শৈলী বাহক

মৃত্যুর সঙ্গে হুমায়ূন আহমদের লড়াইয়ের দিনগুলো

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

(নন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমদের মৃত্যুর পর তার মৃত্যু নিয়ে নানাধরনের কথা হয়েছে,অনেক অভিযোগ অনুযোগ উঠেছে। হয়েছে বিতর্কও। মিডিয়াতে নানা ধরনের খবর বেরিয়েছে যার প্রায় সবই নামহীন সোর্স থেকে,বলা চলে ফার্ষ্টহ্যান্ড সোর্স থেকে উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনাই জানার সুযোগ হয়নি পাঠকদের। হুমায়ূন আহমেদেরচিকিৎসা চলাকালে শেষ সময় পর্যন্তপাশে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী বাংলাদেশী লেখক পূরবী বসু।হুমায়ূনের মৃত্যুর সঙ্গে লড়াইয়ের তিনি প্রত্যক্ষদর্শী, ফাষ্টহ্যান্ড সোর্স।পূরবী বসু ঢাকার দৈনিক সংবাদের জন্য লিখেছেন হুমায়ূন আহমেদের শেষ মুহূর্তগুলোর কিছু স্মৃতিকথা পাঠকদের জন্য পূরবী বসুর লেখাটি তুলে ধরা হলো। আমরা নিশ্চিত পূরবী বসুর এই লেখায় হুমায়ূনের মৃত্যুকে ঘিরে তৈরি হওয়া অনেক প্রশ্নের, অনেক বিতর্কের উত্তর খুজেঁ পাওযা যাবে।-বি.স.)
আগে তেমন জানাশোনা না থাকলেও আমেরিকায় তার ক্যান্সারের চিকিৎসা চলাকালে হুমায়ূন ও তার পরিবারের সঙ্গে ঘটনাচক্রেই আমাদের পরিবারের যথেষ্ট সখ্য গড়ে উঠেছিল, আর এই বন্ধুতার প্রায় সবটাই তার চিকিৎসাকে কেন্দ্র করে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আজ আমার এই ব্যাপারে নিজের কিছু অভিজ্ঞতা ও তার চিকিৎসার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত দুই হাসপাতালের দু`জন সিনিয়র ডাক্তারের সঙ্গে হুমায়ূনের ব্যাপারে আমার যোগাযোগ/ আলোচনার ওপর ভিত্তি করে কিছু কথা লিখছি, কিছু তথ্য পরিবেশন করছি।

হুমায়ূনের ক্যান্সার সার্জারি টিমের প্রধান ডাক্তারকে (ডাক্তার জর্জ মিলার) বারে বারে আমি প্রশ্ন করে জানতে চেয়েছি, হুমায়ূনের পরিবার বা হাসপাতালের পক্ষ থেকে এমন কিছু করার ছিল কিনা যা করা হয়নি, করতে পারিনি, করিনি অথবা সময়মতো করা হয়নি। কিংবা, এমন কিছু করা হয়েছিল কিনা যা করা ঠিক হয়নি, ভুল হয়েছে, অথবা যার জন্যে কোন ক্ষতি হয়েছে? জবাবে ডাক্তার জর্জ মিলার প্রতিবার পরিষ্কার করে জোর দিয়ে বলেছেন, লিখেছেন (এমন কি মাত্র চারদিন আগেও আমার লিখিত প্রশ্নের জবাবে টেক্সট মেসেজ করে জোর দিয়ে বলেছেন, তার জন্যে যা করা সম্ভব ছিল তার সবই করা হয়েছে। করণীয় কোন কিছু থেকেই বিরত থাকা হয়নি।) এ প্রসঙ্গে বলে রাখা উচিত, হুমায়ূন ও তার স্ত্রী শাওন উভয়েই ডাক্তারদের সঙ্গে হুমায়ূনের ক্যান্সার ও তার চিকিৎসার ব্যাপারে আমাকে সরাসরি যোগাযোগ ও আলোচনা করার অনুমতি এবং অধিকার দিয়েছিল বলেই সেটা করতে পেরেছি আমি, তা নইলে এদেশে ডাক্তার বা হাসপাতালের তরফ থেকে রোগীর পরিবারের বাইরের কাউকে রোগীর শারীরিক অবস্থা বা চিকিৎসা সম্পর্কে কোন তথ্য দেয়া হয় না। প্রাইভেসি ক্ষুণ্ন হওয়ার বিধান লঙ্ঘনের সম্ভাবনাতে সবাই বড় সতর্ক এদেশে। আমাকে এ বিশেষ দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল সম্ভবত এ কারণে যে, আমি নিজে ডাক্তার না হলেও বায়োমেডিকেল বিজ্ঞানে, বিশেষ করে ডাক্তারদের সঙ্গে যোগাযোগ ও তথ্য আদানপ্রদানের ক্ষেত্রে, দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছি। এছাড়া সবচেয়ে বড় যে কারণে হয়তো এত অনায়াসে আমাকে এ দায়িত্ব তারা দিতে পেরেছিল, সেটা হলো, চিকিৎসাক্ষেত্রে আমার বিবেচনার ওপর হুমায়ূন ও তার ঘনিষ্ঠজনের একরকম আস্থা জন্মেছিল।

গত বছর (২০১১ সালে) সেপ্টেম্বরের ৭ তারিখে সিঙ্গাপুরে রুটিন শারীরিক পরীক্ষা করতে গিয়ে আকস্মিকভাবেই ধরা পড়ে হুমায়ূনের কোলনে (বৃহদান্ত্রে) ক্যান্সার। আর তাও চতুর্থ স্টেজে। সাধারণত রোগীর শরীরে ক্যান্সারের অবস্থা নির্ণয়ে এ স্টেজগুলোকে বিবেচনায় আনা হয়। কতগুলো নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য ও বিশেষ কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার ফলের ওপর নির্ভর করে ক্যান্সারের ব্যাপকত্ব ও বিস্তৃতি অনুসারে সাধারণত এ স্টেজগুলোকে এক থেকে চার পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে ভাগ করা হয়। স্টেজ ফোর ক্যান্সার মানে সবচেয়ে পরিণত বা Advanced Stage-ক্যান্সার। স্টেজ ফোর-এ কর্কট কোষগুলো মূল জায়গা ছাড়াও শরীরের অন্য অঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। কোলন ক্যান্সারে চার নম্বর স্টেজ থেকে আরোগ্যলাভের সম্ভাবনা খুবই কম, (শতকরা ৭% এর মতো)। সিঙ্গাপুরের ডাক্তাররাই দুঃসংবাদটি দিয়ে হুমায়ূনকে জানিয়েছিলেন কোলন থেকে তার ক্যান্সার লিভারের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় সম্ভবপর চিকিৎসার মধ্যে ছিল কেমোথেরাপি অথবা কিছু কেমোথেরাপি আর সার্জারি। কিন্তু অসুখের নামটা শুনেই হুমায়ূন মনে মনে স্থির করে ফেলেছেন ক্যান্সার চিকিৎসার জন্যে তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো জায়গায় যাবেন এবং সেটা সিঙ্গাপুর নয়। আমেরিকা। সঙ্গে সঙ্গে দেশে ফিরে আসেন তিনি সপরিবারে। স্ত্রী শাওন ইন্টারনেট ও বিভিন্ন জায়গায় খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারেন নিউইয়র্কের মেমোরিয়াল সেস্নান ক্যাটারিং ক্যান্সার সেন্টার এ বিশেষ রোগের চিকিৎসার জন্যে সবচাইতে বিখ্যাত হাসপাতাল। সঙ্গে সঙ্গে হুমায়ুন আমেরিকায় সেস্নান ক্যাটারিং হাসপাতালে চিকিৎসার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। এত নামকরা ও পুরনো প্রতিষ্ঠান বলেই হয়তো চাইলেই সঙ্গে সঙ্গে এসে এখানে চিকিৎসা শুরু করে দেয়া সম্ভব হয় না। অপেক্ষা করতে হয়। সে যাই হোক, হুমায়ূনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, প্রকাশক ও প্রতিবেশি আলমগীর রহমানের (আলমগীর আমাদের-ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু, অন্তত চার দশক ধরে) কাছে কাকতালীয়ভাবে সংবাদটা জানতে পেরে আমি হুমায়ূনের জন্যে তার নিউইয়র্কে পেঁৗছার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সেস্নান ক্যাটারিংয়ে ডাক্তার দেখাবার জন্যে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্টের ব্যবস্থা করি। এ ব্যাপারে আমার সাবেক বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর রিভলিন আমাকে প্রভূত সাহায্য করেন। এছাড়া আশি আর নব্বইয়ের দশকে প্রায় এক যুগ ধরে আমি সেস্নান ক্যাটারিংয়ে গবেষণার কাজ করেছি বলে সেখানে এক আধটু জানাশোনা তখনো অবশিষ্ট ছিল। সেপ্টেম্বরের ১৪ তারিখ রাতে সপরিবারে হুমায়ূন নিউইয়র্কে পেঁৗছান আর সেপ্টেম্বরের ১৫ তারিখ দুপুর একটায় তার অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক হয় সেস্নান ক্যাটারিংয়ে। সেদিন সব কাগজপত্র, প্লেট দেখে, কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার পর ডাক্তার স্থির করেন প্রথম কিস্তিতে ছয়টি কেমো নিতে হবে। হুমায়ূনের ক্যান্সারের তখন যে অবস্থা (স্টেজ চতুর্থ), তাতে তখন আর সার্জারি করা সম্ভব ছিল না। বাংলাদেশের কাগজে এ সার্জারি না করার সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক সংবাদ ভেবে লিখে ফেলে, `অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন নেই। অপারেশন ছাড়াই হুমায়ূন আহ?মেদ সুস্থ হয়ে উঠবেন।` ডাক্তার স্টিভেন ভিচ বললেন, প্রথম ছয়টি কেমো দেয়ার পর CT scanmnসহ আবার সমস্তরে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে পরবর্তী কর্মপদ্ধতি স্থির করা হবে। মেমোরিয়াল সেস্নান ক্যাটারিংয়ের আন্তর্জাতিক শাখার প্রধান ডাক্তার স্টিভেন ভিচ নিজেই হলেন হুমায়ূনের ডাক্তার। বললেন, আপাতত যে ৬টি কেমো দেয়া হবে তার প্রতিটির ভেতর ৩টি করে ক্যান্সারের ওষুধ থাকবে। লক্ষ্য করলাম, সেস্নান কেটারিং গত পঁচিশ বছরে অনেক বদলে গেছে। বড়ো ও (আকৃতিতে) হয়েছে অনেকটাই। বিশেষ করে, এখনকার নিয়মে যারা বিদেশি এবং বিশেষ করে যারা স্বাস্থ্য বীমাবিহীন বিদেশি, তাদের চিকিৎসার জন্যে প্রয়োজনীয় সবটা অর্থই আগে থেকে ক্যাশিয়ারে জমা দিতে হবে, তারপরই চিকিৎসা শুরু হবে। এটার কারণ, অনেক বিদেশি রোগী নাকি ধারে চিকিৎসা নিয়ে অর্থ পরিশোধ না করেই নিজ দেশে ফিরে গেছে। তারা জানান, নতুন পলিসি অনুযায়ী হুমায়ূনের কেমোথেরাপির প্রথম কোর্সের (৬টি কেমোর) যাবতীয় অর্থ আগাম পরিশোধ করলে তবেই চিকিৎসা শুরু হবে। সে তো একসঙ্গে বিস্তর টাকার ব্যাপার। অত টাকার ব্যবস্থা রাতারাতি করা প্রায় অসম্ভব। অথচ চিকিৎসা আর দেরি না করে এক্ষুণি শুরু করা দরকার। এ অবস্থায় ডক্টর ভিচসহ আরও দু`একজনের সঙ্গে কথা বলে কিস্তিতে টাকাটা দেয়ার ব্যবস্থা করতে সক্ষম হই।
সেস্নানে কেমো দেয়ার ধরনটি ছিল এরকম। কেমো নেয়ার দিন সকালে হাসপাতালে গেলে প্রথমে রোগীর রক্ত নিয়ে পরীক্ষা করা হবে। দেখার জন্যে, কেমো নেয়ার জন্যে তার স্বাস্থ্য উপযুক্ত কিনা। তার হিমোগ্লোবিন, লাল, সাদা ও অন্য (প্লেটিলেট) রক্তকণার পরিমাণ, ধাতব পদার্থ ইত্যাদি সব ঠিক আছে কিনা দেখা হবে। তার পরে ডাক্তার তাকে পরীক্ষা করবেন, কথা বলবেন, বিভিন্ন প্রশ্ন করবেন। ইতোমধ্যে ফার্মেসিতে তার ইন্ট্রাভেনাস কেমো দেয়ার জন্যে ককটেইল তৈরি হতে থাকবে। অর্থাৎ ক্যান্সার-কোষগুলো মেরে ফেলার জন্যে যে তিনটি কড়া ওষুধ শরীরে যাবে তা শরীরের ভালো জীবকোষগুলোকেও যাতে ধ্বংস বা ক্ষতি না করে সে জন্যে ওই ওষুধের সঙ্গে ভিটামিন, মিনারেল, স্টেরয়েড ছাড়াও বিভিন্ন দ্রব্য মেশানো হয় যার জন্যে কেমোথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ইদানিং আগেকার দিনের তুলনায় অনেক কম হয়। কয়েক ঘণ্টা ধরে সেই ওষুধ-ককটেল শরীরে দেয়ার পরে বাকি ওষুধটা একটি বোতলের মতো ধাতব পাত্রে ভরে রোগীর পেটের ওপর একটা ব্যাগে বেঁধে দেয়া হয়। একটা সরু নল দিয়ে সেই বোতল থেকে ওষুধ এসে রোগীর বুকের চামড়ার ভেতরে semi-permanent–ভাবে বসানোসবফর-ঢ়ড়ৎঃ ুএর ভেতর দিয়ে দুদিন ধরে ধীরে ধীরে শরীরে প্রবেশ করবে কিন্তু তার জন্যে এ দুদিন হাসপাতালে থাকার প্রয়োজন নেই। ঘরে গিয়ে দুদিন পরে এসে খালি ক্যানিস্টার তা খুলিয়ে আসতে হয় কেবল। এভাবে প্রতি দু`সপ্তাহ পর পর তিন দিন ধরে কেমো চলতে থাকে। কিন্তু কেবল প্রথম দিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত আউটপেশেন্ট বিভাগে থাকতে হয়। বাকি কেমো চলে বাড়িতেই।

ডাক্তার ভিচ ও সেস্নান ক্যাটারিংয়ের সমাজকর্মীদের সঙ্গে এ চিকিৎসার খরচের ব্যয়ের ব্যাপারে কথা বলে কিছু করে উঠতে পারিনি। গত ২৫ বছরে অনেক বদলে গেছে এ প্রতিষ্ঠানটি। অত্যন্ত বেশি ব্যবসায়ী মনোভাব গড়ে উঠেছে এখানে_ ওটাই যে বর্তমানে সেস্নান ক্যাটারিংয়ের সংস্কৃতি, মনে হলো আমার। আন্তর্জাতিক ভবনে প্রতিটি আন্তর্জাতিক রোগীর জন্য রয়েছে একজন করে বিশেষ সমন্বয়কারী। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমাদের বেলায় সমন্বয়কারী হিসেবে পড়লেন, এমন একজন মধ্যপ্রাচ্যের নারী, যার আগাগোড়া ব্যবহারে এটিই ফুটে উঠছিল যে, `বাবু যত বলে, মোসাহেব দলে বলে তার শতগুণ।` আমার যুক্তি ছিল, হাসপাতাল যা বিল করে, কোন ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিই তার পুরোটা কখনো দেয় না। তারা তাদের হিসেব মতো একটা ন্যায্য ও নির্দিষ্টমূল্য স্থির করে দেয় প্রতিটি চিকিৎসা সংক্রান্ত কাজ বা সেবার জন্যে। প্রত্যেকটি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিই যেহেতু স্বতন্ত্র ও স্বাধীন, তাদের সবার `ন্যায্য মূল্য`ও-এক নয়। আর কোন বিশেষ হাসপাতাল যদি কোন একটি বিশেষ ইন্স্যুরেন্স গ্রহণ করে থাকে (সব হাসপাতাল সব ইন্স্যুরেন্স নেয় না), তাহলে সেই হাসপাতাল ওই ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি নির্ধারিত ন্যায্য মূল্য গ্রহণ করতে বাধ্য। তারপর পলিসি অনুযায়ী রোগী তার পরিশোধ মেটায়। যেমন, যদি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি `ন্যায্যমূল্যের` ৮০% দেয়, রোগীকে দিতে হয় বাকি ২০%। আর তখন মূল বিল থেকে ন্যায্যমূল্যের অংশটা হাসপাতাল বাদ দিয়ে দেয়। আমার যুক্তি ছিল, ইন্স্যুরেন্স থাকলে যদি তারা চিকিৎসার জন্যে আংশিক মূল্য নিয়ে বাকিটা ছেড়ে দিতে পারে, তাহলে যে ব্যক্তির ইন্স্যুরেন্স নেই, যে ক্যান্সার চিকিৎসার মতো বিশাল খরচ নিজে বহন করছে, তার জন্যে কোন প্রকার ডিসকাউন্টের ব্যবস্থা থাকবে না কেন। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও এ নামকরা প্রাইভেট হাসপাতাল মেমোরিয়াল সেস্নান ক্যাটারিংয়ের ব্যাপারে কিছু করতে সক্ষম হলাম না।

ইতোমধ্যে সব দেখেশুনে পরে অবশ্য আমি পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েছিলাম, কোলন ক্যান্সারের জন্যে যে কেমো হুমায়ূন নিচ্ছে এখানে, তার সঙ্গে এদেশের অন্য হাসপাতালের কোলন ক্যান্সারের কেমোর কোন বস্তুগত বা গুণগত পার্থক্য নেই। ডক্টর ভিচ প্রথম থেকেই হুমায়ূনকে খুব পছন্দ করেন এবং হুমায়ূন-ও ভিচ বলতে অজ্ঞান। ড. ভিচ আমাদের প্রথম দিনেই বলেছেন, এখন যে চিকিৎসা চলছে তা একেবারেই স্ট্যান্ডার্ড কেমোথেরাপি যা বেশকিছু বছর ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ফলে অন্তত এ বিশেষ চিকিৎসাটির ক্ষেত্রে সেস্নান কেটারিংয়ের মতো প্রাইভেট এবং খরচসাপেক্ষ হাসপাতালে এসে নিজের বিত্তের এক বিশাল অংশ খুইয়ে রুটিন চিকিৎসা নেয়ার মানে হয় না। তিনি বলেছিলেন, শুধু এখানকার সিটি হাসপাতালে কেন, ভারত, সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, এমন কি হয়তো ঢাকায় বসেও একই চিকিৎসা পেতে পারেন হুমায়ূন। ইতোমধ্যে শাওন সিটি হাসপাতালে কর্মরত এক বাঙালি ডাক্তার দম্পতির কাছে খোঁজখবর নিয়ে দেখে সিটি হাসপাতালগুলোতে ফোর্থ স্টেজ কোলন ক্যান্সারের জন্য কেমোতে একই ওষুধ দেয়া হয়। কিন্তু তবু আমাদের দ্বিধা কাটে না। হুমায়ূন রাজি হলেও শাওনের মনে ভয়, যদি চিকিৎসার মান একই রকম না হয়! ওদিকে শাওনের মা এখান থেকে ও শাওনের বাবা ঢাকা থেকে ক্রমাগত বলছেন সেস্নান ছাড়া অন্য কোথাও গেলে যদি চিকিৎসার ব্যাপারে কোন রকম ছাড় দিতে হয়, সেটা করার কথা যেন চিন্তাতেও না রাখে তারা। যাই হোক, সবাইকে নিশ্চিন্ত করার জন্যে আমি ডেনভার, কলরেডোতেও খোঁজ করি। নিউইয়র্কের সিটি হাসপাতালের মতো না হলেও সেস্নানের চাইতে অনেক কম খরচ এখানেও। আমি তখন ডাক্তার ভিচকে গিয়ে দুটো কথা বলি। আমার সঙ্গে তখন ছিলেন হুমায়ূনের অত্যন্ত প্রিয়জন-তার সুহৃদ, ঢাকায় তার পাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশি, হুমায়ূনের বইয়ের প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম। ব্যবসা, বাড়িঘর, পরিবার সব ছেড়ে দীর্ঘদিন তিনি এখানে পড়ে আছেন কেবল হুমায়ূনের চিকিৎসার তদারকি করতে। তাছাড়া মাযহারকে হুমায়ূন খুবই স্নেহ করে। অনেক ব্যাপারে তার ওপর নির্ভর করে। সেই গৃহে আমাদের অবস্থানের সময় আমি দেখেছি, অন্যের জন্যে কী সাংঘাতিক করতে পারে এই মাজহার। খাবারের ব্যাপারে হুমায়ূন খুবই খুঁতখুঁতে। এক খাবার দুবেলা খাবে না, বাসি কিছু তো খাবেই না। তার ওপর কেমোথেয়াপী নিলে এমনিতেই খাদ্যে রুচি চলে যায়। গত নয়-দশ মাসে আমরা অন্তত যা বলে, সেটা কিনতে তখনই বাজারে ছোটে মাজহার। শুধু তাই নয়, অনেক দিনই নিজের হাতে রান্না করে মাজহার, হুমায়ূন যেমন করে রাঁধলে পছন্দ করে ঠিক সেভাবেই রাঁধে। প্রায় বিকেলেই সুস্বাদু ও পুষ্টিকর স্যুপ বানিয়ে আনে তাজা তরিতরকারি দিয়ে হুমায়ূনের জন্যে। কখনো ফল কেটে সুন্দর করে সাজিয়ে নিয়ে আসে প্লেটে। বাড়ির এ অনাত্মীয় লোকটিকে বরাবর দেখেছি সম্পূর্ণ পরিবারটিকে আগলে রাখতে। কে বলবে ওকে দেখে সে ঢাকায় এত বড় ব্যবসায়ী!
যে কথা বলছিলাম। সবাইকে নিশ্চিন্ত করার জন্যে, নিজেরা নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্যে আমরা আবার ডাক্তার ভিচের সঙ্গে বসি একদিন। তিনি আমাদের সবাইকে বোঝাতে সক্ষম হন যে সিটি হাসপাতালে একই চিকিৎসা চলবে হুমায়ূনের। কথা দেন সিটি হাসপাতালের জন্যে একটি ফাইল তৈরি করে দেবেন। সেখানে তার চলতি চিকিৎসার বিষয়ে সবকিছু লিখে দেবেন, মানে এখানে কিভাবে কোন ওষুধ কত ডোজে কত দ্রুততার সঙ্গে দেয়া হচ্ছে ইত্যাদি। আমি তখন তাকে অনুরোধ করলাম এটা কি আদৌ সম্ভব যে তিনি তার ওষুধের ককটেইলের একটা রেসিপি দিয়ে দেবেন আমাদের কাছে বা সিটি হাসপাতালে যেখানে রন্ধন পদ্ধতির মতো করে লেখা থাকবে প্রতিটি adjvuant দ্রব্যের নাম, পরিমাণ, মেশাবার পদ্ধতি, কতক্ষণ ধরে মেশানো হয়, সবকিছু, পরম্পরাসহ। ডক্টর ভিচ রাজি হলেন, সেটাও নিজের হাতে লিখে দেবেন তিনি। এরপর তার সঙ্গে কথা হলো, তার পরামর্শমতো, তার তত্ত্বাবধানেই চিকিৎসা চলবে কিন্তু খরচ কমাবার জন্যে কেমোটা নেয়া হবে সিটি হাসপাতালে। এছাড়া কিছুদিন পর পর রোগীর অবস্থা নিরুপণে যে স্ক্রিনিং চলবে, জানার জন্যে কতটা উন্নতি হলো, কতটা ছোট বা শুকিয়ে এলো টিউমারের আকৃতি, টিউমার মার্কারের পরিমাণ কতখানি কমল ইত্যাদি সব তথ্য আমরা ডাক্তার ভিচকে জানাব, দেখাব সব কাগজপত্র, প্লেট। তিনি রাজি হলেন। সেই থেকে আমি হুমায়ূনের ব্যাপারে তার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে গেছি। ডাক্তার ভিচের সঙ্গে আমার ই-মেইলে শেষ দুটি যোগাযোগ হয়েছে ১৭ আর ১৯ জুলাই (হুমায়ূনের মৃত্যুর দিন)।

