রিপন কুমার দে

প্রেম সমাচার (না-বলা গোপন কথা)!

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

funny-emoticons-3জুন-জুলাই মাস! বৃষ্টির মা বাপ নাই। এমন সময় যখন-তখন বৃষ্টি আসবে, ভিজাবে, আবার চলে যাবে, এমনই তো নিয়ম। কিন্তু তা হচ্ছে না! বর্ষাকালে মানেই একটু প্রেমপ্রেম ভাব থাকবে, মেঘবাদল আসলে সবাইকে একটুআধটু ভিজিয়ে যাবে, কাউয়াভেজা অবস্থায় প্রেমভাব জাগ্রত হবে! সেরকমও কোন লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। সেটা থেকে অনেকে বঞ্চিত। আমি বঞ্চিত নই। আমার প্রেম ভাব জাগ্রত, ইনসম্নিয়া কারনে জাগ্রত! এই জাগ্রত ভাব ধরে রেখেই এই প্রেম সমাচার শুরু করছি।

ঘটনা-১:

তখন আমার একটুতেই প্রেমে কাইত হয়ে যাওয়ার বয়স! যাই দেখি তাই ভাল লাগে। বুড়া-ধুরা একটু সুন্দরী হলেই আমি কাইত!  প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা ভাল, তখন আমার কোন প্রেমই ৭ দিনের বেশি টিকে নাই। শুধু এটাই একটু বেশি দিন লাস্টিং করেছিল। গুনে গুনে ১০ দিন।

তখন আমি সিলেটের সরকারী পাইলট স্কুলে পড়তাম। নবম শ্রেণীতে উঠেছি শুধু। এক ম্যাডাম বিজ্ঞান পড়াতেন। নাম শীলা। আমরা শীলা-দিদি বলেও ডাকতাম। ম্যাডাম ছিলেন অতিমাত্রায় সুন্দরী। “রূপে আগুন জ্বলে” রকমের। ক্লাসের কুট-বন্ধুরা কুটচালে এই ম্যাডামকে ‘ইয়ে’ ম্যাডাম বলেও ডাকত। স্কুলজীবনে আমি ছিলাম লুতুপুতু টাইপের, এমনিতে কিছু প্রকাশ করতাম না, কিন্তু ভিতরে ভিতরে জ্বলে মরতাম!  প্রথম ক্লাসেই আমি ম্যাডামের প্রেমে পড়ে গেলাম।

প্রেমের সূত্র বা নিয়মমাফিক এই ম্যাডামের ক্লাসে আমার মনোযোগ থাকার কথা না! ক্লাসে বসে বসে ম্যাডামের স্কেচ আঁকতাম আর আকাশকুসুম কল্পনা করতাম, “রাজপুত্র ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দে আসিয়া রাজকন্যাকে উড়াইয়া নিয়ে চইলা গেল” টাইপ কল্পনা। তখন আমার চিত্রাংকন প্রতিভা চতুর্ভজ আর ত্রিভুজ আঁকার থেকে সামান্য একটু উপরের দিকে। এই গুন নিয়ে ম্যাডামের ছবি এঁকে বেড়াতাম। ম্যাডামের ছবি আঁকতে আঁকতে ক্রমশ প্রেমভাব আরো বেড়ে যেতে শুরু করল। মানুষের প্রেম জমে ঘি হয়, আমার তখন প্রেম জমে “দৈ দৈ” অবস্থা, বগুড়ার দৈ!

