জুলিয়ান সিদ্দিকী

প্রমিত বাংলা বিষয়ে একটি অসম্পূর্ণ আলাপ(দ্বিতীয় কিস্তি)

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

পূর্বে প্রকাশিত অংশের পর

এই যে বাংলা ভাষার প্রমিত রূপ প্রণয়নের লক্ষ্যে এত হাঁক ডাক লম্ফ-ঝম্প, কেন? নদী যেমন গতিপথ বদলায়, লোকালয়ের পুরোনো রাস্তা ভেঙে বা বদলে নতুন রাস্তা তৈরি হয়। ভাষাও তেমনি একটি পরিবর্তনশীল বিষয়। নয়তো প্রমিত বলে যে শব্দগুলো আমরা বাল্যকাল থেকে পাঠ্যবই থেকে শিখেছি তার রূপ কিন্তু এখনো ঠিক তেমনটিই বজায় থাকেনি। অখণ্ড বাংলার বিজ্ঞ পণ্ডিতরা যে কতকগুলো শব্দকে নির্দিষ্ট পরিধিতে বেঁধে দিয়েছিলেন, প্রমিত বা মান অথবা স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে তা আজ তো বটেই ভবিষ্যতেও বাংলা ভাষা যতদিন লিখিত রূপে বেঁচে থাকবে তা অত্যাবশকীয় হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু কালে কালে তার রূপও বদলে যেতে দেখেছি। নমুনা হিসেবে বলতে পারি যে, বাল্যকালে অনেক শব্দ দীর্ঘ-ঈ কার দিয়ে লিখেছি। যৌবনে এসে তার অনেকগুলো হ্রস্ব-ই কার দিয়ে লেখা অভ্যাস করতে হয়েছে। এখন বার্ধক্যে এসেও পুনরায় শিখতে হচ্ছে নতুন বানান রীতি। যেমন, তৈরী শব্দটাকে লিখতে হচ্ছে তৈরি। এই যে ক্রমাগত শাব্দিক গঠন বা নির্মাণের উত্থান-পতন বা নাড়াচাড়া তা কি প্রমিত বিধানের লঙ্ঘন নয়?

আমাদের ভাষার কান ধরে টানাটানির অধিকার কেবল বাংলা একাডেমী নামের অসীম ক্ষমতাধর সরকারি প্রতিষ্ঠা্নটিরই আছে বলে, সে একবার বলে এভাবে, আরেকবার বলে এভাবে নয় ওভাবে। মায়ের মুখে একটি কথা প্রায়ই শুনতাম যে, “তিন লাড়ায় কামাইল্যা মরে।“ এখানে কামাইল্যা হচ্ছে এক জাতের গাছের আঞ্চলিক নাম। ভিন্ন এলাকায় তার নাম কাফিলা। পরিশুদ্ধ ভাষায় বা তার লিখিত রূপ হিসেবে পাই ঝিগা বা ঝিকা গাছ হিসেবে। একটি শব্দের নানা রূপ বা পরিচিতি আছে। এমনকি তার বানানে আর উচ্চারণেও এলাকা ভেদে বেশ হেরফের লক্ষ্য করা যায়। আমি মনে করি বানানের বা উচ্চারণের ভিন্নতা থেকে পরিত্রাণের উদ্দেশ্যেই প্রমিত রীতিটির প্রয়োজনীয়তা চলে আসে। নয়তো শব্দটাকে লিখে অভ্যস্ত ব্যক্তি নতুন রূপে লিখতে গিয়ে প্রথম প্রথম ভুল করবেনই।

পৃথিবীর সব দেশে তরল খাদ্য পান করার বিধান আছে। কেবল আমরাই আজব একটি জাতি যারা দুনিয়ার তাবৎ বস্তুই খায়। অর্থাৎ ভক্ষন করে। এ জাতির কাছে পান করার মত কিছুই নাই। এ ব্যাপারটির একটি প্রমিত শব্দ পান করা ছিলো। কিন্তু কালে কালে তা রূপান্তরিত হয়ে হয়ে গেল খাওয়া। বাংলাদেশীরা চা, পানি, দুধ, কফি, মদ, বিয়ার, শরবত, ফেন্সিডিল সবই কেবল খায়। ক্ষমতাসীনরা যেমন ইদানীং খেতে আরম্ভ করেছে বুড়িগঙ্গা নদীকে। গুলশান লেককে।