ইতোমধ্যে সেস্নান ক্যাটারিং হাসপাতালে ৫টি কেমো নেয়া হয়ে গেছে। এরপরে হুমায়ূনের সিটি হাসপাতালে (বেলভিউ হাসপাতালে) চিকিৎসার সব ব্যবস্থা সম্পন্ন করলেন নিউইয়র্কের মুক্তধারার বিশ্বজিৎ সাহা। সেস্নান কেটারিংয়ের এক একটা কেমোতে যেখানে সাড়ে সতেরো হাজার ডলার লাগত, সেখানে বলতে গেলে সামান্য খরচে বা বিনা খরচে তার একই কেমো চলতে থাকে বেলভিউতে। বরং বেলভিউতে Avastin নামে আরও একটি নতুন ওষুধ যোগ করা হলো যেটা মেমোরিয়াল সেস্নান ক্যাটারিংয়ে দেয়া হতো না। Avastin সাধারণত এ পর্যায়ের অধিকাংশ কোলন ক্যান্সার রোগীদের দেয়া হয় অন্য তিনটি Oxaliplatin, Levo covenin, 5 FU) ওষুধের সঙ্গে, যে তিনটি সেস্নান কেটারিংয়ে দেয়া হচ্ছিল। Avastin কেন এতদিন দেয়া হয়নি বেলভিউ হাসপাতালের অঙ্কোলজিস্টের প্রশ্নের উত্তরে ডাক্তার ভিচের বক্তব্য ছিল, দুই কারণে সেটা করা হয়নি। ১) যখন হুমায়ূন প্রথম চিকিৎসা শুরু করেন এখানে, তার কোলনের টিউমারের যা অবস্থা ছিল, আকৃতি ও রক্তক্ষরণের পরিপ্রেক্ষিতে, যে তিনি ইচ্ছে করেই আধংঃরহ দেননি, কেননা, তাতে বিস্নডিং বেশি হতে পারত। ২) আর দ্বিতীয় কারণটি হলো, তিনি ভেবে দেখেছেন Avastin (যা টিউমর কোষে রক্ত সাপ্লাই বন্ধ করে টিউমারকে বড় হতে বাধা দেয়)। তার ককটেইলে যোগ করলে ফলাফল ঊনিশ বিশের বেশি কিছু পার্থক্য হতো না। এজন্যে পকেট থেকে এত খরচের পর আরেকটি খুব দামি ওষুধ যোগ করে খরচ বাড়াতে বিবেকের কাছে সায় পাননি তিনি। বেলভিউর অল্প বয়সী অত্যন্ত সতর্ক নারী ডাক্তারটি তখন এ প্রৌঢ় অভিজ্ঞ ডাক্তার ভিচকে জিজ্ঞেস করলেন, ৫টি কেমোর পরে যেহেতু তার টিউমারের অবস্থা বেশ কিছুটা ভালো, রক্তক্ষরণও আর নেই, টিউমার মার্কারের পরিমাণও কমে এসেছে, সেক্ষেত্রে এখন Avastin যোগ করলে কেমন হয়? ডাক্তার ভিচ তাকে Avastin যোগ করার পরামর্শ দিলেন। এভাবে হুমায়ূন আহমেদের সেস্নান কেটারিংয়ের চিকিৎসাই বেলভিউ হাসপাতালে (সিটির অধীনে হলেও বেলভিউ হাসপাতাল গুণগত দিক দিয়ে খুবই নাম করা হাসপাতাল। শুধু সিটির অধীনে নয়, বেলভিউ হাসপাতাল খ্যাতনামা নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল কলেজের সঙ্গেও সম্পৃক্ত) হতে থাকে। পার্থক্য শুধু বেলভিউতে ঘরে কেমো নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা নেই। এখানে কেমো নেয়ার প্রথমদিন আউটপেশেন্ট হিসেবে এবং পরবর্তী দুদিন হাসপাতালে ভর্তি হয়ে কেমো নিতে হয়। এটা একদিক দিয়ে ভালো কেননা, কেমো নেয়ার সময়েও সর্বক্ষণ ডাক্তারদের নজরের ভেতর থাকে হুমায়ূন। বেলভিউ হাসপাতালে কর্মরত দু`একজন বাঙালি স্বাস্থ্যকর্মী হুমায়ূনকে রোগী হিসেবে পেয়ে মহাআনন্দিত এবং তাদের একজন, রন্? সাধ্যের বাইরে গিয়ে কিছু করার চেষ্টা করেছেন তাদের প্রিয় লেখকের জন্যে। যেমন, কেমো নেয়ার সময়ে semi private room এর বদলে শুনেছি private room এর ব্যবস্থা করেন তারাই যাতে ইছে করলে শাওন এসে থাকতে পারে রাতে। মাঝখানে কেমোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় দু` দু`বার সাদা রক্তকণা এবং প্লেটিলেটের পরিমাণ অনেকটা কমে যায় হুমায়ূনের। এ রকমটি ঘটা খুবই স্বাভাবিক কেমোথেরাপির রোগীদের। এরকম একবার হয়েছিল সেস্নানে চিকিৎসার সময়েও। তখন নির্ধারিত কেমোর দিন পেছাতে হয়। প্রয়োজনে রক্তকণার সংখ্যা বাড়াবার জন্যে bone-marrow কে চাঙ্গা করতে একরকম উত্তেজক ইঞ্জেকশন দেয়া হয়। তাতে হুমায়ূনের বেশক`দিন ধরে হাতে পায়ে খুব ব্যথা, সামান্য জ্বর ও বিভিন্ন রকম শারীরিক অস্বাচ্ছন্দ্য হতো।
কেমো নেয়া, রক্ত পরীক্ষা করা ও স্ক্রিনিংয়ের জন্যে হাসপাতালে ঘন ঘনই যেতে হতো হুমায়ূনকে। বেলভিউ হাসপাতাল ম্যানহাটানের দক্ষিণ পূর্বদিকে, নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার কাছে। আর হুমায়ূনের ভাড়া করা বাসা জামাইকা, কুইন্সে। অনেকটাই পথ। প্রথমদিকে বিশ্বজিতের স্ত্রী রুমা সাহাই প্রধানত নিয়ে যেত হুমায়ূন-শাওনকে হাসপাতালে। পরের দিকে জ্যোতি (জ্যোতি প্রকাশ দত্ত) নিউইয়র্কে থাকাকালীন অবস্থায় (মার্চ থেকে জুন) প্রায়ই নিয়ে যেত হুমায়ূনকে। জ্যোতির সঙ্গ খুব উপভোগ করত হুমায়ূন। অপেক্ষা করে বসে থাকতো কখন সে আসবে। রুমা ও জ্যোতি ছাড়াও কখনো কখনো হুমায়ূনকে হাসপাতালে নিয়ে গেছেন হুমায়ূনের বাল্যবন্ধু ফান্সু ম-ল, নুরুদ্দীন সাহেব ও রুবেল। আটটি কেমো শেষ হওয়ার পর দ্বিতীয় দফায় পুরো স্ক্রিনিং হলো। আমরা ফলাফল নিয়ে সেস্নান কেটারিংয়ে ডক্টর ভিচের কাছে গেলাম। শাওন, মাজহার, জ্যোতি ও আমি ছিলাম সেখানে। মনে মনে আশা ছিল। কেননা, আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়েছে হুমায়ূনের অবস্থা বেশ কিছুটা ভালো হয়েছে, ওর ওজন বেড়েছে, আগের তুলনায় খাবারও খাচ্ছে নিয়মিত। এতদিনে লিভারের টিউমারগুলো হয়তো যথেষ্ট সংকোচিত হয়েছে। হয়তো সে এখন অস্ত্রোপচারের জন্যে উপযুক্ত হবে। কিন্তু তারপরেও মনে সন্দেহ ছিল বলে আমরা রোগীকে সঙ্গে নিয়ে যাইনি। হুমায়ূন অত্যন্ত আবেগপ্রবণ মানুষ। এসব ব্যাপারে একেবারে ছেলে মানুষের মতো। ভয় ছিল, কোন কিছু নেতিবাচক শুনলেই না বলে বসে, `তাহলে আমি চললাম দেশে।` ডাক্তার ভিচ দেখেশুনে বললেন, (পরে তাদের সার্জারি বিভাগের সঙ্গেও কথা বলে একই মন্তব্য করেছিলেন) হুমায়ূনের অনেক উন্নতি হলেও লিভারের টিউমার এখনো সেই পর্যায়ে আসেনি, যখন Local Emboli“ation করা যাবে। সেস্নান কেটারিংয়ে প্রচলিতই যুগান্তকারী টেকনিকের কথা বলেছিলেন ডাক্তার রিভলিন (আমার প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান) ও ডাক্তার ভিচ। যাদের টিউমার প্রাইমারি জায়গাথেকে শুরু করে এখন ছড়িয়ে গেছে অন্যত্র, যেমন, লিভারে (liver metastatis)। এ পদ্ধতি তখন ব্যবহার করা হয়। ইদানিং আরও কিছু প্রতিষ্ঠানে এ পদ্ধতি ব্যবহৃত হচ্ছে। এ পদ্ধতি অনুযায়ী লিভারের যেখানে যেখানে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়েছে, সেখানে সেখানে গিয়ে ওই বিশেষ বিশেষ স্থানগুলোকে স্থানীয়ভাবে এক ধরনের বিশেষ টেকনিকে পুড়িয়ে ফেলা হয় যাতে ওদের নির্মূল করতে দীর্ঘদিন ধরে উচ্চমাত্রায় কেমো দিতে না হয়। ফলে পুরো লিভার বা সমস্ত শরীরের জীবকোষগুলো মাত্রাতিরক্ত কেমোর প্রভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ার আর সম্ভাবনা থাকে না।
এরপর বেলভিউতে আরও ৪টা কিমো দেয়া হলো। ১২টা কিমোর ধাক্কা সামলানো কম কঠিন কাজ নয়। হুমায়ূন মনের জোরে একরকম সহজভাবেই তা পার করে দিল। এদিকে শত কর্মব্যস্ততার মধ্যেও শাওনের মা এবং কখনো কখনো ওর ছোটবোন এসে ওকে সাহায্য করে, মনে জোর দেয়। দুটো অতি শিশু সন্তান নিয়ে নিউইয়র্কের মতো বৃহৎ শহরে তা না হলে ওদের খুব অসুবিধে হতো। ১২টা কিমো দেয়ার পর নতুন করে আবার স্ক্রিনিং হওয়ার পর বেলভিউ-নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল কলেজের সার্জন ডাক্তার মিলারের সঙ্গে হুমায়ূন ও তার পরিবারের দীর্ঘ মিটিং হয়। আমি তখন ডেনভারে। প্রতিদিনই টেলিফোনে খবর পাই হুমায়ূনের শারীরিক অবস্থার। সার্জারির ব্যাপারে অঙ্কোলজি বিভাগ থেকেই উদ্যোগ নেয়া হয়। ৩০ এপ্রিলে প্রাথমিক কথা হওয়ার পরে আবার দ্বিতীয় দফায় বসে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে ১২ জুন ভোরে হুমায়ূনের সার্জারি হবে কোলন ও লিভারে দুই জায়গাতে একই দিনে। কোলনে হবে প্রথাগত সার্জারি। অর্থাৎ বৃহদান্ত্রের যে অংশে ক্যান্সার রয়েছে সেই অংশটুকু কেটে ফেলে দিয়ে আবার সুস্থ বৃহদান্ত্রের দুই মাথা যোগ করে সেলাই করে দেয়া হবে। আর লিভারে প্রথম local emboli“ation technique ব্যবহার করার চেষ্টা করা হবে। যদি সেটা সম্ভবপর না হয় অথবা কোন জটিলতা দেখা দেয়, তাহলে লিভার থেকে প্রথাগতভাবে মানে পুরনো স্টাইলে টিউমার কেটে ফেলে দেয়া হবে। দুটোর জন্যই সম্মতিপত্র রেখে দিলেন তারা। সংবাদটি শুনে আমরা সকলেই খুশি। সার্জারি-ই একমাত্র আশা যদি হুমায়ূনকে নিরাময় করে তোলা যায়। কেননা দিন যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিমোথেরাপি আর আগের মতো কাজ করছিল না। সত্যি বলতে গেলে আটিটি ও বারোটি কিমোর ভেতর লিভারে খুব যে দৃশ্যনীয় উন্নতি ঘটেছে তা নয়। ১২ জুন হুমায়ূনের সার্জারি হবে, বেলভিউ থেকেই সুসংবাদটি দিল আমায় শাওন। আর ওরা হাসপাতালে থাকতে থাকতেই আমি ১১ জুন সন্ধায় ডেনভার থেকে নিউইয়র্কে পেঁৗছার একটি প্লেনের টিকিট কেটে ফেলি। জ্যোতিও অখন নিউইয়র্কেই থাকবে। ওর সার্জারির জন্য আমার এতদূরে আসার খবর শুনে হুমায়ূন খুবই খুশি হয়। সেকথা হাসপাতাল থেকে ঘরে যেতে যেতে ফোন করে জানায় আমাকে।

আমরা সকলে উদগ্রীব হয়ে প্রতীক্ষা করি। ১১ তারিখে রাতে লাগোর্ডিয়া বিমানন্দর থেকে আমাকে তুলে নিয়ে জ্যোতি, ও সঙ্গে আসা মাজহার, হুমায়ূনের জামাইকার বাসায় নিয়ে আসে। হুমায়ূনকে সে রাতে খুব হাসি খুশি ও চিন্তামুক্ত লাগছিল। আসন্ন সার্জারির জন্য দুশ্চিন্তার কোন চিহ্ন নেই। পরদিন সকাল ৬টায় সার্জারি। সাড়ে ৫টায় পেঁৗছুতে হবে। হুমায়ূনের ইচ্ছা জ্যোতির সঙ্গে যাবে হাসপাতালে। যথারীতি ভোর সাড়ে ৪টায় জ্যোতি আমাদের নিয়ে রওনা হয়ে সাড়ে ৫টার আগেই আমরা বেলভিউতে পেঁৗছি। আমাদের গাড়িতে হুমায়ূন, শাওন, জ্যোতি ও আমি। মাজহারের বন্ধু রুবেলের গাড়িতে রুবেল, মাজহার, ও ফান্সু। সাড়ে ৫টায় সার্জারি বিভাগে এসে কাগজপত্র জমা দেয় হুমায়ূন। ৬টার আগেই আমাদের ওয়েটিং রুমে রেখে হুমায়ূনকে নিয়ে গেল নার্স। বলল অপারেশন থিয়েটারে যাওয়ার আগে আবার দেখা পাব তার। ওয়েটিং রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে আমরা অপেক্ষা করি। ভোর ৬টার দিকে কয়েকজন রোগীকে স্ট্রেচারে করে নার্স নিয়ে গেল সার্জারিতে আমাদের সামনে দিয়ে। কিন্তু হুমায়ূন কোথায়? একটু পরে দেখি গাউন পরা হুমায়ূন আমাদের সামনে দিয়ে, স্ট্রেচারে করে নয়, পায়ে হেঁটে দিব্যি নার্সের সঙ্গে হাসিমুখে চলে গেল অপারেশন থিয়াটারের দিকে।

প্রতীক্ষার মুহূর্তগুলো বড় দীর্ঘ। মনে হয়, অনন্তকাল ধরে চলে। ওয়েটিং রুমে বসে আছি আমরা শাওন, আমি, জ্যোতি, মাজহার, বিশ্বজিৎ, বগুড়ায় হুমায়ূনের স্কুলের সহপাঠী বন্ধু ফানসু আর মাজহারের পুরনো বন্ধু রুবেল। অপেক্ষা করছে আরও কিছু অপরিচিত মানুষ, আমাদেরই মতো তাদের প্রিয়জনদের জন্য। আমাদের সকলের দৃষ্টি টিভি মনিটরের দিকে। হুমায়ূনের জন্য আমাদের একটা নম্বর দেয়া হয়েছে, আমরা বসে বসে দেখছি মনিটরে কোথায় কী পর্যায়ে আছে সে। প্রতিটি পর্যায়ের জন্য একটি ভিন্ন রঙ। হুমায়ূনের সার্জারির রঙ আর পাল্টায় না। সার্জারি চলছে তো চলছেই। সাড়ে ৬ ঘণ্টা পরে দেখা গেল তার সার্জারি শেষ। রিকোভারি রুমে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাকে। অবশেষে রঙ পাল্টালো হুমায়ূনের নম্বরে। আমরা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে বা করমর্দন করে নিজেদের আনন্দ ও তৃপ্তি প্রকাশ করি। আমি বিশ্বজিতের কাছে গিয়ে তাকে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা জানাই। তার ব্যবস্থাব জন্যই এটি সম্ভব হয়েছে। আরও কিছুক্ষণ পরে রিকোভারি রুমে জ্ঞান ফিরল হুমায়ূনের। ততক্ষণে হুমায়ূনের সার্জিকেল টিম এসে আমাদের বলে গেল অপারেশন সফল হয়েছে। Local emboli“ationলেগেছে। লিভার কাটার দরকার হয়নি। কোলনের সার্জারিও ভালোভাবে হয়েছে। সার্জন বললেন, `যতদূর আমরা দেখতে পাচ্ছি, তার শরীরে এখন আর কোন ক্যান্সার নেই`। যদি কোন টিউমার ইতোমধ্যেই অন্য কোথাও তৈরি হতে শুরু করে থাকে যা এখনো চোখে দেখা যাচ্ছে না, অথবা আবার পরে যদি নতুন করে কোন টিউমার হয়, সেটার কথা অবশ্য বলা যাবে না এই মুহূর্তে। সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না যেহেতু স্টেজ ফোরে হুমায়ূনের ক্যান্সারের অবস্থান। আমরা ডাক্তারদের ধন্যবাদ জানাই। ডাক্তার মিলার আসেননি ওয়েটিং রুমে অন্য সার্জনদের সঙ্গে। জিজ্ঞেস করলে তারা জানান হুমায়ূনের সার্জারিকালে ডাক্তার মিলার সর্বক্ষণ উপস্থিত ছিলেন অপারেশন রুমে। মঙ্গলবার সারাদিন ধরে সার্জারি চলে এই হাসপাতালে। পরবর্তী সার্জারি নিয়ে নিশ্চয় ব্যস্ত আছেন মিলার।
আমরা তখন একে একে গিয়ে রিকোভারি রুমে হুমায়ূনকে দেখে এলাম। যদিও সবার আগেই গেছে শাওন, তবু আমরা যারা তাকে দেখতে যাচ্ছি, সবাইকেই শুধু তার `কুসুম`- এর কথা জিজ্ঞেস করছে হুমায়ূন। কুসুমকে কাছে, চোখের সামনে সবসময়ের জন্য চায় হুমায়ূন। সাত ঘণ্টা একনাগাড়ে ওই রুমটাতে বসে আছি আমরা। কোথাও যাইনি কেউ এক মুহূর্তের জন্যও। এখন সবারই খিদে লেগেছে। খেতে হবে। হুমায়ূনের কেবল পিপাসা পাচ্ছে তখন। পানি এখন দেয়া যাবে না, মুখে বরফের দু-একটা ছোট টুকরো দেয়া হলো। এ সময় তাকে দেখতে ঘরে ঢুকলেন নিউইয়র্কের প্রখ্যাত সাংবাদিক সৈয়দ মুহাম্মদ উল্লাহ?। এলো বেলভিউ হাসপাতালে কর্মরত সেই বাঙালি ছেলে রণি। আমার কানে তখন শুধু ঝংকার তুলছে `ক্যান্সার ফ্রি` শব্দ দুটি। হুমায়ূন ক্যান্সার ফ্রি। আঃ! কী মিষ্টি ওই শব্দ দুটি।
৫ দিন সার্জিকেল বিভাগের ICU তে থাকার পর ১৭ তারিখে রাতে সাধারণ ওয়ার্ডে স্থানান্তরিত করা হলো হুমায়ূনকে। সাধারণত প্রাইভেট রুমই দেয়া হয় তাকে, কিন্তু সেদিন কোন প্রাইভেট রুম খালি না থাকায় তাকে semi-private রুমে থাকতে হলো। তার মানে আরেকজন রোগী ছিলেন সেই ঘরে। সেদিন সকাল থেকেই হুমায়ূনকে ওঈট থেকে স্থানান্তরিত করার প্রক্রিয়া চলছে, টের পেয়েছিলাম আমরা। ডাক্তার রিলিজপত্র লিখে দিয়েছেন অতি ভোরেই। কিন্তু ওয়ার্ডে রুম খালি না পাওয়ায় এই অবেলায় মানে রাত্রিতে তাকে নেয়া হলো সেখানে।