একদিন হঠাৎ ম্যাডাম কি মনে করে ক্লাসের মাঝখানে আমাকে ডাকলেন, গলার স্বরের মধ্যে আমি প্রেমময়তায় উপস্থিতি পেলাম। আমার হৃদস্পন্দন দ্রুত বেড়ে যেতে লাগল। হা করে তাকিয়ে আছি, প্রথম প্র্রেমের সাড়া পেলে যা হয় আরকি! মনে মনে ভাবলাম, ম্যাডামদের ‘আই রিডিং’ তো খুব ভাল থাকে, ক্লাসে পড়ান তো। হয়তো ম্যাডাম আমার “দিল কা ধারকান” যে কোনভাবেই হউক বুঝতে পেরেছেন। ক্লাসের অনেকেই আমার এই ব্যাপারটি জানত। ম্যাডামের ডাকা দেখে তখন চুপিচুপি টিটকারী মারা শুরু করে দিল। আমার শার্ট ধরে খুছাতে লাগল। আমি তখন ম্যাডামের ডাকে সাড়া দিয়ে ক্লাসের মাঝখান দিনে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছি। লেখালেখীতে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বাজানোর ব্যাবস্থা থাকলে তখন স্লো-মোশনে “দিদি ত্যারা দেবর……..” মিউজিকটি বাজানো যেত।

ম্যাডামের সামনে যাওয়া মাত্রই ম্যাডাম আমাকে অবাক করে দিয়ে একটি লম্বা শাড়ি ধরিয়ে দিলেন। ম্যাডাম কার কাছ থেকে জানি শুনেছেন, চিত্রাংকনে আমার তখন বিরল (?) প্রতিভা, এ প্রতিভা তো এমনি এমনি নষ্ট হতে দেওয়া যায় না, প্রতিভা কাজে লাগানো দরকার! এ সুযোগ ম্যাডাম কাজে লাগাচ্ছেন। আমার অনেক উপকার করছেন (!)। আমাকে শাড়িটি ধরিয়ে দিয়ে শাড়ির জমিনে সুন্দর করে আল্পনা আঁকার জন্য আদেশ দিলেন। আমি তখনও নির্বিকার তাকিয়ে আছি। এরকম কোন মেয়েলি ব্যাপার-স্যাপারে আগে কখনই পড়িনি! আর আঁকবই কি, কিছুই তো জানি না।

কিন্তু তারপরেই মনকে বুঝালাম এই বলে যে, প্রেম করতে গেলে অনেক চড়াই উৎরাই পার হতে হয়, প্রেমিকেরা তো ডেমকেয়ার ভাব নিয়ে জলেও ঝাপ দেয়, তাজমহল বানিয়ে ফেলে, গাছে রশি লটকিয়ে ঝুলে পড়ে, শরীরে বিষ ঢুকিয়ে যেকোন সময় মরে যায়, আর এ তো সামান্য কয়েকটি আল্পনা আঁকা, এ আর এমন কি! মামুলি ব্যাপার!

আমি তাই এ সুযোগটি কাজে লাগাবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলাম। বাসায় গিয়ে নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে আল্পনা আঁকা শুরু করে দিলাম। মনের অজান্তে যা আঁকলাম, তা হল, ‘লাভ’ সাইন বড় করে তার ভিতরে আরও ছোট ছোট ‘লাভ’ সাইন জোড়া দিয়ে বিশাল বড় প্রেমচিত্র-ক্যানভাস!

১০ দিনের মাথায় ক্লাসে আমার প্রেম শিল্পকর্মটি নিয়ে ম্যাডামের কাছে প্রেম-নয়নে হাজির হলাম। ম্যাডাম আমার এই হেন বিরল (!) প্রতিভা দেখে যারপরনাই শক খেলেন! আকাশ থেকে পড়লেন। চোখমুখ দেখি একটু একটু করে ফুসে উঠছে। একটু পরেই রেগেমেগে আগুন। বললেন, তোকে মেরে “তক্তা” বানিয়ে দেওয়া দরকার। তোকে কি শাড়ি নষ্ট করতে বলেছি? তোকে এগুলো আকতেঁ বলেছি? ম্যাডাম আমাকে শেষমেষ পর্যন্ত “তক্তা” বানান নাই। সামনে বসা ক্লাস-টিচার আমাকে বাঁচিয়ে দিলেন। তবে আমার কিশোর-প্রেম তখন মরে “তক্তা” হয়ে গিয়েছিল, সেই তক্তা দিয়ে ইজিলি ‘অতবি-র’ চেয়ার, টেবিল বানানো যেত!

