নীল নক্ষত্র

নির্বাক বসন্ত-৭

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page


পরদিন ওরা ঢাকায় চলে এল। মিরপুর এলাকায়, বাবা যেভাবে ঠিকানা লিখে বলে দিয়েছিলেন সেই অনুযায়ী ঠিক ভাবে আসতে কোন অসুবিধা হয়নি। গাবতলি নেমে নতুন শহর বলে একটু ইতস্তত লাগছিল তবুও আসতে পেরেছে। জাহিদ কলেজে ভর্তি হোল, ছোট ভাই বোনেরা স্কুলে।
কয়েক মাস থাকার পর মা এক দিন জাহিদের সাথে পরামর্শ করলেন, পরের বাড়িতে থেকে মাসে মাসে এত গুলি টাকা ভাড়া দিয়ে সংসার চালান কঠিন হয়ে যাচ্ছে। আমি ভাবছি যদি নিজেদের একটু জায়গা হোত তাহলে যেমন তেমন একটু টিনের চাল বেধে থাকার ব্যবস্থা করতে পারলে এই ভাড়ার টাকা গুলি বেচে যেত।
তা হয় কিন্তু জমি কেনার এত টাকা পাবেন কোথায়?

কেন, গ্রামের বাড়িতে আমাদের এজমালি জমি গুলি আছে সেগুলি থেকে আমরা কি পাই?ওগুলি বিক্রি করে দিলে যে টাকা আসবে তা দিয়ে হয়ে যাবে।
বেশ ভাল কথা, আব্বার সাথে আলাপ করে দেখেন কি বলে।

জাহিদের বাবা বিকেলে অফিস থেকে ফেরার পর হাত মুখ ধুয়ে চা নাস্তা খাবার সময় জাহিদের মা কথাটা তুললেন। শুনে সেও মোটা মুটি সম্মতি জানাল। এবার গ্রামের ওই সব টুকরা টুকরা জমি পুকুর, বাগানের অংশ যেখানে যা ছিল সব বিক্রি হয়ে গেল। শুরু হোল জমি খোজার পালা। এক সময় তাও হয়ে গেল, যেখানে ভাড়া থাকত তার কাছেই ছোট এক টুকরো জমি পেয়ে রেজিস্ট্রি ইত্যাদি যা করার তাও হয়ে গেল। নতুন জমিতে কোন রকম কাচা মাটির একটা দোচালা টিনের ঘর, পাশে বাশের বেরার চাল দেয়া রান্না ঘড় আর কাচা একটা টয়লেট বানানোর কাজ হয়ে গেল। এবার একটা শুভ দিন শুভ লগ্নে তারা নতুন বাড়িতে উঠে পরল। কাচা পাকা যাই হোক নিজেরতো, মাস শেষে ভাড়ার টাকা গুনতে হবে না। বাড়ি দিকে আস্তে আস্তে বাশের বেরা দিয়ে ভিতরে কিছু শাক সবজির বাগান করে নিল পাশেই একটু খোয়ারের মত করে কয়েকটা মুরগী। এইতো নিজের বাড়ি আর ভাড়া বাড়ির তফাত। এখন থেকে ভাড়াতো দিতে হয়ই না উপরন্তু কিছু শাক সব্জী সহ ডিম মাংশের খরচও কমে গেল। যত ছোটই হোক আর যত সামান্যই হোক ঢাকা শহরে নিজের একটু খানি কুটিরের দাম যে কি তা হারে হারে বোঝা যাচ্ছে।

এক দিন সকালে কলেজে যাবার আগে জাহিদ বাগানে সব্জীর যত্ন করছে এমন সময় একটু দূরে খোলা রাস্তায় নজর গেল। দেখল সবুজ শারী পরা এক জন মহিলা আর তার সাথে বাচ্চা কোলে নীলের মধ্যে হলুদ ছাপা কামিজ গায়ে এক মেয়ে এদিকে এগিয়ে আসছে। হঠাত চেনা চেনা মনে হোল। আরো একটু কাছে এলে দেখল পারুল আর তার বড় বোন শিমুল আসছে। শিমুল মাঝে মাঝেই আসে। পাশে যখন ভাড়া বাড়িতে থাকত তখনও এসেছে কয়েক বার। কিন্তু সেই আসা আর আজকের আসার মধ্যে কোথায় যেন একটু পার্থক্য মনে হল জাহিদের কাছে। আজ যেন এক ভিন্ন সুর বেজে উঠল জাহিদের মনে।

বিশ্বে প্রতিনিয়ত কত কিছুই ঘটে যাচ্ছে তার সব কিছু মনের চোখে সব সময় ধরা পরে না। আবার অনেক কিছু আজ যে রকম মনে হয় সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথেই ভিন্ন জনের কাছে ভিন্ন ভাবে ধরা দেয়। সময়, কাল, স্থান ভেদে ভিন্ন রূপ ধারন করে। এও ভাল। এক ধরনের বৈচিত্র। প্রকৃতি যেমন খেয়াল পাল্টায় মানুষের মনও তেমন। আজকের যা ভাল লাগছে কাল তা আকড়ে ধরে রাখতে পারছে না। শুধু পার্থক্য এ টুক যে এর মধ্যে মেঘনা নদী বেয়ে অনেক পানি বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে, ঘড়ির কাটা মহা কালের সাথে মিলনের জন্য বার বার ঘুড়েই চলেছে। দক্ষিন মেরু থেকে অনেক বাতাস উত্তর মেরুর দিকে বয়ে গেছে। পৃথিবীতে অনেক ক্ষুধা তৈরী হয়েছে।