১৯ তারিখে খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল মাজহারের ফোনে, বলল হুমায়ূনকে রিলিজ করে দিয়েছে হাসপাতাল থেকে। সে ঘরে আসার জন্য অস্থির আগ্রহে অপেক্ষ করছে তার হাসপাতালের রুমে। আমরা তখন আমদের বাড়িতে রকল্যান্ড কাউনটিতে, শহর থেকে প্রায় ৫০ মাইল উত্তরে। আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আসার চেষ্টা করছি এটা বলেই প্রায় সঙ্গে সঙ্গে রওনা হই। কিন্তু হাসপাতালে পেঁৗছার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের চোখের সামনে দিয়ে ফান্সু ম-লের গাড়িতে করে হুমায়ূন ও শাওন বাড়ি চলে যায়। বুঝলাম, হুমায়ূন আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করতে পারছিল না। নিষাদ আর নিনিদকে দেখে না আজ এক সপ্তাহ। ওকে দোষ দিই কী করে? হাসপাতালে তখনো মাজহার ও বিশ্বজিৎ। বিশ্বিজতের বেশ খানিকটা সময় লাগল হুমায়ূনের বিভিন্ন রকম প্রয়োজনীয় ওষুধগুলো হাসপাতালের একাধিক ফার্মেসি থেকে তুলতে। অপেক্ষা শেষে ওকে আর মাজহারকে নিয়ে আমরা কুইন্সে যেতে থাকি। হুমায়ূনের ঘর থেকে আগেই সব জিনিসপত্র বের করে পরিষ্কার করে ফেলা হয়েছিল। এই বাড়িটি যেহেতু দোতলা, হুমায়ূনকে কেউ ঝামেলা বা বিরক্ত করতে পারবে না। কেননা বাইরের ঘরটি নিচতলায়। যারা আসবে সেখানেই বসবে। আমরা নিজেরাও হুমায়ূনের ঘরের বাইরে দূর থেকে তাকে দেখে এলাম একবার। ঘরের ভেতরে যাইনি।
হুমায়ূনের খোঁজ নেই প্রতিদিন। শুনি পেটে ব্যথা ও অস্বস্তি। সেটা প্রত্যাশিত, ডাক্তারও বলেছিলেন। আর সেতো হবেই! একই সঙ্গে পেটের দুই জায়গায় এত বড় সার্জারি হয়েছে। ২১ তারিখ দুপুরে মাজহার আমাদের রকল্যান্ডের বাড়িতে ফোন করে জানায় হুমায়ূনের কিছুটা অস্বস্তি হচ্ছে। পেটে ব্যথাতো আছেই এবং সামান্য জ্বর ৯৯.৭ ডিগ্রি। আমি তাকে বললাম হুমায়ূনের ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে। আমার সঙ্গে কথা বলার পর ওরা হাসপাতালে ফোন করে। কিন্তু ডাক্তার মিলার ছিলেন না। তবে তার সহকারীর সঙ্গে কথা হয়। সহকারী সার্জন জ্যোতি পরামর্শ দেন জ্বর ১০১ ডিগ্রি হলে টাইলেনল দিতে। আর ব্যথা খুব বেড়ে গেলে হাসপাতালে নিয়ে আসতে। এরপর খুব ভোরে মাজহারের ফোনে ঘুম ভেঙে গেল। বলল হুমায়ূনের পেটের ব্যথা বেড়ে গেছে, অস্বস্তি হচ্ছে খুব।। আমরা এই মুহূর্তে সঙ্গে সঙ্গে বেরুলেও আরও দুটি ঘণ্টা লাগবে পাক্কা এই বাড়ি থেকে রওনা হয়ে হুমায়ূনের বাড়ি যেতে। ফলে আমাদের জন্য অপেক্ষা না করে ওদের হাসপাতালে চলে যেতে বললাম। মাজহার ইতোমধ্যেই ফান্সুকে ডেকেছে। আমরা নিজেরাও রওনা হই শহরের দিকে। যেতে যেতেই খবর পেলাম, ফান্সুর গাড়িতে এক ব্লক না যেতেই হুমায়ূনের এত বেশি খারাপ লাগা শুরু হয় যে সে আর বসে থাকতে পারছিল না। ফলে তারা ৯১১ কল করলে সঙ্গে সঙ্গেই অ্যাম্বুলেন্স আসে। অ্যাম্বুলেন্সকে তারা বেলভিউতে নিয়ে যেতে বললেও অ্যাম্বুলেন্স তাদের নিকটবর্তী জামাইকা হাসপাতালের ইমারজেন্সিতে নিয়ে এসেছে। রাস্তায় খবর পেয়ে আমরাও দিক পরিবর্তন করে দ্রুত গাড়ি চালিয়ে তাদের কাছেই ছুটে চলি। মাজহার জানতো না, হয়তো ফান্সু-ও নয়, যে আমেরিকায় ৯১১ কল করে অ্যাম্বুলেন্স ডাকলে ওরা সব সময়েই সবচেয়ে কাছের হাসপাতালের ইমারজেন্সিতে নিয়ে আসে রোগীকে। রোগীর পছন্দমতো বা চাহিদামতো হাসপাতালে নয়। জামাইকা হাসপাতাল কুইন্সে অনেক কাছে হুমায়ূনের বাসা থেকে। আমরা যখন জামাইকা হাসপাতালে পেঁৗছি, দেখি ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে হুমায়ূন শুয়ে আছে। তার হার্টবিট ১৩০-১৩৫। জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে সে। ওদিকে মাজহার ও বিশ্বজিৎ বেলভিউর সঙ্গে যোগাযোগ করে হুমায়ূনকে সেখানে নেয়ার ও ভর্তির ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছে। এ ব্যাপারে বেলভিউর স্বাস্থ্যকর্মী বাংলাদেশের সেই তরুণ রণি এবং ভারতীয় নারী সার্জন জ্যোতি খুব সাহায্য করেন। কিন্তু এক অদ্ভুত ব্যুরোক্রেটিক জটিলতায় পড়ে গেল। যদিও বেলভিউ হুমায়ূনের জন্য ICU তে রুম রেডি করে ভর্তির সব ব্যবস্থা করে রেখেছে, তারা অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করতে পারবে না। কোন খালি অ্যাম্বুলেন্স নেই। এদিকে জামাইকা হাসপাতাল বলে তারা রোগী আনতে অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহার করে, রোগীকে চলে যাওয়ার জন্য নয়। অবশ্য সময় নষ্ট হয়নি। কেননা অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করতে করতে হুমায়ূনের পেটের CT scan করা ও তার রিপোর্টগুলো পাওয়া গেল, যেগুলো বেলিভিউতে গেলেও সর্বপ্রথমেই করতে হতো। জামাইকা হাসপাতালের attending সার্জন বললেন, যদিও স্ক্যানে সুনির্দিষ্ট কোন `লিক` দেখা যাছে না অন্ত্রে, কিন্তু পেটে abdominal cavity  তে) যথেষ্ট গ্যাস ও তরল পদার্থ জমা হয়েছে। তার মানে লিক আছে কোথাও। এর মাত্র কিছক্ষণ আগেই আমি জানতে পেরেছি গতকাল হুমায়ূন তার শোবার ঘরের একটি প্লাস্টিক চেয়ারে বসে ছিল। হঠাৎ ওই প্লাস্টিকের চেয়ারটির পাগুলো বেঁকে গিয়ে মেঝের দিকে বসে যেতে থাকে। চেয়ারে উপবিষ্ট হুমায়ূন ধীরে ধীরে মেঝেতে বসে পড়তে শুরু করে। সামনেই ছিল শাওন। চেয়ার মাটি ছোবার আগেই সে তাকে দুই হাত দিয়ে ধরে তুলে খাটে নিয়ে বসায়। সেই সার্জন ডাক্তার ঘটনাটির আদ্যোপান্ত শুনে বললেন, তার এখনকার এই অবস্থার সঙ্গে ওই ঘটনার কোন যোগ আছ বলে তিনি মনে করেন না। ডাক্তার আমাদের বোঝান, পেটে abdominal cavity তে) গ্যাস ও তরল পদার্থ থাকায় তার পেট ফুলে উঠেছে। যথেষ্ট অক্সিজেনের জন্য এমন ঘন ঘন নিশ্বাস নিচ্ছে সে। দ্রুত হার্টরেট ও রেস্পিরেটরি রেট বোঝাচ্ছে, যে আরও অক্সিজেনের প্রয়োজন তার, আর সেটাই মেটাবার চেষ্টা করছে হৃদপি-। হুমায়ূনের নাক দিয়ে অক্সিজেন দেয়া হচ্ছিল তখন। সে পূর্ণ সচেতন। জাগ্রত। তবে চোখে মুখে শারীরিক অস্বস্তির চিহ্ন। আমি ততক্ষণ contrast CT scan জন্য একটু একটু করে একটা গ্লাস থেকে একরকম তরল পদার্থ খাওয়াচ্ছি হুমায়ূনকে। সে ওটা একেবারেই খেতে চাচ্ছে না। অথচ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এটা শেষ করতেই হবে।
অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে যখন একটা জটিলতা চলছে, তখন নিজেরাই একটা প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে হুমায়ূনকে নিয়ে আসা হয় বেলভিউতে। হুমায়ূনের ভর্তির সব ব্যবস্থা ও রুম তৈরি-ই ছিল সেখানে। তাই কোন দেরি হয়নি কোথাও। বেলভিউতে আসার পরপরই ডাক্তাররা আসতে শুরু করলেন, অনেক ছোটাছুটি চলে নার্স ডাক্তারদের মধ্যে। বেশ কয়েক শিশি রক্ত নেয়া হয় হুমায়ূনের কাছ থেকে ল্যাবে পাঠাবে বলে। অন্যান্য ভাইটাল সাইন পরীক্ষা করা হলো। অন্য হাসপাতালে বসানো সব টিউব, নল, ক্যাথেটার খুলে ফেলে দিয়ে নতুন সব লাগানো হলো। একদল ডাক্তার CT scan রিপোর্ট পড়তে একসঙ্গে একটি ঘরে প্রবেশ করলেন। সার্জারি বিভাগ থেকে ডাক্তার শাহ্? বলে এক অল্প বয়সী ভারতীয় চেহারার ডাক্তার হুমায়ূনের মেডিকেল ইতিহাস নিতে শুরু করলেন। ডাক্তার শাহ্?কে আমি গতকালের প্লাস্টিক চেয়ার কলাপ্স করে হুমায়ূনের মেঝের দিকে কিছুটা ঝুলে পড়ার কথা বললাম। ডাক্তার শাহ আমার কথায় তেমন গুরুত্ব দিলেন না। বললেন, `ওটা তেমন কিছু নয়। ওর জন্য কিছু হয়েছে মনে হয় না। আমি নিজে CT scan  দেখে এসেছি। `আমরা হাসপাতাল রুমে প্রায় রাত ১০টা পর্যন্ত থেকে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হলাম। আমরা তখন সবে জর্জ ওয়াশিংটন ব্রিজ পার হয়ে নিউ জার্সিতে ঢুকেছি। মাজহার ফোন করল। হুমায়ূনকে এক ঘণ্টার মধ্যে emergency surgery  করবে বলে নিয়ে যাবে। সেখানে পেট থেকে গ্যাস ও পানি বের করবে। তা না হলে তার জীবন সংশয় হতে পারে। এছাড়া অন্ত্রের সেই লিকটাও মেরামত করতে হবে জরুরি ভিত্তিতে যেখান থেকে গ্যাস ও তরল পদার্থ বেরুতে শুরু করেছে । আমরা আবার হাসপাতালে ফিরে যাব কিনা জিজ্ঞেস করলে মাজহার বলে, এতদূর থেকে এসে তো কিছু লাভ হবে না, তার আগেই ওকে অপারেশনে নিয়ে যাবে। সে রাতে প্রায় সাড়ে ৪টা পর্যন্ত মাজহারের সঙ্গে কথা হয়। ভালোমতো সার্জারি হয়েছে মাজহারের ফোনে সেটা শোনার পরেই আমরা শুতে যাই। পরের দিন সকালে আবার হাসপাতালের দিকে যাত্রা করি আমরা। আমরা গিয়ে দেখি, বেলা তখন ১১টাও বাজেনি, হুমায়ূন পরিপূর্ণ জাগ্রত। সে শুয়ে আছে ওঈট -এর সার্জারি ইউনিটে অন্য একটি রুমে। গতকাল রাতের সার্জারির চার্জে ছিলেন ডাক্তার মুর। ভালোভাবেই হয়েছে সার্জারি। আমি ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে প্রথম কথা হুমায়ূন যেটা জিজ্ঞেস করে আমায় `আমার কি কোলেস্টমি করেছে?`
বিছানার এক ধারে শোয়ানো কিছুটা বাদামি তরল পদার্থ দিয়ে ভরা ব্যাগটার দিকে তাকিয়ে আমি বলি `হ্যাঁ।` আমি জানি `গু-এর ব্যাগ` বাইরে থেকে বয়ে বেড়াতে তার কী ভীষণ অস্বস্তি_ কী ভয়ানক আপত্তি। তাই প্রথম সার্জারির সময় কোলেস্টমি হবে না শুনে সে কি আনন্দ হুমায়ূনের! আমরা গতকাল রাতেই খবর পেয়েছি এবার শুধু কোলেস্টমি নয়, পেট থেকে তরল পদার্থ বের করে নিয়ে আসার জন্য একটা টিউবও লাগানে হবে ভেতর থেকে বাইরে পর্যন্ত।
আমি বীজনুনাশক ক্রিম দুহাতে ভালো করে মেখে হুমায়ূনের হাতের ও পায়ের আঙ্গুল একটি একটি করে টিপে দিতে শুরু করি। কিমোথেরাপির জন্য নিউরোপ্যাথি হওয়ার জন্য হাত-পা খুব ব্যথা করে ওর, টিপে দিলে আরাম পায়। ক`দিন আগেও আমাকে সংকোচ করত, টিপে দিতে দিত না। কেবল শাওন, বিশ্বজিৎ ও মাজহার করত এটা। কয়েকদিন আগে একদিন আচ্ছা করে বকা দিলাম হুমায়ূনকে, শাওনের সামনেই।
`এত সেকেলে কেন হুমায়ূন? আমি আপনার হাত বা পা টিপে দিলে ক্ষতি কী হবে? তাছাড়া, আমি তো অফিসিয়ালিই আপনার বোন এখন। তাই না?`
আর আপত্তি করেনি হুমায়ূন। হেসে নিজের ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছিল।
জীবনের শেষ বিকেলে হঠাৎ `কুড়িয়ে পাওয়া ধন`, আমার ভাইটির একটি একটি করে আঙ্গুল টিপে দিতে থাকি আমি। এই বাক্যটা লিখতে গিয়ে ওর সেই হাতের উষ্ণতা এখনো যেন টের পাচ্ছি। চোখের সামনে ভাসে, একটা আঙ্গুল শেষ হতে না হতেই আরেকটা বাড়িয়ে দিচ্ছে। হাত শেষ হয়ে গেলে খাটের ওপর একটু নাড়াচাড়া করে এগিয়ে দেয় পা।
সেদিন হুমায়ূনকে ক্লান্ত দেখালেও কেমন প্রশান্ত লাগছিল। দুপুরে তাকে semi-solid খাবার দিয়েছিল। কিন্তু কিছুই মুখে দিতে চায় না। আমি জোর করে চামচ দিয়ে একটু কমলা-জেলো খাওয়াতে চেষ্টা করলাম। তিন চার চামচ খাবার পরেই আর খেতে চায় না।
জিজ্ঞেস করি, কেমন লাগল?
অতি স্বভাবিকভাবে হুমায়ূন বলল, `গুয়ের মতো।`
আমি হেসে বলি, `আপনি কি কখনো গু খেয়ে দেখেছেন কেমন খেতে?`
হুমায়ূন হাসে।
আমি ওর আঙ্গুল টিপে দিই।

গত ২১ বছর ধরে নিউইয়র্কের মুক্তধারার বইমেলার সঙ্গে আমরা সম্পৃক্ত। অথচ এবার মেলা নিউইয়র্কে হওয়া সত্ত্বেও তিন দিনের ভেতর মাত্র একদিন মানে প্রথম দিন রাতে ঘণ্টা দুয়েকের জন্য আমি গিয়েছিলাম সেখানে। তাও আমার শিক্ষক, বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক, এবারের বইমেলার প্রধান অতিথি শামসুজ্জামান খানের ফোন পেয়ে। জ্যোতিকে একা দেখে তিনি আমার কথা জানতে চেয়েছিলেন এবং ফোন করেছিলেন। স্যারের কথায় শুক্রবার রাতে, মানে ২৯ জুন, বইমেলায় গিয়েছিলাম কিছুক্ষণের জন্য। প্রোগ্রাম অনুযায়ী এবার মেলার দ্বিতীয় দিনে হুমায়ূনকে সম্মাননা দেয়ার কথা ছিল। বইমেলার পক্ষ থেকে হুমায়ূনকে অনেক আগেই জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, `কার হাত থেকে সম্মাননা গ্রহণ করতে চান আপনি?` উত্তরে হুমায়ূন নাকি বলেছিল, `পূরবীর হাত থেকে।` সেই অনুযায়ী-ই প্রোগ্রাম ছাপা হয়েছিল। কিন্তু সেই ৩০ জুন, বইমেলার দ্বিতীয় দিনে, মেলায় নয়, প্রায় সবটা সময়েই আমি ছিলাম হুমায়ূনের পাশে বেলভিউতে। সার্জারি বিভাগের ওঈট তে। কিন্তু Show Must Go On. অতএব, বইমেলার মঞ্চে সেই নির্দিষ্ট সম্মাননা পর্বে হুমায়ূন ও আমার অনুপস্থিতিতে জ্যোতি মঞ্চে গিয়ে বলেছিল হুমায়ূনকে সম্মাননা দেয়ার জন্য পূরবীর হাতে সম্মাননা সনদখানি সে পেঁৗছে দেবে।
১ জুলাই রোববার। কেউ জাগার আগে খুব ভোরে আমি ও শাওন হাসপাতালে চলে আসি। বাংলাদেশ মিশন থেকে গত কয়দিন ধরে হাসপাতালে আসা যাওয়ার জন্য চাইলে গাড়িতে রাইড পাওয়া যাচ্ছিল (অবশ্য যদি সেই মুহূর্তে খালি গাড়ি থাকে মিশনে, তবেই)। বাংলাদেশ সরকারের অনারারি সিনিয়র পরামর্শক হিসেবে হুমায়ূন নিয়োগ পাওয়ার পরে এইটিই হয়তো প্রথম কোন সুবিধা নেয়া। সেই সাতসকালে মিশনের গাড়িতেই হুমায়ূনের বাসা থেকে হাসপাতালে আসি আমরা। এত সকালে আসি যাতে ডাক্তাররা রাউন্ডে বেরুনোর আগেই আমরা সেখানে পেঁৗছুতে পারি। ওঈট-এর লম্বা করিডোরের অন্য প্রান্ত থেকে হঠাৎ দেখি, শাওন আমি দুজনেই দেখি, হুমায়ূনের ঘরের সামনে কে একজন দাঁড়িয়ে কাচের দেয়াল দিয়ে ভেতরে উঁকিঝুঁকি মারছে। হাসপাতালের কোন কর্মী এটা করবে না। আমরা দ্রুত কাছে ছুটে যাই। গিয়ে দেখি, সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন জাতিসংঘে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আবদুল মোমেন। এত ভোরে এভাবে এসে হুমায়ূনকে দেখছেন রাষ্ট্রদূত, এতে একটু বিস্মিত হয়েছি বৈকি? হঠাৎ মনে পড়ে, গতকাল বিকেলে শহরে একটা গুজব উঠেছিল, হুমায়ূন আহমেদ মারা গেছেন। বইমেলায় উত্তেজনা, ও হৈচৈ শুরু হওয়ার আগেই আসল সত্যটা জেনে গেছে সবাই। কেননা, আমরা শাওনসহ আমরা কয়েকজন ততক্ষণ হাসপাতালে ছিলাম।

২ জুলাই। সোমবার। রাউন্ডে আসা ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলার জন্য ভোর হতে না হতেই আবারও হাসপাতালে চলে এসেছি আমি ও শাওন। সকাল সাড়ে ৬টা তখন। আরও কিছুক্ষণ পরে Critical Care Unit এর প্রধানের সঙ্গে নতুন শিক্ষা বছরের ৯-১০ জন তরুণ ইন্টার্ন রেসিডেন্ট এসে উপস্থিত। তারা ঘুরে ঘুরে প্রতিটি রুমে গিয়ে রোগী দেখে তাদের অবস্থা নিয়ে রুমের বাইরে এসে হলওয়েতে দাঁড়িয়ে আলোচনা করেন। আগের দিন হুমায়ূনকে বলা হয়েছিল আজ সকালে তার মুখ থেকে পাইপটা খুলে দেবে, ওই পাইপের জন্য সে কথা বলতে পারে না। প্রচন্ড অস্বস্তি। আজ ভোরেও যখন আমরা ওকে দেখতে গিয়েছিলাম, শাওনকে কাগজে লিখে জিজ্ঞেস করেছে হুমায়ূন কবে খুলবে তার মুখের নল। শাওন বলেছে কিছুক্ষণ পর, হুমায়ূন আবার লিখে জানতে চায় `কয় ঘণ্টা পর?` কিন্তু সে বা আমরা কেউ তখনো জানি না যে গতকাল আবার বমি করেছিল হুমায়ূন এবং কিছুটা বমি আগের বারের মতো ফুসফুসে ঢুকে গেলে ফুসফুসের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ হয়ে পড়েছে। হুমায়ূন এখন ১০০% সাপোর্ট নিচ্ছে ভেন্টিলেটরের। ডাক্তারের দল অবশেষে হুমায়ূনের রুমে ঢোকেন। ইউনিট প্রধান হুমায়ূনের কাছে এসে বলেন, `আমি জানি তুমি খুব অপেক্ষা করে আছ তোমার মুখের পাইপটা খোলার জন্য। কিন্তু, আজ নয়, কাল নয়, পরশু-ও নয়। তোমাকে আর একটু ধৈর্য ধরতে হবে।` বড় বড় চোখ মেলে শুধু তাকিয়ে থাকে হুমায়ূন। ডাক্তার বলতে থাকেন তার বমির কথা। সেটা যে কতখানি ক্ষতি করেছে তার ফুসফুসের! বাইরে এসে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলাম, বমি ঢুকে গেলে যদি এতই ক্ষতি হয় ফুসফুসের এমন কিছু কেন আপনারা করেন না যাতে বমি ভেতরে শ্বাস নালিতে চলে যেতে না পারে। কারণ এ ধরনের সার্জিক্যাল রোগীদের জন্য বমি করাটাতো খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। তাছাড়া শোয়া অবস্থায় বমি করলে কিছুটা তো ভেতরে চলেই যেতে পারে শ্বাসনালিতে। ডাক্তার আমাকে বোঝাতে চেষ্টা করেন সেই জন্যই মুখের টিউবের পেছনে একটা বেলুনের মতো থাকে যাতে বমি ভেতরে না গিয়ে বাইরে ফিরে আসে। কিন্তু সেটা ১০০% বমিতো সবসময় আটকাতে পারে না! গলাকে আর যা-ই হোক একেবারে সিল তো করে দেয়া যায় না! তাই না? তবে আজ আরেকটা বেলুনের মতো জিনিস বসানো হয়েছে মুখের ধারে বাইরে, যাতে এমন আর না হয়। ডাক্তাররা তখন হুমায়ূনের রুমের বদ্ধ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে হুমায়ূনের অসুস্থতা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করেন। শুনতে পাই ARDS শব্দটা বহুবার উচ্চারিত হতে। Acute Respiratory Distress Syndrome বা ARDS অনেক ইন্টার্ন ও রেসিডেন্ট-ই হুমায়ূনের ARDS হয়েছে বলে সন্দেহ করেন। শাওন ও আমি পরে ইন্টারনেটে ARDS সম্পর্কে পড়ে দেখেছি, যদিও এটা বিশেষ কোন অসুখ নয়, এটি অনেকগুলো মারাত্মক উপসর্গের সমাহার। খুবই জটিল ও সিরিয়াস মেডিকেল সমস্যা। ARDS Syndrome-এর ভয়াবহতার কথা জানতে পেরে আমরা বিমর্ষ হয়ে পড়ি। রাতে আবার একা একা ইন্টারনেট ঘাঁটতে গিয়ে জানতে পাই অন্য আরও কারণের মধ্যে ফুসফুসে বমি চলে যাওয়া সত্যি একটা বড় কারণ অজউঝ-এর। তার ওপর দীর্ঘদিন ধরে প্রচুর পরিমাণে সিগারেট খাওয়ার (নিউইয়র্কে আসার পরে সিগারেট বন্ধ করেছে হুমায়ূন) কারণে ওর ফুসফুসের সাধারণ অবস্থা খুব ভালো ছিল না। তার ওপর ফুসফুসে এখন তো সংক্রমণও রয়েছে। এক্স-রেতে দেখা গেছে ফুসফুসের বাইরের পর্দায় জল জমেছে। তাই সব মিলিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাসে এত কষ্ট। হার্ট রেটও সেই কারণেই বেশি।
এর কয়েক দিন আগে হুমায়ূন যেদিন বমি করে, আমি ও শাওন কাছেই ছিলাম। ছিল নার্স, সে ডেকে এনেছিল আরও কয়েকজনকে। কিন্তু তবু নাকি কিছুটা বমি চলে-ই গিয়েছিল ফুসফুসে। বমি করার ঠিক আগে বিছানায় এক পাশে বসা শাওনকে হাতের আঙ্গুল দিয়ে মুখের কাছে কী দেখাচ্ছিল হুমায়ূন। আমাকে একদিন এরকম দেখানোতে আমি একগাদা চৌকো গজ এর টুকরো মুখের কাছে ধরেছিলাম। হুমায়ূন একটু থুথু ফেলে মুখটা পরিষ্কার করেছিল। আমি শাওনের হাতে অনেকগুলো গজ কাপড় তুলে দিলে ও সেগুলো ওর মুখের কাছে ধরতে না ধরতেই সে গল গল করে বমি করে দেয়। শাওন প্রথমে ভেবেছিল হুমায়ূন কিছু লেখার কথা ভাবছে, তাই কাগজ কলম নিয়ে আসছিল সে। হুমায়ূন যখন বমি করে দেয়, তখনো শাওনের বাঁ হাতে কাগজকলম, ডান হাতে গজ-ক্লথ। সে কাছে গিয়ে হুমায়ূনকে পরিষ্কার করার চেষ্টা করার আগেই ঘরের অন্য প্রান্ত থেকে নার্স ছুটে আসে। শাওনকে সরিয়ে দিয়ে আরও সাহায্যের জন্য ডাক দিয়ে নার্স নিজেই হুমায়ূনের মাথাটি সোজা করে ধরে তার মুখ, নল পরিষ্কার করতে শুরু করে। অন্য এক নার্স ও নার্সেস এইডের সঙ্গে স্বয়ং ডাক্তারও ছুটে আসেন ঘরে। সবাই মিলে হুমায়ূনকে পরিষ্কার করতে শুরু করেন তারা। ওদের এত ছোটাছুটি ও কর্মব্যস্ততা দেখে আমার মনে হয়েছিল সাধারণ বমি করা এটা নয়।
ওয়েটিং রুমে বসে থাকতে থাকতে আমরা পালা করে মাঝে মাঝে হুমায়ূনকে দেখে যাই। সেদিন সকালবেলায় ডাক্তার যেহেতু বলে গেছেন আগামী দুতিন দিনের ভেতর টিউব খোলা হবে না মুখ থেকে, আমরা জানতাম সে খুব বিমর্ষ হয়ে পড়বে। আমি কাচের দেয়ালের বাইরে থেকে তাকে দেখে ফিরে যাব ভেবে তার ঘরের সামনে আসতেই থমকে দাঁড়াই। দেয়ালের ওপারে ঘরের ভেতর খাটে শুয়ে ছিল হুমায়ূন। হঠাৎ আমি দেখি হুমায়ূন তার দুই হাত দিয়ে তার শরীর থেকে তার সকল নল তার-টার সব খুলে ফেলার চেষ্টা করছে। অথচ মাত্র কিছুক্ষণ আগে আমরা যখন এখান থেকে যাই, সে গভীরভাবে ঘুমুচ্ছিল। দুদিন আগে ঠিক একই কাজ করেছিল সে। সব কিছু খুলে-ঠুলে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিল। শাওন সেই গভীর রাতে তারই ঘরে ছিল তখন। চেয়ারে বসে বসে ঘুমানোর চেষ্টা করছিল। হুমায়ূনের সেই আকস্মিক কা- দেখে তাকে থামাতে চেষ্টা করতে করতে সে চিৎকার শুরু করে। ডাক্তার নার্স ছুটে এসে সকলে মিলে হুমায়ূনকে শান্ত করে। তারপর ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। শাওন আর বাকি রাত ঘুমুতে পারেনি।
আজ সকালেই ডাক্তার বলে গেলেন হুমায়ূন ১০০% সাপোর্ট পাচ্ছে ভেন্টিলেটর থেকে। এই অবস্থায় টিউব খুলে ফেললে কী হবে ভাবা যায় না। আমি ডাক্তার-নার্সদের ডাকতে থাকি। নার্সেস স্টেশনে দেখি কেউ নেই, অন্য রোগীর কাছে গেছে হয়তো। হুমায়ূনের ঘরের ভেতরে লাল আলো জ্বলতে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে নার্সেস স্টেশনেও। হুমায়ূনের ঘরের দরজার বাইরে ট্রলিতে রাখা গাউন থেকে একটা নিয়ে কোনমতে গায়ে চাপিয়ে ঘরে ঢুকি। তখনো তাকিয়ে তাকিয়ে দুহাত দিয়ে সব কিছু খোলার চেষ্টা করছে হুমায়ূন। আমি হুমায়ূনের খাটের পাশে দাঁড়িয়ে তাকে অনুনয় করতে থাকি, হুমায়ূন, ভাই আমার, প্লিজ ওগুলো খুলবেন না। হুমায়ূন এটা করে না। থামুন। প্লিজ। এগুলো খুললে খুব খারাপ হবে। থামুন। আর আশ্চর্য। আমার দিকে ফিরে না তাকালেও নব্বই ডিগ্রি কোণ করে শূন্যে উত্থিত তার হাত দুটো হঠাৎ নিশ্চল হয়ে পড়ে। আমি ছুটে বাইরে আসি, আশ্চর্য, নার্সকে তখনো দেখতে পাই না। নার্সেস স্টেশন ফাঁকা। করিডোরের উল্টো পাশের কাচের ঘরের ভেতর বসে সব ডাক্তাররা মিটিং করছেন। আমি সোজা সেই ঘরে ঢুকে পড়ি। তাদের বলি, কী ঘটছিল এক মিনিট আগে ওপাশের রুমে। ডাক্তাররা সকলে তখন মিটিং ফেলে হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসেন ঘর থেকে। তাদের ঘরের দরজা থেকেই তারা এবং আমি সকলেই সবিস্ময়ে দেখতে পাই হুমায়ূন আমার কথা না রেখে আবার তার টিউব-নল সব খুলে ফেলার চেষ্টা করছে। ডাক্তাররা কয়েকজন হুমায়ূনের রুমের দিকে ছুটে গিয়ে তাকে অনেক কষ্ট করে থামালেন। পরে লক্ষ্য করেছি, হুমায়ূনের দুই হাতের নিচে লম্বা কাঠের পাত দিয়ে প্লাস্টারের মতো করে বেঁধে দিয়েছেন তারা যাতে সে হাত দিয়ে নাক বা মুখের টিউব খুলে ফেলতে না পারে। অন্য অনেক রোগীর মতো ওর হাত দুটো খাটের সঙ্গে বেঁধে রাখার কথা তারা চিন্তা করেননি কেননা তাতে হুমায়ূন আরও উত্তেজিত ও ক্রুদ্ধ হয়ে উঠবে, এটা তারা বুঝতে পেরেছিলেন।

