ফানুস-৪
৪
মায়া আজ কলেজে যায়নি। কলেজে নাকি কি সব মিটিং ফিটিং হবে। ও বাড়িতে থাকা মানে নতুন কিছু ঘটা। টেলিভিশন রুমে ছোফার উপর পা তুলে বসে গান শুনছে মায়া। “মুন্নি বদনাম হুয়ে, ডার্লিং তেরে লিয়ে”- গানটা নাকি হিট। গানটার কোথায় হিট সেটাই বোঝার চেষ্টা করছে ও।
– মায়া, মা কে দেখেছিস?
– আরে, ভোলাদা! তুই না মাছ ধরতে গেলি?
– যাই নি, যাব। বরশীটাই খুঁজে পাচ্ছিনা, মা কোথায় রে?
– মা কোথায় জানিস?
– কোথায় সেটাই তো জানতে চাচ্ছি।
মায়া দিনের দিকে বেশ খানিকটা দিনের দিকে ঝুঁকে এসে গোপন পরামর্শের মত করে বলল-
– ভাইয়া?
– বল।
– মা তো ছাদে।
– ছাদে?
– হ্যাঁ।
– এই কথাটা এভাবে বললি যে?
– ও তুই বুঝবি না।
– বুঝব না?
– না।
– কি বলিস বুঝব না, বোঝায়ে দিলেই বুঝব, যা বলবিনা তাও বুঝব।
– তুই কি বুঝতে চাস?
– হ্যাঁ চাই, কিন্তু তার আগে মার কাছ থেকে ঘুরে আসি।
– ঠিক আছে যা।
দিন ঘর থেকে বের হয়ে গেল, এবং সাথে সাথে আবার ফিরে এলো।
– কি হল ছাদে গেলি না?
– যাব কিন্তু একটা কথা মনে পড়ে গেল।
– কি?
– তুই আমাকে আর ভোলাদা ডাকবি না।
– ভোলাদা ডাকব না তো কি বলে ডাকব?
– I have a name, আমার একটা নাম আছে, দিন।আমাকে দিন ভাইয়া বলে ডাকতে পারিস, তাছাড়া আমি তোর বড়, শুধু ভাইয়া বলে ডাকলেই চলবে।
– তুই আমার বড় না।
– কি?
– আশ্চর্য হবার মত কিছু হয়নি।
– কিছু হয়নি মানে? আমি কি তোর ছোট?
– আমি তো সেটা বলিনি, বলেছি তুই আমার বড় না।
মায়া আবারও দিনের দিকে বেশ ঝুঁকে এলো
– ভাইয়া?
– বল।
– আল্লাহ সাহেব নামে কেও কি আছেন?
– আল্লাহ সাহেব? আল্লাহ কি সাহেব?
– অবশ্যই সাহেব, আল্লাহর তুলনায় আমাদের বাবা মোঃ মোঃ হো খানের পাওয়ার তো অনেক কম। তাই না?
– হ্যাঁ, তা তো ঠিকই।
– তাহলে বাবা যদি সাহেব হন যিনি সর্বশক্তিমান তিনি কি সাহেব নন?
– অবশ্যই সাহেব, শুধু সাহেব নন, বড় সাহেব।
– তা বড় সাহেব যে একজন আছেন তুই কি তা বিশ্বাস করিস?
– অবশ্যই করি।
– নিশ্চয় এটাও জানিস কোন এক মাহেন্দ্রক্ষণে তিনি আমাদের সবাইকে একসাথে সৃষ্টি করেছিলেন।
– হ্যাঁ জানি।
– তাহলে দাঁড়াল টা কি? তুই কি আমার বড়?
দিন মাফাটা একবার এদিক ওদিক ঝাকায়, ওর চোখ বড় বড় হয়ে যায়।
– তুই এই উচ্চশ্রেণীর চিন্তা কি এখন করলি?
– উঁ হুঁ, অনেক আগেই করেছি।
– আর কি কি করেছিস?
– অনেক কিছুই করেছি, সব তো আর তোকে বলা যায় না।
– একটা তো বল।
মায়া দিনের দিকে আগের ভঙ্গিতেই ঝুঁকে এলো
– শোন ভাইয়া আমি ভেবেছি এখন থেকে বাবাকে বাবা ভাই বলে ডাকব। শুধু বাবা বলে পোষাবে না।
দিন এ কথা শুনে ধাক্কার মত খেল। ও ভুরুটা বেশ কুঞ্চে বলল-
– কি? বাবা ভাই?
– হ্যাঁ।
– তোর কি মাথা নষ্ট হয়ে গেছে?
