রিপন ঘোষ

ভার্চুয়াল জীবন (শেষ পর্ব)

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

৩ মাস পর……..

রক্তিম ও নীলার দাম্পত্য জীবন পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও, ওদের কোল জুড়ে এখনও কোন সন্তান আসেনি। আসলে রক্তিম সবসময় চেয়েছে নীলা উচ্চশিক্ষাটা কমপ্লিট করুক। পড়ালেখা চলাকালীন সময়ে সন্তান নিলে নীলার পড়াশোনার ব্যাঘাত ঘটবে ভেবে রক্তিম সন্তান নিতে চায়নি। কিন্তু নীলার এম.এস.সি সম্পন্ন হওয়ার পরও রক্তিম সন্তান নিতে আগ্রহী নয়। সন্তানের কথা তুললেই কৌশলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু নীলার মাতৃহৃদয় একটি সন্তানের জন্য আকুল হয়ে আছে।

নীলা লক্ষ্য করেছে রক্তিমের আচরণ অনেক পরিবর্তিত। আগে কখনোই সে নীলার সাথে কড়া ভাষায় কথা বলেনি, অথচ ইদানীং সুযোগ পেলেই সে নীলাকে অপমান করতে ছাড়েনা। তাদের পাঁচ বছরের বিবাহিত জীবনে এমন রক্তিমকে সে কখনোই দেখেনি। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে একজন মানুষ কতোটা পরিবর্তিত হতে পারে তার জ্বলন্ত উদাহরণ রক্তিম। তাছাড়া গত কিছুদিন যাবত সে রাতে ঘুমায়ও বেশ দেরীতে। সে জন্য প্রায়দিনই অফিসে যেতে দেরী হয়ে যায়। রাত জেগে নেটে কি করে জানতে চাইলে বলে, অফিসের কাজ করছে। নীলা ঠিক বুঝতে পারেনা রাত জেগে কি এতো কাজ!

রক্তিম আর যুথির ভার্চুয়াল সম্পর্ক অনেক ঘনিষ্টতা লাভ করেছে। তাদের সম্পর্ক ঘনিষ্ট থেকে ঘনিষ্টতর হয়ে প্রেম-ভালোবাসার পর্যায়ে চলে গেছে বলা যায়। রক্তিম যুথির কাছে নীলার কথা গোপন রেখেছে। যুথি জানে রক্তিম অবিবাহিত। রক্তিম বেশ কয়েকবার সিলেট গিয়ে যুথির সাথে দেখাও করেছে। যুথি দেখতে বেশ সুন্দর ও স্মার্ট, নীলার চেয়ে সামান্য একটু ফর্সা। কিন্তু তারপরও নীলার ব্যক্তিত্ত্ব আর সৌন্দর্য্যের কাছে যুথির সৌন্দর্য্য যেন ম্লান হয়ে যায়।

ঘরে সুন্দরী, শিক্ষিত স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও রক্তিম যুথির চটপটে কথাবার্তার মধুময়তা ও চঞ্চলতায় নিজেকে সঁপে দেয়। প্রিয়তমা স্ত্রীর ভালোবাসাও তুচ্ছ মনে হয় যুথির প্রাণচাঞ্চল্যে। দিনে একটিবার যুথির সাথে কথা না বললে মনে হয় যেন যুগ-যুগান্তর পেরিয়ে যাচ্ছে জাগ্রত চৌরঙ্গীর নির্বাক ভাস্কর্য্যের মতো নিশ্চল দাঁড়িয়ে। সময় পেলেই ফেসবুক আর সেলফোনের বিচ্ছুরিত তরঙ্গকণায় হারিয়ে যায় কথার ভুবনে। মাঝে মাঝে তার মনে হয় সে কি দুজনকেই ঠকাচ্ছেনা! কিন্তু তা নিমিষেই মিলিয়ে যায় হৃদয়ের কোলাহলে। এ সবকিছুই চলে নীলার দৃষ্টির অগোচরে।