ম্যাডাম আমার প্রেম ধরতে পারেন নাই। শাহজাহান তপনের পদার্থবিজ্ঞানটি অপদার্থের মত ম্যাডামেক উপজীব্য করে আমাকে কামড়ে দিয়ে গেল শুধু এবং কামড় দিয়ে সফলও হল! তবে আমি ম্যাডামকে এখনও ভুলে যেতে পারি নাই! দেশে গেলে ম্যাডামকে এখনও আমি মনে মনে খুজিঁ। কৈশোর প্রেম কখনও মরে না, সে প্রেম চিরজীবি। খুঁজলে খাজলে আমার স্কেচ বুকে এখনও ম্যাডামের অনেক ছবি পাওয়া যাবে। ম্যাডাম-প্রেমের শেষ নিদর্শন এই ছবিগুলো।

ঘটনা-২:

এটাও স্কুল জীবনের ঘটনা। ক্লাস টেনের দিকের ছাত্র তখন। সিলেটের একটি স্কুলে পড়ি। নতুন নতুন সিনিয়র হয়েছি। কিছুদিন পরেই কলেজে ঢুকে পড়ব। নির্বিকার হাতে নিয়ম ভাঙার ক্ষমতা আর সাহস দুইটা এক সাথে পেয়েছি তখন। নীরবে দুনিয়ার তাবৎ বাঁদরামিকে আমি আমার ক্লান্তিহীন প্রচেষ্টা দিয়ে একটা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেলাম। সেটা কখনই বাইরে প্রকাশ পেত না। সবার কাছে অতি ভদ্র নামেই আমার খ্যাতি! আর আমি এই সুযোগের সদ্ব্যবহার (!) করতে লাগলাম!

আমি একদিন স্কুল শেষ করে পথে আমার ৬ বছর বয়সী কাজিনকে নিয়ে রিকশা করে ওর স্কুল থেকে নিয়ে কোন এক কারনে এমসি কলেজের দিকে যাচ্ছি। এমসি কলেজ সম্বন্ধে যারা জানেন না তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, প্যারিস যদি ফ্রান্সের প্রেম নগরী হয়ে থাকে, তাহলে সিলেটের প্রেমনগরী হল এমসি কলেজ। নানান জাতের প্রেম হয় সেখানে প্রতিদিন! তো মূল ঘটনায় আসি, আমার কাজিনের নাম হল ‘জনি’। ফিরার পথে হঠাৎ দুরে দেখি আরেকটি রিকশা আসছে, রিকশায় তিন সুন্দরী। এমনিতে আমার মাথায় বুদ্ধি থাকে না। কিন্তু সুন্দরী দেখলেই আমার প্রতিভা(!) বেড়ে যায়। দুষ্টবুদ্ধি মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। কাজিনকে বললাম, বাবা, ওই যে দেখছিস রিকশা। ওইটা কাছে আসলেই জোরে “বৌদি” বলে একটা চিৎকার দিবি। পারবি না?

কাজিন চোখ মুখ খিছিয়ে প্রবল উৎসাহ নিয়ে বলল, “পারব না কেন? পারব, ছোড়দা”! দাড়াও খালি, এটা আসুক। আমি দম বন্ধ করে রিকশায় শক্ত হয়ে বসে থাকি। কাজিন চোখ মুখ শক্ত করে তাকিয়ে থাকে লক্ষ্যের দিকে। আমি মনে মনে গোনা শুরু করি। চার, তিন, দুই এক, “গোলললল…”। কাজিন পুরো সিলেট শহর কাঁপিয়ে “বৌদিইইইইই” বলে চিৎকার দিল। ঘটনার আকস্মিকতায় তিন সুন্দরীর উপরে বসা জন উপর থেকে গড়িয়ে পড়তে পড়তে শেষমুহূর্তে এসে নিজকে সামলে ফেলে। আমি খুব ভদ্র ছেলের মত কাজিনকে লোকদেখানো শাসন করতে লাগলাম, “এসব কি করছিস, এমন করে নাকি কেউ!?!?” আমাদের রিকশাওয়ালাও শক খেল। ঘটনার ভয়াবহতাকে পুরোপুররি উপেক্ষা করে, কাজিন আবারো বিপুল উৎসাহে চিৎকার দেওয়ার এটেম নিচ্ছিল। আমি ওর মুখ টিপে ধরলাম। সেদিন কোনভাবে বেঁচে গিয়েছি! কিন্তু এরকম কোন রিকশা দেখলে এখনও সেই ঘটনা মনে হয়! সেই কাজিন এখন অনেক বড়, এখনও এই শিখিয়ে দেওয়া ডাক মনে রেখেছে কিনা কে জানে!

