মাহবুবুর শাহরিয়ার

ছোটগল্প: বীর কাব্য

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

স্বর্গ ও মর্ত্যের মাঝখানে যে বায়ুদুর্গবেষ্টিত অনির্দেশ্য দেশ আছে তার এক প্রান্তে ধূ ধূ খোলা প্রান্তর৷ প্রান্তরের একপাশে বৃক্ষছায়ায় একলা একটা টং দোকান৷ সেখানে অমৃত মেলে৷ দোকান হলেও সেখান থেকে অমৃত সংগ্রহ করতে পয়সা খরচের প্রয়োজন পরে না৷ ইচ্ছা মত অমৃত নেয়া যায় যত খুশি৷

টং দোকানের সামনের বাঁশের বেঞ্চটায় ঝিম ধরে বসে আছে অর্জুন৷ ক্লান্ত, বিমর্ষ, বিধ্বস্ত মলিন চেহারা৷ হাতে অমৃতের পেয়ালা, কিন্তু সেটাতে চুমুক দেয়ার কথা মনে নেই অনেকক্ষণ৷ তাকে দেখে মনে হয় স্বর্গ মর্ত্যের মাঝখানের এই অনির্দেশ্য দেশ তো বটেই, তাবৎ বিশ্ব ব্রক্ষ্মান্ডের তাবৎ কিছুর প্রতি আগ্রহ হারিয়েছে সে৷

সামনে তাকিয়ে কর্ণকে টং দোকানের দিকে হেঁটে আসতে দেখে অর্জুন৷ মহাবীর কর্ণ৷ কর্ণকে দেখে অর্জুন কখনও খুশি হয় না৷ বলা ভালো কর্ণকে সে সহ্য করতে পারে না৷ পৃথিবীতে থাকাকালীন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কর্ণকে হারিয়ে দেয়া সত্ত্বেও কেউ কেউ যে কর্ণকেই তার চেয়ে বড় বীর বলে মনে করে, এ ব্যাপারটা তার অসহ্য বোধ হয়৷ কর্ণকে দেখলে তার চেহারায় বিতৃষ্ণা ফুটে ওঠে৷ টং দোকানের সামনে পৃথিবীর এককালীন বীরদের বৈকালিক আড্ডায় অর্জুন সব সময় চেষ্টা করে কর্ণকে অপদস্ত করার৷

আজ কর্ণকে দেখেও অর্জুনের মধ্যে কোনো ভাবান্তর লক্ষ্য করা গেলো না৷ কর্ণ দর্শনে তার মুখে যে বিতৃষ্ণা ফুটে ওঠে সেটাও ফুটে উঠলো না৷ যেমন বিমর্ষ বসে ছিলো তেমনি বিমর্ষ নতমুখে বসে রইলো৷ কাছে এসে কর্ণ সহাস্যে বলল, “কিহে অর্জুন, বড় বিমর্ষ দেখছি আজ তোমাকে যে?”

“হুঁ৷”

“ব্যাপার কি?”

অর্জুন একটা শ্বাস ফেলে৷ উর্ধ মুখে আকাশের দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থাকে৷ ধীরে ধীরে বলে, “তোমার আমার দিন ফুরিয়েছে৷  আমাদের সময়ে আমরা একেকজন একা একশো জনের সাথে লড়তাম৷ এখন তার উল্টো৷ আজকের পৃথিবীতে আমাদের কেউ বীর বলবে না৷ আমাদের নিয়ে এখন কেউ মহাকাব্য লিখবে না৷ এখন অন্যরকম বীরত্বের দিন৷”

কর্ণ কি বোঝে ঠিক বোঝা যায় না, চেয়ে থাকে অর্জুনের দিকে৷ একটু আগে তার মুখে যে উৎফুল্ল ভাব ছিলো হঠাৎ তা তিরোহিত হয়৷ দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে সেও বিমর্ষ মুখে অর্জুনের পাশে এসে বসে৷

একে একে সেখানে হাজির হয় বিভিন্ন সময়ে পৃথিবী দাপিয়ে বেড়ানো সব বীরেরা৷ ওডেসিয়াস, হেক্টর, ভীম, সোহরাব, রুস্তম এমন বীরেরা সবাই এখানে বৈকালিক আড্ডায় মিলিত হয়৷ অন্যদিন এসব বীরেরা নিজেরা নিজেরা প্রতিযোগীতায় মেতে ওঠে৷ সোহরাব-রুস্তম দুই বাপ-বেটায় এসেই মল্লযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে৷ কেউ হারে না, কেউ জেতে না, কিন্তু তাদের শক্তি মত্তার ঝলকে আর গগন বিদারী হুংকারে মুখরিত হয়ে ওঠে জায়গা৷ আজ সবাই বিমর্ষ৷ অমৃতের পেয়ালা হাতে কেউ বিমর্ষ দৃষ্টিতে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে, কেউ ঝিম ধরে নতমুখে বসে থাকে৷ কেউ বা শূন্য দৃষ্টি মেলে থাকে দূরের দিগন্তের দিকে৷

গ্রীক বীর ওডেসিয়াস হঠাৎ বলে, “আকিলিস কি জানে?”