আমরা কাল ফিরে যাব ডেনভারে। কাল মানে জুলাইর ৩ তারিখে। এসেছিলাম জুনের ১১ তারিখে। অনেক আশা আর আনন্দ নিয়ে এসেছিলাম এবার। পরের দিনের সার্জারি যদি সফল হয়, কে জানে, হয়তো হুমায়ূন এ যাত্রায় মরণব্যাধিকে জয় করে সুস্থ হয়ে উঠবে। পরে ভবিষ্যতে কী হবে আমরা কেউ তা জানি না। কিন্তু এই মুহূর্তে একমাত্র সার্জারির সফলতাই তাকে ক্যান্সারমুক্ত করতে পারে। কেননা কিমোথেরাপিতে আর নতুন করে কোন সুফল পাওয়া যাচ্ছিল না। অথচ, কাল হুমায়ূনের এমন শারীরিক অবস্থায় ওকে হাসপাতালে রেখে আমরা ফিরে যাচ্ছি। যেটা করতে খুবই অস্বস্তি বোধ করছি, কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু উপায় নেই। আমরা ৩ তারিখে চলে আসব সেই সময়সূচি পেয়েই আটলান্টা থেকে আমাদের বন্ধু খালেদ হায়দার ও তার স্ত্রী শেলী প্লেনের টিকিট কেটেছে আমাদের বাড়িতে ডেনভারে ৪ জুলাই বেড়াতে আসবে বলে।

গতকাল দুপুরে মাজহার একটি জরুরি কথা বলেছে, যেটা আমার খুব মনে ধরেছে। মাজহার বলল, যাওয়ার আগে আমি যদি একবার ডাক্তার মিলারের সঙ্গে দেখা করে যেতাম! একটা বিষয় নিয়ে কিছুক্ষণ আগেই আমরা কথা বলছিলাম। আমাদের মনে হয়েছিল হুমায়ূনের একটার পর একটা জরুরি অবস্থা হওয়ায় ICU টিম (Critical care unit) প্রতিটি জরুরি অবস্থাকে ভিন্ন ভিন্নভাবে মোকাবিলা করার চেষ্টা করছে। যখন যেটা দরকার সেটাই যেন সামাল দিচ্ছে। কিন্তু তাদের long term plan কী বুঝতে পারছি না। ডাক্তারদের জিজ্ঞেস করলে বলেন, এই জরুরি অবস্থাটা আগে Stable হোক তো!। তাই মাজহার বলল, `পূরবীদি, আপনি চলে যাওয়ার আগে একবার ডাক্তার মিলারের সঙ্গে দেখা করে তাকে আমাদের সবার দুশ্চিন্তার কথা, আমাদের আশঙ্কার কথা বলুন। তাছাড়া আবার যে স্যারকে এখানে ভর্তি করানো হয়েছে, সার্জারি করা হয়েছে, এ ব্যাপারেও তার সঙ্গে কথা বলা দরকার যদিও সেই সার্জিক্যাল টিমে তিনি ছিলেন না। আপনি যাবার আগে অবশ্যই ডাক্তার মিলারের সঙ্গে একবার কথা বলে যান।` এটা যে কত বড় সুপরামর্শ ছিল তা বলার নয়। সেই পরিকল্পনা অনুসারে গতকাল রাতে ডিউটিরত ডাক্তারকে বিশেষভাবে আমরা বলে গিয়েছিলাম আজ ডাক্তার মিলারের সঙ্গে আমাদের দেখা করা চাই-ই চাই। ডাক্তার সেটা হুমায়ূনের ফাইলে বড় করে লিখে রাখেন। শাওন আমাকে দেখিয়ে বলে, হুমায়ূনের বোন। পরশু ভোরে ফিরে যাবে ডেনভার। ফলে কাল দেখা করতেই হবে ডাক্তার মিলারের সঙ্গে। কিন্তু আমার যে একবার রক্ল্যান্ডের বাড়িতে যাওয়া একান্তই দরকার ছিল!
পরদিন দুপুরের পরে ডাক্তার মিলার সত্যি সাত্যি এলেন আমাদের সঙ্গে দেখা করতে। ডাক্তার মিলার যে খুব বড় একজন ডাক্তার এবং সকলেই যে তাকে খুব সমীহ করে, তার নজির পেলাম, তিনি যখন হুমায়ূনকে দেখার পরে আমাদের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা পোষণ করেন। আমরা তখন ওয়েটিং রুমে। দেখলাম, চারদিকে কেমন ছোটাছুটি সন্ত্রস্ত ভাব। একে অপরকে বলছে, ডাক্তার মিলার এসেছেন ফ্লোরে। এমন অবস্থায় এক নার্স এসে ওই ফ্লোরের কনফারেন্স রুমের দরজা খুলে দিল আমাদের নিশ্চিন্তে এবং একান্তে বসে ডাক্তার মিলারের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ করে দিতে। আমরা, মানে আমি, শাওন, ফান্সু ও ডাক্তার মিলার কনফারেন্স রুমে ঢুকলাম। প্রথমে পরিচয় পর্বের শুরুতেই শাওন আমাকে হুমায়ূনের বড়বোন বলে পরিচয় করিয়ে দিল। জানালো, আগামীকালই আমি চলে যাচ্ছি। তবে প্রয়োজন হলে আমিই সাধারণত ডাক্তারদের সঙ্গে হুমায়ূনের ব্যাপারে কথা বলি এবং বাকি পরিবারের সদস্যদের জানাই। প্রথমে ডাক্তার বর্ণনা করলেন হুমায়ূনের কী শারীরিক অবস্থা ছিল যখন সে প্রথম আমেরিকায় আসে। এখানে আসার পর কিমোথেরাপি নিয়ে কতখানি উন্নতি হয়েছিল। তারপর যে সার্জারি করা হলো, সেটাও কী রকম সফল হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তার কোলন থেকে পরে `লিক (leak) করতে শুরু করে। ফলে ইমার্জেন্সি সার্জারি করে সেই লিক ঠিক করা হয়েছে। পেটের ক্যাভিটি থেকে সব গ্যাস, পানি বের করে ফেলা হয়েছে। তাকে তিনটি ব্রড স্পেকট্রাম এন্টিবায়োটিক এবং ফ্লাজিল দেয়া হচ্ছে। তার ফুসফুসে সংক্রমণ হয়েছে যা সম্ভবত পেটের সংক্রমণ থেকে এসেছে। তার ওপর বমি ঢুকে যাওয়ার জন্য ফুসফুসে infiltration    হয়েছে। এছাড়া ফুসফুসের বাইরের দেয়ালে জল জমে যাওয়ায় তার ফুসফুসের কর্মক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে মারাত্মকভাবে। এই সব কিছুর ওপরে আছে তার ডায়েবেটিস, হৃৎপিণ্ডের ভাল্বের সমস্যা, করোনারি বাইপাস সার্জারির পরও হৃৎপিণ্ডে রক্ত চলাচলের কিছু অসুবিধে, দীর্ঘদিন কিমোথেরাপি দেয়ার জন্য তার রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা হ্রাস ইত্যাদি। এ ধরনের সব অতিরিক্ত জটিলতা ও risk factor মিলে তার অবস্থা একটু ক্রিটিকেল হয়ে উঠেছে। তবে ডাক্তার মিলার খুবই আশাবাদী। তিনি মনে করেন, এসব কিছু অতিক্রম করে ভালো হয়ে উঠবে হুমায়ূন। তবে সময় লাগবে। শাওনকে দেখিয়ে ডাক্তার বললেন, আমাদের রোগীর বয়স যদি তোমার মতো হতো, যদি অন্য কোন অসুখ না থাকত সঙ্গে, আরও নিশ্চিন্তভাবে আরও জোর দিয়ে আমি বলতে পারতাম। কিন্তু সব কিছু বিবেচনা করেও বলছি সে ভালো হয়ে যাবে, এটাই আমার বিশ্বাস। তখন শাওন হুমায়ূনের তার-টিউব-নল সব কিছু খুলে ফেলার প্রচেষ্টার কথা জানিয়ে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করল একজন নার্স শুধু হুমায়ূনের জন্য ফবফরপধঃব করে দেয়া যায় কিনা। ডাক্তার বললেন, ওঈট তে প্রতি দুজন রোগীর জন্য একজন নার্স। এর বেশি আর সম্ভব নয়। তবে তিনি একজন স্বাস্থ্যকর্মীকে বাকি সময় রোগীর দরজার বাইরে বসিয়ে রাখার চেষ্টা করতে পারেন শুধু রোগীর কাজ কারবার লক্ষ্য করার জন্য। শাওন ডাক্তারকে ধন্যবাদ দিয়ে জানালো তার দুটি ছোট ছোট বাচ্চা আছে বলে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও প্রতি রাতে সে এখানে থাকতে পারে না। ডাক্তার জানতে চাইলেন, তাদের বয়স কত? ফান্সু বললেন, এক ও পাঁচ। শুনেই ডাক্তার মিলার সঙ্গে সঙ্গে মাথা নিচু করলেন, একটু পরে আমরা সবাই দেখি, ডাক্তারের চোখ দিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি পড়ছে তার গাঢ় প্যান্টের ওপর। মুখ তুলে যখন তাকালেন তার সমস্ত মুখমণ্ডল ও চোখ লাল। টিস্যু দিয়ে চোখ-মুখ মুছতে শুরু করেন ডাক্তার মিলার। তিনি তার এই অনিয়ন্ত্রিত আচরণে বেশ অপ্রস্তুত, দেখেই বোঝা যায়। আমি আজ পর্যন্ত কোন ডাক্তারকে কারও সামনে কখনো কাঁদতে দেখিনি। আমার বাবা যে এত আবেগপ্রবণ ডাক্তার ছিলেন, তাকেও নয়। জিজ্ঞেস করলাম, আপনার নিশ্চয়ই বাচ্চা আছে?
ঘাড় নেড়ে শুধু সম্মতি জানান ডাক্তার। প্রায় অস্পষ্ট স্বরে বলেন, `ওকে বাঁচাতেই হবে।`
আমি খুব বিনীতভাবে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করি তখন, প্রথমবারে হুমায়ূনকে কোলেস্টমি কেন করা হলো না?
ডাক্তার মিলার উত্তরে বলেন,`I wish I had a crystal ball. But I did not have one`. তিনি বললেন আজকাল অধিকাংশ কোলন সার্জারির জন্য কোলেস্টমি করা হয় না। ডাক্তার বলেন, `এ ধরনের সার্জারির পরে শতকরা ৫% এরও কম মানুষের লিক বা ওই জাতীয় জটিলতা দেখা দেয়। দুর্ভাগ্যবশত, সেই ৫% এর মধ্যে হুমায়ূন পড়ে গেছেন।`
ডাক্তার মিলার তার একখানা কার্ড বের করে আমায় দিলেন। কার্ডের ওপর কলম বের করে নিজের হাতে তিনি তার মোবাইল নম্বরটা লিখে দিলেন। বললেন দিনে রাত্রে ২৪ ঘণ্টা (২৪/৭) যখন ইচ্ছা আমাকে ফোন করতে পার।` শাওন, ফান্সুর দিকে তাকিয়ে বলেন, `তোমরাও।`
আমি আবারও জিজ্ঞেস করলাম, ICU থেকে বের করার পর এত তাড়াতাড়ি কেন ছেড়ে দেয়া হলো তাকে? আরও দুদিন রাখলে কী ক্ষতি হতো?
ডাক্তার বললেন, এটাই স্টান্ডার্ড প্রোসেডিউর। জটিলতা না থাকলে এক সপ্তাহের বেশি রোগীকে সাধারণত রাখা হয় না।
ডাক্তার মিলারের হস্তক্ষেপের ফলে সেদিন থেকে সব কিছু দ্রুত নড়তে শুরু করল। যে পদ্ধতি প্রয়োগ করে ফুসফুসের পানি বের করে আনা হবে বলছিলেন তারা কয়েকদিন ধরে, তা আজ ডাক্তার মিলারের সহকর্মীরা ৪৫ মিনিটের মধ্যেই করে ফেললেন। প্রায় ৬৫০ মি.লি. পানি বের করলেন তারা শুধু একটি ফুসফুস থেকে, হুমায়ূনের রুমের ভেতরেই, তার খাটে শায়িত অবস্থাতেই। কেবল বন্ধ কাচের ঘরের ভেতর আব্রু রক্ষার্থে বাইরের দিকের মোটা পর্দাটা টেনে দেয়া হয়েছিল প্রায় আধ ঘণ্টার জন্য। যারা কাজটি করলেন, তাদের একজন কালো নারী ডাক্তার, আরেকজন ক্রাচে ভর করা অল্প বয়সী এক সাদা পুরুষ ডাক্তার। শেষোক্ত সার্জন ঠাট্টা করে বলেন, `৬৫০ সিসি মানে এক ক্যান কোকাকোলা বের করে এনেছি।` ওরা মন্তব্য করেন, অনেক আরাম পাবে এখন। নি:শ্বাস সহজ হবে। এছাড়া ফুসফুসের ভেতর থেকে আপনাআপনি পানি বের হয়ে যাওয়ার জন্য একটি ড্রেইন টিউব বসিয়ে দিয়েছেন তারা ভেতর থেকে বাইরে পর্যন্ত।

পরের দিন ভোরে আমরা চলে আসি ডেনভার। সেই দিনই, আমরা চলে আসার কয়েক ঘণ্টা পরই, জাফর ইকবাল ও তার স্ত্রী ইয়াসমিন দেশ থেকে নিউইয়র্কে এলো হুমায়ূনকে দেখতে, তার শুশ্রূষা করতে। খুব অল্পের জন্য ওদের সঙ্গে দেখা হলো না আমাদের। অনেক বছর আগে ওরা যখন নিউজার্সিতে থাকত তখন থেকে আমরা জানি তাদের। সেদিন দেশ থেকে আরও এসেছিল শাওনের কনিষ্ঠা সহোদরা, সেঁজুতি, যাকে গত ডিসেম্বরে দেখেছি, হুমায়ূনদের সঙ্গে ডেনভারে, আমাদের বাড়িতে, যখন সবাই মিলে বেড়াতে এসেছিল ওরা। আমরা রকি মাউন্টেইন ন্যাশনাল পার্কে বেড়াতে গেছিলাম। সবাই মিলে।
এরপর প্রতিদিন (শনি ও রোববারসহ) ভোর ৬টায় উঠে ডাক্তার মিলারের সঙ্গে কথা হতো বা টেক্সট মেসেজ আদানপ্রদান হতো আমার হুমায়ূনের ব্যাপারে। আর হুমায়ুনের যেটুকু সংবাদ পেতাম, আমি তৎক্ষণাৎ তা নিউইয়র্কে তার স্বজনদের ফোন করে অথবা টেক্সট মেসেজে পাঠিয়ে দিতাম। এরপর একের পর এক ঘটনা ঘটতে থাকে। এমনিতে হুমায়ূনের ডায়াবেটিস, হৃৎপিণ্ডের ভাল্বের সমস্যা তো ছিল-ই, ওর বাইপাস সার্জারিও পুরোটা করা সম্ভব হয়নি সিঙ্গাপুরে রক্তনালীর অবস্থা খুব ভালো না থাকায়। দীর্ঘদিন ধরে প্রচুর পরিমাণে সিগারেটি খাওয়ার ফলে ফুসফুসের ধারণ ক্ষমতাও খুব বেশি ভালো ছিল না। তার ওপর স্টেজ ফোর ক্যান্সার ও ক্যান্সারের জন্য ১২টি কিমো নেয়া। রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা অনেকটাই কমে গিয়েছিল তার। ফলে অতি সহজেই সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয় সে। একটার পর একটা জটিলতায় জড়িয়ে পড়ে তার অস্ত্রোপচার পরবর্তী নাজুক শরীর। আগে তাকে ইন্ট্রাভেনাস খাবার দেয়া হতো। পরে পাইপ দিয়ে পাকস্থলীতে সরাসরি খাওয়ানো শুরু হয়। এর ভেতর হুমায়ূনের আরও একটি অস্ত্রোপচার হয়। সেটা হয়, কেননা দ্বিতীয়বার অস্ত্রোপচারের পরে তার পেটের মাঝখান দিয়ে যে কাটা হয়েছিল সেটা ঠিকমতো জোড়া লাগছিল না। জোড়া লাগবার পরিবর্তে ক্ষতের দুধারেই স্কার টিস্যু তৈরি হয়ে মাঝখানের কাটা জায়গাটাকে আস্তে আস্তে ফাঁক করে দিচ্ছিল। ফলে আরেকটি অপারেশন করে স্কার টিস্যুগুলো পরিষ্কার করে ফেলে দিয়ে চামড়ার নিচে ম্যাশ বসিয়ে দুদিক একত্র করে কাটা জায়গাটি জোড়া লাগাবার প্রচলিত পদ্ধতিই ব্যবহার করা হয়েছিল। এটা করার আগে পেটের ভেতরের এবসেস, পুঁজ, পানি সব পরিষ্কার করে ফেলে দেয়া হয়েছিল। হুমায়ূনের ডায়েবেটিক শরীর ঘা শুকানোর জন্য অনুকূল ছিল না। কিডনির জন্যও নয়। তারপর এন্টিবায়োটিক চলা সত্ত্বেও তার শরীরে প্রচন্ড ইনফেকশন থাকার কারণে এক পর্যায়ে কিডনি দুটোও অকেজো হয়ে পড়ে। ডায়ালাইসিসে দিতে হয় তাকে। আরও পরে ট্রাকিওটমিও করা হয় যদি তাতে একটু আরাম পায় রোগী শ্বাস-প্রশ্বাসে। সাদা রক্তকণার সংখ্যা (সংক্রামক রোগের উপস্থিতির লক্ষণ) বাড়তে বাড়তে ৩০,০০০ হয়ে যায়, আবার মাঝে মধ্যে একটু কমে, আবার একদিন খুব বাড়ে, পরের দিন একটু কমে। অবশেষে রক্তেও যখন সংক্রমণ বিস্তার করে, সেপসিসের লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করে। একটি সময় আসে যখন রক্তের চাপ (বস্নাড প্রেসার) কিছুতেই আর যথেষ্ট ওপরে তুলে রাখা যাচ্ছিল না_ সেলাইনের সঙ্গে এপিনেফ্রিন, ভেসোপ্রেসিনের সম্ভবপর সর্বোচ্চ ডোজ দিয়েও নয়। বস্নাড প্রেসার উঠাতে গিয়ে হৃৎপিণ্ডের ওপর প্রচন্ড চাপ পড়ছিল। অক্সিজেন স্যাচুরেশনের জন্য ভেন্টিলেটরের সাহায্যের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে হয় (যেমন, ৫০% থেকে ১০০%)। এভাবে হুমায়ূনের শারীরিক অবস্থা ক্রমান্বয়ে খারাপের দিকে যেতে থাকে। তবে এরই মাঝে আবার কোন কোন দিন ভাইটাল সাইনগুলো হঠাৎ করে স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরে আসে। অনেক স্বাভাবিক ও সংহত মনে হয় ওর অবস্থা। যেমন হয়েছিল মৃত্যুর আগের দিনও। ডাক্তার মিলার খুশি হয়েছিলেন ওকে `stable` দেখে। জুলাই ১৮ তারিখে সকাল ৮টা নয় মিনিটে (নিউইয়র্ক সময় সকাল ১০টা নয়) করা টেক্সট মেসেজে ডাক্তার মিলার আমাকে জানালেন সেকথা। সেইসঙ্গে লিখলেন, হুমায়ূনের `শারীরিক অবস্থা আগের চেয়ে একটু ভালো`। সঙ্গে সঙ্গে মেসেজটি শাওন ও জাফর ইকবালের কাছে ফরোয়ার্ড করি এবং ফোনেও কথা বলি ওদের সঙ্গে।

অবশেষে এল ১৯ জুলাই।। সেদিন খুব ভোরে ডাক্তার মিলার নিজেই আমাকে মেসেজ পাঠালেন, আমি তাকে ফোন করার আগেই। হুমায়ূনের অবস্থা ভালো নয়, ব্লাড প্রেসার ঠিক রাখা যাচ্ছে না। নিউইয়র্কে হুমায়ূনের স্বজনদের খবরটা দিলাম। পরে আস্তে আস্তে হাসপাতাল থেকে একে একে ফোন পেতে শুরু করলাম। শাওনের, মাজহারের, ইয়াসমিনের, ডাক্তার মিলারের। একসময় ডাক্তার মিলার লিখলেন, `হুমায়ূনের অবস্থা খুব খারাপ। তার স্ত্রী ও আত্মীয়স্বজনরা তাকে ঘিরে চারপাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি ভীষণ দুঃখিত।` আমি লিখলাম, `এই কি তাহলে শেষ?` উত্তরে ডাক্তার মিলার লিখলেন, `May be, but we are still trying.` যে মুহূর্তে হুমায়ূন মারা যাচ্ছে, খুব সম্ভবত ইয়াসমিন কাঁদতে কাঁদতে আমায় দু-দুবার টেলিফোন করেছিল, `পূরবীদি, সব কিছু কমে যাচ্ছে, নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে, সব ড্রপ করছে। ফ্ল্যাট হয়ে যাচ্ছে সব, ব্লাড প্রেসার নেমে যাচ্ছে, এখন চলি্লশ, না তিরিশ,……। `ফোনের এপারে আমি আমার সেলুলারে ভেসে ওঠা নম্বরের দিকে না তাকিয়েই ওপারের নারীকণ্ঠকে শাওন ভেবে, বারবার কেবল তাকে ওই নামেই ডাকছিলাম। পরে দেখেছি, ওটা শাওনের নয়, জাফরের নম্বর ছিল। তার মানে ইয়াসমিন। ইয়াসমিন, আমায় তুমি ক্ষমা কর, ভাই। সেই মুহূর্তে আমি স্বাভাবিক ছিলাম না।
হুমায়ূন মারা যাওয়ার পরে অন্যদের মধ্যে জাফর ইকবাল ফোন করে আমায় সংবাদটা দেয় আমার মোবাইল ফোনের ভয়েস মেইলে। আমি তার আগেই সব টে

মৃত্যুর সঙ্গে হুমায়ূন আহমদের লড়াইয়ের দিনগুলো

পূরবী বসু

(নন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমদের মৃত্যুর পর তার মৃত্যু নিয়ে নানাধরনের কথা হয়েছে,অনেক অভিযোগ অনুযোগ উঠেছে। হয়েছে বিতর্কও। মিডিয়াতে নানা ধরনের খবর বেরিয়েছে যার প্রায় সবই নামহীন সোর্স থেকে,বলা চলে ফার্ষ্টহ্যান্ড সোর্স থেকে উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনাই জানার সুযোগ হয়নি পাঠকদের। হুমায়ূন আহমেদের চিকিৎসাচলাকালে শেষ সময় পর্যন্ত পাশে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী বাংলাদেশী লেখক পূরবী বসু।হুমায়ূনের মৃত্যুর সঙ্গে লড়াইয়ের তিনি প্রত্যক্ষদর্শী, ফাষ্টহ্যান্ড সোর্স।পূরবী বসু ঢাকার দৈনিক সংবাদের জন্য লিখেছেন হুমায়ূন আহমেদের শেষ মুহূর্তগুলোর কিছু স্মৃতিকথা।নতুনদেশ ডটকমের পাঠকদের জন্য পূরবী বসুর লেখাটি তুলে ধরা হলো। আমরা নিশ্চিত পূরবী বসুর এই লেখায় হুমায়ূনের মৃত্যুকে ঘিরে তৈরি হওয়া অনেক প্রশ্নের, অনেক বিতর্কের উত্তর খুজেঁ পাওযা যাবে।-বি.স.)
আগে তেমন জানাশোনা না থাকলেও আমেরিকায় তার ক্যান্সারের চিকিৎসা চলাকালে হুমায়ূন ও তার পরিবারের সঙ্গে ঘটনাচক্রেই আমাদের পরিবারের যথেষ্ট সখ্য গড়ে উঠেছিল, আর এই বন্ধুতার প্রায় সবটাই তার চিকিৎসাকে কেন্দ্র করে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আজ আমার এই ব্যাপারে নিজের কিছু অভিজ্ঞতা ও তার চিকিৎসার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত দুই হাসপাতালের দু`জন সিনিয়র ডাক্তারের সঙ্গে হুমায়ূনের ব্যাপারে আমার যোগাযোগ/ আলোচনার ওপর ভিত্তি করে কিছু কথা লিখছি, কিছু তথ্য পরিবেশন করছি।