ঘটনা-৩:

কোন এক অজ্ঞাত কারনে আমার বেশিরভাগ প্রেমই হয়ে যেত বড়দের সাথে। এ গল্পের নায়িকাও ক্লাসের হিসাবে আমার চেয়ে ৮ বছরের সিনিয়র। এই ঘটনাটি আমি আগে কোথাও হয়তো বলেছি। আজ আবারও বলছি।

তখন ক্লাস এইটে পড়ি। নায়িকার সত্যি নাম প্রাসঙ্গিক নয় বলে বলছি না। অসত্যি নাম ঝুমুর। ঝুমুর দিদির বাসা ছিল আমাদের বাড়ির কয়েক বাড়ি পরেই। সাইকেলে করে প্রতিদিন স্কুলে যেতাম তখন। যাওয়ার সময় প্রায়ই উনাকে দেখতাম রিকশার জন্য অপেক্ষা করে থাকতেন। “প্রায়ই দেখতাম”- বলছি কারন উনার বেরুবার সময় আমার মুখস্থ ছিল বলে আমিও ঘড়ি দেখে টায়-টায় ওই সময়ই বের হতাম। উনি আমার সম্বন্ধে কিছু আচঁ করতে পেরেছিল কিনা সেটা জানিনা, তবে আমি রাস্তা অতিক্রম করার সময় উনি মিষ্টি করে প্রায়ই এক চিলতে হাসতেন। একদিন দেখা না হলেই কিছু ভাল লাগত না আমার। স্কুলে গিয়েও ক্লাসে মনোযোগ বসাতে পারতাম না। বন্ধুবান্ধবরাও এ নিয়ে হাসাহাসি করত। পরিচয়ের শুরুটা কিভাবে শুরু করা যায় তাই নিয়ে ভাবতে লাগলাম রাত-দিন, পড়াশোনা তখন চাঙ্গে।

একদিন বিকেলবেলা উনাদের বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। তখন দেখলাম উনি রিকশা থেকে নামছেন। নেমে কি মনে করে নিজে থেকেই হাত ইশারা করে ডাকলেন আমাকে। আমি এই পুচকে বয়সে এরকম অদ্ভুদ আচরণ করছি কেন এসব নিয়ে ক্রমাগত জিজ্ঞাসাবাদ করতে লাগলেন। আমি তখন কোন উত্তরই দিতে পারিনি। ইতিমধ্যেই বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছি। তাকিয়েই ছিলাম শুধূ। তাছাড়া সত্যি বলা তখন সম্ভবও ছিলনা। আর মিথ্যা বলার জন্যও যথেষ্ঠ স্মার্ট হতে হয়। আমি মোটেও স্মার্ট নই। আমার এহেন অবস্থা দেখে আমি চোখে দেখার আগেই হঠাৎ কষে একটা চড় দিলেন আমাকে। আমি নগদে বোল্ড। অফ খেয়ে বিষন্ন চোখে তাকিয়ে থাকলাম। ওনার ভেতরে যে এই চেহারা নির্মম লুকিয়ে ছিল সেটা আমি একদমই আন্দাজ করতে পারিনি। আমার এই অবস্থা দেখে উনি হাসলেন, চুড়ি ভাঙ্গা হাসি। আমি সেই হাসি শুনে আবারও হাবার মত ওর দিকে চেয়ে থাকি। মনে মনে বুঝ দেই, “মেয়েরা বরাবরই  প্রেমে বড়ই নিষ্টুর হয়, এ আর এমন কি!!” প্রথমে ঝড়, তারপরই সুবাতাস। আমি প্রতিবাদের ধার দিয়ে গেলাম না তাই! চুপচাপ বাড়ি চলে গেলাম।

