মামুন ম. আজিজ

বিরহে বিনোদী বৃষ্টি

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

‘বৃষ্টির ফোঁটা বন্ধু আমার, ফোঁটাগুলো যেন আয়না
তোমার রূপটা ছোঁবে বলে রিমঝিম সুরের বায়না।
বৃষ্টি ছুঁয়েছি , তুমিও কি ছোঁবে ?
দেখবে সেথায় ভালবাসা পাবে…’

…হয়েছে! সে তো বৃষ্টির ভালবাসা, তীর্থ। তোমার কি? দেখতে পেলে ঠিক দেখতে পেতে আমার দুহাতে বৃষ্টির জল ভরে গেছে। হাত নাড়ছি, জল নড়ছে। জলের উপর আবার বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে, নাচছে।
আহা! কি সুমুধুর। হাতের শিরা উপশিরায় তোমার শীতল ঢেউ বয়ে যাচ্ছে লক্ষ্মী আমার, একটুও কি পাচ্ছ না আমার আলোড়ন?

‘এই দেখো বৃষ্টি গুলো , আমার থেকে নিয়ে গেলো
তোমার তীরে দেবে বলে – ভালবাসার সাগর ঢেউ ,
বৃষ্টি ফোঁটার ছোঁয়ার ছলে, আমি ছাড়া কি আর কেউ?’

এত কাব্য কেনো? রাস্তার ওপাশের তিনতলার বারান্দায় সেই ঢেপসি মেয়েটা নিশ্চয় বসে আছে।
আছে নাকি? দেখিনি। তোমায় ছাড়া ভাবিনি…
তুমি কল করার আগে সীমি রিকশা নিয়ে তোমার বাসার সামনে দিয়েই গেলো। কথা হচ্ছিল আমার সাথে। ওতো বলল, এক তিন তলায় তুমি আরেক তিনতলায় ঐ ঢেপসী…
তুমি আমারে এত নিচে নামাচ্ছো। সুন্দরী টুন্দরী কেউ হলে তবুও এক কথা। সীমি মিথ্যে বলেছে , কেনো জানো- আমাদের সামনের রাস্তাটা তো গত কয়েকদিন তুমি দেখনি। দেখলে বুঝতে । রিকশায় বসে এই রাস্তায়  কেউ উপরে তাকাবে। তাহলেই হয়েছে।
কেনো?
পুকুর হয়ে গেছে, জাস্ট অনেকগুলো ছোট ছোট পুকুর। সেখানে এখন বৃষ্টি জমছে, বৃষ্টি কাঁদা মাখছে, উছলে উঠছে। বুঝলে না। গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে রাস্তার পিচ্ এবড়ো থেবেড়ো হয়ে প্রায় সবই উঠে গেছে। তারপর নিচের খোয়া গুলো নিয়ে গাড়ী রিকশার চাকা খেলেছে ফুটবল। ফলে এখন বড় বড় গর্ত। গর্ত গুলো এখন একে অপরকে আলিঙ্গন করা প্রয়াসে আছে। সফল হলেই এক দীর্ঘ খাল। গাড়ী হেলছে, গাড়ী দুলছে। রিকশা কাত হচ্ছে। এই উল্টে গেলো বলে। জানালায় দাঁড়িয়ে সেই মজাই দেখি। প্রতিটা যাত্রীর চোখ সে কি ভীষণ আতংক। এই বুঝি উল্টে গেলো ভাবতে ভাবতেই হয়তো ধপ করে একটু গভীর গর্তে চাকা পড়ে গেলো । চোখের আতংক নড়ে উঠল। এই তো সকালে একটা রিকশা একেবারেকাত হয়ে গেলো । কোন মানুষ ছিল না  । দুটো ভারী বস্তা। কাদায় মাখামাখি।