অফিসের গাড়ি বাইরে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কিছুক্ষণ ধরে। ড্রাইভার হর্ণ দিচ্ছে একটু পরপর। রক্তিম তাড়াহুড়ো করে গাড়িতে গিয়ে উঠলো। দরজায় দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে নীলা। রক্তিম চোখের সীমা থেকে চলে যাওয়ার পর সে দরজা বন্ধ করে।

ড্রয়িংরুম দিয়ে যাওয়ার সময় চোখে পড়লো টি-টেবিলের মধ্যে ল্যাপটপ পড়ে রয়েছে। রক্তিম তাড়াহুড়োয় সাথে নিতে ভুলে গেছে। নীলা সামনে এগিয়ে গিয়ে ল্যাপটপের পাওয়ার বাটনে ক্লিক করে ল্যাপটপ অন করলো। ল্যাপটপের ডি ড্রাইভে তাঁদের বেশ কিছু ছবি রয়েছে। সে মাউসে ক্লিক করে ডি ড্রাইভ খুললো। প্রায় সাতটি ফোল্ডার রয়েছে এই ড্রাইভে। সব ফোল্ডারেই বিভিন্ন সময়ে তোলা ছবি রাখা। কিন্তু একটি ফোল্ডার রহস্যজনক নামে সেভ করা। সেটাতে ক্লিক করতেই ভেতরে RJ 143 নামে আরেকটি ফোল্ডার বেরিয়ে এলো। ওই ফোল্ডারটি ওপেন করে থাম্বনেইলস দিতেই নীলার শিরদাড়া বেয়ে একটি শীতল তরঙ্গ বিদ্যুৎবেগে নেমে গেলো। প্রায় প্রত্যেকটি ছবিতেই রক্তিম আরেকটি মেয়ের সাথে দাঁড়িয়ে আছে। উভয়েই একে অপরের সাথে বেশ ঘনিষ্ট ভঙ্গিতে বসে আছে। নীলা তার চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেনা। বুকের ভিতর থেকে দলা পাকিয়ে কান্না বেরিয়ে আসতে গিয়েও পারছেনা, গলা পর্যন্ত এসে আটকে যাচ্ছে।

হঠাৎ সে ভীষন একাকীত্ব অনুভব করছে। মনে হচ্ছে পৃথিবীর সব অন্ধকার একত্রে জমা হয়েছে ওর হৃদয়ের অন্দরমহলে। সে যতোটা সম্ভব নিজেকে সামলে নিয়ে ছবিগুলো দেখলো। অল্পবয়েসী একটি মেয়ে যার দুচোখ কাজলে আঁকা, মাঝারী গড়ন, ফর্সা বর্ণ, কালো চুলের মধ্যে হালকা লালচে শেড, ভরাট যৌবন। ছবিগুলো সে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখলো।

গলায় আটকে থাকা কান্না হঠাৎ করে বমির আদলে বেরিয়ে আসতে চাইলে নীলা দ্রুত বাথরুমে প্রবেশ করে। গড়গড় করে বেসিনে বমি উদগীরণ করে। চোখ মুখে দুহাত ভরে পানি দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই বুকের আঁচল খসে পড়ে পায়ের পাতা অবধি। বেসিনের সামনের আয়নায় নিজের উদ্ধত যৌবনের দৃশ্যমান চোখ রাঙ্গানিতে সে ভীষণ লজ্জ্বিতবোধ করে। দুহাতে উর্ধ্বভাগ ঢাকতে গিয়েও ঢাকেনা। তার অবয়ব গঠনে স্রষ্টা কোন কৃপণতা করেননি। নারী সৌন্দর্য্যের ষোলকলায় সে পরিপূর্ণ। তারপরও তার স্বামী কেন অন্য নারীতে আকৃষ্ট! কি আছে সেই মেয়েটির মধ্যে! নীলা কিছুটা রাগ মাখা ঈর্ষায় আবিষ্ট হয়।

