নীল নক্ষত্র

নির্বাক বসন্ত-৪

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

ফরিদা থেকে ফিরে এসেই কম্বল গায়ে বিছানায় শুয়ে পরেছে। রাত বারোটায় ডিউটি। যদিও নোঙ্গর করা অবস্থায় ডিউটি তেমন কিছু না শুধু কয়েকটা বিয়ারিং দেখা এবং রাডারে চোখ রাখা। নোঙ্গর পিছলে জাহাজ সড়ে যাচ্ছে কি না তাই লক্ষ রাখা। চা, কফি, জুস কোক যা খুশি যত খুশি খাও। ব্রীজে বসে যা খুশী কর কোন বাধা নেই শুধু নিদ্রা দেবির আরাধনায় মগ্ন না হলেই হল। সেই রকম শিক্ষাই দিয়েছে তাদের নেভিগেশন স্কুলে। প্রিন্সিপ্যাল বলতেন ইউ আর গোইং টু বি এ কিং অফ এ স্মল কিংডম সো, ইউ স্যুড গ্রো দ্যাট ওয়ে, আই ডিজায়ার দিস। ইওর এটিচুড, ইওর ম্যানার স্যুড বি লাইক দ্যাট, ইউ স্যুড নট বি এন অর্ডিনারি ম্যান ইউ স্যুড বি এ পারফেক্ট জ্যান্টল ম্যান, দিস ইস মাই ড্রীম। ঠিক এই রকম কঠিন নিয়মানুবর্তিতার মদ্ধ্যে থেকে জাহিদ হয়ে উঠেছে একজন আদর্শ মানুষ।

অথচ সে সাধারন নিম্ন মদ্ধবিত্য ঘড়ের ছেলে। জন্ম নানা বাড়ি ঢাকা শহরের অদুরে রৌহা গ্রামে। বাবা মার প্রথম সন্তান হিসেবে বেশ আদর যত্নেই বেড়ে উঠেছে। ছোট বেলা থেকেই সৌখিন জীবন যাপন তার পছন্দ। তবে বাবার সাদ্ধ্য সীমার বাইরে কখনো কিছু দাবী করেনি। পোষাক আসাক যাই ছিলো তা চকচকে ইস্ত্রী করা ছাড়া কোন পোষাক তাকে কেও কখনো পরতে দেখেনি। পায়ের জুতা জোড়াও সবসময় চকচক করতো। সেই ছোট বেলায় যখন সে মাত্র থ্রীতে পড়তো তখন থেকেই নিজের কাপর কয়লার ইস্তারীতে পাখা দিয়ে বাতাস করে কয়লা জ্বালিয়ে ইস্ত্রী করে পড়তো। নিজের জিনিষ পত্র ঘড় দরজা নিজেই গুছিয়ে পরিষ্কার করে রাখতো। নিজের স্কুলের কাপর চোপর ধুয়ে শুকিয়ে ইস্ত্রী করে গুছিয়ে রাখতো, সাথে বাবা মার কাপরও ইস্ত্রী করে দিত মাঝে মাঝে তবে জুতা পালিশের ব্যাপারে তার একটা খুতখুতানি ভাব থেকেই যেত। এই কাজটাতে সে কখনোই ত্রিপ্তি পেতনা।

রাস্তায় দাঁড়িয়ে জুতা পালিশওয়ালাদের দেখত কেমন করে তারা জুতা পালিশ করছে, আবার বাড়ির কাছের লন্ড্রির সামনে দাড়িয়েও দেখতো তারা কোন কাপর কি ভাবে ইস্ত্রী করছে। বাসায় এসে সেই ভাবে চেষ্টা করতো। এভাবেই অনেক কিছু শিখে নিয়েছিলো। আকাশ, বাতাস, নীল প্রশান্ত সাগর, মাটির ধরনী, কুলি মজুর, ঠ্যালা গাড়ি ওয়ালা, কাঠ মিস্ত্রী কারো কাছ থেকে শেখার কিছু বাকী রাখেনি। ওর বিশাল কৌতুহলি মন যার কাছে যা পেত তাই ধরে রাখত। মা যখন সালাই মেশিন নিয়ে বসতেন তখন তার কাছে বসে দেখতো মা কি ভাবে কেচি দিয়ে কাপর গুলি কেটে তা আবার সেলাই করে কি সুন্দর জামা পাজামা বানিয়ে ফেলছে। ওর অবাক চোখ শুধু বিস্মিত হোত।

