ফকির ইলিয়াস এর একগুচ্ছ সমকালীন কবিতা
শহীদ মুক্তিযোদ্ধার খুলি । আরও কিছু চাঁদ অবনত হয়ে নেমে আসুক
মাটিতে। এবং দেখুক তার চাইতে কোনো অংশেই কম উজ্জ্বল নয়,
বীরাঙ্গনা প্রিয়ভাষিনীর হাসি। আরও দেখুক এই প্রতিবেশী নদী-
যার বক্ষে একদিন ভেসেছিল লাখো শিশু- তরুণ- বৃদ্ধ মানুষের লাশ।
এতোদিন আলবদরের বিচার করতে পারিনি- যে আমরা ভোট দিয়ে
ক্ষমতায় বসিয়েছিলাম চিহ্নিত রাজাকার- আর তাদের গাড়ীতেই
উড়িয়ে দিয়েছিলাম লাল সবুজের গর্বিত পতাকা, সেই আমাদেরই
কলংক মোচনে এগিয়ে আসুক আরও একটি সর্বগ্রাসী বন্যা- মহামারি।
শির উঁচু করে লিখুক- এই দেশ রাজাকারের তালুক নয়,
এই দেশ মুক্তিযোদ্ধার
এইদেশ মুক্তিযোদ্ধার
এ ই দে শ মুক্তিযোদ্ধার ॥
আর বৃদ্ধ কৃষক লাঙল-জোয়াল ফেলে আকাশ থেকে তুলে আনবে বৃষ্টির ফুলকি-
এমন ঘোষণা লিখে আমিও সাজাবো বিলবোর্ড- লিখে দেবো এ শহরে
ডিজিটাল পদ্ধতিতে ঋতুবদল হয়। শ্রাবণে গান গায় ভিনদেশি কোকিল।
নদীই খুলুক তালা। যে বন্দীদশায় কাতরাচ্ছে আমার স্বদেশ, তার গায়ে
কেউ জড়িয়ে দেবে উলের চাদর- এমন বিজ্ঞাপণ দিয়ে আমিও দখল
করে নেবো রাতের রাজধানী। কেউ জানবে না- এখানে এর আগে
কার স্মৃতিচিহ্ন ছিল।
তুমি এসো ঝড়,
তুমি এসো বৃষ্টি,
তোমার বিজলীর আলোয় ভাসুক মানুষ। বজ্রপাত হোক,
দুর্বৃত্তেরা পালিয়ে যাক – এমন কথামালায়
আমিও সাজাবো বিলবোর্ড
না, এখানে আমি আজ কারও নাম লিখে যাবো না।
বিভিন্ন ছুটিদিবস- কীভাবে অন্য কোনো গ্রহে পৌঁছে নেয়া যায়
মুক্ত নিঃশ্বাস। জানি সেদিন হয়তো থাকবে না আর এই শ্বাসকষ্ট,
এই পোড়ামাটিচিহ্ন লেগে থাকবে না আমার হাতে, অথবা যে ছবিগুলো
একদিন ছিঁড়ে ফেলেছিলাম, সেগুলোও জোড়া লাগাবার প্রয়োজন
পড়বে না আর।
জানবে না এই নগরের ভোটার তালিকায় আমারও নাম ছিল,
একদিন কলমও ছিল আমার বিশ্বস্থ বন্ধু আর কাগজে
যে কাটাকুটিগুলো আমার পাঁজর ছিল- মূলত এরাই ছিল আমার কবিতা।
মানুষ আমাকে পরাজিত পথিক বলুক
তারপরও,
যেতে চাই এই নগর থেকে অন্য কোথাও
যেখানে কেউ আমাকে আর চিনবে না
কেউ জানবে না পূর্বজনমে আমি আদৌ মানুষ ছিলাম কী না !