সন্ধ্যায় বেশ দেরীতে বাসায় ফিরলো রক্তিম। নীলার মধ্যে কোন ভাবাবেগ নেই, সে বেশ স্বাভাবিক ভাবেই রক্তিম ফ্রেশ হওয়ার জন্য সবকিছু এগিয়ে দিলো। রক্তিম ফ্রেশ হওয়ার জন্য বাথরুমে ঢুকলে নীলা চুপিচুপি ওর মোবাইল ফোনের লাস্ট ডায়াল কল থেকে যুথির নাম্বারটা বের করে নিজের মোবাইলে সেভ করলো।

সন্ধ্যার নাস্তা শেষে রক্তিম রফিকের সাথে দেখা করার জন্য বাইরে বেরিয়ে গেলো। রক্তিম বেরিয়ে যেতেই নীলা দরজা বন্ধ করে দিলো। সে যুথিকে ফোন করার জন্য মোবাইল হাতে নিলো। তার বুক টিপটিপ করছে, নিজেকে অস্তিত্ত্বহীন জড় পদার্থের মত মনে হচ্ছে। ভুমিকম্পের মত প্রবল বেগে তার শরীর কাঁপছে তারপরও কোন অনুভুতি নেই তার দেহপিন্ডে। সে কাঁপা হাতে যুথির নাম্বারে ডায়াল করলো। অনেকক্ষণ রিং হওয়ার পরও অপরপ্রান্তে কেউ কল রিসিভ করলোনা। দ্বিতীয়বার বেশ কিছুটা সময় রিং হওয়ার পর অপরপ্রান্ত হতে ভেসে এলো, হ্যালো, স্লামালিকুম।

নীলা কাঁপা গলায় বললো, হ্যালো।

যুথি বলে, জ্বী কে বলছেন?

নীলা তার কন্ঠে যতোটাসম্ভব দৃঢ়তা এনে বলে, আমি নীলা, ঢাকা থেকে বলছি। আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিলো।

আমার সাথে কথা! আপনি কে? যুথি বলে।

আমি কে আগেই বলেছি। এখন আমি আপনাকে যা যা জিজ্ঞেস করবো তার সঠিক জবাব দিয়ে আমাকে সাহায্য করবেন। কথাগুলো বলে নীলা থামে।

-আমার সাথে আপনার এমন কি কথা আমি বুঝতে পারছিনা! তারপরও বলছি আমার যথাসাধ্য সাহায্য করবো আপনাকে। কি বলবেন বলুন।

-আপনি নিশ্চয় রক্তিমকে চিনেন?

-চিনব না কেন অবশ্যই চিনি। ওর কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?

-আপনি কতোদিন থেকে ওকে চিনেন?

-অনেকদিন থেকেই চিনি তবে ঠিক কতোদিন বলতে পারবোনা।

-আপনি ওর সম্পর্কে কতোটুকু জানেন?

-একজন মানুষকে যতোটা জানা গেলে ভালোবাসা যায় তার চেয়ে অনেক বেশী জানি।

-আপনি জানেন কি আপনি একটা বড় ভুল করতে চলেছেন?

-এখানে ভুলের কিছু দেখছিনা। আমি ওকে ভালোবাসি, সেও আমাকে ভালোবাসে।

এবার আসল বোমা ফাটালো নীলা। নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, রক্তিম যে বিবাহিত সে কথা কি জানেন?

অপরপ্রান্তে খানিকটা নীরবতার পর যুথি বললো, অসম্ভব। এটা কখনোই হতে পারেনা। আপনি বানিয়ে বলছেন।

নীলা বলে, আমি এক বিন্দুও বানিয়ে বলছিনা। রক্তিম বিবাহিত এবং আমি তার বিবাহিতা স্ত্রী। আমরা আজ থেকে পাঁচ বছর আগে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি।

যুথির গলা মিইয়ে এসেছে। সে ভাঙ্গাগলায় বললো, আপনি সত্য বলছেন তার প্রমাণ কি?