এর পরের সময়টুকু ছিল সিগারেট ধরানোর আর উদাস নয়নে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকার স্টেজ। অনেক যুগান্তকারী কবিতাও লিখে ফেলেছিলাম তখন। আমি হাড় ভাঙ্গলাম না। বিপুল উৎসাহে আবারও ঝাপিয়ে পড়লাম। ন্যাড়া বেল তলায় একবারই যায়। কিন্তু“হ্যালমেট” থাকলে একাধিকবার যাওয়া যায়, এভাবে মনকে বুঝালাম! আমি চারপাশে হ্যালমেট খুজতে থাকি। পেয়েও গেলাম, সেই হ্যালমেট পড়ে আবার এগুবার প্রস্তুতি নিলাম।

পাড়া-প্রতিবেশীর মাধ্যমে খবর নিলাম ওনার বাবা থাকেন দেশের বাইরে, মা-ই উনাদের দেখাশোনার দায়িত্ত্ব পালন করেন। সেই মা নাকি ভালই ডলা দিতে জানেন। তাতে আমি ভয় না পেয়ে রাত দিন শুধুই ভাবতে লাগলাম কিভাবে ভালবাসার কথাটি ওনার কাছে পাড়া যায়। পরে আর কোন উপায়ন্তর না দেখে সহজতর মাধ্যম হিসেবে চিঠি চালাচালির পরিকল্পনাটাই হাতে নিলাম। আর সাত-পাচঁ না ভেবে আমার সকল সাহিত্যপ্রতিভাকে সম্বল করে প্রেমের চিঠিখানি লিখতে শুরু করে দিলাম।

প্রায় দু’সপ্তাহ স্কুলে না গিয়ে, নাওয়া-খাওয়া রীতিমত বন্ধ করে দিয়ে, কলেজ লাইব্রেরী থেকে নানান রকম কবিতা আর অমর প্রেমের কাহিনী সম্বলিত গাদা-গাদা বই বাসায় নিয়ে এসে আমার সকল আবেগ আর সাহিত্যমেধা উজাড় করে দিয়ে অনেক খেটেখুটে চৌদ্দ পাতার একটি কালজয়ী প্রেমের চিঠি দাড় করালাম। লিখার পর নিজেই পড়ে আত্মগুণে যারপরনাই মুগ্ধ হলাম। ভাবতে লাগলাম এ লিখা পড়ে তো ‘মারতে উদ্যত একজন কুখ্যাত খুনি’র মনও গলে যাওয়ার কথা। আর উনি তো যুবতী মেয়ে, প্রেম-সিজন চলমান! আমি কালক্ষেপন না করে প্রবল উৎসাহে চিঠিটি একদিন উনাদের মেইলবক্সে ফেলে দিয়ে আসলাম।

দিন যায়, রাত যায়, আমি চিঠির জবাবের অপেক্ষায় থাকি। গেইটে টুংটাং শব্দ হলেই দৌড়ে আসি, চিঠির খুজেঁ। প্রায় এক সপ্তাহ অপেক্ষার পর লাল খামের মোড়কে একটি চিঠি আসল। আমি ভয়াবহ খুশি হলাম। প্রচন্ড খুশিতে দৌড় দিয়ে চিঠিখানা সাথে নিয়ে নিজের ঘরের সিটকিনি আটকিয়ে পড়তে শুরু করলাম। চিঠিতে শুধু একটিই লাইন লিখা।