আবার শব্দের ওপর আঞ্চলিকতা, ইংরেজির প্রভাবের পাশাপাশি ধর্মিয় প্রভাবও কম বেশি রয়ে গেছে। যেমন একজন কট্টর বাঙালি মুসলিম জল কথাটাকে হিন্দুর ভাষা বলে বিশ্বাস করতে বা ব্যবহার করতে পারেন। তেমনি একজন কট্টর বাঙালি হিন্দুও ভাবতে পারেন পানি শব্দটা মুসলিমদের ভাষা। কাজেই শব্দটা মুসলিম। মানুষের ভেতর যেমন সামাজিক ও ধর্মিয় ভেদাভেদ আছে, তেমনি ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণেই ভাষার কাঁধেও চড়ে বসেছে সেই ভেদাভেদ। কথিত আছে  বা অনেক পণ্ডিতই নানা ভাবে প্রমান করতে চান যে, বাংলা ভাষা সংষ্কৃত থেকে উৎপত্তি। যে কারণে বাংলা ভাষায় তৎসম শব্দের আধিক্য লক্ষণীয়। এক সময় হিন্দু মুসলমানের চাপে পড়ে জেরবার বাংলাভাষা একটি খিচুরি রূপ পরিগ্রহ করতে বসেছিলো। যার ফলে মুসলিম কবি সাহিত্যিক সাংবাদিকরা সচেতন ভাবে বাংলা ভাষায় আরবি ফারসি উর্দু শব্দ ব্যবহার করতেন। ভিন্ন ভাষা থেকে নানাবিধ শব্দ আমদানী করার ফলে হয়তো আমাদের ভাষা সমৃদ্ধ হয়েছে। কিন্তু আমাদের বাংলা ভাষা হারাতে বসেছিলো নিজস্ব পরিচয়। যেমন আজকাল টেলিভিশনে বা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অনেক শিল্পি বা উপস্থাপককে ঠিক ইংরেজি ভঙ্গীতে বাংলা বলতে দেখা যায়। আশির দশকে উচ্চবিত্ত আর মধ্যবিত্ত শ্রেণীটির আলাপ কালীন ভাষায় উচ্চারণগত বেশ কিছু পার্থক্য প্রায় শ্রুতিকটূ পর্যায়ে চলে গিয়েছিলো। ব্যঞ্জণ বর্ণের অন্তর্গত (অন্তস্থ /ব-শূন্য) র অক্ষরটি বেশ কঠিন দশায় পতিত হয়েছিলো। এখনকার ডি-জুস প্রজন্মের মত অনেকেই পরে, করে, ধরে, ঘরে, শব্দগুলোকে উচ্চারণ করতেন পড়ে, কড়ে, ধড়ে, ঘড়ে ইত্যাদি। এই যে শব্দের ওপর অনাকাংক্ষিত ভাষিক বলের অপ প্রয়োগ তা রোধ করতেই আরো বেশি প্রয়োজন প্রমিত রীতির প্রয়োগকে আবশ্যিক করে তোলা। কিন্তু যাঁরা আমাদের জন্য এই বিধান রচনা করবেন বা ঠিক করবেন তাঁরাই আটকে আছেন মান্ধাতা আমলের গ্যাঁড়াকলে। শতবর্ষের বৃত্ত থেকে মুক্ত হতে পারছেন না কিছুতেই। যদিও শেষ পর্যন্ত কায়-ক্লেশে আমাদের বাংলা একাডেমী একটি ‘প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ শিরোনামে একটি গ্রন্থ প্রনয়ণ করেছেন, তাতেও দেখা যায় অনেক ভিন্নতা। যে নিয়ম দেখে আমরা শিখবো, তার যদি একাধিক নিয়ম থাকে, তাহলে আমরা কোন নিয়মটি অনুসরণ করবো? একটি শব্দের একাধিক বিকল্প থাকলে কোনটিকে শুদ্ধ বলে জানবো? একাধিক বিকল্প রাখার প্রয়োজনটা কি? একটি শব্দের একাধিক বিকল্প থাকলে প্রমিত কথাটার মূল্যই বা থাকে কী? আমাদের বাংলা যেমন রাষ্ট্রীয় ভাষা, তেমনি পশ্চিম বঙ্গের বাংলা সেখানকার অঞ্চলিক ভাষা। অথচ বাংলা একাডেমী ভারতের আঞ্চলিক ভাষার নিয়ম নীতি যুক্ত করে দিয়েছেন ‘প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ নামক গ্রন্থটিতে। তাও তাদের নিয়মকে পুরোপুরি আমাদের জন্য অনুকরণীয় হিসেবে বিধান দিয়ে দিতেন তাহলেও বোধ করি আমাদের বাংলা বানান বা শব্দের গঠনের ক্ষেত্রে এমন হ-য-ব-র-ল অবস্থাটা হতো না। যেমন, ‘বাংলায় এ কিংবা এ -কার দ্বারা অবিকৃত এ এবং বিকৃত বা বাঁকা অ্যা এই উভয় উচ্চারণ বা ধ্বনি নিষ্পন্ন হয়।’