এই রাস্তাটা না মাত্র ছয় সাত মাস আগেই নতুন করে পিচ দিলো। কি আরামে তোমার বাসার দিকে তাকাতে তাকাতে স্যারের বাসায় যেতাম । পঙ্খীরাজ ঘোড়ার মত গতিতে চলত রিকশা। মাত্র চতুর্থ দিনের বৃষ্টি এ বর্ষার আজ। এতেই এ অবস্থা। তুমি বানিয়ে বলছ।
সন্ধ্য মণি, রাস্তাতো আমার চোখের সামনেই বানালো।  দেখেছি না, কতুটুক আলকাতরা আর কতটুকু পুরু পিচ! সব শালা চোর।
দেখেছো তো তখন কিছু বললে না। তুমি না পূরকৌশলের ছাত্র। গিয়ে আইডি কার্ডটা দেখিয়ে একটা দূর্বোধ্য  কবিতা শুনিয়ে দিতে।
এখানে আবার কবিতা এলো কোত্থেকে? তুমি না আমার কবিতার প্রতি কোন মমতাই দেখাও না সন্ধ্যা। তোমার মনে সন্ধ্যার মতই আবছা আধাঁর।
তাই ! এই আবছা আঁধারেই যে তোমার হাত ধরে কল্পনায় হাঁটি আমি।
এ রাস্তায় হাঁটা যাবে না, কাঁদা এসে পায়ের সাথে জড়িয়ে আদিরসাত্মক খেলা শুরু করে দেবে। হাতের মাঝে তোমার হাত ধরাতে যে আবেদন তা আর কাজ করবে না। কিংবা কপাল বেশি খারাপ হলে উল্টে একটা সিনিজি কিংবা রিকশা কাত হয়ে পড়বে আমাদের স্পর্শ বন্ধন দেহের উপর।
তাহলে এই এত টাকা খরচ করে রাস্তা করে কি হলো? এর চেয়ে আগের ইট জমে শক্ত হয়ে যাওয়া রাস্তাই তো ভাল ছিল। রিকশায় চলার সময় একটু ঝাঁকিই যা লাগত। ও তখন নিশ্চিত তোমার দৃষ্টি থাকত রিকশায় বসা তরুনীর দেহের মধ্যভাগে। রিকশা লাফাতো সাথে নারীর বুক। ক’টা কবিতা লিখেছ  তা নিয়ে আল্লাহই জানে। দিয়ো তো তোমার পুরানো কবিতার ডায়েরি খানা। আচ্ছা আচ্ছা!এখন তো পুকুরে নামছে রিকশা, পুকুর থেকে উঠছে। বুকের দোলচাল আরও ভাল হচ্ছে। তার উপর বৃষ্টিতে ভেজা থাকে যদি কারও কাপড়, তাহলে তো…
কি করবো, তুমি এসে আলিঙ্গনে বন্দী না করলে কতক্ষণ আর চোখ কে আটকিয়ে রাখি বল।

