এ.বি.ছিদ্দিক

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা উপন্যাস: টুকরো টুকরো অভিশাপ (পর্ব-২)

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page


ঘরের মধ্যে ঢুকতে না ঢুকতেই আজগরের সেই পুরানো ডিপডিপানি আবার শুরু হল। আচ্ছা এটা কোন অসুখ নয় তো? আজই রতন আলী পীরের কাছে যেতে হবে। রতন আলী পীরের পানি-পড়া খেলে নাকি ক্যান্সারের মত কঠিন কঠিন রোগও ভাল হয়ে যায়, ওর ডিপডিপানিও নিশ্চয় ভাল হয়ে যাবে, সতীশ অবশ্য বলে ওসব নাকি ভুয়া, সবই নাকি রতন আলীর ভণ্ডামি। কিন্তু রতন আলী পীরকে তো ও দেখেছে, ওর কাছে কখনও ই মনে হয়নি রতন পীর খারাপ মানুষ। আহা, কত সুন্দর করে বাপ বলে ডাকে আজগরকে। দোষের মধ্যে একটু আধটু আফিম খায় এই। সেটা আজগরের কাছে বড় কোন বিষয় নয়। বড় বড় জীন পরি নিয়ে রতন আলীর কারবার, তাদের মন রক্ষা করতে গেলে ওসব একটু করতে হয়। তাছাড়া সে লোক মুখে শুনেছে রতন পীরের পানি পড়া খেয়ে নাকি জামাল মুন্সির বউ এর পেটে বাচ্চা এসেছে। আহা একটা সন্তানের জন্য কত চেষ্টা ই না করেছে জামাল মুন্সী আর তার বউ। সেই মাদ্রাজ থেকে ঘুরে এলো তবু কাজ হল না। অথচ বাড়ির কাছেই এত বড় নামকরা পীর, তার কাছে গেল না। শেষ পর্যন্ত সেই পীর ই তো মুন্সীর বউ এর পেটে বাচ্চা এনে দিল। মুন্সীর হাজার হাজার টাকা যা পারল না, রতন পীরের পানি পড়া ই তা করে দেখাল। সতীশ যা ই বলুক, রতন আলীর কাছে গিয়ে একবার পানি পড়া নিয়ে আসতেই হবে। আর যা ই হোক সে তো বজলু ডাক্তারের মত জোর করে টাকা নেবে না, টাকা না পেলে গাছের কাঁঠাল, পুকুরের মাছ ও নেবে না।
: আজগর ভাই।
ছালমার মুখে নিজের নামটা শুনতেই আজগর চমকে ওঠে। ওর চমকে ওঠা দেখে ছালমা হাসতে থাকে, হাসি থামাবার বিন্দুমাত্র চেষ্টা না করে ও বলে
: আজগর ভাই, ডর পাইলা নাহি।
: না ডর পামু ক্যা?
: তাইলে চমকাইলা ক্যান? কি ভাবো?
: কই কিছুই ভাবতাছি না।
: আমি কিন্তু বুইজ্জা ফালাইছি।
ছালমার একথা শুনে আজগরের বুকের ডিপডিপানি আরও একধাপ বেড়ে গেল।
সে মনে মনে আল্লাহ, নবীর নাম করতে করতে বলল
: হায়, হায় ক্যান এ মাইয়ার সামনে আইলাম, লজ্জা লজ্জা। ছি, ছি এহন তো মুখ দেখানো যাইবো না, লজ্জা, লজ্জা।
আজগর প্রায় তোতলাতে তোতলাতে বলল
: কি, কিইই, বুইজা ফালাইছো?
: বুইজা ফালাইছি, কমু না।
: না কি বুজছ হেইডা কিন্তু কয়ন ই লাগব।
: না, কমু না।
: কও কইলাম ছালমা।
ছালমা হাসে। হাসতে হাসতে বলে
: সতীশদার মত তোমারও বিয়ে দেয়ন লাগব।
বিয়ের কথা শুনে আজগরের মুখ লজ্জায় লাল হয়ে যায়, সে মেয়েদের মত লজ্জা পেয়ে বলে
: ধুর, কইছে তোমারে।
: ঠিক ই কই।
: তোমার যত আজগুবি কথা।
: দেহি আমার হাতডা ধর তো।
হাত ধরার কথা শুনে আজগরের বুকটা আবারও কেপে উঠে, ওর কেন জানি মনে হয় ছালমা নামের রূপবতী মেয়েটি ওর মনের কথা সব বুঝতে পারছে। আজগরের নিজেকে অসহায় লাগছে। সে লক্ষ করল, ছালমার চোখে সে তাকাতে পারছে না, তার প্রচণ্ড লজ্জাবোধ হচ্ছে। সে মাটির দিকে তাকিয়ে বলল
: হাত ধরুম ক্যা।
: ধরবার কই তাই ধরবা। যার কথা হুইনা ডর লাগে তারে ছুইলে ডর ক্যাইট্যা যায়।
: অ্ এই কথা?
: অয়, তয় হাঁচা কথা।
: কইছে তোমারে।
: অত কথা কইবা না তো, হাত ধর, আর বাড়ি গিয়া লবণ পানি খাইবা।
আজগর আর কোন প্রতিবাদ করে না,ছালমার হাতটা ধরে। ছালমা ওর মনের কথা কিছু বুঝে ফেলেনি এতেই মহা খুশি ও।
: আজগর ভাই এইবার কিন্তু তোমার বিয়া দিমুই দিমু।
: হয়, আমারে আর মাইয়া দিব ক্যাডা?
: ক্যান তোমার কি আর চেহার সুরত খারাপ আছে নাকি? এ গেরামের ব্যাবাক লোক তোমারে পছন্দ করে আর মাইয়ারা করবো না?
: বিয়া করমু, খাওয়ামু কি?
: ক্যান তুমি কি না খাইয়া থাকো নাকি? তুমি যা খাইবা, আমগো ভাবি সাবরেও তাও খাওয়াইবা।
: ভাবি সাব?
: তুমি যারে বিয়া করবা হ্যায় তো ভাবি সাব ই অইব।
আজগর মনে মনে ভাবল, ছালমা যার কথা ভাবছে সে নিশ্চয় ছালমা নিজে হবেনা সেটা বুঝতেই ওর বুকের ভেতরটা কেমন যেন খাঁ খাঁ করে উঠল। সে চিৎকারের মত করে বলে উঠল
: না না, আমি বিয়া করুম না।
কথা বলার এমন সময় পাকা কলার ছড়ি হাতে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ছালমার মা রাহেলা বেগম প্রবেশ করল। রাহেলা বেগম কলার ছড়ি রাখতে রাখতে বলল
: ক্যাডা বিয়া করবো না? কার বিয়ে।
: ক্যাডা আবার, আমগো আজগর ভাই।
: ক্যা গো আলীর ব্যাটা? বিয়া করবা না ক্যা? বিয়া অইল গিয়া ফরজ কাজ, আমগো নবী সাবের ও তো বিয়াকরছে।
ছালমা তার মার কথায় সাড়া দিয়ে বলে
: অয়, একডা দুইডা না, ১৩খান বউ আছিল নবী সাবের।
: হ্যায় নবী সাব আছিল, আমি তো আজগর আলী, আমি বিয়া করুম না।
ছালমা হাসতে হাসতে বলে
: তুমি বিয়া করবানা কইলেই তো আর অইব না, আমরা হগ্গলে মিইলা ধইরা তোমার বিয়া দিমু।
: হুন আলীর ব্যাটা, আমার এক ভইনের মাইয়া আছে দেখতে দুধের নাহাল, জমি জমাও কইলাম মাস আল্লাহ। তোমার তো বাপ, চাচা হেই রহম কেও নাই, তুমি আমার ছ্যালের মত লাগো, কও তো কথাবার্তা কই।
: না না আমি বিয়া করুম না।
: হুন মা, হ্যার লগে কথা কইয়া লাভ নাই, কথা কইলে কইতে অইব সতীশদার লগে।
: ঠিক ই কইচস, আমি সতীশের লগেই কথা কমু।