“লিখ তো ভালই, কিন্তু এত ‘বানান’ ভুল কেন???-ইতি, -ঝুমুরের “মা”।

“মা” শব্দটা দেখে আমার ক্লাস-এইট প্রেম তখনই শেষ! আর ও-পাড়ায় আগ বাড়াই নি! তারপর থেকে আমি অপরিচিত কোন মেয়ে দেখলে আমি ভাই আর প্রেমিকের মাঝামাঝি একটা নোমান্স ল্যান্ডে অবস্থান করি। দুই দায়িত্বই খুশি মনে পালন করি। বেশিরভাগই অবশ্য জোড় করে ভাই বানিয়ে ফেলার একটা অপচেষ্টা প্রায়শই করে। আমি এক্ষেত্রে একটু কৌশলী হওয়ায় সেটা আর সফল হয়ে ওঠেনা। কিন্তু তাতেও ঘটনার নবতর কিছু সংযোজন হয় না!

ঘটনা-৪:

তখন অল্প কিছুদিন হল কানাডায় এসেছি। সবকিছু নতুন লাগে। যা দেখছি তাই ভাল লাগে। বাসে করে প্রতিদিন ইউনিভার্সিটি যাই, রাত করে বাড়ি ফিরি। এক ঘেয়েমি লাইফ, নিরামিষ জীবন-যাপন। প্রতিদিন গাড়িতে উঠার সময় আমি সামনের সিটে বসে যেতাম। বাসে যাতায়াতটা নিয়মিত হওয়ায় একঘেয়েমিত্ব আরো বেড়ে গিয়েছিল। তাই একবার মন্ট্রিলে যাওয়ার সময় ‘ট্রেনে’ করে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। কানাডায় ট্রেনে আগে কখনও চড়িনি। কেন জানি কানাডায় কোন ধরনের যন্ত্রযানের লেবেলের দিকেই আমি তাকাতাম না, তখনও ওদের নিয়মনীতির কিছুতেই অভ্যস্থ হয়ে উঠিনি। আমি ট্রেনের সামনের সিট জুড়ে বসলাম, কারন ব্যাগ-ট্যাগ নিয়ে নামতে সুবিধা। বসার কিছুক্ষন পর লক্ষ্য করলাম, সবাই আমার দিকে কেমন যেন আড়চোখে তাকায়। আামি ভুল ভেবে আবারও ব্যাপারটি মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করলাম। ঠিকই তো, সবাই ই-তো আড়চোখে তাকাচ্ছে। আমি চুপিচুপি নিজের দিকে নজর দিলাম। সবই তো ঠিক আছে, শার্টের জায়গায় শার্ট, জুতোর জায়গায় জুতো, প্যান্টের জায়গায় প্যান্ট। খুব খেয়াল করেও কোন অভিনব অথবা ব্যতিক্রম তো কিছু চোখে পড়ল না। সবার এই কোরবানীর গরু গরু চোখ নিয়ে তাকানোর রহস্য উদঘাটন করতে পারলাম না! সম্ভাব্য সমস্যাটা খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ ধারনা হল, আসলে ওরা মনে হয় আমার দিকে প্রেমনয়নে তাকায়। সাদা চামড়ার ভীরে একজন বিচিত্র চামড়ার প্রতি প্রেম জাগতেই পারে। আমি তখন খুশিতে আটকানা না, আটশ আনার অবস্থায়। মনে মনে বলি, হায়রে বাঙ্গালী নারীসমাজ, তোমরা বুঝলে না! এতটা বসন্ত চলে গেল, আমি এখনও ফেসবুকে রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস সিঙ্গেল দিয়ে ঘুরে বেড়াই। দেখ দেখ এরা গুণী লোকের কদর করতে জানে। আমি মানে মানে চুলের “মাঞ্জা” আরো জোড়ে জোড়ে ঘষামাজা করতে থাকি!