হুমায়ূনের ক্যান্সার সার্জারি টিমের প্রধান ডাক্তারকে (ডাক্তার জর্জ মিলার) বারে বারে আমি প্রশ্ন করে জানতে চেয়েছি, হুমায়ূনের পরিবার বা হাসপাতালের পক্ষ থেকে এমন কিছু করার ছিল কিনা যা করা হয়নি, করতে পারিনি, করিনি অথবা সময়মতো করা হয়নি। কিংবা, এমন কিছু করা হয়েছিল কিনা যা করা ঠিক হয়নি, ভুল হয়েছে, অথবা যার জন্যে কোন ক্ষতি হয়েছে? জবাবে ডাক্তার জর্জ মিলার প্রতিবার পরিষ্কার করে জোর দিয়ে বলেছেন, লিখেছেন (এমন কি মাত্র চারদিন আগেও আমার লিখিত প্রশ্নের জবাবে টেক্সট মেসেজ করে জোর দিয়ে বলেছেন, তার জন্যে যা করা সম্ভব ছিল তার সবই করা হয়েছে। করণীয় কোন কিছু থেকেই বিরত থাকা হয়নি।) এ প্রসঙ্গে বলে রাখা উচিত, হুমায়ূন ও তার স্ত্রী শাওন উভয়েই ডাক্তারদের সঙ্গে হুমায়ূনের ক্যান্সার ও তার চিকিৎসার ব্যাপারে আমাকে সরাসরি যোগাযোগ ও আলোচনা করার অনুমতি এবং অধিকার দিয়েছিল বলেই সেটা করতে পেরেছি আমি, তা নইলে এদেশে ডাক্তার বা হাসপাতালের তরফ থেকে রোগীর পরিবারের বাইরের কাউকে রোগীর শারীরিক অবস্থা বা চিকিৎসা সম্পর্কে কোন তথ্য দেয়া হয় না। প্রাইভেসি ক্ষুণ্ন হওয়ার বিধান লঙ্ঘনের সম্ভাবনাতে সবাই বড় সতর্ক এদেশে। আমাকে এ বিশেষ দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল সম্ভবত এ কারণে যে, আমি নিজে ডাক্তার না হলেও বায়োমেডিকেল বিজ্ঞানে, বিশেষ করে ডাক্তারদের সঙ্গে যোগাযোগ ও তথ্য আদানপ্রদানের ক্ষেত্রে, দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছি। এছাড়া সবচেয়ে বড় যে কারণে হয়তো এত অনায়াসে আমাকে এ দায়িত্ব তারা দিতে পেরেছিল, সেটা হলো, চিকিৎসাক্ষেত্রে আমার বিবেচনার ওপর হুমায়ূন ও তার ঘনিষ্ঠজনের একরকম আস্থা জন্মেছিল।

গত বছর (২০১১ সালে) সেপ্টেম্বরের ৭ তারিখে সিঙ্গাপুরে রুটিন শারীরিক পরীক্ষা করতে গিয়ে আকস্মিকভাবেই ধরা পড়ে হুমায়ূনের কোলনে (বৃহদান্ত্রে) ক্যান্সার। আর তাও চতুর্থ স্টেজে। সাধারণত রোগীর শরীরে ক্যান্সারের অবস্থা নির্ণয়ে এ স্টেজগুলোকে বিবেচনায় আনা হয়। কতগুলো নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য ও বিশেষ কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার ফলের ওপর নির্ভর করে ক্যান্সারের ব্যাপকত্ব ও বিস্তৃতি অনুসারে সাধারণত এ স্টেজগুলোকে এক থেকে চার পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে ভাগ করা হয়। স্টেজ ফোর ক্যান্সার মানে সবচেয়ে পরিণত বা Advanced Stage-ক্যান্সার। স্টেজ ফোর-এ কর্কট কোষগুলো মূল জায়গা ছাড়াও শরীরের অন্য অঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। কোলন ক্যান্সারে চার নম্বর স্টেজ থেকে আরোগ্যলাভের সম্ভাবনা খুবই কম, (শতকরা ৭% এর মতো)। সিঙ্গাপুরের ডাক্তাররাই দুঃসংবাদটি দিয়ে হুমায়ূনকে জানিয়েছিলেন কোলন থেকে তার ক্যান্সার লিভারের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় সম্ভবপর চিকিৎসার মধ্যে ছিল কেমোথেরাপি অথবা কিছু কেমোথেরাপি আর সার্জারি। কিন্তু অসুখের নামটা শুনেই হুমায়ূন মনে মনে স্থির করে ফেলেছেন ক্যান্সার চিকিৎসার জন্যে তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো জায়গায় যাবেন এবং সেটা সিঙ্গাপুর নয়। আমেরিকা। সঙ্গে সঙ্গে দেশে ফিরে আসেন তিনি সপরিবারে। স্ত্রী শাওন ইন্টারনেট ও বিভিন্ন জায়গায় খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারেন নিউইয়র্কের মেমোরিয়াল সেস্নান ক্যাটারিং ক্যান্সার সেন্টার এ বিশেষ রোগের চিকিৎসার জন্যে সবচাইতে বিখ্যাত হাসপাতাল। সঙ্গে সঙ্গে হুমায়ুন আমেরিকায় সেস্নান ক্যাটারিং হাসপাতালে চিকিৎসার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। এত নামকরা ও পুরনো প্রতিষ্ঠান বলেই হয়তো চাইলেই সঙ্গে সঙ্গে এসে এখানে চিকিৎসা শুরু করে দেয়া সম্ভব হয় না। অপেক্ষা করতে হয়। সে যাই হোক, হুমায়ূনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, প্রকাশক ও প্রতিবেশি আলমগীর রহমানের (আলমগীর আমাদের-ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু, অন্তত চার দশক ধরে) কাছে কাকতালীয়ভাবে সংবাদটা জানতে পেরে আমি হুমায়ূনের জন্যে তার নিউইয়র্কে পেঁৗছার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সেস্নান ক্যাটারিংয়ে ডাক্তার দেখাবার জন্যে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্টের ব্যবস্থা করি। এ ব্যাপারে আমার সাবেক বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর রিভলিন আমাকে প্রভূত সাহায্য করেন। এছাড়া আশি আর নব্বইয়ের দশকে প্রায় এক যুগ ধরে আমি সেস্নান ক্যাটারিংয়ে গবেষণার কাজ করেছি বলে সেখানে এক আধটু জানাশোনা তখনো অবশিষ্ট ছিল। সেপ্টেম্বরের ১৪ তারিখ রাতে সপরিবারে হুমায়ূন নিউইয়র্কে পেঁৗছান আর সেপ্টেম্বরের ১৫ তারিখ দুপুর একটায় তার অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক হয় সেস্নান ক্যাটারিংয়ে। সেদিন সব কাগজপত্র, প্লেট দেখে, কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার পর ডাক্তার স্থির করেন প্রথম কিস্তিতে ছয়টি কেমো নিতে হবে। হুমায়ূনের ক্যান্সারের তখন যে অবস্থা (স্টেজ চতুর্থ), তাতে তখন আর সার্জারি করা সম্ভব ছিল না। বাংলাদেশের কাগজে এ সার্জারি না করার সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক সংবাদ ভেবে লিখে ফেলে, `অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন নেই। অপারেশন ছাড়াই হুমায়ূন আহ?মেদ সুস্থ হয়ে উঠবেন।` ডাক্তার স্টিভেন ভিচ বললেন, প্রথম ছয়টি কেমো দেয়ার পর CT scanmnসহ আবার সমস্তরে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে পরবর্তী কর্মপদ্ধতি স্থির করা হবে। মেমোরিয়াল সেস্নান ক্যাটারিংয়ের আন্তর্জাতিক শাখার প্রধান ডাক্তার স্টিভেন ভিচ নিজেই হলেন হুমায়ূনের ডাক্তার। বললেন, আপাতত যে ৬টি কেমো দেয়া হবে তার প্রতিটির ভেতর ৩টি করে ক্যান্সারের ওষুধ থাকবে। লক্ষ্য করলাম, সেস্নান কেটারিং গত পঁচিশ বছরে অনেক বদলে গেছে। বড়ো ও (আকৃতিতে) হয়েছে অনেকটাই। বিশেষ করে, এখনকার নিয়মে যারা বিদেশি এবং বিশেষ করে যারা স্বাস্থ্য বীমাবিহীন বিদেশি, তাদের চিকিৎসার জন্যে প্রয়োজনীয় সবটা অর্থই আগে থেকে ক্যাশিয়ারে জমা দিতে হবে, তারপরই চিকিৎসা শুরু হবে। এটার কারণ, অনেক বিদেশি রোগী নাকি ধারে চিকিৎসা নিয়ে অর্থ পরিশোধ না করেই নিজ দেশে ফিরে গেছে। তারা জানান, নতুন পলিসি অনুযায়ী হুমায়ূনের কেমোথেরাপির প্রথম কোর্সের (৬টি কেমোর) যাবতীয় অর্থ আগাম পরিশোধ করলে তবেই চিকিৎসা শুরু হবে। সে তো একসঙ্গে বিস্তর টাকার ব্যাপার। অত টাকার ব্যবস্থা রাতারাতি করা প্রায় অসম্ভব। অথচ চিকিৎসা আর দেরি না করে এক্ষুণি শুরু করা দরকার। এ অবস্থায় ডক্টর ভিচসহ আরও দু`একজনের সঙ্গে কথা বলে কিস্তিতে টাকাটা দেয়ার ব্যবস্থা করতে সক্ষম হই।
সেস্নানে কেমো দেয়ার ধরনটি ছিল এরকম। কেমো নেয়ার দিন সকালে হাসপাতালে গেলে প্রথমে রোগীর রক্ত নিয়ে পরীক্ষা করা হবে। দেখার জন্যে, কেমো নেয়ার জন্যে তার স্বাস্থ্য উপযুক্ত কিনা। তার হিমোগ্লোবিন, লাল, সাদা ও অন্য (প্লেটিলেট) রক্তকণার পরিমাণ, ধাতব পদার্থ ইত্যাদি সব ঠিক আছে কিনা দেখা হবে। তার পরে ডাক্তার তাকে পরীক্ষা করবেন, কথা বলবেন, বিভিন্ন প্রশ্ন করবেন। ইতোমধ্যে ফার্মেসিতে তার ইন্ট্রাভেনাস কেমো দেয়ার জন্যে ককটেইল তৈরি হতে থাকবে। অর্থাৎ ক্যান্সার-কোষগুলো মেরে ফেলার জন্যে যে তিনটি কড়া ওষুধ শরীরে যাবে তা শরীরের ভালো জীবকোষগুলোকেও যাতে ধ্বংস বা ক্ষতি না করে সে জন্যে ওই ওষুধের সঙ্গে ভিটামিন, মিনারেল, স্টেরয়েড ছাড়াও বিভিন্ন দ্রব্য মেশানো হয় যার জন্যে কেমোথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ইদানিং আগেকার দিনের তুলনায় অনেক কম হয়। কয়েক ঘণ্টা ধরে সেই ওষুধ-ককটেল শরীরে দেয়ার পরে বাকি ওষুধটা একটি বোতলের মতো ধাতব পাত্রে ভরে রোগীর পেটের ওপর একটা ব্যাগে বেঁধে দেয়া হয়। একটা সরু নল দিয়ে সেই বোতল থেকে ওষুধ এসে রোগীর বুকের চামড়ার ভেতরে semi-permanent–ভাবে বসানোসবফর-ঢ়ড়ৎঃ ুএর ভেতর দিয়ে দুদিন ধরে ধীরে ধীরে শরীরে প্রবেশ করবে কিন্তু তার জন্যে এ দুদিন হাসপাতালে থাকার প্রয়োজন নেই। ঘরে গিয়ে দুদিন পরে এসে খালি ক্যানিস্টার তা খুলিয়ে আসতে হয় কেবল। এভাবে প্রতি দু`সপ্তাহ পর পর তিন দিন ধরে কেমো চলতে থাকে। কিন্তু কেবল প্রথম দিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত আউটপেশেন্ট বিভাগে থাকতে হয়। বাকি কেমো চলে বাড়িতেই।

ডাক্তার ভিচ ও সেস্নান ক্যাটারিংয়ের সমাজকর্মীদের সঙ্গে এ চিকিৎসার খরচের ব্যয়ের ব্যাপারে কথা বলে কিছু করে উঠতে পারিনি। গত ২৫ বছরে অনেক বদলে গেছে এ প্রতিষ্ঠানটি। অত্যন্ত বেশি ব্যবসায়ী মনোভাব গড়ে উঠেছে এখানে_ ওটাই যে বর্তমানে সেস্নান ক্যাটারিংয়ের সংস্কৃতি, মনে হলো আমার। আন্তর্জাতিক ভবনে প্রতিটি আন্তর্জাতিক রোগীর জন্য রয়েছে একজন করে বিশেষ সমন্বয়কারী। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমাদের বেলায় সমন্বয়কারী হিসেবে পড়লেন, এমন একজন মধ্যপ্রাচ্যের নারী, যার আগাগোড়া ব্যবহারে এটিই ফুটে উঠছিল যে, `বাবু যত বলে, মোসাহেব দলে বলে তার শতগুণ।` আমার যুক্তি ছিল, হাসপাতাল যা বিল করে, কোন ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিই তার পুরোটা কখনো দেয় না। তারা তাদের হিসেব মতো একটা ন্যায্য ও নির্দিষ্টমূল্য স্থির করে দেয় প্রতিটি চিকিৎসা সংক্রান্ত কাজ বা সেবার জন্যে। প্রত্যেকটি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিই যেহেতু স্বতন্ত্র ও স্বাধীন, তাদের সবার `ন্যায্য মূল্য`ও-এক নয়। আর কোন বিশেষ হাসপাতাল যদি কোন একটি বিশেষ ইন্স্যুরেন্স গ্রহণ করে থাকে (সব হাসপাতাল সব ইন্স্যুরেন্স নেয় না), তাহলে সেই হাসপাতাল ওই ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি নির্ধারিত ন্যায্য মূল্য গ্রহণ করতে বাধ্য। তারপর পলিসি অনুযায়ী রোগী তার পরিশোধ মেটায়। যেমন, যদি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি `ন্যায্যমূল্যের` ৮০% দেয়, রোগীকে দিতে হয় বাকি ২০%। আর তখন মূল বিল থেকে ন্যায্যমূল্যের অংশটা হাসপাতাল বাদ দিয়ে দেয়। আমার যুক্তি ছিল, ইন্স্যুরেন্স থাকলে যদি তারা চিকিৎসার জন্যে আংশিক মূল্য নিয়ে বাকিটা ছেড়ে দিতে পারে, তাহলে যে ব্যক্তির ইন্স্যুরেন্স নেই, যে ক্যান্সার চিকিৎসার মতো বিশাল খরচ নিজে বহন করছে, তার জন্যে কোন প্রকার ডিসকাউন্টের ব্যবস্থা থাকবে না কেন। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও এ নামকরা প্রাইভেট হাসপাতাল মেমোরিয়াল সেস্নান ক্যাটারিংয়ের ব্যাপারে কিছু করতে সক্ষম হলাম না।
ইতোমধ্যে সব দেখেশুনে পরে অবশ্য আমি পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েছিলাম, কোলন ক্যান্সারের জন্যে যে কেমো হুমায়ূন নিচ্ছে এখানে, তার সঙ্গে এদেশের অন্য হাসপাতালের কোলন ক্যান্সারের কেমোর কোন বস্তুগত বা গুণগত পার্থক্য নেই। ডক্টর ভিচ প্রথম থেকেই হুমায়ূনকে খুব পছন্দ করেন এবং হুমায়ূন-ও ভিচ বলতে অজ্ঞান। ড. ভিচ আমাদের প্রথম দিনেই বলেছেন, এখন যে চিকিৎসা চলছে তা একেবারেই স্ট্যান্ডার্ড কেমোথেরাপি যা বেশকিছু বছর ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ফলে অন্তত এ বিশেষ চিকিৎসাটির ক্ষেত্রে সেস্নান কেটারিংয়ের মতো প্রাইভেট এবং খরচসাপেক্ষ হাসপাতালে এসে নিজের বিত্তের এক বিশাল অংশ খুইয়ে রুটিন চিকিৎসা নেয়ার মানে হয় না। তিনি বলেছিলেন, শুধু এখানকার সিটি হাসপাতালে কেন, ভারত, সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, এমন কি হয়তো ঢাকায় বসেও একই চিকিৎসা পেতে পারেন হুমায়ূন। ইতোমধ্যে শাওন সিটি হাসপাতালে কর্মরত এক বাঙালি ডাক্তার দম্পতি কাছে খোঁজখবর নিয়ে দেখে সিটি হাসপাতালগুলোতে ফোর্থ স্টেজ কোলন ক্যান্সারের জন্য কেমোতে একই ওষুধ দেয়া হয়। কিন্তু তবু আমাদের দ্বিধা কাটে না। হুমায়ূন রাজি হলেও শাওনের মনে ভয়, যদি চিকিৎসার মান একই রকম না হয়! ওদিকে শাওনের মা এখান থেকে ও শাওনের বাবা ঢাকা থেকে ক্রমাগত বলছেন সেস্নান ছাড়া অন্য কোথাও গেলে যদি চিকিৎসার ব্যাপারে কোন রকম ছাড় দিতে হয়, সেটা করার কথা যেন চিন্তাতেও না রাখে তারা। যাই হোক, সবাইকে নিশ্চিন্ত করার জন্যে আমি ডেনভার, কলরেডোতেও খোঁজ করি। নিউইয়র্কের সিটি হাসপাতালের মতো না হলেও সেস্নানের চাইতে অনেক কম খরচ এখানেও। আমি তখন ডাক্তার ভিচকে গিয়ে দুটো কথা বলি। আমার সঙ্গে তখন ছিলেন হুমায়ূনের অত্যন্ত প্রিয়জন-তার সুহৃদ, ঢাকায় তার পাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশি, হুমায়ূনের বইয়ের প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম। ব্যবসা, বাড়িঘর, পরিবার সব ছেড়ে দীর্ঘদিন তিনি এখানে পড়ে আছেন কেবল হুমায়ূনের চিকিৎসার তদারকি করতে। তাছাড়া মাযহারকে হুমায়ূন খুবই স্নেহ করে। অনেক ব্যাপারে তার ওপর নির্ভর করে। সেই গৃহে আমাদের অবস্থানের সময় আমি দেখেছি, অন্যের জন্যে কী সাংঘাতিক করতে পারে এই মাজহার। খাবারের ব্যাপারে হুমায়ূন খুবই খুঁতখুঁতে। এক খাবার দুবেলা খাবে না, বাসি কিছু তো খাবেই না। তার ওপর কেমোথেয়াপী নিলে এমনিতেই খাদ্যে রুচি চলে যায়। গত নয়-দশ মাসে আমরা অন্তত যা বলে, সেটা কিনতে তখনই বাজারে ছোটে মাজহার। শুধু তাই নয়, অনেক দিনই নিজের হাতে রান্না করে মাজহার, হুমায়ূন যেমন করে রাঁধলে পছন্দ করে ঠিক সেভাবেই রাঁধে। প্রায় বিকেলেই সুস্বাদু ও পুষ্টিকর স্যুপ বানিয়ে আনে তাজা তরিতরকারি দিয়ে হুমায়ূনের জন্যে। কখনো ফল কেটে সুন্দর করে সাজিয়ে নিয়ে আসে প্লেটে। বাড়ির এ অনাত্মীয় লোকটিকে বরাবর দেখেছি সম্পূর্ণ পরিবারটিকে আগলে রাখতে। কে বলবে ওকে দেখে সে ঢাকায় এত বড় ব্যবসায়ী!
যে কথা বলছিলাম। সবাইকে নিশ্চিন্ত করার জন্যে, নিজেরা নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্যে আমরা আবার ডাক্তার ভিচের সঙ্গে বসি একদিন। তিনি আমাদের সবাইকে বোঝাতে সক্ষম হন যে সিটি হাসপাতালে একই চিকিৎসা চলবে হুমায়ূনের। কথা দেন সিটি হাসপাতালের জন্যে একটি ফাইল তৈরি করে দেবেন। সেখানে তার চলতি চিকিৎসার বিষয়ে সবকিছু লিখে দেবেন, মানে এখানে কিভাবে কোন ওষুধ কত ডোজে কত দ্রুততার সঙ্গে দেয়া হচ্ছে ইত্যাদি। আমি তখন তাকে অনুরোধ করলাম এটা কি আদৌ সম্ভব যে তিনি তার ওষুধের ককটেইলের একটা রেসিপি দিয়ে দেবেন আমাদের কাছে বা সিটি হাসপাতালে যেখানে রন্ধন পদ্ধতির মতো করে লেখা থাকবে প্রতিটি adjvuant দ্রব্যের নাম, পরিমাণ, মেশাবার পদ্ধতি, কতক্ষণ ধরে মেশানো হয়, সবকিছু, পরম্পরাসহ। ডক্টর ভিচ রাজি হলেন, সেটাও নিজের হাতে লিখে দেবেন তিনি। এরপর তার সঙ্গে কথা হলো, তার পরামর্শমতো, তার তত্ত্বাবধানেই চিকিৎসা চলবে কিন্তু খরচ কমাবার জন্যে কেমোটা নেয়া হবে সিটি হাসপাতালে। এছাড়া কিছুদিন পর পর রোগীর অবস্থা নিরুপণে যে স্ক্রিনিং চলবে, জানার জন্যে কতটা উন্নতি হলো, কতটা ছোট বা শুকিয়ে এলো টিউমারের আকৃতি, টিউমার মার্কারের পরিমাণ কতখানি কমল ইত্যাদি সব তথ্য আমরা ডাক্তার ভিচকে জানাব, দেখাব সব কাগজপত্র, প্লেট। তিনি রাজি হলেন। সেই থেকে আমি হুমায়ূনের ব্যাপারে তার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে গেছি। ডাক্তার ভিচের সঙ্গে আমার ই-মেইলে শেষ দুটি যোগাযোগ হয়েছে ১৭ আর ১৯ জুলাই (হুমায়ূনের মৃত্যুর দিন)।