শিমুল পারুলকে নিয়ে জাহিদদের বাড়িতে এসেছে। চাচির সাথে দেখা করার জন্য। গতকাল পারুল এসেছে ওকেও সাথে করে নিয়ে এসেছে। পারুলের স্কুল বন্ধ হলেই একটা দিনও দেরি না করে সোজা বড় বোনের কাছে এসে কাটিয়ে যায়। পারুল গ্রাম থেকে আসার সময় এই এটা ওটা যা গ্রামের বাড়ি থেকে শহরে আনতে হয়, ক্ষেতের কিছু মটর শাক, ধনে পাতা, কলার মোচা, গাছের কিছু ফল মুল, কাচা আম, কিছু আম সত্ব, নারকেলের লাড়ু, গাছের পাকা কুমড়োর মোরব্বা যা কিনা মা নিজে বানিয়েছে, কয়েকটা গাছ পাকা কত বেল। ঢাকা শহরে কি আর গাছ পাকা কত বেল পায়? ওতো সব জাগ দেয়া। যা খেয়ে বড় হয়েছে সেই ছোট বেলায় যা নিয়ে মন কষা কষি হয়েছে, যা নিয়ে ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখেছে সে দিন গুলির স্মৃতি কি মনে পরে না?সেই বাড়ির ঘাটের নয়তো চৌ রাস্তার ছবি, সেই গন্ধ আবার পিছনে ফিরে দেখতে ইচ্ছে করে না?তাই আসার আগে মা পোটলা বেধে এগুলিও দিয়ে দেয়। শিমুল আবার তাই কিছু চাচির জন্যে নিয়ে এসেছে। চাচীও ওগুলি পেয়ে বেশ খুশি। দেখ শিমুল তোর মা আছে সে এই সব পাঠিয়েছে, আমার মাও নেই কে পাঠাবে।

মা সিঙ্গারা বানালেন, রান্না ঘরের পাশে পিড়িতে বসেই চা সিঙ্গারার পালা শেষ। মা বায়না ধরলেন পারুলকে নিয়ে এসেছিস আজ দুপুরে এখানে খেয়ে যাবি, কফিল আসবে সেই সন্ধ্যায় কাজেই আর চিন্তা কি?বাড়িতে ভাড়াটিয়ারা আছে। অকাট্য যুক্তি দেখালেও প্রথমে শিমুল একটু আমতা আমতা করে শেষ পর্যন্ত রাজী হয়ে গেল। জাহিদের মা রান্না ঘর থেকে বের হয়ে জাহিদকে একটা মুরগী বের করতে বলে কলেজে যাবার তাগিদ দিলেন। জাহিদ আস্তে করে বলল আজ কলেজ বন্ধ। বন্ধ! তখন যে বললি তারাতারি যাবি! বলেছিলাম না কি? কি জানি ভুলে বলেছি মনে হয়। আচ্ছা থাক কলেজে আজ যেতে হবে না তার চেয়ে মুরগীর খাচার বেড়া গুলি জায়গায় জায়গায় ভেঙ্গে গেছে ওগুলি ঠিক করি কাজে লাগবে। মুরিগী বেরিয়ে যায় ধরে আনতে আপনার কষ্ট হয়। মা কি বুঝলেন তা জাহিদ জানে না তবে মা আর চাপা চাপি করেননি। জাহিদ একটা মুরগী বের করে পাশের বাড়ির কালামকে ডেকে জবাই করে মার হাতে এনে দিয়ে ঘর থেকে সারাশি   গুনা তার এনে আবার লেগে গেল খোয়ার ঠিক করার জন্য। মন কাজে ছিল না হাত দুটাই শুধু নেট বাধার কাজে উঠা নামা করছে। এক সময় পিছনে চেনা পায়ের শব্দ শুনে পিছন ফিরে দেখে পারুল এসে দাঁড়িয়ে তার মুরগীর খামার দেখছে। জাহিদকে পিছনে তাকাতে দেখে পারুল বলল বাহ বেশ সুন্দর। এক এক করে মুরগী গুলি গুনে দেখে বলল পনেরটা। জাহিদ পিছনে তাকিয়ে ধমকে উঠল তুই আবার এখানে কেন এলি, যা তোর চাচীর কাছে গিয়ে বস। এ কথা শুনে পারুল আর একটা মুহুর্ত দেরি না করে চলে গেল। জাহিদ আবার পিছনে ফিরে ওকে দেখতে না পেয়ে কেমন যেন বেদিশা হয়ে গেল। এ কি করলাম যার জন্য কলেজে গেলাম না তাকে এ কি বললাম?কি হে জাহিদ মিয়া। তুমি কোন ধরনের মানুষ? এ যে তোমার প্রথম প্রেম তা কি বুঝতে পারছ না?ওদিকে পারুল এসে সেই যে চাচীর কাছে বসল  যতক্ষন ও বাড়িতে ছিল ততক্ষন কারো সাথে আর একটি কথাও বলে নি।(চলবে)

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


2 Responses to নির্বাক বসন্ত-৭

You must be logged in to post a comment Login