– মাথা আমার নষ্ট হয়নি হয়েছে তোর।
– আমার?
– হ্যাঁ।
– ও আচ্ছা।
– ও আচ্ছা টাচ্ছা রাখ, শোন ভোলাদা তুই ফুটবল খেলা দেখিস?
– হ্যাঁ দেখি।
– তুই যেন কোন দলের saporter?
– বাবাকে তো ভাই বলার সাথে কোন দলের saporter সেটার সম্পর্ক নেই।
– আমি তো তোকে বলিনি বাবাকে ভাই ডাকতে।
– কেন একটু আগে ই না বললি।
– বললাম বাবাকে বাবা ভাই ডাকতে শুধু ভাই তো তোকে ডাকতে বলিনি।
– ও বুঝেছি, কিন্তু বাবাকে বাবা ভাই বলার সাথে তো ফুটবলের সম্পর্ক নেই।
– অবশ্যই আছে।
– কিভাবে?
– তার আগে বল তুই কোন দলের saporter?
– ব্রাজিল।
– তা ব্রাজিলের একটা প্লেয়ার আছে না, কাকা?
– হ্যাঁ আছে।
– আচ্ছা ভাইয়া তুই উল্লাস ভাইকে কি বলে ডাকিস?
– উল্লাস ভাই বলে।
– ক্যাম্পাসে সবাই তোকে, তোর জুনিয়ররা তোকে কি বলে ডাকে?
– দিন ভাইয়া, দিন ভাই, দিন দাদা ঠিক নাই।
– দিন ভাই আর কি, তাই তো?
– হ্যাঁ।
– তাহলে ভাব কাকার চেয়ে যারা ছোট তারা কাকাকে কি ভাই বলে ডাকবে?
– কাকা ভাই।
– কারো নাম মামা হলে কি হবে?
– মামা ভাই।
– আচ্ছা সুমন ভাই যেন আমাদের কেমন ভাই?
– তুই জানিসনা বুঝি?
– আহা বলবি তো।
– মামাতো ভাই।
– আর দ্বীপ?
– খালাতো ভাই।
– টগর?
– চাচাতো ভাই।
– ইরফান সাহেব?
– উনি আবার ভাই হতে যাবেন কেন? উনিতো মামা।
– কেন চাচার ছেলে চাচাত ভাই, খালার ছেলে খালাতো ভাই, মামার ছেলে মামাতো ভাই। তাহলে নানার ছেলেকে নানাতো ভাই বললে কি খুব সমস্যা হবে?
– নানাতো ভাই?
– হ্যাঁ, নানাতো ভাই। আর তুই তো জানিস আমরা সবাই ভাই ভাই।
– হ্যাঁ।
– তাহলে কি দাঁড়াল? বাবার চেয়ে যারা ছোট তারা বাবাকে কি বাবা ভাই বলা যাবে না?
দিনের চোখ চকচক করে উঠল। ও সজোরে হাতে তালি দিয়ে বলে উঠল
– অবশ্যই যাবে। মায়া?
– বল।
– বাবা কোথায় রে?
– বাবা তো বাজারে।
– কখন আসবে?
– সেটা তো আমার জানবার কথা নয়।
– আমি এক কাজ করি বাজারে চলে যায়, বাবাকে বাবা ভাই বলতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে।
– কিন্তু তুই তো মাকে খুঁজছিলি।
– হ্যাঁ তাইতো, মা যেন কোথায় রে মায়া?
– রান্নাঘরে।
– কিন্তু একটু আগে না বললি মা ছাদে।
– ভাইয়া তুই তো ফলিত রসায়নেরই ছাত্র, নাকি?
– সন্দেহ আছে?
– আছে, কোঠায় চান্স পাওয়া ছাত্রের মত কথা বলবি না।
– আমি আবার কি করলাম?
– দোষটা তো তোরই।
– আমার?
– হ্যাঁ তোর, আচ্ছা ধর তুই কপার সালফেট আর জিংক এক পাত্রে রাখলি, ৫ মিনিট পর কি ওগুলো অমন থাকবে?
– না থাকবে না, বুঝতে পেরেছি মা ছাদে ছিল এখন রান্নাঘরে।
– কিছুই বুঝিস নি, আচ্ছা ভাইয়া তুই কি প্রমাণ করতে পারবি ৴dx=x+c
– এটা তো সূত্র, কিভাবে প্রমাণ করব?
– না, এটা সুত্র না। আর সূত্র হলেও সমস্যা ছিলনা।
– সমস্যা ছিল না?