আবার ‘তৎসম এবং বিদেশি শব্দ ছাড়া অন্য সকল বানানে অবিকৃত-বিকৃত নির্বিশেষে এ বা এ-কার হবে’ এমনকি ‘বিদেশী শব্দে অবিকৃত উচ্চারণের ক্ষেত্রে এ বা এ-কার’, ‘বিকৃত বা বাঁকা উচ্চারণে অ্যা বা ্যা (য-ফলা আকার) ব্যবহৃত হবে।’

১৯৮৮ সালে টেক্সট বুক বোর্ডের বানান বিধিতে বলা ছিলো ‘ইংরেজি বক্র ধ ধ্বনির জন্য শব্দের প্রারম্ভে এ ব্যবহার্য।‘ যা কিনা ১৯৯২ সালে পরিবর্তন করে বলা হয়, উচ্চারণ বিভ্রান্তির সম্ভাবনা থাকলে বক্র ধ-র জন্য অ্যা ব্যবহার করতে হবে। তবে যেসব বিদেশি শব্দের ক্ষেত্রে বাংলায় ব্যাপকভাবে ‘এ’ ব্যবহার হয়ে এসেছে, সেসব ক্ষেত্রে বিকল্পে ‘এ’ ব্যবহার করা যাবে। যেমন- একাডেমী, এডমিরাল, এভিনিউ,এলকোহল, এসিড প্রভৃতি বানানের ক্ষেত্রে বিকল্প বানান নির্দেশ করা হয়নি। অথচ বিকল্প বানানের ফলেই মূলত: বিভ্রান্তির সুযোগটা থেকে যায় বলে মনে করি।

আমরা যখন কথা নিজেদের ভেতর কথা বলি, এমনকি অনেক বাংলা নাটকের সংলাপে আর বাংলা ব্লগ তো আছেই, সেখানে বলা হচ্ছে তুমি কি ব্যাপারটা আলাপ কোরসো? বা ব্লগের কোনো পোস্ট পড়ে পাঠক যখন মন্তব্য করেন, “আপ্নের লেখাটা তাইলে কপি-পেস্ট মার্সেন!”

প্রমিত রীতিতে ও কথ্য রীতিতে সে দুটো বাক্য কেমন হবে দেখি-

তুমি কি ব্যাপারটি আলাপ করেছো বা করেছ? পশ্চিম বঙ্গে হলে মুখে বলতো তুমি কি ব্যাপারখানা আলাপ করেচো?