সব কাজের লোকদের বেশ সমীহ করে চলতো, কখনো কাউকে ছোট ভাবতে পারতো না। এরা কি সুন্দর করে সব কিছু বানিয়ে ফেলছে এই থেকে তাদের প্রতি ওর একটা শ্রদ্ধা বোধ আসতো ওর মনে। সংসারের কাজ মা একাই করতেন বাসায় কোন কাজের মানুষ ছিলো না তাই সবসময় মাকে এটা ওটা কাজে সাহায্য করত। আটা মাখা। ঘড় ঝাড়ু দেয়া, কাপর গুছিয়ে রাখা থেকে শুরু করে ছোট ভাই বোনদের কান্না থামানো এমনকি রান্নার কাজেও মাকে সাহায্য করতো। সার্টের বোতাম ছিড়ে গেলে কিংবা কোথাও একটু সেলাই খুলে গেলে নিজেই ঠিক করে নিতো মাকে কখনো বলতো না। এই ভাবেই ধীরে ধীরে কখন যেন সংসার নামের বিশাল নাট্য মঞ্চের সকল কুশীলবের অভিনয় তার মুখস্ত হয়ে গেছে তা সেও বুঝতে পারেনি। মা শেখাতেন কি ভাবে বাজার থেকে তাজা শব্জী চিনে কিনতে হয়, কি ভাবে তাজা মাছ চেনা যায়, বাসায় নতুন অচেনা কোন অতিথী এলে তার পরিচয় জানতে হয়, কি ভাবে অতিথী আপ্যায়ন করতে হয়, কোথায় কখন কি খেতে হয় কি খেতে হয় না। সব কিছু।

বাবা মাসের প্রথমে বেতন পেয়ে বাসায় এসে খেয়ে দেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে বাজারে যাবার সময় জাহিদকে সাথে নিয়ে যেতেন। সেদিন সকাল থেকে মাকে দেখতো তেলের বোতল, বাজারের ব্যাগ ধুয়ে মুছে শুকিয়ে রাখতে, বাজারের লিস্ট করতে আর তাই দেখে জাহিদ বুঝতে পারতো আজ মাসের প্রথম, নিশ্চয়ই বাবা বাজারে যাবেন। বাবার সাথে বাজারে যেয়ে লক্ষ করতো বাবা কোন দোকান থেকে কি কিনছে, কি ভাবে দামাদামি করছে, কোন দোকানে কি জিনিষ পাওয়া যায়। বাজার শেষ করে সাইকেলের চার চাকার ঠ্যালা গাড়িতে মালামাল উঠিয়ে দিয়ে বাসার ঠিকানা দিয়ে দিতেন গাড়িওয়ালাকে, সে বাসায় মাল পৌছে দিত। আর ওদিকে বাবা তাকে নিয়ে যেতেন মিষ্টির দোকানে। দেখ বাবা্ তোমার কি পছন্দ। জাহিদ ঘুরে ঘুরে চানাচুর, ডাল ভাজা কিংবা বাদাম ভাজা দেখিয়ে দিত আর তাই দেখে বাবা রসিকতা করেই বলতেন তোমাকে নিয়ে এলাম মিষ্টি কিনতে আর তুমি এসব কি দেখাচ্ছ?হ্যা আম্মুতো মিষ্টি খায় না তাই আম্মুর জন্য এগুলি নিবেন।

ও আচ্ছা আচ্ছা বেশ তাহলে বল তোমার জন্য কি নিবে? একটা কিছু হলেই হবে। মিষ্টি আর ঝাল কিছু নিয়ে বাবার হাত ধরে বাসায় এসেই মার হাতে ঠোঙ্গাটা দিয়ে দিত। বাবা সরকারি চাকরী করতেন কিন্তু তিনি ছিলেন অত্যান্ত ন্যায় পরায়ন লোক, কোন অসদুপায় অবলম্বন করা তার পক্ষে সম্ভব ছিলোনা। যা বেতন পেতেন উচ্ছল ভাবে না হোক মোটা মুটি স্বচ্ছল ভাবেই চলে যেত, বিলাসিতা করা হয়ে উঠতো না। এখনো জাহিদের পরিস্কার মনে আছে যখন সে ক্লাশ সিক্স থেকে সেভেনে উঠেছিল তখন স্কুলের টিফিনের পয়সা বাচিয়ে বাবার হাতে কিছু টাকা তুলে দিয়ে একটা ইলেকট্রিক ইস্ত্রী কিনে আনার জন্য বলেছিল। বাবা তাই দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞ্যেস করেছিলেন তুমি এতো টাকা কোথায় পেলে? যাই হোক সেই দিনই বাবা সন্ধ্যায় দোকানে গিয়ে একটা ইস্ত্রি কিনে এনেছিলেন।

নতুন চকচকে ইস্ত্রী পেয়ে জাহিদের আনন্দ দেখে কে?বারবার উলটে পালটে দেখছে প্লাগে কানেকশন দিয়ে দেখে নিল গড়ম হচ্ছে কি না। গড়ম হতে দেখে সে যে কি খুশী। সাথে সাথেই নিজের স্কুলের জামা প্যান্ট, বাবার জামা মায়ের শারী সব ইস্ত্রী করে ফেললো।