– না ছিলনা।
– কেন?
– কারণ সকল সূত্রেরই তো প্রমাণ আছে, এমনকি নিউটনের গতির নিশ্চয়তার সূত্রের ও।
– নিউটনের নিশ্চয়তার সূত্র? সেটা আবার কবে আবিষ্কার হল?
– কেন হাইজেনবার্গের সূত্র যদি অনিশ্চয়তার সূত্র হয় তাহলে নিউটনের গতির সূত্রকে কি নিশ্চয়তার সূত্র বললে ভুল হবে?
– তা হবার কথা নয়।
– ওসব রেখে এবার বল, এটা প্রমাণ করতে পারবি?
– না পারব না, তুই করে দেখা।
মায়া খাতা কলমে ওটা করে দেখাল
৴dx= ৴1.dx = ৴x0dx = x0+1/0+1 +c = x +c
– মায়া তুই তো বুদ্ধিমতী।
– আমাকে কিন্তু অসম্মান করা হল।
– মন থেকে বলছি, এই দেখ চোখ ছুয়ে বলছি ফাজলামো করছি না।
– কিন্তু তোর বোঝা উচিত আমি বুদ্ধিমতীদের মধ্যে পরিনা, আমি খুব বুদ্ধিমতীদের মধ্যে পরি।
– ঠিক তো, তুই খুব খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে মায়া, কিন্তু আমার তো একটা খটকা লেগে গেল।
– কি?
– কাকা তো কাকার নাম, বাবার নাম তো বাবা না। তাহলে কাকা ভাই হলেও বাবা ভাই হবে না। বললে বলতে হবে মোঃ মোঃ হো ভাই। আর বাবা তো আমার ভাই না। তাই সেটাও বলা যাবেনা।
– তুই একটা গাধা।
– আমি গাধা?
– অব্যশই গাধা।
– কেন, গাধার মত কথা বলা হয়ে গেছে নাকি?
– হ্যাঁ হয়েছে।
– ও আচ্ছা।
– শোন ভাইয়া পৃথিবীতে সব সম্পর্কের নাম আছে, যেমন উল্লাস ভাই, বাবর কাকা, তরী আপা, কিন্তু বাবাকে কখনও বলিস মোঃ মোঃ হো বাবা?
– না।
– তাই বাবা ইজ বাবা, সেখান থেকে বাবা ভাই। বুঝতে পেরেছিস?
– হ্যাঁ পেরেছি, তা ছাড়া মুসলমান তো ভাই ভাই ই। তাইনা?
– হ্যাঁ।
– মায়া?
– বল।
– বাবাকে তো বাবা ভাই না বলে শান্তি পাচ্ছি না, বাবা যে কখন আসবে!
– সময় কাটাবার জন্য তুই এক কাজ কর মার কাছ থেকে ঘুরে আয়।
– ও তাইতো।
দিন ওখানে আর দাড়াল না, রান্না ঘরে গেল।
– শোন মা—-!!
রূপকথা হেসে ফেলল।
– ও আপনি? মা কে দেখেছেন?
– জি উনি তো কাজল দিদির ঘরে।
– ও আচ্ছা।
– আপনি কি চা খাবেন? চা করে দেই?
– চা? চা তো খেতে চাই ই, চা, তো ঠিক আছে না হয় দিন।
দিন মায়ের বদলে রান্নাঘরে হঠাৎ করে রূপকথাকে দেখে ঘাবড়ে গেছে। ও বুঝতে পারছে না রূপকথার সাথে ঠিক কি ধরনের কথা বলবে। তার চেয়ে বড় কথা দিনের আমতা আমতা দেখে রূপকথা মিটমিট করে হাসছে, খুব কষ্ট করেও রূপকথা হাসি আটকাতে পারছে না, হাসি আটকাতে গিয়ে সেটা মাঝেমাঝে আরও ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে
– আপনি না হয় এক কাজ করুন, টেলিভিশন রুমে বসুন আমি চা করে আনছি।
– আচ্ছা ।
আচ্ছা বলেও দিন দাড়িয়ে আছে, ও কোন কথা বলছে না, রূপকথার দিকে তাকিয়ে আছে, যে কোন কারনেই হোক রূপকথার দিকে তাকিয়ে থাকতে দিনের ভাল লাগছে, কিন্তু কেন ভাল লাগছে সেটা কিছুতেই ধরতে পারছেনা ও। মায়ার তো আবার অনেক বুদ্ধি ও নিশ্চয় বলতে পারবে।
4 Responses to ফানুস-৪
You must be logged in to post a comment Login