নীল নক্ষত্র

যাযাবরের চিঠি

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

প্রিয় শফিক,
আশা করি ভাল আছিস। অনেক দিন যাবত তোর কোন চিঠি পাই না। জানি বারবার এত করে বলার পরেও তোদের গ্রামের বাড়ি না গিয়ে চলে এসেছি বলে রাগ করেছিস তাই না?আমি ঠিক বুঝতে পেরেছি। কিন্তু, আমি কেন যাইনি সে কথা এতো দিনেও বলি বলি করে বলা হয়নি। তুই যখন রাগ করে আমাকে ভুল বুঝে চুপ করে বসে আছিস তা হলে আজ বলি, দেখ চেষ্টা করে আমাকে ক্ষমা করতে পারিস কি না।

তোদের গ্রামে এমন এক জন আছে যার হবার কথা ছিল আমার অনেক কিছু অথচ সে এখন আমার কেউ না। এ কথা আমার বাবা মা, আমি আর আমার বাবার এক বন্ধু ছাড়া আর কেউ জানে না, আরো এক জন জানতেন তবে তিনি এখন এই পৃথিবীতে নেই। কি ভাবে যেন সব ওলট পালট হয়ে বিধাতার যা ইচ্ছা তাই হয়ে গেল। আচ্ছা, শুনেছিস কোথাও, যে নাকি বৌ হবে তাকে জন্মের পর প্রথম কোলে নিয়েছে কেউ?

আমার জীবনে ঠিক এমনি এক ঘটনা ঘটতে গিয়েও নিয়তির নিতান্ত অনিচ্ছা ছিল বলে আর হয়ে উঠেনি। আমার ছোট বেলা বিদেশে কেটেছে সে তুই জানিস। ওখানে একটা নাম করা হাসপাতালে আমার বাবার এক বন্ধু কালাম চাচার কণ্যা সন্তান জন্ম নেয়। চাচী অত্যন্ত অসুস্থ ছিল বলে আমার মা তাকে দেখা শুনা করছিল। মেয়ে হবার সংবাদ পেয়ে কালাম চাচা বাবা এবং আমাকে নিয়ে হাসপাতালে গেল। হাসপাতালে দেখি চাচির বিছানার পাশে দোলনায় ফুটফুটে এক মোমের পুতুল ঘুমাচ্ছে। পাশে আমার মা বসে। কিছুক্ষণ আগে নার্সরা দোলনায় দিয়ে গেছে এখনো কেউ কোলে নেয়নি। চাচির অবস্থা খুবই খারাপ। কে কেমন আছে কার কি অবস্থা এসব কথার মধ্যে সেই পুতুলের ঘুম ভেঙ্গে গেল, একটু কান্না করতে চাইল। আমি এগিয়ে দোলনার কাছে গেলাম আর চাচী আমাকে বলল নাও কোলে নাও। ওই বয়সে যতটা সাবধান হয়ে এমন নব জাতক কে কোলে নিতে হবে বুঝেছি ততটা সাবধানে আস্তে করে তুলে নিলাম। কি করি না করি সে ভয়ে মা এসে কাছে দাঁড়ালেন। চাচী ডান দিকে মুখ ফিরিয়ে আমার কোলে তার মেয়েকে দেখে রোগ ক্লিষ্ট মুখে একটু হেসে বলল তুমিই প্রথম কোলে নিলে বাবা, এটা তোমাকেই দিব। তখন চাচির এ কথার মানে বুঝিনি। এমনিতেই চাচী আমাকে খুব আদর করতেন। না, মেয়ের জামাই করবে এই আশা নিয়ে নয় কারণ তখন তাদের কোন বাচ্চাই ছিল না। বাসায় গেলেই ফ্রিজ খুলে যত রকমের খাবার আছে সব বের করে দিত। না খেলে সাঙ্ঘাতিক বকা বকি করত। আমি নাকি ছোট বেলায় খুব শান্ত সুবোধ আর একটু বোকা ধরনের ছিলাম।

