নীল নক্ষত্র

নির্বাক বসন্ত [মোট ২৫ পর্ব], পর্ব-৯

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

এমন সময় দরজার দিকে দেখে শিকদার সাহেব আসছে।

দাঁড়াও যেয়ো না দেখি শিকদার কোন খবর পেয়েছে কি না জেনে যাও।

শিকদার, এদের কনফার্মেশন পেয়েছ? শিকদার এদিকে এগিয়ে এসে বুড়োর হাতে কয়েকটা কাগজ দিল। বুড়ো সেগুলি দেখে বলল নাও তোমাদের ফ্লাইটের ডিটেইলস নিয়ে যাও। সবার হাতে যার যার একটা ফ্লাইট সিডিউল দিয়ে দিল। নিশাত দেখে আগামী রবিবার বিকেল ৫টায় চিটাগাং থেকে ঢাকা, ঢাকা থেকে বাংলাদেশ বিমানে রাত ৯টায় দুবাই, দুবাই থেকে পরদিন রাত ৯টায় গালফ এয়ারে বাহরাইন হয়ে লন্ডন।

তা হলে আমরা কি এখন যেতে পারি?

ওকে মাই ডিয়ার, শনিবারে সকালে এসে সব কিছু নিয়ে যাবে আর ফ্লাইটের দিন দুপুর দুইটার মধ্যে এসে এখানে রিপোর্ট করবে, গুড নাইট।

গুড নাইট।

অফিস থেকে বের হতেই সন্ধ্যা হয়ে গেছে।

নিশাত বলল, হাবিব আজ হলো মাত্র বুধবার তাহলে বাড়িতে একটা টেলিগ্রাম করে দেই, অন্তত ঢাকা এয়ারপোর্টে ওরা আসলে দেখা হবে।

হ্যাঁ চল টেলিগ্রাম অফিসে, দেখি খোলা আছে কিনা।

একটা রিকশা নিয়ে কাছের আগ্রাবাদ টেলিগ্রাম অফিসে গিয়ে হাবিব এবং নিশাত দুই জনেই নিজ নিজ বাড়িতে টেলিগ্রাম করে জানিয়ে দিল, চিটাগাং থেকে আমাদের ফ্লাইট আগামী রবিবার বিকেলে, ঢাকা থেকে টার্মিনাল চেঞ্জ করার সময় কিছুক্ষণের জন্য দেখা হতে পারে, আপনারা সবাই ঢাকা এয়ারপোর্টে আসবেন। টেলিগ্রাম করে আবার আর একটা রিকশা নিয়ে মাদার বাড়ি খালার বাসায় ফেরার পথে বারেক বিল্ডিঙের কাছে এসে হাবিব নিশাতকে জিজ্ঞেস করল

কি রে নিশাত তোর কি হয়েছে আমাকে বলবি না?

নিশাতের কোন সারা নেই।

হাবিব আবার জিগ্যেস করল।

এবারেও নিশাত নিরুত্তর দেখে হাবিব নিশাতের হাত ধরে ঝাঁকুনি দিতেই নিশাত চমকে উঠে বলল

কি হয়েছে?

তুই কি এখনই লন্ডন চলে গেলি?

না।

তাহলে সেদিন থেকেই দেখছি তোর কোন কথা নেই এখনও দুই বার ডাকলাম কোন সারা নেই, কি ব্যাপার কি হয়েছে আমাকে খুলে বল।

নিশাত মনে মনে বলল না রে হাবিব আমি লন্ডন যাইনি। আমি যেখানে গিয়েছিলাম সে তোকে এই মুহূর্তে বলতে পারছি না। যেখানে নিরু নামের এক চঞ্চলা দুরন্ত হরিণীর মত এক মেয়ে আছে, সারা দিন ছুটে বেড়ায়, গুন গুন করে গান গায় যার মনের কোন এক গহীনে আমার জন্য একটু খানি জায়গা আছে এবং আমি সে কথা বুঝতে পারি। সেদিন সে আমাকে বলেছে আমার জন্য অপেক্ষা করবে।

হাবিব আবার তারা দিল, কি রে বলবি না?

না হাবিব কিছু হয়নি এমনিই ভাবছি কোথায় যাচ্ছি, কেমন হবে কি হবে এই সব।

তুই কি ভয় পাচ্ছিস?

আরে না, ভয়ের কি আছে, শুনলি না বুড়ো কি বলল, ওখানে এজেন্ট আছে না?

তাই বলে এমন মন খারাপ করে থাকবি না কি?

না মন খারাপ করলাম কোথায়?

এই যে কোন কথা বলছিস না, ডাকলে তার কোন জবাব দিস না। চল কাল তো কোন কাজ নেই, আলমাস হলে একটা সিনেমা দেখে যাই।

কাল?