আকিলিস, পৃথিবীতে জন্ম নেয়া সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বীর বলে অনেকে যাকে চিহ্নিত করে থাকে৷ অহংকারী, উদ্ধত, একলা৷ বীরদের এই বৈকালিক আড্ডায় সে কখনো আসে না৷ সে থাকে নিজের ভুবনে, নিজের মত করে৷ একটা রহস্যের বেড়াজাল সব সময়ই তাকে ঘিরে থাকে৷

সবাই মুখ চাওয়া চাওয়ি করে৷ আকিলিস জানে কিনা তা কেউ নিশ্চিত নয়৷ আকিলিসের বন্ধু ও পরম সুহৃদ ওডেসিয়াসের কথায় সবাই একসাথে আকিলিসের ডেরায় হাজির হয়৷ আকিলিস তার অহংকারী গ্রীবা উঁচু করে সহাস্যে বলে, “কি ব্যাপার? পৃথিবীর তাবৎ বীরেরা আমার ডেরায়?”

“আকিলিস, তুমি কি ঘটনা জানো?” ওডেসিয়াস প্রশ্ন করে৷

“কি ঘটনা?”

ওডেসিয়াস একটু ইতস্তত করে৷ আকিলিসকে ঘটনা বলতে তার প্রত্যয় হয় না৷ কিন্তু আকিলিসের তাড়া খেয়ে অবশেষে মুখ খুলতে বাধ্য হয়, “পৃথিবীতে নতুন ধরণের বীরত্বের উদ্ভব ঘটেছে৷ আমরা এখন আর বীর নই৷”

আকিলিস সহজে বিস্মিত হয় না, বা হলেও তার মুখ দেখে সেটা বোঝা যায় না৷ অথচ আজ তার মুখে পরম বিস্ময়ের ভাব ফুটে ওঠে, “বীরত্বের আবার নতুন ধরণ কেমন?”

ওডেসিয়াস তখন ঘটনা খুলে বলে৷ পৃথিবীর এক কোনায় বাংলাদেশ নামক এক দেশে ঢাকা নামে এক শহরে ঘটেছে ঘটনা৷ হেফাজতে ইসলাম নামে এক সংঘটন মতিঝিল নামক এক স্থানে জমায়েত হয়েছে৷ শাহবাগ নামক আরেক স্থানে আরেকটা সংঘটন আবার তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে৷ তাদের আশঙ্কা, হেফাজতে ইসলাম শাহবাগ আক্রমন করবে৷ তারা লাঠি সোটা নিয়ে হেফাজতের আক্রমন মোকাবেলার প্রস্তুতি নিয়েছে৷

ওডেসিয়াস এই পর্যন্ত বলার পর আকিলিস বলে, “তাতে কি হলো?”

“বলছি, অধৈর্য হয়ো না,” বলে ওডেসিয়াস৷ “শাহবাগ আর আশেপাশে ওরা তো লাঠিসোটা নিয়ে প্রস্তুত৷ শাহবাগের পাশেই রমনা নামের একটা পার্ক৷ শশ্রুমন্ডিত পক্ককেশ ষাটোর্ধ এক বৃদ্ধ সেই পার্কে নিজমনে হেঁটে যাচ্ছিলো৷ লাঠিসোটা নিয়ে ওরা করলো কি, দশ বারোজন মিলে পিটিয়ে সেই বৃদ্ধের মাথা ফাটিয়ে দিলো৷”

“দশ বারোজন মিলে একা এক বৃদ্ধের?”

“হ্যাঁ৷”

“সেই বৃদ্ধ হেফাজতের ছিলো?”

“তা কেউ জানে না৷ কেউ জানতে চায় নি৷”

“আর এটাই লাঠিঅলাদের বীরত্ব?”

“হুঁ৷”

আকিলিস; অহংকারী, উদ্ধত আকিলিস তার উন্নত গ্রীবা উঁচু করে চেয়ে রইলো বিস্মিত হয়ে৷ হঠাতই সে হেসে ওঠে হো হো করে৷ হাসি যেন আর থামতে চায় না৷ হাসির দমকে শরীর কেঁপে কেঁপে ওঠে তার৷ হঠাৎ, একেবারে অকস্মাত, আচমকাই আকিলিস হাসি থামিয়ে ফেলে৷ মুখ ভর্তি এক দলা থুথু ফেলে প্রচন্ড ঘৃণায় চেঁচিয়ে ওঠে, “ওয়াক থু!”

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


You must be logged in to post a comment Login