চাচির কি যে একটা কঠিন অসুখ হয়েছিল নাম মনে নেই, এখনো মনে আছে শরতের স্নিগ্ধ জোসনার সাথে সিঁদুর মাখা মাখি হলে যেমন হয় তেমন ছিল চাচির গায়ের রঙ। পরে আস্তে আস্তে তার শরীরের নানা জায়গা নীল হয়ে যেতে দেখেছি। মাংশ পেশিতে পচন। সোনার পুতুলটাকে রেখে ওই রোগেই চাচী বছর খানিক পর মারা গেল।
স্বাভাবিক ভাবে পুতুলটার সব ভার এসে পরল আমার মায়ের উপর, নিজের কাছে এনে রাখলেন। এ ছাড়া আর কিছু করার ছিল না, বিদেশে কার কয় জন আত্মীয় থাকে?প্রথম মাস কয়েক চাচার অবস্থা প্রায় পাগলের মত, অফিস নেই খাওয়া নেই, কখন কোথায় যায় কি করে কিচ্ছু ঠিক ঠিকানা নেই। এ ভাবে প্রায় বছর খানিক পর অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে আমার মা বাবা পুতুল সহ চাচাকে দেশে পাঠিয়ে দিলেন লম্বা ছুটি নিয়ে। এই মেয়ের ভার কে নিবে?দেশে যাবার পর সবাই ভেবে চিন্তে মেয়ের কথা ভেবে চাচির মার পেটের ছোট বোনের সাথে আবার চাচার বিয়ে দিলেন। কিন্তু মার পেটের বোন তার মেয়েকে নিজের পেটের মেয়ে বলে মেনে নিতে পারেনি। যা হবার তাই হোল। ও মেয়ের আশ্রয় হোল নানির কাছে।

এর মধ্যে হিমালয় থেকে অনেক বরফ গলা পানি গঙ্গা যমুনা পদ্মা বয়ে সাগরে, মিশেছে, অনেক কলি ফুটে ঝরে গেছে। পৃথিবীর মানচিত্রে একটা নতুন দেশের জন্ম হয়েছে আর আমরা সেই দেশে ফিরে এসেছি। কলেজে তোর সাথে প্রথম পরিচয়, মনে আছে সে দিনের কথা?ওই তখনকার কথা। সে যখন ক্লাস এইটে তখন নারায়ণগঞ্জে ওর নানার বাড়িতে আমি শেষ দেখেছি। ওর অবস্থা দেখে এসে মাকে বললাম সব কথা। বিশ্বাস করবি কিনা, গায়ের রংটা পেয়েছিল মায়ের মত সেই রঙ পুড়ে তামার মত হয়ে গেছে, আমি চিনতেই পারিনি। এই মেয়েকে ময়লা কাপড় পরনে, বিষণ্ণ মলিন মুখে রান্না ঘরে হাড়ি পাতিল মাজতে দেখলে কার সহ্য হয় বলতে পারবি? আমার মা কিছুক্ষণ কাঁদলেন, মার সাথে আমিও কেঁদেছিলাম। কয়েক দিন পর গিয়ে মা দেখে আসলেন, এসে আবার কান্না। এতো দিনে চাচির সেই কথার মানে বুঝতে শিখেছি। মনে মনে কখন যে মোর স্বপন চারিনী হয়ে গিয়েছিল বুঝিনি। তাই বুঝি মার কান্নার সাথে আমার কান্নাও মিশে গিয়েছিল
আমরা ঢাকায় আসার পরে বাবা দেখে শুনে ঢাকায় আমাদের বাড়ির কাছে একটা জায়গা দেখিয়ে দিয়েছিলেন। ওই জায়গা কিনে চাচা বাড়িও করলেন কিন্তু বাবার এই বাড়িতে ওই মেয়ের থাকা হয়নি। ছোট বেলা থেকেই আমি বিশেষ করে মেয়েদের কষ্ট সহ্য করতে পারতাম না। আমার একটাই বোন তাকে যে আমি কি ভালবাসি সে তুই জানিস।

তত দিনে লেখা পড়ার পাট শেষ করে এই চাকরিতে জয়েন করেছি, ওই যে যখন প্রথম চিটাগাং গেলাম তখন। এক বার ছুটিতে এসেছি তখন এক দিন সন্ধ্যায় কালাম চাচা তার মেয়ের বিয়ের নিমন্ত্রণ করতে আমাদের বাড়িতে এলেন। কথাটা শুনে চমকে উঠলাম, মা অবাক হয়ে মুখে কি!! বলে কিছুক্ষণ চাচার দিকে তাকিয়ে থেকে চাচাকে ডেকে ভিতরে নিয়ে গেলেন। চাচাও কোন কিছু না বলে মাথা নিচু করে মাকে অনুসরণ করলেন। বাবা বাসায় নেই। ও ঘরে কি কথা হোল সব শুনতে পাইনি তবে মাঝে একবার মায়ের উচ্চ কণ্ঠ পেলাম এ মেয়ে আমার, আমি কিচ্ছু বুঝি না আমাকে এ মেয়ে দিতে হবে মার এ কথার প্রেক্ষিতে চাচার একটু উচ্চ কণ্ঠ শুনলাম, “আমি কি করব ভাবী”।
সেদিনের মত চাচা চলে গেল। একটু পরে বাবা এলেন। বাবার সাথে যখন মা এ নিয়ে আলাপ করছিল তখন যা শুনলাম তা হচ্ছে

