের প্লেন যেখান থেকে ফ্লাই করবে সেই সি গেটের কাছে। মনিরা খরচের কথাটা রাশেদ সাহেবকে বুঝতেই দেয়নি যে সে খরচের কথা ভেবে বাইরে যেতে চায়নি। এখানে বাইরে গেলেই অন্তত সত্তর ডলার বা পঞ্চাশ পাউন্ড খরচ হয়ে যাবে। সে জানে তার পাগল খেয়ালের বসে যা মনে আসছ তাই বলছে। সেও যদি আবেগের বশে তাই রাজী হয়ে যায় তাহলে কি আর চলে?মামার কাছ থেকে আনা টাকা দিয়ে পাউন্ড কিনে এনেছে। তাকে যে আবার এই টাকা ফেরত দিতে হবে। লন্ডনে গিয়ে কি হবে না হবে তার কি কিছু ঠিক আছে?
আজও মানুষটা সংসারি হতে পারলো না। আজ ছাব্বিশ টা বছর ধরে দেখে আসছে সংসার সম্পর্কে কি উদাসীন। নিজের কথা আর কোন দিন ভাবতে পারবে না। এমনি কি আর বলে, তুমি না হলে আমি কবে বাতাসে উড়ে যেতাম। মনি নিজে যদি শক্ত করে হাল না ধরত তাহলে কি যে হতো কে জানে। মানুষটার মনে সারাক্ষণ শুধু দেশ, সমাজ, প্রতিবেশী, বাবা মা ভাই বোন। কোন সময় একবার ভুলেও নিজের কথা ভাবতে দেখেনি। বাজারে গেলে দুটার বেশি তিনটা জিনিসের কথা বলে দিলে আর মনে রাখতে পারে না, লিখে দিতে হয়। টাকা, ব্যাগ আর লিস্ট লিখে বাজারে পাঠালে কখনো দেখা যায় যে খালি ব্যাগটা হাতে নিয়ে ফিরে এসেছে। কি হোল, বাজারে যাওনি?না, ওই ভ্যান ওয়ালা টা বললো ওর মেয়ের অসুখ তাই ওকে ওষুধ কেনার জন্য টাকা দিয়ে দিলাম। আমাদের তো আছে, চলবে না?এই মানুষকে আর কি বলবে। ছাব্বিশ বছর ধরে এই দেখে আসছে।
রাগা রাগিও করা যাবে না, ওই ড্রইং রুমে টিভির সামনে বসে থাকবে, যতক্ষণ পর্যন্ত আদর সোহাগ করে না আনা হবে ততক্ষণ পর্যন্ত কিচ্ছু খাবে না। এই পাগলকে বুকে নিয়েই মনি চলছে। মনটা শিশুর মত সরল আর সাগরের মত বিশাল। থাকুক, আমার পাগল আমার বুকেই থাক এইতো আমার পরম শান্তি। কত বলেছে ভবিষ্যতের জন্য কিছু ভাব, সে কথা কোন দিন কানে নেয়নি। অফিসের বেতন তোলার সময় চেক লিখে তার পিওন সুনীলের হাতে দিয়ে দিত। সুনীল আবার সেই টাকা এনে মনির কাছে দিয়ে যেত। কোন দিন জিজ্ঞেসও করেনি সুনীল কত টাকা দিয়েছে। সেই জিজ্ঞেস করে নিত আজ কত টাকার চেক লিখেছিলে মনে আছে?না। চেকের মুড়ি দেখে মনিকেই তা সামাল দিতে হতো। যদিও জানে সুনীল খুবই বিশ্বাসী তবুও। ওর নিজের কখনো টাকার দরকার হলে মনির কাছে চেয়ে নিত। মনি আমাকে পঞ্চাশ টা টাকা দিতে পারবে?তার নিজের রোজগারের টাকা সে চাইছে বলে মনি কোন দিন জিজ্ঞেস করেনি টাকা দিয়ে কি করবে?মনি নিজেই এর মধ্যে থেকে সংসার চালিয়ে যা কিছু সঞ্চয় করতে পেরেছে তাই তার সম্বল।
খুব ক্ষুধা লেগেছে মনি।
মনি ব্যাগ থেকে ঢাকা থেকে বড় মেয়ের দেয়া সেদ্ধ আটার রুটি আর শামী কাবাব বের করে দিয়ে খালি হয়ে যাওয়া পানির বোতলটা ভরে এনে দিল।
নাও খাও।
তুমি খাবে না, তোমারও তো ক্ষুধা লেগেছে।
একটু পরেই দেখলো তারা যে গেট দিয়ে লন্ডন যাবার প্লেনে উঠবে সেখানে এক বিশাল ৭৪৭ বোইং এসে দাঁড়ালো। দেখ, দেখ মনি আমরা এই প্লেনে লন্ডন যাব। ঘন্টা খানিক পর লন্ডনের যাত্রীদের প্লেনে ওঠার জন্য সি গেটে যাবার ঘোষনা শুনে তারা এগিয়ে গেল। ওদের বাংলাদেশী সবুজ পাসপোর্ট দেখে যথারীতি অন্যান্য এয়ারপোর্টের মত এখানেও বিব্রতকর পরিস্থিতি। তবুও রক্ষা যে ওদের বেশ মোটা এবং পুরাতন পাসপোর্ট এবং রাশেদ সাহেবের পাসপোর্টে ইতিপূর্বে বৃটেন ভ্রমণের ভিসা দেখে তেমন কোন ঝামেলা করেনি। এক সময় সব ঝামেলা শেষ করে প্লেনে উঠে সীট খুঁজে বসে পরলেন। এবারেও মনি জানালার পাশে।

অল্পক্ষণের মধ্যেই প্লেন ভারত মহাসাগরের উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। সামনের জি পিএস এর স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে। জানালা দিয়ে নিচে নীল সাগরের ঢেউয়ের চূড়ায় সাদা ফেনা আরো বেশি সুন্দর ছবির মত দেখাচ্ছে, মাঝে মাঝে টুকরো মেঘ গুলির উপর দিয়ে যাচ্ছিল। সাগর পাড়ি দেয়ার পর যে শহরের উপর দিয়ে যাচ্ছে রাশেদ সাহেব বলে যাচ্ছেন কবে এই শহরে এসেছিলেন, তোমাকে নিয়ে এই যে এই এই শহরে এসেছিলাম দেখ উপর থেকে দেখ কেমন দেখাচ্ছে। ওইসব শহরের নানা গল্প বলছিলেন। তার কোনটা মনিরার কানে যাচ্ছে কোনটা যাচ্ছে না। সে শুধু অবাক হয়ে রাশেদ সাহেবের মুখের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছে। মনে হচ্ছে যেন তাকে এই প্রথম দেখছে।[চলবে]

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


3 Responses to নক্ষত্রের গোধূলি-১৬

You must be logged in to post a comment Login