নীল নক্ষত্র

নক্ষত্রের গোধূলি-৬

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

একটু পরে নিচে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে রাশেদ সাহেব অবাক।
একি মহিউদ্দিন, এ কি করেছ? এ তো রাজকীয় ভোজের আয়োজন! রাশেদ ভাই যে কি বলেন, ভেবেছেন আপনার কথা ভুলে গেছি?তবুও আমার মন বলছে আপনার মন মত কিছুই হয়নি। আপনার মনে আছে সেই পিকনিকের কথা?
কোন পিকনিক?
ওই যে আহসান স্যার যেবার গিয়েছিলেন।

সে আর মনে থাকবে না?এ কি ভোলা যায়? সেগুলি তো এখন স্মৃতি। তবে কি জান মহিউদ্দিন এখন আর আমার সে দিন নেই।
কেন ভাবী বুঝি রাঁধতে পারে না?
রফিক বললো না মহিউদ্দিন তোমার অনুমান সঠিক নয়, ভাবীর রান্নার তুলনা নেই।
তাহলে?
আমার যে ডায়াবেটিস।
ওঃ তাই নাকি?
তোমার ভাবী আর কি দিয়েছে জানি না তবে ওষুধ গুলি দিতে ভুল্ করে নাই সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত, ব্যাগ খুলে দেখতে পার।
এমন সময় মহিউদ্দিনের মোবাইল বেজে উঠলো। পকেট থেকে বাম হাতে ফোন বের করে কানে নিয়েই বলল ভাবী আপনার আয়ু অনেক দিনের, এই মাত্র আপনার কথাই হচ্ছিল, না ভাই বলছিল যে তোমার ভাবী ওষুধ দিতে ভুল করার কথা নয়। নেন ভাবী ভাইয়ের সাথে কথা বলেন।

হ্যালো!
ও পাশ থেকে মনিরার কন্ঠ ভেসে এল।
কি করছ?
এইতো রাজকীয় ভোজের সামনে বসেছি এখনই শুরু করবো, তোমরা কি করছ?
আমরাও খেতে বসবো, ওষুধ গুলি খেও সময় মত।
হ্যা সেই কথাই বলছিলাম, খাবো চিন্তা করো না।
রাশেদ সাহেব যাবার পর থেকেই মনিরার মনটা ছটফট করছিল একটু কথা শোনার জন্য, কোথায় আছে, কি করছে জানার জন্য।

ভোরের দিকে জাহাজ চিটাগাং পৌছার পর পতেঙ্গায় তেল কোম্পানির জেটি গুলির কাছে কর্ণফুলি নদীর এক পাশে নোঙ্গর করে রেখে সবাই কিছুক্ষণের জন্য শুয়ে পরলো। সারা রাতই প্রায় গল্প করে চা খেতে খেতে এসেছে। সকাল নয়টায় অফিস খোলার পর রফিক অফিসে গিয়ে লোডিং অর্ডার নিয়ে এলে জাহাজ নোঙ্গর তুলে জেটিতে এসে ভিড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাইপ কানেকশন করে লোড শুরু করে রফিক আর মহিউদ্দিন চলে এলো। বিকেল নাগাদ লোড শেষ হলে রাতের জোয়ার নিয়ে খুলনা যাবে।

দেখলেন রাশেদ ভাই, কিছু চন্দন কাঠ পুরিয়ে এই যে এই লোডিং অর্ডার আনলাম ওই দেখেন ময়ূরপঙ্খী আমাদের আগে এসে বসে আছে। সারা বছরই এই ভাবে চলে। কাঠ খর না পোড়ালে লোডিং অর্ডার দিবে না, এক সপ্তাহ বসে থাকলে কোম্পানিই বা বাঁচে কি ভাবে আর আমরাই বা বাচি কি ভাবে। কোম্পানিও জানে তাই চন্দনের যোগাড় দিয়ে দেয়, মাথা ঘামায় না। এদিকে বেতনও কমিয়ে দিয়েছে কাজেই এই ভাবে নানান কলা কৌশল ফন্দি ফিকির করে আমরাও টিকে আছি আবার কোম্পানিকেও টিকিয়ে রেখেছি। নতুবা কোম্পানির লাল বাতি জ্বলে যেত অনেক আগে।
এই অবস্থায় আমার মনে হয়না, আপনার যে আদর্শ দেখে এসেছি এতোদিন তা বিসর্যন দিয়ে এখানে টিকতে পারবেন।