ইতোমধ্যে সেস্নান ক্যাটারিং হাসপাতালে ৫টি কেমো নেয়া হয়ে গেছে। এরপরে হুমায়ূনের সিটি হাসপাতালে (বেলভিউ হাসপাতালে) চিকিৎসার সব ব্যবস্থা সম্পন্ন করলেন নিউইয়র্কের মুক্তধারার বিশ্বজিৎ সাহা। সেস্নান কেটারিংয়ের এক একটা কেমোতে যেখানে সাড়ে সতেরো হাজার ডলার লাগত, সেখানে বলতে গেলে সামান্য খরচে বা বিনা খরচে তার একই কেমো চলতে থাকে বেলভিউতে। বরং বেলভিউতে Avastin নামে আরও একটি নতুন ওষুধ যোগ করা হলো যেটা মেমোরিয়াল সেস্নান ক্যাটারিংয়ে দেয়া হতো না। Avastin সাধারণত এ পর্যায়ের অধিকাংশ কোলন ক্যান্সার রোগীদের দেয়া হয় অন্য তিনটি Oxaliplatin, Levo covenin, 5 FU) ওষুধের সঙ্গে, যে তিনটি সেস্নান কেটারিংয়ে দেয়া হচ্ছিল। Avastin কেন এতদিন দেয়া হয়নি বেলভিউ হাসপাতালের অঙ্কোলজিস্টের প্রশ্নের উত্তরে ডাক্তার ভিচের বক্তব্য ছিল, দুই কারণে সেটা করা হয়নি। ১) যখন হুমায়ূন প্রথম চিকিৎসা শুরু করেন এখানে, তার কোলনের টিউমারের যা অবস্থা ছিল, আকৃতি ও রক্তক্ষরণের পরিপ্রেক্ষিতে, যে তিনি ইচ্ছে করেই আধংঃরহ দেননি, কেননা, তাতে বিস্নডিং বেশি হতে পারত। ২) আর দ্বিতীয় কারণটি হলো, তিনি ভেবে দেখেছেন Avastin (যা টিউমর কোষে রক্ত সাপ্লাই বন্ধ করে টিউমারকে বড় হতে বাধা দেয়)। তার ককটেইলে যোগ করলে ফলাফল ঊনিশ বিশের বেশি কিছু পার্থক্য হতো না। এজন্যে পকেট থেকে এত খরচের পর আরেকটি খুব দামি ওষুধ যোগ করে খরচ বাড়াতে বিবেকের কাছে সায় পাননি তিনি। বেলভিউর অল্প বয়সী অত্যন্ত সতর্ক নারী ডাক্তারটি তখন এ প্রৌঢ় অভিজ্ঞ ডাক্তার ভিচকে জিজ্ঞেস করলেন, ৫টি কেমোর পরে যেহেতু তার টিউমারের অবস্থা বেশ কিছুটা ভালো, রক্তক্ষরণও আর নেই, টিউমার মার্কারের পরিমাণও কমে এসেছে, সেক্ষেত্রে এখন Avastin যোগ করলে কেমন হয়? ডাক্তার ভিচ তাকে Avastin যোগ করার পরামর্শ দিলেন। এভাবে হুমায়ূন আহমেদের সেস্নান কেটারিংয়ের চিকিৎসাই বেলভিউ হাসপাতালে (সিটির অধীনে হলেও বেলভিউ হাসপাতাল গুণগত দিক দিয়ে খুবই নাম করা হাসপাতাল। শুধু সিটির অধীনে নয়, বেলভিউ হাসপাতাল খ্যাতনামা নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল কলেজের সঙ্গেও সম্পৃক্ত) হতে থাকে। পার্থক্য শুধু বেলভিউতে ঘরে কেমো নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা নেই। এখানে কেমো নেয়ার প্রথমদিন আউটপেশেন্ট হিসেবে এবং পরবর্তী দুদিন হাসপাতালে ভর্তি হয়ে কেমো নিতে হয়। এটা একদিক দিয়ে ভালো কেননা, কেমো নেয়ার সময়েও সর্বক্ষণ ডাক্তারদের নজরের ভেতর থাকে হুমায়ূন। বেলভিউ হাসপাতালে কর্মরত দু`একজন বাঙালি স্বাস্থ্যকর্মী হুমায়ূনকে রোগী হিসেবে পেয়ে মহাআনন্দিত এবং তাদের একজন, রন্? সাধ্যের বাইরে গিয়ে কিছু করার চেষ্টা করেছেন তাদের প্রিয় লেখকের জন্যে। যেমন, কেমো নেয়ার সময়ে semi private room এর বদলে শুনেছি private room এর ব্যবস্থা করেন তারাই যাতে ইছে করলে শাওন এসে থাকতে পারে রাতে। মাঝখানে কেমোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় দু` দু`বার সাদা রক্তকণা এবং প্লেটিলেটের পরিমাণ অনেকটা কমে যায় হুমায়ূনের। এ রকমটি ঘটা খুবই স্বাভাবিক কেমোথেরাপির রোগীদের। এরকম একবার হয়েছিল সেস্নানে চিকিৎসার সময়েও। তখন নির্ধারিত কেমোর দিন পেছাতে হয়। প্রয়োজনে রক্তকণার সংখ্যা বাড়াবার জন্যে bone-marrow কে চাঙ্গা করতে একরকম উত্তেজক ইঞ্জেকশন দেয়া হয়। তাতে হুমায়ূনের বেশক`দিন ধরে হাতে পায়ে খুব ব্যথা, সামান্য জ্বর ও বিভিন্ন রকম শারীরিক অস্বাচ্ছন্দ্য হতো।
কেমো নেয়া, রক্ত পরীক্ষা করা ও স্ক্রিনিংয়ের জন্যে হাসপাতালে ঘন ঘনই যেতে হতো হুমায়ূনকে। বেলভিউ হাসপাতাল ম্যানহাটানের দক্ষিণ পূর্বদিকে, নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার কাছে। আর হুমায়ূনের ভাড়া করা বাসা জামাইকা, কুইন্সে। অনেকটাই পথ। প্রথমদিকে বিশ্বজিতের স্ত্রী রুমা সাহাই প্রধানত নিয়ে যেত হুমায়ূন-শাওনকে হাসপাতালে। পরের দিকে জ্যোতি (জ্যোতি প্রকাশ দত্ত) নিউইয়র্কে থাকাকালীন অবস্থায় (মার্চ থেকে জুন) প্রায়ই নিয়ে যেত হুমায়ূনকে। জ্যোতির সঙ্গ খুব উপভোগ করত হুমায়ূন। অপেক্ষা করে বসে থাকতো কখন সে আসবে। রুমা ও জ্যোতি ছাড়াও কখনো কখনো হুমায়ূনকে হাসপাতালে নিয়ে গেছেন হুমায়ূনের বাল্যবন্ধু ফান্সু ম-ল, নুরুদ্দীন সাহেব ও রুবেল। আটটি কেমো শেষ হওয়ার পর দ্বিতীয় দফায় পুরো স্ক্রিনিং হলো। আমরা ফলাফল নিয়ে সেস্নান কেটারিংয়ে ডক্টর ভিচের কাছে গেলাম। শাওন, মাজহার, জ্যোতি ও আমি ছিলাম সেখানে। মনে মনে আশা ছিল। কেননা, আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়েছে হুমায়ূনের অবস্থা বেশ কিছুটা ভালো হয়েছে, ওর ওজন বেড়েছে, আগের তুলনায় খাবারও খাচ্ছে নিয়মিত। এতদিনে লিভারের টিউমারগুলো হয়তো যথেষ্ট সংকোচিত হয়েছে। হয়তো সে এখন অস্ত্রোপচারের জন্যে উপযুক্ত হবে। কিন্তু তারপরেও মনে সন্দেহ ছিল বলে আমরা রোগীকে সঙ্গে নিয়ে যাইনি। হুমায়ূন অত্যন্ত আবেগপ্রবণ মানুষ। এসব ব্যাপারে একেবারে ছেলে মানুষের মতো। ভয় ছিল, কোন কিছু নেতিবাচক শুনলেই না বলে বসে, `তাহলে আমি চললাম দেশে।` ডাক্তার ভিচ দেখেশুনে বললেন, (পরে তাদের সার্জারি বিভাগের সঙ্গেও কথা বলে একই মন্তব্য করেছিলেন) হুমায়ূনের অনেক উন্নতি হলেও লিভারের টিউমার এখনো সেই পর্যায়ে আসেনি, যখন Local Emboli“ation করা যাবে। সেস্নান কেটারিংয়ে প্রচলিতই যুগান্তকারী টেকনিকের কথা বলেছিলেন ডাক্তার রিভলিন (আমার প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান) ও ডাক্তার ভিচ। যাদের টিউমার প্রাইমারি জায়গাথেকে শুরু করে এখন ছড়িয়ে গেছে অন্যত্র, যেমন, লিভারে (liver metastatis)। এ পদ্ধতি তখন ব্যবহার করা হয়। ইদানিং আরও কিছু প্রতিষ্ঠানে এ পদ্ধতি ব্যবহৃত হচ্ছে। এ পদ্ধতি অনুযায়ী লিভারের যেখানে যেখানে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়েছে, সেখানে সেখানে গিয়ে ওই বিশেষ বিশেষ স্থানগুলোকে স্থানীয়ভাবে এক ধরনের বিশেষ টেকনিকে পুড়িয়ে ফেলা হয় যাতে ওদের নির্মূল করতে দীর্ঘদিন ধরে উচ্চমাত্রায় কেমো দিতে না হয়। ফলে পুরো লিভার বা সমস্ত শরীরের জীবকোষগুলো মাত্রাতিরক্ত কেমোর প্রভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ার আর সম্ভাবনা থাকে না।
এরপর বেলভিউতে আরও ৪টা কিমো দেয়া হলো। ১২টা কিমোর ধাক্কা সামলানো কম কঠিন কাজ নয়। হুমায়ূন মনের জোরে একরকম সহজভাবেই তা পার করে দিল। এদিকে শত কর্মব্যস্ততার মধ্যেও শাওনের মা এবং কখনো কখনো ওর ছোটবোন এসে ওকে সাহায্য করে, মনে জোর দেয়। দুটো অতি শিশু সন্তান নিয়ে নিউইয়র্কের মতো বৃহৎ শহরে তা না হলে ওদের খুব অসুবিধে হতো। ১২টা কিমো দেয়ার পর নতুন করে আবার স্ক্রিনিং হওয়ার পর বেলভিউ-নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল কলেজের সার্জন ডাক্তার মিলারের সঙ্গে হুমায়ূন ও তার পরিবারের দীর্ঘ মিটিং হয়। আমি তখন ডেনভারে। প্রতিদিনই টেলিফোনে খবর পাই হুমায়ূনের শারীরিক অবস্থার। সার্জারির ব্যাপারে অঙ্কোলজি বিভাগ থেকেই উদ্যোগ নেয়া হয়। ৩০ এপ্রিলে প্রাথমিক কথা হওয়ার পরে আবার দ্বিতীয় দফায় বসে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে ১২ জুন ভোরে হুমায়ূনের সার্জারি হবে কোলন ও লিভারে দুই জায়গাতে একই দিনে। কোলনে হবে প্রথাগত সার্জারি। অর্থাৎ বৃহদান্ত্রের যে অংশে ক্যান্সার রয়েছে সেই অংশটুকু কেটে ফেলে দিয়ে আবার সুস্থ বৃহদান্ত্রের দুই মাথা যোগ করে সেলাই করে দেয়া হবে। আর লিভারে প্রথম local emboli“ation technique ব্যবহার করার চেষ্টা করা হবে। যদি সেটা সম্ভবপর না হয় অথবা কোন জটিলতা দেখা দেয়, তাহলে লিভার থেকে প্রথাগতভাবে মানে পুরনো স্টাইলে টিউমার কেটে ফেলে দেয়া হবে। দুটোর জন্যই সম্মতিপত্র রেখে দিলেন তারা। সংবাদটি শুনে আমরা সকলেই খুশি। সার্জারি-ই একমাত্র আশা যদি হুমায়ূনকে নিরাময় করে তোলা যায়। কেননা দিন যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিমোথেরাপি আর আগের মতো কাজ করছিল না। সত্যি বলতে গেলে আটিটি ও বারোটি কিমোর ভেতর লিভারে খুব যে দৃশ্যনীয় উন্নতি ঘটেছে তা নয়। ১২ জুন হুমায়ূনের সার্জারি হবে, বেলভিউ থেকেই সুসংবাদটি দিল আমায় শাওন। আর ওরা হাসপাতালে থাকতে থাকতেই আমি ১১ জুন সন্ধায় ডেনভার থেকে নিউইয়র্কে পেঁৗছার একটি প্লেনের টিকিট কেটে ফেলি। জ্যোতিও অখন নিউইয়র্কেই থাকবে। ওর সার্জারির জন্য আমার এতদূরে আসার খবর শুনে হুমায়ূন খুবই খুশি হয়। সেকথা হাসপাতাল থেকে ঘরে যেতে যেতে ফোন করে জানায় আমাকে।

আমরা সকলে উদগ্রীব হয়ে প্রতীক্ষা করি। ১১ তারিখে রাতে লাগোর্ডিয়া বিমানন্দর থেকে আমাকে তুলে নিয়ে জ্যোতি, ও সঙ্গে আসা মাজহার, হুমায়ূনের জামাইকার বাসায় নিয়ে আসে। হুমায়ূনকে সে রাতে খুব হাসি খুশি ও চিন্তামুক্ত লাগছিল। আসন্ন সার্জারির জন্য দুশ্চিন্তার কোন চিহ্ন নেই। পরদিন সকাল ৬টায় সার্জারি। সাড়ে ৫টায় পেঁৗছুতে হবে। হুমায়ূনের ইচ্ছা জ্যোতির সঙ্গে যাবে হাসপাতালে। যথারীতি ভোর সাড়ে ৪টায় জ্যোতি আমাদের নিয়ে রওনা হয়ে সাড়ে ৫টার আগেই আমরা বেলভিউতে পেঁৗছি। আমাদের গাড়িতে হুমায়ূন, শাওন, জ্যোতি ও আমি। মাজহারের বন্ধু রুবেলের গাড়িতে রুবেল, মাজহার, ও ফান্সু। সাড়ে ৫টায় সার্জারি বিভাগে এসে কাগজপত্র জমা দেয় হুমায়ূন। ৬টার আগেই আমাদের ওয়েটিং রুমে রেখে হুমায়ূনকে নিয়ে গেল নার্স। বলল অপারেশন থিয়েটারে যাওয়ার আগে আবার দেখা পাব তার। ওয়েটিং রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে আমরা অপেক্ষা করি। ভোর ৬টার দিকে কয়েকজন রোগীকে স্ট্রেচারে করে নার্স নিয়ে গেল সার্জারিতে আমাদের সামনে দিয়ে। কিন্তু হুমায়ূন কোথায়? একটু পরে দেখি গাউন পরা হুমায়ূন আমাদের সামনে দিয়ে, স্ট্রেচারে করে নয়, পায়ে হেঁটে দিব্যি নার্সের সঙ্গে হাসিমুখে চলে গেল অপারেশন থিয়াটারের দিকে।

প্রতীক্ষার মুহূর্তগুলো বড় দীর্ঘ। মনে হয়, অনন্তকাল ধরে চলে। ওয়েটিং রুমে বসে আছি আমরা শাওন, আমি, জ্যোতি, মাজহার, বিশ্বজিৎ, বগুড়ায় হুমায়ূনের স্কুলের সহপাঠী বন্ধু ফানসু আর মাজহারের পুরনো বন্ধু রুবেল। অপেক্ষা করছে আরও কিছু অপরিচিত মানুষ, আমাদেরই মতো তাদের প্রিয়জনদের জন্য। আমাদের সকলের দৃষ্টি টিভি মনিটরের দিকে। হুমায়ূনের জন্য আমাদের একটা নম্বর দেয়া হয়েছে, আমরা বসে বসে দেখছি মনিটরে কোথায় কী পর্যায়ে আছে সে। প্রতিটি পর্যায়ের জন্য একটি ভিন্ন রঙ। হুমায়ূনের সার্জারির রঙ আর পাল্টায় না। সার্জারি চলছে তো চলছেই। সাড়ে ৬ ঘণ্টা পরে দেখা গেল তার সার্জারি শেষ। রিকোভারি রুমে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাকে। অবশেষে রঙ পাল্টালো হুমায়ূনের নম্বরে। আমরা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে বা করমর্দন করে নিজেদের আনন্দ ও তৃপ্তি প্রকাশ করি। আমি বিশ্বজিতের কাছে গিয়ে তাকে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা জানাই। তার ব্যবস্থাব জন্যই এটি সম্ভব হয়েছে। আরও কিছুক্ষণ পরে রিকোভারি রুমে জ্ঞান ফিরল হুমায়ূনের। ততক্ষণে হুমায়ূনের সার্জিকেল টিম এসে আমাদের বলে গেল অপারেশন সফল হয়েছে। Local emboli“ationলেগেছে। লিভার কাটার দরকার হয়নি। কোলনের সার্জারিও ভালোভাবে হয়েছে। সার্জন বললেন, `যতদূর আমরা দেখতে পাচ্ছি, তার শরীরে এখন আর কোন ক্যান্সার নেই`। যদি কোন টিউমার ইতোমধ্যেই অন্য কোথাও তৈরি হতে শুরু করে থাকে যা এখনো চোখে দেখা যাচ্ছে না, অথবা আবার পরে যদি নতুন করে কোন টিউমার হয়, সেটার কথা অবশ্য বলা যাবে না এই মুহূর্তে। সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না যেহেতু স্টেজ ফোরে হুমায়ূনের ক্যান্সারের অবস্থান। আমরা ডাক্তারদের ধন্যবাদ জানাই। ডাক্তার মিলার আসেননি ওয়েটিং রুমে অন্য সার্জনদের সঙ্গে। জিজ্ঞেস করলে তারা জানান হুমায়ূনের সার্জারিকালে ডাক্তার মিলার সর্বক্ষণ উপস্থিত ছিলেন অপারেশন রুমে। মঙ্গলবার সারাদিন ধরে সার্জারি চলে এই হাসপাতালে। পরবর্তী সার্জারি নিয়ে নিশ্চয় ব্যস্ত আছেন মিলার।
আমরা তখন একে একে গিয়ে রিকোভারি রুমে হুমায়ূনকে দেখে এলাম। যদিও সবার আগেই গেছে শাওন, তবু আমরা যারা তাকে দেখতে যাচ্ছি, সবাইকেই শুধু তার `কুসুম`- এর কথা জিজ্ঞেস করছে হুমায়ূন। কুসুমকে কাছে, চোখের সামনে সবসময়ের জন্য চায় হুমায়ূন। সাত ঘণ্টা একনাগাড়ে ওই রুমটাতে বসে আছি আমরা। কোথাও যাইনি কেউ এক মুহূর্তের জন্যও। এখন সবারই খিদে লেগেছে। খেতে হবে। হুমায়ূনের কেবল পিপাসা পাচ্ছে তখন। পানি এখন দেয়া যাবে না, মুখে বরফের দু-একটা ছোট টুকরো দেয়া হলো। এ সময় তাকে দেখতে ঘরে ঢুকলেন নিউইয়র্কের প্রখ্যাত সাংবাদিক সৈয়দ মুহাম্মদ উল্লাহ?। এলো বেলভিউ হাসপাতালে কর্মরত সেই বাঙালি ছেলে রণি। আমার কানে তখন শুধু ঝংকার তুলছে `ক্যান্সার ফ্রি` শব্দ দুটি। হুমায়ূন ক্যান্সার ফ্রি। আঃ! কী মিষ্টি ওই শব্দ দুটি।
৫ দিন সার্জিকেল বিভাগের ICU তে থাকার পর ১৭ তারিখে রাতে সাধারণ ওয়ার্ডে স্থানান্তরিত করা হলো হুমায়ূনকে। সাধারণত প্রাইভেট রুমই দেয়া হয় তাকে, কিন্তু সেদিন কোন প্রাইভেট রুম খালি না থাকায় তাকে semi-private রুমে থাকতে হলো। তার মানে আরেকজন রোগী ছিলেন সেই ঘরে। সেদিন সকাল থেকেই হুমায়ূনকে ওঈট থেকে স্থানান্তরিত করার প্রক্রিয়া চলছে, টের পেয়েছিলাম আমরা। ডাক্তার রিলিজপত্র লিখে দিয়েছেন অতি ভোরেই। কিন্তু ওয়ার্ডে রুম খালি না পাওয়ায় এই অবেলায় মানে রাত্রিতে তাকে নেয়া হলো সেখানে।

১৯ তারিখে খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল মাজহারের ফোনে, বলল হুমায়ূনকে রিলিজ করে দিয়েছে হাসপাতাল থেকে। সে ঘরে আসার জন্য অস্থির আগ্রহে অপেক্ষ করছে তার হাসপাতালের রুমে। আমরা তখন আমদের বাড়িতে রকল্যান্ড কাউনটিতে, শহর থেকে প্রায় ৫০ মাইল উত্তরে। আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আসার চেষ্টা করছি এটা বলেই প্রায় সঙ্গে সঙ্গে রওনা হই। কিন্তু হাসপাতালে পেঁৗছার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের চোখের সামনে দিয়ে ফান্সু ম-লের গাড়িতে করে হুমায়ূন ও শাওন বাড়ি চলে যায়। বুঝলাম, হুমায়ূন আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করতে পারছিল না। নিষাদ আর নিনিদকে দেখে না আজ এক সপ্তাহ। ওকে দোষ দিই কী করে? হাসপাতালে তখনো মাজহার ও বিশ্বজিৎ। বিশ্বিজতের বেশ খানিকটা সময় লাগল হুমায়ূনের বিভিন্ন রকম প্রয়োজনীয় ওষুধগুলো হাসপাতালের একাধিক ফার্মেসি থেকে তুলতে। অপেক্ষা শেষে ওকে আর মাজহারকে নিয়ে আমরা কুইন্সে যেতে থাকি। হুমায়ূনের ঘর থেকে আগেই সব জিনিসপত্র বের করে পরিষ্কার করে ফেলা হয়েছিল। এই বাড়িটি যেহেতু দোতলা, হুমায়ূনকে কেউ ঝামেলা বা বিরক্ত করতে পারবে না। কেননা বাইরের ঘরটি নিচতলায়। যারা আসবে সেখানেই বসবে। আমরা নিজেরাও হুমায়ূনের ঘরের বাইরে দূর থেকে তাকে দেখে এলাম একবার। ঘরের ভেতরে যাইনি।
হুমায়ূনের খোঁজ নেই প্রতিদিন। শুনি পেটে ব্যথা ও অস্বস্তি। সেটা প্রত্যাশিত, ডাক্তারও বলেছিলেন। আর সেতো হবেই! একই সঙ্গে পেটের দুই জায়গায় এত বড় সার্জারি হয়েছে। ২১ তারিখ দুপুরে মাজহার আমাদের রকল্যান্ডের বাড়িতে ফোন করে জানায় হুমায়ূনের কিছুটা অস্বস্তি হচ্ছে। পেটে ব্যথাতো আছেই এবং সামান্য জ্বর ৯৯.৭ ডিগ্রি। আমি তাকে বললাম হুমায়ূনের ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে। আমার সঙ্গে কথা বলার পর ওরা হাসপাতালে ফোন করে। কিন্তু ডাক্তার মিলার ছিলেন না। তবে তার সহকারীর সঙ্গে কথা হয়। সহকারী সার্জন জ্যোতি পরামর্শ দেন জ্বর ১০১ ডিগ্রি হলে টাইলেনল দিতে। আর ব্যথা খুব বেড়ে গেলে হাসপাতালে নিয়ে আসতে। এরপর খুব ভোরে মাজহারের ফোনে ঘুম ভেঙে গেল। বলল হুমায়ূনের পেটের ব্যথা বেড়ে গেছে, অস্বস্তি হচ্ছে খুব।। আমরা এই মুহূর্তে সঙ্গে সঙ্গে বেরুলেও আরও দুটি ঘণ্টা লাগবে পাক্কা এই বাড়ি থেকে রওনা হয়ে হুমায়ূনের বাড়ি যেতে। ফলে আমাদের জন্য অপেক্ষা না করে ওদের হাসপাতালে চলে যেতে বললাম। মাজহার ইতোমধ্যেই ফান্সুকে ডেকেছে। আমরা নিজেরাও রওনা হই শহরের দিকে। যেতে যেতেই খবর পেলাম, ফান্সুর গাড়িতে এক ব্লক না যেতেই হুমায়ূনের এত বেশি খারাপ লাগা শুরু হয় যে সে আর বসে থাকতে পারছিল না। ফলে তারা ৯১১ কল করলে সঙ্গে সঙ্গেই অ্যাম্বুলেন্স আসে। অ্যাম্বুলেন্সকে তারা বেলভিউতে নিয়ে যেতে বললেও অ্যাম্বুলেন্স তাদের নিকটবর্তী জামাইকা হাসপাতালের ইমারজেন্সিতে নিয়ে এসেছে। রাস্তায় খবর পেয়ে আমরাও দিক পরিবর্তন করে দ্রুত গাড়ি চালিয়ে তাদের কাছেই ছুটে চলি। মাজহার জানতো না, হয়তো ফান্সু-ও নয়, যে আমেরিকায় ৯১১ কল করে অ্যাম্বুলেন্স ডাকলে ওরা সব সময়েই সবচেয়ে কাছের হাসপাতালের ইমারজেন্সিতে নিয়ে আসে রোগীকে। রোগীর পছন্দমতো বা চাহিদামতো হাসপাতালে নয়। জামাইকা হাসপাতাল কুইন্সে অনেক কাছে হুমায়ূনের বাসা থেকে। আমরা যখন জামাইকা হাসপাতালে পেঁৗছি, দেখি ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে হুমায়ূন শুয়ে আছে। তার হার্টবিট ১৩০-১৩৫। জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে সে। ওদিকে মাজহার ও বিশ্বজিৎ বেলভিউর সঙ্গে যোগাযোগ করে হুমায়ূনকে সেখানে নেয়ার ও ভর্তির ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছে। এ ব্যাপারে বেলভিউর স্বাস্থ্যকর্মী বাংলাদেশের সেই তরুণ রণি এবং ভারতীয় নারী সার্জন জ্যোতি খুব সাহায্য করেন। কিন্তু এক অদ্ভুত ব্যুরোক্রেটিক জটিলতায় পড়ে গেল। যদিও বেলভিউ হুমায়ূনের জন্য ICU তে রুম রেডি করে ভর্তির সব ব্যবস্থা করে রেখেছে, তারা অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করতে পারবে না। কোন খালি অ্যাম্বুলেন্স নেই। এদিকে জামাইকা হাসপাতাল বলে তারা রোগী আনতে অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহার করে, রোগীকে চলে যাওয়ার জন্য নয়। অবশ্য সময় নষ্ট হয়নি। কেননা অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করতে করতে হুমায়ূনের পেটের CT scan করা ও তার রিপোর্টগুলো পাওয়া গেল, যেগুলো বেলিভিউতে গেলেও সর্বপ্রথমেই করতে হতো। জামাইকা হাসপাতালের attending সার্জন বললেন, যদিও স্ক্যানে সুনির্দিষ্ট কোন `লিক` দেখা যাছে না অন্ত্রে, কিন্তু পেটে abdominal cavity  তে) যথেষ্ট গ্যাস ও তরল পদার্থ জমা হয়েছে। তার মানে লিক আছে কোথাও। এর মাত্র কিছক্ষণ আগেই আমি জানতে পেরেছি গতকাল হুমায়ূন তার শোবার ঘরের একটি প্লাস্টিক চেয়ারে বসে ছিল। হঠাৎ ওই প্লাস্টিকের চেয়ারটির পাগুলো বেঁকে গিয়ে মেঝের দিকে বসে যেতে থাকে। চেয়ারে উপবিষ্ট হুমায়ূন ধীরে ধীরে মেঝেতে বসে পড়তে শুরু করে। সামনেই ছিল শাওন। চেয়ার মাটি ছোবার আগেই সে তাকে দুই হাত দিয়ে ধরে তুলে খাটে নিয়ে বসায়। সেই সার্জন ডাক্তার ঘটনাটির আদ্যোপান্ত শুনে বললেন, তার এখনকার এই অবস্থার সঙ্গে ওই ঘটনার কোন যোগ আছ বলে তিনি মনে করেন না। ডাক্তার আমাদের বোঝান, পেটে abdominal cavity তে) গ্যাস ও তরল পদার্থ থাকায় তার পেট ফুলে উঠেছে। যথেষ্ট অক্সিজেনের জন্য এমন ঘন ঘন নিশ্বাস নিচ্ছে সে। দ্রুত হার্টরেট ও রেস্পিরেটরি রেট বোঝাচ্ছে, যে আরও অক্সিজেনের প্রয়োজন তার, আর সেটাই মেটাবার চেষ্টা করছে হৃদপি-। হুমায়ূনের নাক দিয়ে অক্সিজেন দেয়া হচ্ছিল তখন। সে পূর্ণ সচেতন। জাগ্রত। তবে চোখে মুখে শারীরিক অস্বস্তির চিহ্ন। আমি ততক্ষণ contrast CT scan জন্য একটু একটু করে একটা গ্লাস থেকে একরকম তরল পদার্থ খাওয়াচ্ছি হুমায়ূনকে। সে ওটা একেবারেই খেতে চাচ্ছে না। অথচ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এটা শেষ করতেই হবে।
অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে যখন একটা জটিলতা চলছে, তখন নিজেরাই একটা প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে হুমায়ূনকে নিয়ে আসা হয় বেলভিউতে। হুমায়ূনের ভর্তির সব ব্যবস্থা ও রুম তৈরি-ই ছিল সেখানে। তাই কোন দেরি হয়নি কোথাও। বেলভিউতে আসার পরপরই ডাক্তাররা আসতে শুরু করলেন, অনেক ছোটাছুটি চলে নার্স ডাক্তারদের মধ্যে। বেশ কয়েক শিশি রক্ত নেয়া হয় হুমায়ূনের কাছ থেকে ল্যাবে পাঠাবে বলে। অন্যান্য ভাইটাল সাইন পরীক্ষা করা হলো। অন্য হাসপাতালে বসানো সব টিউব, নল, ক্যাথেটার খুলে ফেলে দিয়ে নতুন সব লাগানো হলো। একদল ডাক্তার CT scan রিপোর্ট পড়তে একসঙ্গে একটি ঘরে প্রবেশ করলেন। সার্জারি বিভাগ থেকে ডাক্তার শাহ্? বলে এক অল্প বয়সী ভারতীয় চেহারার ডাক্তার হুমায়ূনের মেডিকেল ইতিহাস নিতে শুরু করলেন। ডাক্তার শাহ্?কে আমি গতকালের প্লাস্টিক চেয়ার কলাপ্স করে হুমায়ূনের মেঝের দিকে কিছুটা ঝুলে পড়ার কথা বললাম। ডাক্তার শাহ আমার কথায় তেমন গুরুত্ব দিলেন না। বললেন, `ওটা তেমন কিছু নয়। ওর জন্য কিছু হয়েছে মনে হয় না। আমি নিজে CT scan  দেখে এসেছি। `আমরা হাসপাতাল রুমে প্রায় রাত ১০টা পর্যন্ত থেকে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হলাম। আমরা তখন সবে জর্জ ওয়াশিংটন ব্রিজ পার হয়ে নিউ জার্সিতে ঢুকেছি। মাজহার ফোন করল। হুমায়ূনকে এক ঘণ্টার মধ্যে emergency surgery  করবে বলে নিয়ে যাবে। সেখানে পেট থেকে গ্যাস ও পানি বের করবে। তা না হলে তার জীবন সংশয় হতে পারে। এছাড়া অন্ত্রের সেই লিকটাও মেরামত করতে হবে জরুরি ভিত্তিতে যেখান থেকে গ্যাস ও তরল পদার্থ বেরুতে শুরু করেছে । আমরা আবার হাসপাতালে ফিরে যাব কিনা জিজ্ঞেস করলে মাজহার বলে, এতদূর থেকে এসে তো কিছু লাভ হবে না, তার আগেই ওকে অপারেশনে নিয়ে যাবে। সে রাতে প্রায় সাড়ে ৪টা পর্যন্ত মাজহারের সঙ্গে কথা হয়। ভালোমতো সার্জারি হয়েছে মাজহারের ফোনে সেটা শোনার পরেই আমরা শুতে যাই। পরের দিন সকালে আবার হাসপাতালের দিকে যাত্রা করি আমরা। আমরা গিয়ে দেখি, বেলা তখন ১১টাও বাজেনি, হুমায়ূন পরিপূর্ণ জাগ্রত। সে শুয়ে আছে ওঈট -এর সার্জারি ইউনিটে অন্য একটি রুমে। গতকাল রাতের সার্জারির চার্জে ছিলেন ডাক্তার মুর। ভালোভাবেই হয়েছে সার্জারি। আমি ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে প্রথম কথা হুমায়ূন যেটা জিজ্ঞেস করে আমায় `আমার কি কোলেস্টমি করেছে?`
বিছানার এক ধারে শোয়ানো কিছুটা বাদামি তরল পদার্থ দিয়ে ভরা ব্যাগটার দিকে তাকিয়ে আমি বলি `হ্যাঁ।` আমি জানি `গু-এর ব্যাগ` বাইরে থেকে বয়ে বেড়াতে তার কী ভীষণ অস্বস্তি_ কী ভয়ানক আপত্তি। তাই প্রথম সার্জারির সময় কোলেস্টমি হবে না শুনে সে কি আনন্দ হুমায়ূনের! আমরা গতকাল রাতেই খবর পেয়েছি এবার শুধু কোলেস্টমি নয়, পেট থেকে তরল পদার্থ বের করে নিয়ে আসার জন্য একটা টিউবও লাগানে হবে ভেতর থেকে বাইরে পর্যন্ত।
আমি বীজনুনাশক ক্রিম দুহাতে ভালো করে মেখে হুমায়ূনের হাতের ও পায়ের আঙ্গুল একটি একটি করে টিপে দিতে শুরু করি। কিমোথেরাপির জন্য নিউরোপ্যাথি হওয়ার জন্য হাত-পা খুব ব্যথা করে ওর, টিপে দিলে আরাম পায়। ক`দিন আগেও আমাকে সংকোচ করত, টিপে দিতে দিত না। কেবল শাওন, বিশ্বজিৎ ও মাজহার করত এটা। কয়েকদিন আগে একদিন আচ্ছা করে বকা দিলাম হুমায়ূনকে, শাওনের সামনেই।
`এত সেকেলে কেন হুমায়ূন? আমি আপনার হাত বা পা টিপে দিলে ক্ষতি কী হবে? তাছাড়া, আমি তো অফিসিয়ালিই আপনার বোন এখন। তাই না?`
আর আপত্তি করেনি হুমায়ূন। হেসে নিজের ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছিল।
জীবনের শেষ বিকেলে হঠাৎ `কুড়িয়ে পাওয়া ধন`, আমার ভাইটির একটি একটি করে আঙ্গুল টিপে দিতে থাকি আমি। এই বাক্যটা লিখতে গিয়ে ওর সেই হাতের উষ্ণতা এখনো যেন টের পাচ্ছি। চোখের সামনে ভাসে, একটা আঙ্গুল শেষ হতে না হতেই আরেকটা বাড়িয়ে দিচ্ছে। হাত শেষ হয়ে গেলে খাটের ওপর একটু নাড়াচাড়া করে এগিয়ে দেয় পা।
সেদিন হুমায়ূনকে ক্লান্ত দেখালেও কেমন প্রশান্ত লাগছিল। দুপুরে তাকে semi-solid খাবার দিয়েছিল। কিন্তু কিছুই মুখে দিতে চায় না। আমি জোর করে চামচ দিয়ে একটু কমলা-জেলো খাওয়াতে চেষ্টা করলাম। তিন চার চামচ খাবার পরেই আর খেতে চায় না।
জিজ্ঞেস করি, কেমন লাগল?
অতি স্বভাবিকভাবে হুমায়ূন বলল, `গুয়ের মতো।`
আমি হেসে বলি, `আপনি কি কখনো গু খেয়ে দেখেছেন কেমন খেতে?`
হুমায়ূন হাসে।
আমি ওর আঙ্গুল টিপে দিই।