পাকিস্তানের করাচি শহরেই এতোদিন বড় হয়েছে। সবে মাত্র স্কুল ফাইনাল শেষ হবার পর পরই শুরু হোল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ। যুদ্ধ চলা কালিন জুলাই মাসে ওরা করাচির সব ছেড়ে চলে এলো নিজ দেশে। ঢাকা এয়ারপোর্টে নামার আগেই প্লেনের জানালা দিয়ে দেখতে পেল পাকিস্তানি আর্মিরা নানা রকম অসত্র হাতে এয়ারপোর্ট ঘিড়ে রেখেছে, দেখেই মেজাজ বিগিড়ে গেল। রাখ শালারা তোদের মজা দেখাচ্ছি, বাবা মা যেতে দিক বা না দিক আমিতো অবশ্যই মুক্তি বাহিনিতে যাবই, তখন দেখবি মজা। শালারা পরের দেশ দখল করে রেখেছ আবার হাতিয়ার দেখাচ্ছ? এয়ারপোর্টের বাইরে এসে দেখে মেঝ মামা দড়িয়ে আছেন। বাবা আগেই টেলিগ্রাম করে জানিয়ে রেখেছিলেন।

মামার গাড়িতে করে তার ধানমন্ডির বাসায় এলো। পথে বৃষ্টি ভেজা, কাদা মাখা চাপা রাস্তা, শেওলা ধরা দালান কোঠা দেখে মনটা দমে গেল, পরক্ষনেই আবার মনে জোড় ফিরে এলো যাই হোক এই হোল আমার নিজ দেশ। পরের চাকচিক্য দেখে ভুলে থাকলে চলবে না, নিজের যা আছে তাই নিয়েই মাথা উচু করে বাচতে হবে, এরই নাম জীবন, এরই নাম স্বাধিনতা। আবার মনে হোল এইতো যুদ্ধ শুরু হবার পর এখানে আসার মাস দুয়েক আগে বাবা দাদির জন্য কিছু টাকা পাঠাতে দিয়েছিলেন। করাচি শহরে তাদের স্থানিয় পোস্ট অফিসে গিয়ে টাকা সহ মানিওর্ডার ফরমটা পোস্ট অফিসের কেরানির হাতে দেয়ার পর যখন সে দেখলো ইস্ট পাকিস্তানে যাবে তখনই সে ফরমটা ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলো মুখে বলেছিলো ইস্ট পাকিস্তানমে রুপিয়া নেহি যায়গা, ভাগো ইহাছে।

টাকার নোট গুলি ঘড় ভরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গিয়েছিলো। তার পিছনের কিউতে দাঁড়ানো পাকিস্তানি লোকেরা তামশা দেখছিলো। জাহিদ স্থির থাকতে পারেনি, কাচের কাউন্টারের উপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে লোকটার মাথার চুল টেনে ধরে বলেছিলো ‘কিউ নেহি যায়গা?ইয়ে তেরা বাপকা রুপিয়া হায় কিয়া? দিখা তেরা সরকারি হুকুম দিখা।পিছন থেকে এক পাঞ্জাবি লোক এগিয়ে এসে জিজ্ঞ্যেস করলো কিতনা রুপিয়া, যাদা নেই স্রেফ ৫০ রুপিয়া। শুনে সে কেরানীকে বলে বুঝিয়ে তারপর সে টাকা পাঠায়। সেই দিনই বুঝতে পেরেছিলো স্বাধযীনতা আমরা এখনো পাইনি। স্বাধীনতা আমাদের অর্জন করতে হবে।

মামার বাসায় ২/১ দিন থেকে তারা সোজা চলে এসেছিলো ঢাকা ছেড়ে মানিকগঞ্জের অদুরে ছোট্ট এক গ্রামে, মামার গাড়িই তাদের মালামাল সহ বানিয়াজুরি পর্যন্ত পৌছে দিয়েছিলো। বর্ষা কাল বলে গাড়ি আর যেতে পারেনি। সেখান থেকে নৌকায় করে এসেছিলো গালা ইউনিয়নের ছয় আনি গালা গ্রামে। তখন মুক্তি যুদ্ধের তোলপার। জাহিদ সেই পোস্ট অফিসের ক্ষত এখনো ভুলেনি। গ্রামে তার সমবয়সী চাচা, অন্যান্ন চাচাত ভাইদের সাথে বুদ্ধি পরামর্শ করে মুক্তি যুদ্ধে যাবার দিন তারিখ ঠিক ঠাক করে ফেললো। গোপন চুক্তি হোল, কে কে যাবে, কখন কোথা থেকে কি ভাবে যাত্রা শুরু হবে সব পরিকল্পনা অত্যান্ত চুপি চুপি করা হোল, কাক পক্ষীতেও টের পায়নি।

লুঙ্গী, গামছা, গুড় চিরা সব কিছুই বেধে রেডি। রাত ১২টায় চাচাতো ভাই মালেক আরো কয়েক জনকে সঙ্গে নিয়ে আসলে এক সাথে রওয়ানা হবে। রাত জেগে বসে রইলো, এক সময় মোরগে বাগ দিল, কাকের কা কা ডাক শুরু হোল, পাখীরা কিচির মিচির করতে করতে বাসা ছেড়ে রওয়ানা হোল, ঘড়ের বেড়ার ফাক দিয়ে ভোড়ের মৃদু আলো এসে ঢুকলো কিন্তু মালেক এলো না। তার বদলে এলো বাবা।(চলবে)

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


7 Responses to নির্বাক বসন্ত-৪

You must be logged in to post a comment Login