হ্যাঁ, কাল দুপুরে বা সন্ধ্যার শো।

চল, দেখা যায়।

কথা বলতে বলতে খালার বাসা এসে গেল। বাসায় ঢুকে গত রাতের মত খালা খালুর সাথে আজ সারা দিনের ফিরিস্তি জানাল। ফ্লাইটের খবর শুনে হাবিবের খালাত ভাই বোনেরা সবাই আনন্দে লাফিয়ে উঠলো। পর দিন সকালে নাশতা খেয়ে আশে পাশে একটু ঘোরাঘুরি করা বাসায় ফিরে এসে দুপুরে খেয়ে আবার বের হলো আলমাস হলের দিকে। সিনেমা দেখে সন্ধ্যায় ফিরে এলো। যাবার আগে এক দিন পতেঙ্গা, ফয়েজ লেক আরও কোথায় কোথায় বেড়াল।

শনি বার সকালে এসে জেমস ফিনলের অফিসে বুড়োর সাথে দেখা করল। ওরা সবাই এসেছে। বুড়ো চা খাচ্ছে। নিশাতকে দেখে হ্যাল্লো ইয়াং ম্যান গুড মর্নিং!

গুড মর্নিং।

বুড়ো টেবিলের ড্রয়ার খুলে একটা একটা করে বড় খাম বের করে তার ভিতরে থাকা ওদের টিকেট, ঢাকা এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন অফিসারকে লেখা চিঠি এবং আরও কিছু প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র বুঝিয়ে দিয়ে বলল এগুলি সব সাবধানে রাখবে। তোমরা এই প্রথম দেশের বাইরে যাচ্ছ সাবধানে থাকবে, ওয়েল ড্রেসে থাকবে। আর শোন মেয়েদের দিকে কিন্তু ভুলেও তাকাবে না বলে একটু হেসে দিল। কি, বুঝেছ?, অল ক্লিয়ার?

ইয়েস অল ক্লিয়ার।

ও কে, তাহলে কমপ্লিটলি রেডি হয়ে ব্যাগ এন্ড ব্যাগেজ নিয়ে কাল ঠিক দুপুর দুইটায় এখানে এসে ওই শিকদার সাহেবের সাথে দেখা করবে। উনি তোমাদেরকে এয়ারপোর্টে নিয়ে যাবে।

হুট করেই শনিবার ফুরিয়ে গেল। রাতে নিশাতের চোখে ঘুম নেই। সারা রাত নিরু তার চোখের পাতা দিয়ে ধীর পায়ে কেমন একটা উদাস ছন্দে হেঁটে বেড়াল। গানের সুরে সুরে যেন কি কি বলেছে কিন্তু নিশাত তার কিছুই বুঝতে পারেনি শুধু কান পেতে দূর পাহাড়ের ঝর্ণাধারার তানের মত একটা সুর ওর কানে বেজেছে। মনে হচ্ছিল তুমি আমার তুমি আমার। চোখে ঘুমের কোন চিহ্ন নেই। সকালে হাবিব ডাকল

নিশাত উঠবি?

আমিতো উঠেই আছি।

উঠ, নাশতা করে সব গুছিয়ে নিই।

নিশাত উঠে হাত মুখ ধুয়ে খালার সাথে নাশতা খেয়ে হাবিবের সাথে এসে ব্যাগ থেকে সব কিছু বের করে আবার ভাজ করে কাপড় চোপর টুকি টাকি এটা সেটা সব গুছিয়ে সবার শেষে ক্রু ডিপার্টমেন্টের বুড়োর দেয়া প্যাকেট বের করে সিডিসি, আইডি কার্ড, টিকেট, চিঠি সব কিছু বুড়ো যে ভাবে বলে দিয়েছে সে ভাবে ভরে ব্যাগের পকেটে রেখে রেডি হয়েই বসে রইল। খালা আজ একটু তাড়াতাড়ি রান্না করে ওদের খাইয়ে দিলেন। বাসা থেকে একটায় বের হয়ে সময় মত অফিসে এসে পৌঁছে দেখে এনামুল আর সালেক মিয়া এখনো আসেনি। একটু অপেক্ষা করার পর ওরা এলো।

দুপুর তিনটা। সবাইকে নিয়ে অফিসের একটা বড় গাড়িতে শিকদার সাহেব চিটাগাং এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছালেন। এখানে ডমিস্টিক এয়ারপোর্ট তেমন কিছু দেখল না। শুধু টিকেট দেখে মালামাল চেক করে বোর্ডিং কার্ড দিয়ে দিল। শিকদার সাহেব সবার সাথে হ্যান্ড সেক করে বুড়োর মত মাগনা কিছু উপদেশ দিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেল আর ওরা প্লেনে উঠে বসল। একটু পরেই বিমান বালার ঘোষণা শুনে বুঝল প্লেন টেক অফ করতে যাচ্ছে। ঘোষণা শেষ হবার সাথে সাথেই প্রায় প্লেন রান ওয়ে দিয়ে ট্যাক্সিং করে এক সময় সো করে আকাশে উরে গেল। সামনে নিচে বঙ্গোপসাগর পরে রইল। নিশাত আর হাবিব মাত্র সেদিন পতেঙ্গা এসে এই সাগর দেখে গেছে।