‘তুমি আসবে, কোমল ছোঁয়ায় স্বর্গে ছুটবে প্রাণ
তোমায় পরশে ভদ্র হবে এ দুষ্টু চোখ দু’খান…’

আর আমি না এলে তার দুষ্টুমি চলতেই থাকবে? একটু আমার বাসার সামনে এলেও তো পার। কতদিন হলো তোমার চেহারাটা দেখি না।
কি করে আসব সন্ধ্যা। জ্বর যে এখনও আমার থেকে পালায়নি পুরো। বৃষ্টির সাথে বিমাতা আচরণ করছি। বর্ষার চারটে বৃষ্টি শেষ। অথচ বৃষ্টির সাথে আমার সঙ্গম হলো না।

‘আমার কবিত্ব অপূর্ণ আজও এ বর্ষায় ওগো প্রিয়া
খাঁচায় বন্দী চাতক  আমার কষ্টে কাঁদে যে হিয়া…’

কথা বলো তীর্থ। কবিতা একটু থাক না। কাল যে বললে জ্বর আর নেই?
রাতে এসেছিল।
বলোনি কেনো? আমি আসি তোমার বাসায়। আমি আর বুয়া ছাড়া কেউ নেই। মা বাসায় নেই। একটু এসে দেখে যাই।
তোমার মা জানলে  বৃষ্টির ফোঁটার মত লক্ষ টুকরো করে দেবে আমাদের ভালবাসার স্বপ্ন।
পাঁচ মিনিটের জন্য আসব। আন্টি ছাড়া বাসায় তো আর কেউ নেই, তাই না? কেউ জানবে না। আমি জানি তোমার মা আমাকে অনেক ভালবাসেন। কিন্তু অন্যদের ভয়ে দূরে দূরে থাকার ভান করেন।
কি জানি? থাক না। শুধু শুধু অশান্তি বাড়িয়ে কি লাভ। কদিন পরেই তো সুস্থ হয়ে উঠব। তখন বিকেলের খসে পড়া রোদে, শান্ত হিমেল বাতাসে বৃষ্টির পরে জেগে ওঠা প্রকৃতির মাঝে হাত ধরাধরি করে হাঁটব। আমি একটু বেয়াড়া হতে চাইব। তুমি চিরকালের মত না না করবে। তোমার ঠোঁটটা আর কোনকালেই হয়তো ছুঁয়ে দেখা হবে না আমার! আচ্ছা এমন কেনো হলো? এই এত নিবির বন্ধু আমার এ বৃষ্টি। এত ভয়ানক একটা ঘটনা সে কেনো ঘটালো?
থাক না তীর্থ।
তোমার মনে আছে। তুমি কাঁদছিলে হাসপাতালের নির্জন নৈঃশব্দের করিডোরে একলা। আমি কাছে যেতেই বুকে মাথা রেখে চোখের  জলে ভাসিয়ে দিলে আমায়। সেই প্রথম তোমার স্পর্শ অতটা নিবিরে। আচ্ছা  আমি তো জানি সন্ধ্যা আমাদের দোষটাই বেশী। অন্যরা না বুঝলে না বুঝুক। আমি তো অবুঝ না। আমি হলে কি তোমাকে তাড়িয়ে দিতে পারতাম! তাহলে কিসের ভালবাসা। সন্তানই সব। ভাইয়া ভাবিও তো খুব ভালবেসেছিল। আমরা তো তাই দেখতাম এ চর্ম চোখে।
হয়তো তোমার ভাইয়া বাসতোনা। হয়তো তার কাছে নারী শুধুই কাম ভোগ আর সন্তান প্রদানের যন্ত্র।
কিন্তু আমি কি তাই? আমাকে কেনো সেই শাস্তি পেতে হবে? তোমাকেই বা কেনো? আমাদের ভালবাসার কি দোষ? তোমার মনে পড়ে এমনই এক পড়ন্ত বিকেলে। প্রচন্ড বৃষ্টি সাথে ঝড়। ভাইয়া ভাবি রাস্তায় , রিকশায় বাসায় ফিরছিলেন। রিকশাটা উল্টে গেলো। ভাবী তখনই তিন/চার মাসের অন্তঃসত্তা। বৃষ্টি এত নিষ্ঠূর হলো কি করে। নাকি ঝড়ের ষড়যন্ত্র! হাসপাতালে নিয়ে ডিএনসি করা হলো। তাতেও ভাবী সুস্থ হলেন না। ডাক্তাররা জরায়ু ফেলেই দিলেন। হতেই পারে। তাই বলে ভাইয়া আবার বিয়ে করবেন? আমি মানতে পারি না এখনও। ভাবী মানে তোমার আপু আর বিয়ে করবে না?
কেনো করবে? তোমার ভাইয়া আপুকে ভাল না বাসুক, আপু তো বাসে। আপু তো ডিভোর্স পেপারেও কখনও স্বাক্ষর করবে না বলে দিয়েছে।
তাতে তো আমার ভাইয়া আর বাবার সুবিধাই হয়েছে।
তীর্থ, এসব কথা থাক। বৃষ্টির কমছে আর তুমি আমাকে কাঁদাচ্ছ।
সন্ধ্যা , এই দেখ , এই মাত্র একটা  রিকশা পুরো কাত হয়ে উল্টে গেলো।
ইস্ ।
কি ভয়াবহ! একি- তোমার মা , হ্যাঁ,  আন্টিই তো। সন্ধ্যা এক্ষুনি চলে এস। আমি নিচে নামছি।
সত্যি ! ঠিকাছে আমি বেরোচ্ছি। তুমি কিন্তু ছাতা নিয়ে নেমো।
কপালে বৃষ্টিই আছে আমাদের , ছাতা দিয়ে কি হবে। তুমি চিন্তা করো না। আমি আন্টিকে বাসায় এনে সুশ্রষা করার ব্যবস্থা করছি। তুমি তাড়াতাড়ি চলে এস। কাউকে বলার দরকার নেই।

[আমরাবন্ধু.কম এর বৃষ্টিবন্দনা ই-বুক- ‌’মেঘবন্দী’ তে প্রকাশিত]

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


13 Responses to বিরহে বিনোদী বৃষ্টি

You must be logged in to post a comment Login