নীলা দৃঢ়কন্ঠে বলে, আমিই সবচেয়ে বড় প্রমাণ, সবচেয়ে বড় সত্য। পৃথিবীতে এর চেয়ে ধ্রুব সত্য আর কিছু হতে পারেনা।

নীলা রিসিভারে কান রেখেই বুঝতে পারছিলো, ওপাশে যুথি কাঁদছে। যুথি কান্নাতাড়িত কন্ঠে বলে, আপনার কথাগুলো যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে আমার কিছু বলার নেই। কিন্তু ভাবতে কষ্ট হচ্ছে রক্তিম কীভাবে আমার সাথে এ ছলনা করলো! জীবনে এই প্রথম আমি কাউকে ভালোবেসেছিলাম আর সে ভালোবাসায় এমন প্রতারিত হলাম। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, আপনি কোন চিন্তা করবেন না, সে আমার কাছে আর কোন প্রশ্রয় পাবেনা। সে এটাও জানবেনা আপনি আমায় ফোন করেছেন।

কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে সে মোবাইল রাখতে গিয়েও রাখেনা। নীলা বুঝতে পারে অপরপ্রান্তে যুথি অঝোরে কেঁদে চলেছে। ঢুকরে ঢুকরে কান্নার শব্দে তারহীন ফোনের সমস্ত তরঙ্গ বিষাদময় হয়ে উঠে। অনেকক্ষণ পর নীলা ফোন কেটে দেয়। মেয়েটা প্রাণভরে কাঁদুক। কেঁদে কেঁদে হালকা করুক নিজের মনটাকে। নীলা নিজেও মেয়ে তাই সে বুঝতে পারে, মেয়েরা কতো আবেগ দিয়ে একজন মানুষকে ভালোবাসে। তার চোখের কোনেও কিছুটা জল এসে যায়।

গতরাতে বেশ তাড়াতাড়ি রক্তিম বিছানায় গিয়েছিলো। কিন্তু দুচোখের পাতা একবারও বুজতে পারেনি। চোখ বুজলেই যুথির তিরস্কার কানে আসছিলো। যুথি কেন এমন করলো! কেন এতো কঠোরতা দেখালো! এইসব ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমের জগতে হারিয়ে গিয়েছিলো।

ঘুম যখন ভাঙ্গলো তখন সকালের তেজোদীপ্ত সূর্য্যকীরণ উজ্জ্বল জ্যেতি ছড়িয়ে দিয়েছে পুরো শোবার ঘরে। আড়মোড়া ভেঙ্গে পাশ ফিরতেই চোখে পড়ে, নীলা সদ্য গোসল সেরে ড্রেসিংটেবিলের আয়নায় হালকা প্রসাধনী করছে। সাদা তোয়ালে দিয়ে ভেজা চুল বেধে রাখা। কানের লতি বেয়ে পড়ছে বিন্দু বিন্দু জলকণা। তারুন্যের উজ্জ্বল আভায় রাঙ্গানো মুখমন্ডল যেন নন্দনকাননে প্রস্ফুটিত পুষ্পের একটি কোমল পাঁপড়ি। এমন সুন্দরী স্ত্রী ঘরে থাকা সত্ত্বেও সে কেন অন্য মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে ভাবতেই নিজে লজ্জ্বিতবোধ করছে, অপরাধবোধে আচ্ছ্বন্ন হচ্ছে।

রক্তিম নীলার ডানহাতে আচমকা একটা টান দিয়ে বিছানায় নিজের বুকে নিয়ে এলো। নীলার স্নিগ্ধ চাহনীতে তার হৃদয়ে তোলপাড় শুরু হয়ে গেলো। নীলার কোমল ওষ্ঠে নিজের ওষ্ঠ ডুবিয়ে দিলো। ভালোবাসার মধুর অবগাহনে দুটি ভিন্ন সত্ত্বা অভিন্ন সত্ত্বায় পরিণত হয়ে সাঁতরে বেড়াতে লাগলো ভালোবাসার নীল সমুদ্রে। যে ভালোবাসা কখনোই হারিয়ে যাবার নয়।

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


2 Responses to ভার্চুয়াল জীবন (শেষ পর্ব)

You must be logged in to post a comment Login