প্রায় চল্লিশ মিনিটের মধ্যেই ঢাকা ডমিস্টিক টার্মিনালে নেমে ভিতর দিয়ে ওরা আন্তর্জাতিক লাউঞ্জে এসে পৌঁছেই দেখে নিশাতের দাদি, মা বাবা সহ সব ভাই বোন এসেছে। নিশাত আরও যেন কাকে খুঁজছিল। এদিক ওদিক তাকাল কিন্তু না কেউ কোথাও নেই। হাবিবের মা বাবা ভাই বোনদের দেখল। এগিয়ে এসেই দাদিকে সালাম করে নিলো। দাদি মাথায় হাত দিয়ে অনেকক্ষণ কাঁদলেন। এই বয়সে তোকে একা একা বিদেশ যেতে হচ্ছে। দাদির কথা জড়িয়ে জড়িয়ে আসছিল। নিশাত দাদিকে বুকে জড়িয়ে শিশুর মত বোঝাল। যাবার সময় কেঁদে মন দুর্বল করে দিবেন না, মন ভালো আছে তাই থাকুক। শুধু শুধু তাকে কেন দুর্বল করছেন? এমন না যে, না গেলে চলবে, যেতে যখন হবেই তা হলে আর কান্না কাটি করে কি হবে? একে একে মা বাবা সবাইকে সালাম করে মায়ের কাঁধে মাথা রেখে একটু আদর নিয়ে ছোট ভাই বোন দের বুকে নিয়ে আদর করে এদিক ওদিক কাকে যেন খুঁজে কাওকে না পেয়ে হাবিবকে নিয়ে এগিয়ে গেল চেক ইন কাউন্টারের দিকে। সাথের এনাম আর সালেক একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিল। ওরা সহ চেক ইন কাউন্টারে এসে টিকেট, সিডিসি দেখিয়ে বোর্ডিং কার্ড নিয়ে নিলো। সাথে মালপত্র কিছু নেই শুধু সবার সাথে একটা করে হাত ব্যাগ। এর আবার কি ওজন হবে তাই মালামাল ওজনের ঝামেলা নেই। শুধু একটা ট্যাগ লাগানো। বোর্ডিং কার্ড নিয়ে আবার ফিরে এলো মা বাবার কাছে। আবার এক দফা সবাই মিলে বিচ্ছেদের গান গেয়ে মাইকে দুবাই যাত্রীদের প্লেনে আরোহণ করার ঘোষণা শুনে এগিয়ে গেল ইমিগ্রেশন কাউন্টারে। ওখানে জেমস ফিনলে অফিসের ক্রু ডিপার্টমেন্টের বুড়ো ব্যাপ্টিস্টের দেয়া খাম আর সিডিসি দেখাল। ইমিগ্রেশন অফিসার খাম খুলে চিঠি দেখে সবার সিডিসিতে ঢাকা ডিপার্চার সিল দিয়ে ফেরত দিয়ে দিল। ওরা এগিয়ে বোর্ডিং লাউঞ্জে গেল। একটু পরে প্লেনে উঠে সীট নম্বর দেখে খুঁজে যার যার সীটে বসে পরল। সব যাত্রী ওঠা হলে যাত্রীদের সীট বেল্ট বাধার ঘোষণা। নিশাত এর আগে বাবা মায়ের সাথে অনেক বার ঢাকা করাচী বা করাচী ঢাকা বিমানে ভ্রমণ করেছে কিন্তু হাবিবের এই প্রথম, কাজেই হাবিব নিশাতের কাছে কাছে থাকছে।

একটু পরেই প্লেন ট্যাক্সিং করে রাতের ঝল মল ঢাকা শহরের বাতি গুলি নিচে রেখে নিজের ডানা মেলে পাখির মত আকাশে উড়ে গেল। নানা ভাবনার পর আবার সেই নিরু। প্লেন তো বীণা আপার বাড়ির উপর দিয়েই যাচ্ছে। ওখানে নিরু কি করছে এখন, ঘুমিয়ে পরেছে? হাতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ভাবল এখন কি ও রাত জেগে গল্পের বই পড়ছে নাকি ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে? নিরু কি জানে এই প্লেনে কে যাচ্ছে?

[চলবে। এতক্ষণ নিশাতের সাথে নিরুর চায়ের নিমন্ত্রণের অপেক্ষায় থাকুন। ধন্যবাদ]

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


You must be logged in to post a comment Login