লিখো সেইসব মানুষের নাম- যারা বিচ্ছেদী গান গেয়ে এই
নদীতে কেটেছে সাঁতার – এই ঘাটে দেখেছে প্রিয়তমা নারীর
মুখ। এই নক্ষত্রনয়নে, জুড়ে দিয়েছে নিজেদের চোখ, আর বলেছে
দীর্ঘজীবি হোক ঘাটপ্রেম, ঘাটের ঘটনা।
আঁচড় হয়ে বেঁচে থাকি, তারাই জানি আঘাতের পাশে যে পুষ্প
ফোটে থাকে মূলতঃ সেই পাপড়িগুলো সবসময়ই থাকে ভাষাহীন-বাকরুদ্ধ ।
ভিটেহীন ছিল একশ দশক।
গল্পটা এভাবেই শুরু হয়। আমরা জেনে যাই গৃহহীন প্রতিপত্তিবানদের অতীত
ইতিহাস। তারপর হাঁটি। হেঁটে যাই ঘাট পর্যন্ত। যে ঘাটে একদিন ভিড়তো
ভাঙা নৌকো। নৌকোর তলানি থেকে পানি সেচে এই এই নদীতেই ফেলে
দিতো প্রাজ্ঞ মাঝি। আমরা মাঝির হাতের কারুকাজ দেখতাম। আর দেখতাম
শেষরাতেও নদীপাড়ে থামে না মানুষের কোলাহল। নদী পারাপার।
তাই এদেশের মানুষ ভুলে গেছে কীভাবে ঝড়ের সাথে পাল্লা দিয়ে সাজাতে
হয় জীবন। অথবা ঝড়ের মতোই মাঝে মাঝে কীভাবে সবকিছু তছনছ করে
দিতে হয়। যে ভাবে হায়েনা শত্রুশিবির এই মানুষেরাই ভেঙে দিয়েছিল একাত্তরে।
ঝড়- দুঃখ সহ্য করতে পারলেও, চাঁদ তা পারে না।
আমরা সেই কান্নার ধ্বনি প্রতিরাতে শুনি চাঁদের গীটারে।
এই দেয়ালে একটা ছবি ছিল গৃহমালিকের। তিনি দেশত্যাগ করেছেন অনেক আগে।আর
রেখে গেছেন যে ধুলোচিহ্ন, এখন তারও অবশেষ খুঁজে পাওয়া যায় না আর।
মৃতশামুকের দাগ। ভেতরে মুক্তো খুঁজে যারা এই শামুকটিকে হত্যা করেছিল,
তাদের হস্তছাপ দেখে জেনে যাই এই পথ দিয়ে এগিয়েছে অনেক দুর্বৃত্ত সময়।
নেই দেখে বিশ্বস্থ সড়ককেও পর ভেবে ফাড়ি পথে অতিক্রম করি কাল। এবং
হতবাক মানুষেরা চেয়ে দেখে – নরকসভ্যতা দখল করছে ভূগোলের ছবিগুলো।
আর নদীকে বলেছিলাম- তুমি বয়ে যাও, আমি স্থির থেকে যেতে চাই। নদী আমার
দিকে তাকিয়ে কেবল কেঁদেছিল। বলেছিল- তোমার দুইচোখ আমার হোক,কবি!
কেঁদেছিল বৃষ্টির রাত, ঠিক সেভাবে সারারাত কেঁদেছিল এই বনবাদাড়। কিছু ঝড়
অনুসরণ করে যেতে চেয়েছিল দ্বীপান্তরে। আর কিছু ভোর নিজেদের মৃত্যুদণ্ড চেয়েছিল।
অন্ধ প্রাণের সকল পাপ খুব সহজেই বরণ করে নেয় আকাশ ও তার বুকের নক্ষত্রেরা।
এর আগেও তোমাকে ভেবেছিল- আর বলেছিল, আবার কি দেখা হবে-ঋতু!
জানি অনেক পদছাপই আর খুঁজে দেখা হয় না। অনেক রোদ কেবলই
ঝরে পড়ে গাঁয়ের ওপারে। একটা প্রজাপতি গোটা বিকেলের গায়ে
তার আহ্লাদের ছবি ছড়াতে ছড়াতে আরামে ঘুমায়।
পুনরায় দেখে নিতে তোমার বাহু। যে বাহু একদিন এই মৃত্তিকার মন
ছুঁয়ে কুড়িয়েছিল পাতা, হলুদ পাতার ধ্বনি।
বুক চিরে হেঁটে যায় অনেকগুলো পা।
হেঁটে যাচ্ছে তোমার রেখে যাওয়া এ্যলবামের পাতা দেখে দেখে।
You must be logged in to post a comment Login