পরক্ষনেই আরেকটি ব্যাপার নজরে এল, মেয়েরা না হয় তাকায় ঠিক আছে, কিন্তু ছেলেরাও কেন তাকায়?? রহস্য আবারো ঘনীভূত হয়ে গেল। আবারো চিন্তায় পড়ে গেলাম। নাহ, এবার যেকোন উপায়ে ঘটনার জট উন্মোচন করতেই হবে। পরে কি মনে করে সিটের পেছন দিকটায় একটু নজর দিলাম, সিটের উপরে একটা টেক্স দেখে আমি তব্দা হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলাম, সিটের উপরে লিখা:

“এই সিট বুদ্ধি প্রতিবন্দী অথবা গর্ভবতী মহিলাদের জন্য।”

ঘটনার আকস্মিকতায় আমি থ হয়ে রইলাম। একটু পরে সবার দিকে একটা বিগলিত হাসি মেরে ধীরে ধীরে মোলায়েম কায়দায় সটকে গেলাম পেছনের দিকে। বিধাতা আমাকে প্রমাণ সাইজের একটা মাথা দিয়েছেন। উনি হয়তো চেয়েছিলেন এটা খালিই থাক। ও ওর নিজের খুশি মত সিস্টেম ইন্সটল দিয়ে নেবে। পরে আমার আর সিস্টেম ইন্সটল দেওয়া হয় নাই। আমি খালি মাথা নিয়ে ঘুরাঘুরি করি। আর মাঝে মাঝেই এই জাতীয় বিপদে পড়ি।

এরপর থেকে আমি কোথায বসবার আগে সিটের লেবেলগুলো বড় বড় চোখ করে দেখে নেই! আর নতুন আসা ছেলেপুলেদের অভিভাবকীয় কায়দায় কড়া করে উপদেশ দেই!!

পরিশিষ্ট: গতকাল আমি মহাবিশ্বের সবচেয়ে আচানক আরেকটি খবরটা পেলাম! আমার নাকি বিয়ে সাদি সব ঠিক, বিয়ের সব সরঞ্জাম কেনাও শেষ! আগামী মাসে বিয়ে হচ্ছে! ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য যে বলেছে তার প্রাণপ্রিয় বন্ধুবরকেও জিজ্ঞাসা করলাম। সে গলায় অতিরিক্ত গম্ভীরতা আর জ্ঞানগর্ভ ভাব ফুটিয়ে এনে বলল, “সত্য কখনও চাপা থাকে না, সত্য একদিন না একদিন বেড়ুবেই”!! আমি বললাম, আমার বিয়ের খবর বন্ধু জানে, বন্ধুর বন্ধু জানে, পাড়াভর্তি লোক জানে, আর আমি জানি না, এটা কেমন কথা! সে আরও গম্ভীর গলায় বলল, “কারন তুই মুখচোড়া, ইচ্ছে করেই চেপে যাচ্ছিস!” সে তার কোন আরেক বিশিষ্ট বন্ধু বরের কাছ থেকে খবর পেয়েছে!! বিশ্বস্থ বন্ধু! তার সে বিশ্বাস আমি কোনভাবেই ভাঙ্গাতে পারিনি। কোন কোন বিশ্বাস আছে ভাঙ্গানোরও প্রয়োজন পড়ে না। এমনিতেই ভেঙ্গে যায়। আমিও আছি তারই অপেক্ষায়!

ঘুম এসে যাচ্ছে, ইমনমসিয়া কেটে গেছে। আমার লিখনকর্মও আজকের মত এখানে শেষ হচ্ছে! আরেকদিন না হয় হবে স্কুল পরবর্তী সমাচারগুলো নিয়ে!

(ন্যাঁকা ধরনের এই লেখাটা প্রাণপ্রিয় বন্ধু তারেককে উৎসর্গ করা হলো, সাম্প্রতিক কালে তারেকের কোন আচার-আচরনই সুবিধার ঠেকছেনা!!)

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


13 Responses to প্রেম সমাচার (না-বলা গোপন কথা)!

You must be logged in to post a comment Login