ঠিকই বলেছ মহিউদ্দিন। এসব আমি করতে পারবো না। দেখি শেষ পর্যন্ত মনে হচ্ছে বিলাতেই যেতে হবে। আমি যেতে চাই না। বিদেশে যারা থাকে তাদের কয়জন মান সম্মত কাজ করতে পারে তা দেখেছ। যে দেশে থাকে তারাই বা কি্ রকম ঘৃণার চোখে দেখে তাও জান, এই সব নানা কিছু ভেবে আমি বিদেশে যেতে চাই না। অথচ এদেশে আমি প্রথম শ্রেনীর নাগরিক আর ওখানে গেলে কি হব, সাধারন দিন মজুর তাই না?কারন পরিচয় দেবার মত কাজ পাওয়া আমার সম্ভব নয়, আমার যে যোগ্যতা তাতে তা পাবো না, এটাও একটা কারন তার পর যাদের দেশে থাকবো তারা যদি আন্তরিক হতো তাহলেও একটা কথা ছিল, কিন্তু সে কি আর সম্ভব?ওরা জানে যে এই সব তৃতীয় বিশ্বের আধা কাল মানুষ গুলি আমাদের দেশ থেকে রোজগার করে নিজ দেশে ধনী সাজতে এখানে এসেছে।

এই তাচ্ছিল্য আর অবজ্ঞা আমি কোন দিন সহ্য করতে পারিনি মহিউদ্দিন। আমার নিয়তি যদি তাই লিখে থাকে আমার ভাগ্যে তাহলে তা খণ্ডাবার কোন উপায় নেই। এই বয়সে স্ত্রী সন্তান ছেড়ে থাকা যে কি কঠিন কাজ সে তো আর তোমাদের বলতে হবে না নিজেরাই এখন বুঝতে পার। তবুও যেতেই হবে।
কথার ফাকে স্টুয়ার্ড এসে দুপুরের খাবার রেডি হয়েছে কখন খাবে জানতে চাইল। চলেন ভাই খেয়ে নিই।
চল।
টেবিলে বসার পর মহিউদ্দিন বিরাট একটা ভাজা কৈ মাছ তুলে দিল রাশেদ সাহেবের পাতে, প্লেটের প্রায় এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত।
একি মহিউদ্দিন, এতো বড় কৈ কোথায় পেলে?
আপনার জন্য জোগার করেছি, কথা বলবেন না খেয়ে নেন।

বিকেলে লোড হবার পর হিসেব নিকেশ করে জেটি ছেড়ে আবার বাইরে গিয়ে জোয়ারের অপেক্ষা করবে। জেটি ছাড়ার আগে রফিক রাশেদ সাহেবকে নিয়ে লাল খা বাজারের কাছে কোচ স্টেশনে এলো। রফিক স্কুটার থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে কাউন্টার থেকে কোচের টিকেট কিনে রাশেদ সাহেবের হাতে দিল। রাস্তায় খাবার জন্য কিছু কমলা, দু’টা স্যান্ডউইচ আর এক বোতল পানি কিনে দিল।
রাশেদ ভাই কিছু মনে করবেন না, ভীষন নির্দয় ভাবেই কথাটা বলছি, মহিউদ্দিন যা বলেছে আমার মনে হয় তাই ভাল হবে, আপনি শুধু শুধু এখানে আর কিছু খোজা খুজির চেষ্টা না করে পারলে ওখানেই চলে যান, আপনার তো আর ভিসার সমস্যা হবে না। কি করবেন, আপনার কাছেই শিখেছি, জীবন যেখানে যেমন তেমন চলতে দিও’ কথাটা আপনি বলতেন কিন্তু তখন এর মানে বুঝিনি এখন বুঝি। মাঝে মাঝে মানুষের জীবনে এমন সব জটিল মুহুর্ত এসে পরে যে কি করবে, কোথায় যাবে হিতাহিত বিচার করার কোন সুযোগ থাকে না। কষ্ট হলেও কিছু করার নেই, ভাগ্যকে মেনে নিতেই হবে। নয়তো কে ভেবেছে যে সারা জীবন এমন ন্যায় নীতি আর আদর্শ নিয়ে চলে আপনার আজ এই পরিণতি হবে। আমার কষ্ট হচ্ছে যে আপনার এই দুর্যোগের মধ্যে আমি কিছু করতে পারলাম না, আমার ক্ষমতাই বা কতটুক, আমাকে ভুল বুঝবেন না, আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি আগেও আপনাকে যেমন শ্রদ্ধা করতাম এখনো তেমনি করি। এ কদিন ভেবে আমি এ ছাড়া আর কোন সহজ সমাধান পাইনি।

ওদের কথা বলতে বলতে ড্রাইভার এসে গাড়ি স্টার্ট দিল।
যান গাড়িতে বসুন গিয়ে, আসি তাহলে।
রাশেদ সাহেব রফিককে বুকে জড়িয়ে ধরে প্রায় কেঁদে ফেললেন।
তাহলে আসি, তোমরা সাবধানে থাক, ভালো থাক।
বলে গাড়িতে উঠে পরলেন। জানালার পর্দা সরিয়ে দেখলেন রফিক কোচ অফিসের সামনের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আছে, কোচ ছেড়ে দিল।(চলবে)

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


One Response to নক্ষত্রের গোধূলি-৬

You must be logged in to post a comment Login