আজগর ছালমা আর তার মায়ের উৎসাহ দেখে অসহায় বোধ করতে থাকে। সত্যি সত্যি ওকে ধরে বিয়ে দিয়ে দেবেনা তো? তাহলে ছালমা? ছালমার কি হবে? ওকে কে বিয়ে করবে? নিশ্চয় অন্য কেও। আজগরের বুকের ভেতরে অজানা হতাশায় আবারো হা হা করে ওঠে। খানিক আগে ও ওর ক্ষুধা বোধ হচ্ছিল, এখন হচ্ছেনা। এই অবস্থা থেকে ওকে এখন একজন ই বাচাতে পারে, সতীশ। কিন্তু ওর কাছে তো যাওয়া যাবেনা কিছুতেই যাওয়া যাবেনা।
: এই লও আজগর ভাই, কলা খাও।
আজগর আবার চমকে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ছালমা আগের মতই হাসতে শুরু করে।
: ও মা দেহ দেহি আমি ভূত অইয়া গেছি নাকি।
পাশের ঘর থেকে রাহেলা বেগম ভেজা শাড়ী বদলাতে বদলাতে বলে
: ক্যান রে বেটি?
: এমনেই কই, আইজকাল আমারে দ্যাখলে অনেক মানষেই ডর পায়।
: ক্যাডায় ডর পায়?
: হেইডা কওন যাইবো না, তই তুমি ও দুই দিন পর ডর পাইবা। দেশে নাকি মিলিটারি নামবো, হ্যারাও আমারে দ্যাখলে ডরাইবো, ঠিক কইছি না মা?
: তর সব পাগলামি কথা।
: পাগলামি না মা, হাচা ই কই।
: অয় হাচা কস।
রাহেলা বেগম শাড়ির ভাজ ঠিক করতে করতে ও ঘরে এসে বলে
: আজগররে খালি কলা দিলি ক্যান ও ছালমা? গাইয়ের দুধ ও আইনা দে, একটু আরাম কইরা খায়ুক।
: না, না, আমি কিছু খামু না, চইলা যামু।
: এই বৃষ্টির মইধ্যে যাইবা ক্যামনে গো ব্যাট্যা? খাও, বৃষ্টি থামুক, তোমার বাপে আগে কত আইছে আমগো বাড়ি, তুমিই তো আর আসো না, আমরা কি তোমার পর লাগি বাজান?
একথা শুনে আজগর বিবর্ত বোধ করে।
: তোমার তো কেও নাই, পুরুষ মানুষ কেমনে রানধো, খাও, আমগো বাইত মাঝে মাঝে আইলেই তো পার।
ছালমা দুধ, কলা আর মুড়ি এনে আজগরকে দেয়। আজগর কোন কথা বলে না, খাবারের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। সেই সুখাদ্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আজগরের পেটের ভিতরটা আবার মোচড় দিয়ে ওঠে, ওর পুরানো ক্ষুধাবোধ আবার ফিরে আসে। ও প্রায় রাক্ষসের মত খাওয়া শুরু করে। ছালমা আজগরকে আরও দুটো কলা আর চিড়ি এনে দেয়, আজগর ছালমার মুখের দিকে একবার তাকায়। ছালমা মৃদু হাসে, কিছুই বলে না।

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


6 Responses to মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা উপন্যাস: টুকরো টুকরো অভিশাপ (পর্ব-২)

You must be logged in to post a comment Login