গত ২১ বছর ধরে নিউইয়র্কের মুক্তধারার বইমেলার সঙ্গে আমরা সম্পৃক্ত। অথচ এবার মেলা নিউইয়র্কে হওয়া সত্ত্বেও তিন দিনের ভেতর মাত্র একদিন মানে প্রথম দিন রাতে ঘণ্টা দুয়েকের জন্য আমি গিয়েছিলাম সেখানে। তাও আমার শিক্ষক, বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক, এবারের বইমেলার প্রধান অতিথি শামসুজ্জামান খানের ফোন পেয়ে। জ্যোতিকে একা দেখে তিনি আমার কথা জানতে চেয়েছিলেন এবং ফোন করেছিলেন। স্যারের কথায় শুক্রবার রাতে, মানে ২৯ জুন, বইমেলায় গিয়েছিলাম কিছুক্ষণের জন্য। প্রোগ্রাম অনুযায়ী এবার মেলার দ্বিতীয় দিনে হুমায়ূনকে সম্মাননা দেয়ার কথা ছিল। বইমেলার পক্ষ থেকে হুমায়ূনকে অনেক আগেই জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, `কার হাত থেকে সম্মাননা গ্রহণ করতে চান আপনি?` উত্তরে হুমায়ূন নাকি বলেছিল, `পূরবীর হাত থেকে।` সেই অনুযায়ী-ই প্রোগ্রাম ছাপা হয়েছিল। কিন্তু সেই ৩০ জুন, বইমেলার দ্বিতীয় দিনে, মেলায় নয়, প্রায় সবটা সময়েই আমি ছিলাম হুমায়ূনের পাশে বেলভিউতে। সার্জারি বিভাগের ওঈট তে। কিন্তু Show Must Go On. অতএব, বইমেলার মঞ্চে সেই নির্দিষ্ট সম্মাননা পর্বে হুমায়ূন ও আমার অনুপস্থিতিতে জ্যোতি মঞ্চে গিয়ে বলেছিল হুমায়ূনকে সম্মাননা দেয়ার জন্য পূরবীর হাতে সম্মাননা সনদখানি সে পেঁৗছে দেবে।
১ জুলাই রোববার। কেউ জাগার আগে খুব ভোরে আমি ও শাওন হাসপাতালে চলে আসি। বাংলাদেশ মিশন থেকে গত কয়দিন ধরে হাসপাতালে আসা যাওয়ার জন্য চাইলে গাড়িতে রাইড পাওয়া যাচ্ছিল (অবশ্য যদি সেই মুহূর্তে খালি গাড়ি থাকে মিশনে, তবেই)। বাংলাদেশ সরকারের অনারারি সিনিয়র পরামর্শক হিসেবে হুমায়ূন নিয়োগ পাওয়ার পরে এইটিই হয়তো প্রথম কোন সুবিধা নেয়া। সেই সাতসকালে মিশনের গাড়িতেই হুমায়ূনের বাসা থেকে হাসপাতালে আসি আমরা। এত সকালে আসি যাতে ডাক্তাররা রাউন্ডে বেরুনোর আগেই আমরা সেখানে পেঁৗছুতে পারি। ওঈট-এর লম্বা করিডোরের অন্য প্রান্ত থেকে হঠাৎ দেখি, শাওন আমি দুজনেই দেখি, হুমায়ূনের ঘরের সামনে কে একজন দাঁড়িয়ে কাচের দেয়াল দিয়ে ভেতরে উঁকিঝুঁকি মারছে। হাসপাতালের কোন কর্মী এটা করবে না। আমরা দ্রুত কাছে ছুটে যাই। গিয়ে দেখি, সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন জাতিসংঘে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আবদুল মোমেন। এত ভোরে এভাবে এসে হুমায়ূনকে দেখছেন রাষ্ট্রদূত, এতে একটু বিস্মিত হয়েছি বৈকি? হঠাৎ মনে পড়ে, গতকাল বিকেলে শহরে একটা গুজব উঠেছিল, হুমায়ূন আহমেদ মারা গেছেন। বইমেলায় উত্তেজনা, ও হৈচৈ শুরু হওয়ার আগেই আসল সত্যটা জেনে গেছে সবাই। কেননা, আমরা শাওনসহ আমরা কয়েকজন ততক্ষণ হাসপাতালে ছিলাম।

২ জুলাই। সোমবার। রাউন্ডে আসা ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলার জন্য ভোর হতে না হতেই আবারও হাসপাতালে চলে এসেছি আমি ও শাওন। সকাল সাড়ে ৬টা তখন। আরও কিছুক্ষণ পরে Critical Care Unit এর প্রধানের সঙ্গে নতুন শিক্ষা বছরের ৯-১০ জন তরুণ ইন্টার্ন রেসিডেন্ট এসে উপস্থিত। তারা ঘুরে ঘুরে প্রতিটি রুমে গিয়ে রোগী দেখে তাদের অবস্থা নিয়ে রুমের বাইরে এসে হলওয়েতে দাঁড়িয়ে আলোচনা করেন। আগের দিন হুমায়ূনকে বলা হয়েছিল আজ সকালে তার মুখ থেকে পাইপটা খুলে দেবে, ওই পাইপের জন্য সে কথা বলতে পারে না। প্রচন্ড অস্বস্তি। আজ ভোরেও যখন আমরা ওকে দেখতে গিয়েছিলাম, শাওনকে কাগজে লিখে জিজ্ঞেস করেছে হুমায়ূন কবে খুলবে তার মুখের নল। শাওন বলেছে কিছুক্ষণ পর, হুমায়ূন আবার লিখে জানতে চায় `কয় ঘণ্টা পর?` কিন্তু সে বা আমরা কেউ তখনো জানি না যে গতকাল আবার বমি করেছিল হুমায়ূন এবং কিছুটা বমি আগের বারের মতো ফুসফুসে ঢুকে গেলে ফুসফুসের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ হয়ে পড়েছে। হুমায়ূন এখন ১০০% সাপোর্ট নিচ্ছে ভেন্টিলেটরের। ডাক্তারের দল অবশেষে হুমায়ূনের রুমে ঢোকেন। ইউনিট প্রধান হুমায়ূনের কাছে এসে বলেন, `আমি জানি তুমি খুব অপেক্ষা করে আছ তোমার মুখের পাইপটা খোলার জন্য। কিন্তু, আজ নয়, কাল নয়, পরশু-ও নয়। তোমাকে আর একটু ধৈর্য ধরতে হবে।` বড় বড় চোখ মেলে শুধু তাকিয়ে থাকে হুমায়ূন। ডাক্তার বলতে থাকেন তার বমির কথা। সেটা যে কতখানি ক্ষতি করেছে তার ফুসফুসের! বাইরে এসে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলাম, বমি ঢুকে গেলে যদি এতই ক্ষতি হয় ফুসফুসের এমন কিছু কেন আপনারা করেন না যাতে বমি ভেতরে শ্বাস নালিতে চলে যেতে না পারে। কারণ এ ধরনের সার্জিক্যাল রোগীদের জন্য বমি করাটাতো খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। তাছাড়া শোয়া অবস্থায় বমি করলে কিছুটা তো ভেতরে চলেই যেতে পারে শ্বাসনালিতে। ডাক্তার আমাকে বোঝাতে চেষ্টা করেন সেই জন্যই মুখের টিউবের পেছনে একটা বেলুনের মতো থাকে যাতে বমি ভেতরে না গিয়ে বাইরে ফিরে আসে। কিন্তু সেটা ১০০% বমিতো সবসময় আটকাতে পারে না! গলাকে আর যা-ই হোক একেবারে সিল তো করে দেয়া যায় না! তাই না? তবে আজ আরেকটা বেলুনের মতো জিনিস বসানো হয়েছে মুখের ধারে বাইরে, যাতে এমন আর না হয়। ডাক্তাররা তখন হুমায়ূনের রুমের বদ্ধ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে হুমায়ূনের অসুস্থতা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করেন। শুনতে পাই ARDS শব্দটা বহুবার উচ্চারিত হতে। Acute Respiratory Distress Syndrome বা ARDS অনেক ইন্টার্ন ও রেসিডেন্ট-ই হুমায়ূনের ARDS হয়েছে বলে সন্দেহ করেন। শাওন ও আমি পরে ইন্টারনেটে ARDS সম্পর্কে পড়ে দেখেছি, যদিও এটা বিশেষ কোন অসুখ নয়, এটি অনেকগুলো মারাত্মক উপসর্গের সমাহার। খুবই জটিল ও সিরিয়াস মেডিকেল সমস্যা। ARDS Syndrome-এর ভয়াবহতার কথা জানতে পেরে আমরা বিমর্ষ হয়ে পড়ি। রাতে আবার একা একা ইন্টারনেট ঘাঁটতে গিয়ে জানতে পাই অন্য আরও কারণের মধ্যে ফুসফুসে বমি চলে যাওয়া সত্যি একটা বড় কারণ অজউঝ-এর। তার ওপর দীর্ঘদিন ধরে প্রচুর পরিমাণে সিগারেট খাওয়ার (নিউইয়র্কে আসার পরে সিগারেট বন্ধ করেছে হুমায়ূন) কারণে ওর ফুসফুসের সাধারণ অবস্থা খুব ভালো ছিল না। তার ওপর ফুসফুসে এখন তো সংক্রমণও রয়েছে। এক্স-রেতে দেখা গেছে ফুসফুসের বাইরের পর্দায় জল জমেছে। তাই সব মিলিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাসে এত কষ্ট। হার্ট রেটও সেই কারণেই বেশি।
এর কয়েক দিন আগে হুমায়ূন যেদিন বমি করে, আমি ও শাওন কাছেই ছিলাম। ছিল নার্স, সে ডেকে এনেছিল আরও কয়েকজনকে। কিন্তু তবু নাকি কিছুটা বমি চলে-ই গিয়েছিল ফুসফুসে। বমি করার ঠিক আগে বিছানায় এক পাশে বসা শাওনকে হাতের আঙ্গুল দিয়ে মুখের কাছে কী দেখাচ্ছিল হুমায়ূন। আমাকে একদিন এরকম দেখানোতে আমি একগাদা চৌকো গজ এর টুকরো মুখের কাছে ধরেছিলাম। হুমায়ূন একটু থুথু ফেলে মুখটা পরিষ্কার করেছিল। আমি শাওনের হাতে অনেকগুলো গজ কাপড় তুলে দিলে ও সেগুলো ওর মুখের কাছে ধরতে না ধরতেই সে গল গল করে বমি করে দেয়। শাওন প্রথমে ভেবেছিল হুমায়ূন কিছু লেখার কথা ভাবছে, তাই কাগজ কলম নিয়ে আসছিল সে। হুমায়ূন যখন বমি করে দেয়, তখনো শাওনের বাঁ হাতে কাগজকলম, ডান হাতে গজ-ক্লথ। সে কাছে গিয়ে হুমায়ূনকে পরিষ্কার করার চেষ্টা করার আগেই ঘরের অন্য প্রান্ত থেকে নার্স ছুটে আসে। শাওনকে সরিয়ে দিয়ে আরও সাহায্যের জন্য ডাক দিয়ে নার্স নিজেই হুমায়ূনের মাথাটি সোজা করে ধরে তার মুখ, নল পরিষ্কার করতে শুরু করে। অন্য এক নার্স ও নার্সেস এইডের সঙ্গে স্বয়ং ডাক্তারও ছুটে আসেন ঘরে। সবাই মিলে হুমায়ূনকে পরিষ্কার করতে শুরু করেন তারা। ওদের এত ছোটাছুটি ও কর্মব্যস্ততা দেখে আমার মনে হয়েছিল সাধারণ বমি করা এটা নয়।
ওয়েটিং রুমে বসে থাকতে থাকতে আমরা পালা করে মাঝে মাঝে হুমায়ূনকে দেখে যাই। সেদিন সকালবেলায় ডাক্তার যেহেতু বলে গেছেন আগামী দুতিন দিনের ভেতর টিউব খোলা হবে না মুখ থেকে, আমরা জানতাম সে খুব বিমর্ষ হয়ে পড়বে। আমি কাচের দেয়ালের বাইরে থেকে তাকে দেখে ফিরে যাব ভেবে তার ঘরের সামনে আসতেই থমকে দাঁড়াই। দেয়ালের ওপারে ঘরের ভেতর খাটে শুয়ে ছিল হুমায়ূন। হঠাৎ আমি দেখি হুমায়ূন তার দুই হাত দিয়ে তার শরীর থেকে তার সকল নল তার-টার সব খুলে ফেলার চেষ্টা করছে। অথচ মাত্র কিছুক্ষণ আগে আমরা যখন এখান থেকে যাই, সে গভীরভাবে ঘুমুচ্ছিল। দুদিন আগে ঠিক একই কাজ করেছিল সে। সব কিছু খুলে-ঠুলে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিল। শাওন সেই গভীর রাতে তারই ঘরে ছিল তখন। চেয়ারে বসে বসে ঘুমানোর চেষ্টা করছিল। হুমায়ূনের সেই আকস্মিক কা- দেখে তাকে থামাতে চেষ্টা করতে করতে সে চিৎকার শুরু করে। ডাক্তার নার্স ছুটে এসে সকলে মিলে হুমায়ূনকে শান্ত করে। তারপর ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। শাওন আর বাকি রাত ঘুমুতে পারেনি।
আজ সকালেই ডাক্তার বলে গেলেন হুমায়ূন ১০০% সাপোর্ট পাচ্ছে ভেন্টিলেটর থেকে। এই অবস্থায় টিউব খুলে ফেললে কী হবে ভাবা যায় না। আমি ডাক্তার-নার্সদের ডাকতে থাকি। নার্সেস স্টেশনে দেখি কেউ নেই, অন্য রোগীর কাছে গেছে হয়তো। হুমায়ূনের ঘরের ভেতরে লাল আলো জ্বলতে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে নার্সেস স্টেশনেও। হুমায়ূনের ঘরের দরজার বাইরে ট্রলিতে রাখা গাউন থেকে একটা নিয়ে কোনমতে গায়ে চাপিয়ে ঘরে ঢুকি। তখনো তাকিয়ে তাকিয়ে দুহাত দিয়ে সব কিছু খোলার চেষ্টা করছে হুমায়ূন। আমি হুমায়ূনের খাটের পাশে দাঁড়িয়ে তাকে অনুনয় করতে থাকি, হুমায়ূন, ভাই আমার, প্লিজ ওগুলো খুলবেন না। হুমায়ূন এটা করে না। থামুন। প্লিজ। এগুলো খুললে খুব খারাপ হবে। থামুন। আর আশ্চর্য। আমার দিকে ফিরে না তাকালেও নব্বই ডিগ্রি কোণ করে শূন্যে উত্থিত তার হাত দুটো হঠাৎ নিশ্চল হয়ে পড়ে। আমি ছুটে বাইরে আসি, আশ্চর্য, নার্সকে তখনো দেখতে পাই না। নার্সেস স্টেশন ফাঁকা। করিডোরের উল্টো পাশের কাচের ঘরের ভেতর বসে সব ডাক্তাররা মিটিং করছেন। আমি সোজা সেই ঘরে ঢুকে পড়ি। তাদের বলি, কী ঘটছিল এক মিনিট আগে ওপাশের রুমে। ডাক্তাররা সকলে তখন মিটিং ফেলে হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসেন ঘর থেকে। তাদের ঘরের দরজা থেকেই তারা এবং আমি সকলেই সবিস্ময়ে দেখতে পাই হুমায়ূন আমার কথা না রেখে আবার তার টিউব-নল সব খুলে ফেলার চেষ্টা করছে। ডাক্তাররা কয়েকজন হুমায়ূনের রুমের দিকে ছুটে গিয়ে তাকে অনেক কষ্ট করে থামালেন। পরে লক্ষ্য করেছি, হুমায়ূনের দুই হাতের নিচে লম্বা কাঠের পাত দিয়ে প্লাস্টারের মতো করে বেঁধে দিয়েছেন তারা যাতে সে হাত দিয়ে নাক বা মুখের টিউব খুলে ফেলতে না পারে। অন্য অনেক রোগীর মতো ওর হাত দুটো খাটের সঙ্গে বেঁধে রাখার কথা তারা চিন্তা করেননি কেননা তাতে হুমায়ূন আরও উত্তেজিত ও ক্রুদ্ধ হয়ে উঠবে, এটা তারা বুঝতে পেরেছিলেন।

আমরা কাল ফিরে যাব ডেনভারে। কাল মানে জুলাইর ৩ তারিখে। এসেছিলাম জুনের ১১ তারিখে। অনেক আশা আর আনন্দ নিয়ে এসেছিলাম এবার। পরের দিনের সার্জারি যদি সফল হয়, কে জানে, হয়তো হুমায়ূন এ যাত্রায় মরণব্যাধিকে জয় করে সুস্থ হয়ে উঠবে। পরে ভবিষ্যতে কী হবে আমরা কেউ তা জানি না। কিন্তু এই মুহূর্তে একমাত্র সার্জারির সফলতাই তাকে ক্যান্সারমুক্ত করতে পারে। কেননা কিমোথেরাপিতে আর নতুন করে কোন সুফল পাওয়া যাচ্ছিল না। অথচ, কাল হুমায়ূনের এমন শারীরিক অবস্থায় ওকে হাসপাতালে রেখে আমরা ফিরে যাচ্ছি। যেটা করতে খুবই অস্বস্তি বোধ করছি, কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু উপায় নেই। আমরা ৩ তারিখে চলে আসব সেই সময়সূচি পেয়েই আটলান্টা থেকে আমাদের বন্ধু খালেদ হায়দার ও তার স্ত্রী শেলী প্লেনের টিকিট কেটেছে আমাদের বাড়িতে ডেনভারে ৪ জুলাই বেড়াতে আসবে বলে।