আবার দ্বিতীয় বাক্যে আপনার লেখাটা তাহলে কপি-পেস্ট মেরেছেন? পশ্চিম বঙ্গে মুখে- আপনার লেকাটা তা’লে কপি-পেস্ট মেরেচেন? লেখার সময় ঠিক লিখলেও বলার সময় কিন্তু ঠিক থাকছে না। বলার ক্ষেত্রে বললুম, খেলুম, দেখলুম ‘উম’প্রত্যয় বা অনুসর্গ কোন শ্রেণীভূক্ত তা আমার কাছে ততোটা পরিষ্কার নয়।

এখন কেউ যদি মনে করেন যেমন করে বলতে পারছি তেমন করে লিখতে পারবো না কেন? তখনই কেউ কেউ হা হা করে উঠে বলে উঠবেন, এটা কি একটা ভাষা হলো? অনেক আগে কলকাতার দেশ বা আনন্দলোক পত্রিকাতে কানন বালা আথবা আঙুর বালা দেবীর হাতে লেখা একটি চিঠি ছাপা হয়েছিলো। সেখানে চলে গেছে’র স্থলে লেখা ছিলো চোলে গেছে। আবার আমাদের কোনো কোনো কবি সাহিত্যিকের কিছু কিছু বাতিক আছে দেখা শব্দটাকে দ্যাখা, লেখা কে ল্যাখা লেখেন। এমন অবস্থা বেশিদিন চলতে পারে না। বা চলা উচিত নয়। লেখালিখির ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট শব্দ থাকা উচিত, যার হাজারটা অর্থ থাকলেও ক্ষতি নেই। কিন্তু প্রায়োগিক দিক থেকে যেন তার কাঠামোর পরিবর্তন না হয়।

কারো কারো লেখায় জমি বা ক্ষেত বুঝাতে ‘খেত’ লিখতে দেখেছি। অথচ সাধু বা চলিত ভাষায় সেটি খাইত ‘খেতো (আহার), বোঝাতো।

তা ছাড়া আমাদের কোনো কোনো শব্দ অতি ব্যবহারে শুদ্ধতায় পরিবর্তিত হতে দেখেছি। এমনকি বাংলা একাডেমী তা গ্রহণও করেছেন। যেমন- উপর(Up, On, Top) শব্দটি সৈয়দ শামসুল হকের হাতে পড়ে হয়ে ওঠে ওপর, উঠে হয় ওঠে। যেমন আমি নিজেই এমন শব্দ ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। পুরোনো কালের লেখকরা ‘উঠে’র বদলে ‘ওঠে’ ব্যবহার করেছেন বলে খুব একটা মনে পড়ে না। যা এখন আমাদের কারো কাছে ভুল বলে মনে হয় না। তবু আমরা দেখতে পাই যে, বাংলা একাডেমী নিজেই নিয়ম বানায় অথচ নিজেরাই সে নিয়ম লঙ্ঘন করে বসে আছেন। আজ একটি নিয়ম তৈরি হলে দুদিন পরই নিয়মটি উলটে যাবে, তাহলে প্রমিত বলতে কী সৃষ্টি হলো বা থাকবে? একজন এটা বলে যাবেন, ভিন্ন জন এসে বলবেন আরেক কথা। প্রমিত ভাষা বা বানান তো বিজ্ঞানের থিয়োরি বা হাইপোথেসিস নয় যে, যুক্তি তর্কে বা গবেষণায় উলটে যাবে! একটি ভুল বানান যদি আমরা দেশের সব স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবহার করি তাহলে সেটাই সঠিক। কারণ সবাই একই বানান আর গঠন রীতি মানছেন। কিন্তু শ্রদ্ধেয় বুড়ো জমিদার বাবু যখন ভুল ভাবে লেখেন- ভেঙে মোর ঘরের চাবি, নিয়ে যাবি কে আমারে… তখন তা কী নিদারুণ ভাবে আমাদের বিচারে সঠিক বাক্য বলে পরিগণিত হয়। সে ক্ষেত্রে যুক্তি একটাই- তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলে। একজন বিশ্ব কবি বলে। তিনি ভুল করলে সেই ভুলটাই শুদ্ধ বলে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য।

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


9 Responses to প্রমিত বাংলা বিষয়ে একটি অসম্পূর্ণ আলাপ(দ্বিতীয় কিস্তি)

You must be logged in to post a comment Login