মেয়ের নানা বিয়ে ঠিক করেছে, ছেলে গ্রামে (তোদের গ্রাম) থেকে দোকান দারী করে, অনেক জমি জমা নাকি আছে, এর চেয়ে ভাল পাত্র পাওয়া যাবে না তাই দেরি না করে বিয়ের দিন ঠিক করে পাকা কথা দিয়ে দিয়েছে। মেয়ের বাবাকে একটু জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করেনি। মেয়ের বাবা এ কথা শুনে প্রতিবাদ করেছিল,
না আমি মেয়ের জন্য ছেলে ঠিক করে রেখেছি, ওর মা বলে গেছে, এ বিয়ে হবে না। আমার মেয়ে আমাকে একটু জিজ্ঞেস করবেন না?
তোমাকে কি জিজ্ঞেস করব, মেয়ে কি তুমি পেলে বড় করেছ?

দেখ, এই হোল আমাদের মেয়েদের জীবন, এক জন মা হারা মেয়ের জীবন কি এমন হতে হবে?এখানে তার কি দোষ ছিল?বাবা থাকতেও বাবার গলা জড়িয়ে ধরে একটু সোহাগ, একটু স্নেহ কেন পেল না?আমার মা বাবা ওই বিয়েতে যেতে পারেনি, আমার বিয়েতে ও ওই চাচা আসেনি। আমার বিয়ের আগে হবু বৌকে সব বলেছি এমনকি বিয়ের পরে ওকে সাথে নিয়ে চাচার বাড়িও গেছি। ওর কৌতুহল ছিল এ কেমন মা একটু দেখব, সৎ মা হলেই কি এমন হতে হবে আর বাবাই বা কেমন বাবা?তাই দেখাতে নিয়ে গেছিলাম। ও বাড়ি যাবার পর আমার বৌ এর মাথায় হাত রেখে চাচা কেঁদে ফেললেন, আমি তাকিয়ে দেখলাম। এ কান্না কিসের কান্না আমাকে একটু বুঝিয়ে দিবি?তবে ওই পুতুলকে দেখতে চেয়েছিল তা আর হয়ে উঠেনি।

এখন বল আমার পক্ষে কি ওই গ্রামে যাওয়া উচিত?এখানে আমার কি দোষ? আশা করি আমাকে ভুল বুঝবি না। কারো মনে কষ্ট দেয়া তো দূরের কথা সে রকম কিছু ভাবাও আমার পক্ষে সম্ভব না। মানুষের সাথে সু সম্পর্ক না হতে পারে কিন্তু খারাপ সম্পর্ক থাকবে কেন?একটু খানি বন্ধুত্ব গড়ে তোলা অনেক কঠিন তাই চেষ্টা করি তা টিকিয়ে রাখতে। তোদের মত বন্ধুদের ভালবাসা আমার জীবনের পাথেয়। ও্ কথা ভুলে থাকার চেষ্টা করেছি, কিন্তু মানুষ কি তা পারে?হঠাত্ করে সেদিন মনে হয়ে যাওয়ায় মনটা ভীষন ভাবে অস্থির হয়েছিল। বৌকে বললাম এখন আমি কি করি?বৌ কি চিকিৎসা দিল শুনবি?বলল ঘুমাবার চেষ্টা কর, আর তার জন্য দোয়া কর তার ইহ কালের সুখ যেন পর কালে পায়, এ ছাড়া আর কিছু বলার নেই।

তুই তো জানিস আমার স্ত্রী ভাগ্য খুবই ভাল, এদিক দিয়ে আমি অত্যন্ত সুখী মানুষ। আমার কি প্রয়োজন তা আমি বোঝার আগেই সে বুঝে ফেলে। তাই মনে হয় আমার এই ভবঘুরে ছন্ন ছাড়া জীবন এখনো টিকে আছে।
আশা করি তোর ভুল ভেঙ্গেছে, এবার চিঠির উত্তর দিবি। এবার দেশে গেলে অবশ্যই দেখা করবি।

ইতি,
যে নামে আমাকে ডাকতে তুই পছন্দ করিস
তোর সেই যাযাবর

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


6 Responses to যাযাবরের চিঠি

You must be logged in to post a comment Login