গতকাল দুপুরে মাজহার একটি জরুরি কথা বলেছে, যেটা আমার খুব মনে ধরেছে। মাজহার বলল, যাওয়ার আগে আমি যদি একবার ডাক্তার মিলারের সঙ্গে দেখা করে যেতাম! একটা বিষয় নিয়ে কিছুক্ষণ আগেই আমরা কথা বলছিলাম। আমাদের মনে হয়েছিল হুমায়ূনের একটার পর একটা জরুরি অবস্থা হওয়ায় ICU টিম (Critical care unit) প্রতিটি জরুরি অবস্থাকে ভিন্ন ভিন্নভাবে মোকাবিলা করার চেষ্টা করছে। যখন যেটা দরকার সেটাই যেন সামাল দিচ্ছে। কিন্তু তাদের long term plan কী বুঝতে পারছি না। ডাক্তারদের জিজ্ঞেস করলে বলেন, এই জরুরি অবস্থাটা আগে Stable হোক তো!। তাই মাজহার বলল, `পূরবীদি, আপনি চলে যাওয়ার আগে একবার ডাক্তার মিলারের সঙ্গে দেখা করে তাকে আমাদের সবার দুশ্চিন্তার কথা, আমাদের আশঙ্কার কথা বলুন। তাছাড়া আবার যে স্যারকে এখানে ভর্তি করানো হয়েছে, সার্জারি করা হয়েছে, এ ব্যাপারেও তার সঙ্গে কথা বলা দরকার যদিও সেই সার্জিক্যাল টিমে তিনি ছিলেন না। আপনি যাবার আগে অবশ্যই ডাক্তার মিলারের সঙ্গে একবার কথা বলে যান।` এটা যে কত বড় সুপরামর্শ ছিল তা বলার নয়। সেই পরিকল্পনা অনুসারে গতকাল রাতে ডিউটিরত ডাক্তারকে বিশেষভাবে আমরা বলে গিয়েছিলাম আজ ডাক্তার মিলারের সঙ্গে আমাদের দেখা করা চাই-ই চাই। ডাক্তার সেটা হুমায়ূনের ফাইলে বড় করে লিখে রাখেন। শাওন আমাকে দেখিয়ে বলে, হুমায়ূনের বোন। পরশু ভোরে ফিরে যাবে ডেনভার। ফলে কাল দেখা করতেই হবে ডাক্তার মিলারের সঙ্গে। কিন্তু আমার যে একবার রক্ল্যান্ডের বাড়িতে যাওয়া একান্তই দরকার ছিল!
পরদিন দুপুরের পরে ডাক্তার মিলার সত্যি সাত্যি এলেন আমাদের সঙ্গে দেখা করতে। ডাক্তার মিলার যে খুব বড় একজন ডাক্তার এবং সকলেই যে তাকে খুব সমীহ করে, তার নজির পেলাম, তিনি যখন হুমায়ূনকে দেখার পরে আমাদের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা পোষণ করেন। আমরা তখন ওয়েটিং রুমে। দেখলাম, চারদিকে কেমন ছোটাছুটি সন্ত্রস্ত ভাব। একে অপরকে বলছে, ডাক্তার মিলার এসেছেন ফ্লোরে। এমন অবস্থায় এক নার্স এসে ওই ফ্লোরের কনফারেন্স রুমের দরজা খুলে দিল আমাদের নিশ্চিন্তে এবং একান্তে বসে ডাক্তার মিলারের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ করে দিতে। আমরা, মানে আমি, শাওন, ফান্সু ও ডাক্তার মিলার কনফারেন্স রুমে ঢুকলাম। প্রথমে পরিচয় পর্বের শুরুতেই শাওন আমাকে হুমায়ূনের বড়বোন বলে পরিচয় করিয়ে দিল। জানালো, আগামীকালই আমি চলে যাচ্ছি। তবে প্রয়োজন হলে আমিই সাধারণত ডাক্তারদের সঙ্গে হুমায়ূনের ব্যাপারে কথা বলি এবং বাকি পরিবারের সদস্যদের জানাই। প্রথমে ডাক্তার বর্ণনা করলেন হুমায়ূনের কী শারীরিক অবস্থা ছিল যখন সে প্রথম আমেরিকায় আসে। এখানে আসার পর কিমোথেরাপি নিয়ে কতখানি উন্নতি হয়েছিল। তারপর যে সার্জারি করা হলো, সেটাও কী রকম সফল হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তার কোলন থেকে পরে `লিক (leak) করতে শুরু করে। ফলে ইমার্জেন্সি সার্জারি করে সেই লিক ঠিক করা হয়েছে। পেটের ক্যাভিটি থেকে সব গ্যাস, পানি বের করে ফেলা হয়েছে। তাকে তিনটি ব্রড স্পেকট্রাম এন্টিবায়োটিক এবং ফ্লাজিল দেয়া হচ্ছে। তার ফুসফুসে সংক্রমণ হয়েছে যা সম্ভবত পেটের সংক্রমণ থেকে এসেছে। তার ওপর বমি ঢুকে যাওয়ার জন্য ফুসফুসে infiltration    হয়েছে। এছাড়া ফুসফুসের বাইরের দেয়ালে জল জমে যাওয়ায় তার ফুসফুসের কর্মক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে মারাত্মকভাবে। এই সব কিছুর ওপরে আছে তার ডায়েবেটিস, হৃৎপিণ্ডের ভাল্বের সমস্যা, করোনারি বাইপাস সার্জারির পরও হৃৎপিণ্ডে রক্ত চলাচলের কিছু অসুবিধে, দীর্ঘদিন কিমোথেরাপি দেয়ার জন্য তার রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা হ্রাস ইত্যাদি। এ ধরনের সব অতিরিক্ত জটিলতা ও risk factor মিলে তার অবস্থা একটু ক্রিটিকেল হয়ে উঠেছে। তবে ডাক্তার মিলার খুবই আশাবাদী। তিনি মনে করেন, এসব কিছু অতিক্রম করে ভালো হয়ে উঠবে হুমায়ূন। তবে সময় লাগবে। শাওনকে দেখিয়ে ডাক্তার বললেন, আমাদের রোগীর বয়স যদি তোমার মতো হতো, যদি অন্য কোন অসুখ না থাকত সঙ্গে, আরও নিশ্চিন্তভাবে আরও জোর দিয়ে আমি বলতে পারতাম। কিন্তু সব কিছু বিবেচনা করেও বলছি সে ভালো হয়ে যাবে, এটাই আমার বিশ্বাস। তখন শাওন হুমায়ূনের তার-টিউব-নল সব কিছু খুলে ফেলার প্রচেষ্টার কথা জানিয়ে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করল একজন নার্স শুধু হুমায়ূনের জন্য ফবফরপধঃব করে দেয়া যায় কিনা। ডাক্তার বললেন, ওঈট তে প্রতি দুজন রোগীর জন্য একজন নার্স। এর বেশি আর সম্ভব নয়। তবে তিনি একজন স্বাস্থ্যকর্মীকে বাকি সময় রোগীর দরজার বাইরে বসিয়ে রাখার চেষ্টা করতে পারেন শুধু রোগীর কাজ কারবার লক্ষ্য করার জন্য। শাওন ডাক্তারকে ধন্যবাদ দিয়ে জানালো তার দুটি ছোট ছোট বাচ্চা আছে বলে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও প্রতি রাতে সে এখানে থাকতে পারে না। ডাক্তার জানতে চাইলেন, তাদের বয়স কত? ফান্সু বললেন, এক ও পাঁচ। শুনেই ডাক্তার মিলার সঙ্গে সঙ্গে মাথা নিচু করলেন, একটু পরে আমরা সবাই দেখি, ডাক্তারের চোখ দিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি পড়ছে তার গাঢ় প্যান্টের ওপর। মুখ তুলে যখন তাকালেন তার সমস্ত মুখমণ্ডল ও চোখ লাল। টিস্যু দিয়ে চোখ-মুখ মুছতে শুরু করেন ডাক্তার মিলার। তিনি তার এই অনিয়ন্ত্রিত আচরণে বেশ অপ্রস্তুত, দেখেই বোঝা যায়। আমি আজ পর্যন্ত কোন ডাক্তারকে কারও সামনে কখনো কাঁদতে দেখিনি। আমার বাবা যে এত আবেগপ্রবণ ডাক্তার ছিলেন, তাকেও নয়। জিজ্ঞেস করলাম, আপনার নিশ্চয়ই বাচ্চা আছে?
ঘাড় নেড়ে শুধু সম্মতি জানান ডাক্তার। প্রায় অস্পষ্ট স্বরে বলেন, `ওকে বাঁচাতেই হবে।`
আমি খুব বিনীতভাবে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করি তখন, প্রথমবারে হুমায়ূনকে কোলেস্টমি কেন করা হলো না?
ডাক্তার মিলার উত্তরে বলেন,`I wish I had a crystal ball. But I did not have one`. তিনি বললেন আজকাল অধিকাংশ কোলন সার্জারির জন্য কোলেস্টমি করা হয় না। ডাক্তার বলেন, `এ ধরনের সার্জারির পরে শতকরা ৫% এরও কম মানুষের লিক বা ওই জাতীয় জটিলতা দেখা দেয়। দুর্ভাগ্যবশত, সেই ৫% এর মধ্যে হুমায়ূন পড়ে গেছেন।`
ডাক্তার মিলার তার একখানা কার্ড বের করে আমায় দিলেন। কার্ডের ওপর কলম বের করে নিজের হাতে তিনি তার মোবাইল নম্বরটা লিখে দিলেন। বললেন দিনে রাত্রে ২৪ ঘণ্টা (২৪/৭) যখন ইচ্ছা আমাকে ফোন করতে পার।` শাওন, ফান্সুর দিকে তাকিয়ে বলেন, `তোমরাও।`
আমি আবারও জিজ্ঞেস করলাম, ICU থেকে বের করার পর এত তাড়াতাড়ি কেন ছেড়ে দেয়া হলো তাকে? আরও দুদিন রাখলে কী ক্ষতি হতো?
ডাক্তার বললেন, এটাই স্টান্ডার্ড প্রোসেডিউর। জটিলতা না থাকলে এক সপ্তাহের বেশি রোগীকে সাধারণত রাখা হয় না।
ডাক্তার মিলারের হস্তক্ষেপের ফলে সেদিন থেকে সব কিছু দ্রুত নড়তে শুরু করল। যে পদ্ধতি প্রয়োগ করে ফুসফুসের পানি বের করে আনা হবে বলছিলেন তারা কয়েকদিন ধরে, তা আজ ডাক্তার মিলারের সহকর্মীরা ৪৫ মিনিটের মধ্যেই করে ফেললেন। প্রায় ৬৫০ মি.লি. পানি বের করলেন তারা শুধু একটি ফুসফুস থেকে, হুমায়ূনের রুমের ভেতরেই, তার খাটে শায়িত অবস্থাতেই। কেবল বন্ধ কাচের ঘরের ভেতর আব্রু রক্ষার্থে বাইরের দিকের মোটা পর্দাটা টেনে দেয়া হয়েছিল প্রায় আধ ঘণ্টার জন্য। যারা কাজটি করলেন, তাদের একজন কালো নারী ডাক্তার, আরেকজন ক্রাচে ভর করা অল্প বয়সী এক সাদা পুরুষ ডাক্তার। শেষোক্ত সার্জন ঠাট্টা করে বলেন, `৬৫০ সিসি মানে এক ক্যান কোকাকোলা বের করে এনেছি।` ওরা মন্তব্য করেন, অনেক আরাম পাবে এখন। নি:শ্বাস সহজ হবে। এছাড়া ফুসফুসের ভেতর থেকে আপনাআপনি পানি বের হয়ে যাওয়ার জন্য একটি ড্রেইন টিউব বসিয়ে দিয়েছেন তারা ভেতর থেকে বাইরে পর্যন্ত।

পরের দিন ভোরে আমরা চলে আসি ডেনভার। সেই দিনই, আমরা চলে আসার কয়েক ঘণ্টা পরই, জাফর ইকবাল ও তার স্ত্রী ইয়াসমিন দেশ থেকে নিউইয়র্কে এলো হুমায়ূনকে দেখতে, তার শুশ্রূষা করতে। খুব অল্পের জন্য ওদের সঙ্গে দেখা হলো না আমাদের। অনেক বছর আগে ওরা যখন নিউজার্সিতে থাকত তখন থেকে আমরা জানি তাদের। সেদিন দেশ থেকে আরও এসেছিল শাওনের কনিষ্ঠা সহোদরা, সেঁজুতি, যাকে গত ডিসেম্বরে দেখেছি, হুমায়ূনদের সঙ্গে ডেনভারে, আমাদের বাড়িতে, যখন সবাই মিলে বেড়াতে এসেছিল ওরা। আমরা রকি মাউন্টেইন ন্যাশনাল পার্কে বেড়াতে গেছিলাম। সবাই মিলে।
এরপর প্রতিদিন (শনি ও রোববারসহ) ভোর ৬টায় উঠে ডাক্তার মিলারের সঙ্গে কথা হতো বা টেক্সট মেসেজ আদানপ্রদান হতো আমার হুমায়ূনের ব্যাপারে। আর হুমায়ুনের যেটুকু সংবাদ পেতাম, আমি তৎক্ষণাৎ তা নিউইয়র্কে তার স্বজনদের ফোন করে অথবা টেক্সট মেসেজে পাঠিয়ে দিতাম। এরপর একের পর এক ঘটনা ঘটতে থাকে। এমনিতে হুমায়ূনের ডায়াবেটিস, হৃৎপিণ্ডের ভাল্বের সমস্যা তো ছিল-ই, ওর বাইপাস সার্জারিও পুরোটা করা সম্ভব হয়নি সিঙ্গাপুরে রক্তনালীর অবস্থা খুব ভালো না থাকায়। দীর্ঘদিন ধরে প্রচুর পরিমাণে সিগারেটি খাওয়ার ফলে ফুসফুসের ধারণ ক্ষমতাও খুব বেশি ভালো ছিল না। তার ওপর স্টেজ ফোর ক্যান্সার ও ক্যান্সারের জন্য ১২টি কিমো নেয়া। রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা অনেকটাই কমে গিয়েছিল তার। ফলে অতি সহজেই সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয় সে। একটার পর একটা জটিলতায় জড়িয়ে পড়ে তার অস্ত্রোপচার পরবর্তী নাজুক শরীর। আগে তাকে ইন্ট্রাভেনাস খাবার দেয়া হতো। পরে পাইপ দিয়ে পাকস্থলীতে সরাসরি খাওয়ানো শুরু হয়। এর ভেতর হুমায়ূনের আরও একটি অস্ত্রোপচার হয়। সেটা হয়, কেননা দ্বিতীয়বার অস্ত্রোপচারের পরে তার পেটের মাঝখান দিয়ে যে কাটা হয়েছিল সেটা ঠিকমতো জোড়া লাগছিল না। জোড়া লাগবার পরিবর্তে ক্ষতের দুধারেই স্কার টিস্যু তৈরি হয়ে মাঝখানের কাটা জায়গাটাকে আস্তে আস্তে ফাঁক করে দিচ্ছিল। ফলে আরেকটি অপারেশন করে স্কার টিস্যুগুলো পরিষ্কার করে ফেলে দিয়ে চামড়ার নিচে ম্যাশ বসিয়ে দুদিক একত্র করে কাটা জায়গাটি জোড়া লাগাবার প্রচলিত পদ্ধতিই ব্যবহার করা হয়েছিল। এটা করার আগে পেটের ভেতরের এবসেস, পুঁজ, পানি সব পরিষ্কার করে ফেলে দেয়া হয়েছিল। হুমায়ূনের ডায়েবেটিক শরীর ঘা শুকানোর জন্য অনুকূল ছিল না। কিডনির জন্যও নয়। তারপর এন্টিবায়োটিক চলা সত্ত্বেও তার শরীরে প্রচন্ড ইনফেকশন থাকার কারণে এক পর্যায়ে কিডনি দুটোও অকেজো হয়ে পড়ে। ডায়ালাইসিসে দিতে হয় তাকে। আরও পরে ট্রাকিওটমিও করা হয় যদি তাতে একটু আরাম পায় রোগী শ্বাস-প্রশ্বাসে। সাদা রক্তকণার সংখ্যা (সংক্রামক রোগের উপস্থিতির লক্ষণ) বাড়তে বাড়তে ৩০,০০০ হয়ে যায়, আবার মাঝে মধ্যে একটু কমে, আবার একদিন খুব বাড়ে, পরের দিন একটু কমে। অবশেষে রক্তেও যখন সংক্রমণ বিস্তার করে, সেপসিসের লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করে। একটি সময় আসে যখন রক্তের চাপ (বস্নাড প্রেসার) কিছুতেই আর যথেষ্ট ওপরে তুলে রাখা যাচ্ছিল না_ সেলাইনের সঙ্গে এপিনেফ্রিন, ভেসোপ্রেসিনের সম্ভবপর সর্বোচ্চ ডোজ দিয়েও নয়। বস্নাড প্রেসার উঠাতে গিয়ে হৃৎপিণ্ডের ওপর প্রচন্ড চাপ পড়ছিল। অক্সিজেন স্যাচুরেশনের জন্য ভেন্টিলেটরের সাহায্যের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে হয় (যেমন, ৫০% থেকে ১০০%)। এভাবে হুমায়ূনের শারীরিক অবস্থা ক্রমান্বয়ে খারাপের দিকে যেতে থাকে। তবে এরই মাঝে আবার কোন কোন দিন ভাইটাল সাইনগুলো হঠাৎ করে স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরে আসে। অনেক স্বাভাবিক ও সংহত মনে হয় ওর অবস্থা। যেমন হয়েছিল মৃত্যুর আগের দিনও। ডাক্তার মিলার খুশি হয়েছিলেন ওকে `stable` দেখে। জুলাই ১৮ তারিখে সকাল ৮টা নয় মিনিটে (নিউইয়র্ক সময় সকাল ১০টা নয়) করা টেক্সট মেসেজে ডাক্তার মিলার আমাকে জানালেন সেকথা। সেইসঙ্গে লিখলেন, হুমায়ূনের `শারীরিক অবস্থা আগের চেয়ে একটু ভালো`। সঙ্গে সঙ্গে মেসেজটি শাওন ও জাফর ইকবালের কাছে ফরোয়ার্ড করি এবং ফোনেও কথা বলি ওদের সঙ্গে।

অবশেষে এল ১৯ জুলাই।। সেদিন খুব ভোরে ডাক্তার মিলার নিজেই আমাকে মেসেজ পাঠালেন, আমি তাকে ফোন করার আগেই। হুমায়ূনের অবস্থা ভালো নয়, ব্লাড প্রেসার ঠিক রাখা যাচ্ছে না। নিউইয়র্কে হুমায়ূনের স্বজনদের খবরটা দিলাম। পরে আস্তে আস্তে হাসপাতাল থেকে একে একে ফোন পেতে শুরু করলাম। শাওনের, মাজহারের, ইয়াসমিনের, ডাক্তার মিলারের। একসময় ডাক্তার মিলার লিখলেন, `হুমায়ূনের অবস্থা খুব খারাপ। তার স্ত্রী ও আত্মীয়স্বজনরা তাকে ঘিরে চারপাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি ভীষণ দুঃখিত।` আমি লিখলাম, `এই কি তাহলে শেষ?` উত্তরে ডাক্তার মিলার লিখলেন, `May be, but we are still trying.` যে মুহূর্তে হুমায়ূন মারা যাচ্ছে, খুব সম্ভবত ইয়াসমিন কাঁদতে কাঁদতে আমায় দু-দুবার টেলিফোন করেছিল, `পূরবীদি, সব কিছু কমে যাচ্ছে, নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে, সব ড্রপ করছে। ফ্ল্যাট হয়ে যাচ্ছে সব, ব্লাড প্রেসার নেমে যাচ্ছে, এখন চলি্লশ, না তিরিশ,……। `ফোনের এপারে আমি আমার সেলুলারে ভেসে ওঠা নম্বরের দিকে না তাকিয়েই ওপারের নারীকণ্ঠকে শাওন ভেবে, বারবার কেবল তাকে ওই নামেই ডাকছিলাম। পরে দেখেছি, ওটা শাওনের নয়, জাফরের নম্বর ছিল। তার মানে ইয়াসমিন। ইয়াসমিন, আমায় তুমি ক্ষমা কর, ভাই। সেই মুহূর্তে আমি স্বাভাবিক ছিলাম না।
হুমায়ূন মারা যাওয়ার পরে অন্যদের মধ্যে জাফর ইকবাল ফোন করে আমায় সংবাদটা দেয় আমার মোবাইল ফোনের ভয়েস মেইলে। আমি তার আগেই সব টেলিফোন বন্ধ করে রেখেছিলাম। বলার মতো কোন কথা ছিল না আমার_ শোনার মতো ধৈর্য-ও নয়।

এরপর, সেদিনই ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে আরও কয়েকটি মেসেজ আমাকে পাঠিয়েছিলেন ডাক্তার মিলার। নিচে কেবল দুটোর উল্লেখ করলাম :
deepest condolence. I am terribly sorry. He had so much more to live for. I hope, u and the rest of the family will be able to take comfort in the great life that he lived which will inspire everyone for ever. 2:44 , Thur, July 19, 2012

`I feel awful that he won`t be able to see his young children grow but I am sure his wife and u will keep his influence on them. 2:46 PM. July 19, 2012 আমরা হুমায়ূনের মৃত্যুর কারণ কী ছিল জানতে চাইলে এক কথায় বলা শক্ত। সম্ভবত ARDS, sepsis, সেপ্টিক শক। এগুলো শুরু হয়েছিল যা থেকে সেগুলো হলো : বৃহদান্ত্রে (কোলনে) লিক, পেটের ভেতর সংক্রমণ, এবসেস, ফুসফুসের শ্লথ কার্যকারিতা, ফুসফুসে পানি জমা, পেটে-ফুসফুসে-রক্তে সংক্রমণ। অবশেষে শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা ও রক্তচাপ কমতে থাকা। সেগুলো জীবন ধারণের জন্য নিম্নতম পর্যায়ে বজায় রাখার চেষ্টা করতে গিয়েও হৃৎপিন্ডেরর ওপর প্রচন্ড ধকল এবং সবশেষে হৃৎপিন্ড থেমে যাওয়া। তবে প্লাস্টিকের চেয়ারটির পাগুলো কলাপ্স করা বা বসে যাওয়ার সঙ্গে এসবের যে কোন সংযোগ নেই তা একাধিক ডাক্তার ভিন্ন ভিন্নভাবে বলেছেন, যেমন, ডাক্তার মিলার, ডাক্তার শাহ্?, ডাক্তার ভিচ ও জ্যামাইকা হাসপাতালের ইমার্জেন্সি রুমে কর্তব্যরত ২২ জুনের সেই সার্জন (নামটা ভুলে গিয়েছি) যিনি হুমায়ূনের CT scan পড়ে আমাদের রিপোর্ট বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।
আগেই বলেছি হুমায়ূনের সঙ্গে আমাদের আগে তেমন জানাশোনা ছিল না। যদিও, আশ্চর্য, আমরা ধানমন্ডির একই রাস্তার ওপরে একেবারে মুখোমুখি দুটি দালানে বাস করেছি প্রায় তিন বছর। নব্বই-এর দশকের শেষ দিকে। গত নভেম্বরে ওর জন্মদিনে প্রকাশিত হুমায়ূনের লেখা `রংপেন্সিল` বইটি জ্যোতিকে আর আমাকে উৎসর্গ করতে গিয়ে হুমায়ূন লিখেছিল, `এদের সঙ্গে আগে কেন পরিচয় হলো না`। সব শেষ হয়ে গেলে আজ কেবল মনে হয়, পরিচয় যদি হয়েছিল-ই, এত তাড়াতাড়ি কেন চলে যেতে হলো তাকে?

সৌজন্য: দৈনিক সংবাদ

লিফোন বন্ধ করে রেখেছিলাম। বলার মতো কোন কথা ছিল না আমার_ শোনার মতো ধৈর্য-ও নয়।

এরপর, সেদিনই ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে আরও কয়েকটি মেসেজ আমাকে পাঠিয়েছিলেন ডাক্তার মিলার। নিচে কেবল দুটোর উল্লেখ করলাম :
deepest condolence. I am terribly sorry. He had so much more to live for. I hope, u and the rest of the family will be able to take comfort in the great life that he lived which will inspire everyone for ever. 2:44 , Thur, July 19, 2012

`I feel awful that he won`t be able to see his young children grow but I am sure his wife and u will keep his influence on them. 2:46 PM. July 19, 2012 আমরা হুমায়ূনের মৃত্যুর কারণ কী ছিল জানতে চাইলে এক কথায় বলা শক্ত। সম্ভবত ARDS, sepsis, সেপ্টিক শক। এগুলো শুরু হয়েছিল যা থেকে সেগুলো হলো : বৃহদান্ত্রে (কোলনে) লিক, পেটের ভেতর সংক্রমণ, এবসেস, ফুসফুসের শ্লথ কার্যকারিতা, ফুসফুসে পানি জমা, পেটে-ফুসফুসে-রক্তে সংক্রমণ। অবশেষে শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা ও রক্তচাপ কমতে থাকা। সেগুলো জীবন ধারণের জন্য নিম্নতম পর্যায়ে বজায় রাখার চেষ্টা করতে গিয়েও হৃৎপিন্ডেরর ওপর প্রচন্ড ধকল এবং সবশেষে হৃৎপিন্ড থেমে যাওয়া। তবে প্লাস্টিকের চেয়ারটির পাগুলো কলাপ্স করা বা বসে যাওয়ার সঙ্গে এসবের যে কোন সংযোগ নেই তা একাধিক ডাক্তার ভিন্ন ভিন্নভাবে বলেছেন, যেমন, ডাক্তার মিলার, ডাক্তার শাহ্?, ডাক্তার ভিচ ও জ্যামাইকা হাসপাতালের ইমার্জেন্সি রুমে কর্তব্যরত ২২ জুনের সেই সার্জন (নামটা ভুলে গিয়েছি) যিনি হুমায়ূনের CT scan পড়ে আমাদের রিপোর্ট বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।
আগেই বলেছি হুমায়ূনের সঙ্গে আমাদের আগে তেমন জানাশোনা ছিল না। যদিও, আশ্চর্য, আমরা ধানমন্ডির একই রাস্তার ওপরে একেবারে মুখোমুখি দুটি দালানে বাস করেছি প্রায় তিন বছর। নব্বই-এর দশকের শেষ দিকে। গত নভেম্বরে ওর জন্মদিনে প্রকাশিত হুমায়ূনের লেখা `রংপেন্সিল` বইটি জ্যোতিকে আর আমাকে উৎসর্গ করতে গিয়ে হুমায়ূন লিখেছিল, `এদের সঙ্গে আগে কেন পরিচয় হলো না`। সব শেষ হয়ে গেলে আজ কেবল মনে হয়, পরিচয় যদি হয়েছিল-ই, এত তাড়াতাড়ি কেন চলে যেতে হলো তাকে?

সৌজন্য: দৈনিক সংবাদ

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


You must be logged in to post a comment Login