অনুলেখা

রোমেচার মতো আর একজন কাজের ঝি সহসা পাওয়া যাবেতো?

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

শিকড়ের টানে প্রতি বৎসর ঈদুল ফিতর উৎসব নিজ বাড়িতে উদযাপন করা পারিবারিক ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে কবে থেকে জানা নেই। তবে বংশানুক্রমে এই রিতী পালন করা নাদের আলীর পরিবারে অবশ্য কর্তব্য হয়েছে সেটা ঈদুল ফিতর আসলেই লক্ষ্য করা যায়। বিশাল পরিবারের সন্তান নাদের আলী প্রতি বৎসর ঈদুল ফিতরে আর যাই করুক না কেন বাড়িতে আসবেই। পারিবারিক ঐতিহ্যের পাশা-পাশি এখন পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা নাদের আলীকে দেখার জন্য মূখ্য উদ্দেশ্য নিয়েই সমবেত হয় ঈদ উৎসবে। ঢাকায় বিশাল গার্মেন্টস ব্যবসা তার। ছয় ভ্রাতার সংশারে নাদের আলী জৈষ্ঠ। তিন বোন ছাড়াও তাদের ছেলে মেয়ে সহ জামাতা পুত্রবধুও অংশগ্রহন করে ঈদকে করে তোলে উৎসবমূখর। এবারও ব্যতিক্রম ছিল না তার। তবে উৎসবে অনন্য সংযোজন ছিল নতুন এক অতিথির। নাদের আলীর পুত্র নাহিদের কন্যা সন্তান এই প্রথমবারের মত ঈদ উৎসবে যোগ দেওয়ায় অনুষ্ঠানকে ভিন্নতার স্বাদ উপহার দেয়। সকলের দৃষ্টি ছিল নাহিদের কন্যা সেজুতির দিকে। ফুটফুটে ছোট্ট কন্যা শিশুটিও পরিবারের সকলের আদর পেয়ে ছিল পুলকিত।

ইফতারী শেষে ঈদের চাঁদ দেখতে বাড়ির ছাঁদে উঠে বাড়ির প্রায় সকল সদস্য। চাঁদ দেখতে পেয়ে আনন্দে উদ্বেলিত সকলে একসাথে নেঁচে গেঁয়ে উঠে সেই চির অম্লান নজরুলের অমর গান “রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ”। শহরে ইটের ইমারতে বাস করা মানুষগুলো গ্রাম্য প্রকৃতিতে আপ্লুত স্বজনদের সান্নিধ্যে ঈদের খুশিতে যেন হয়ে যায় আত্মহারা। পাশের বাড়ির স্বামী-স্বজনহীন পঞ্চাশোর্ধ রোমেচা বেগম ছিন্ন বস্ত্রে ভাংগা কুড়েঘর থেকে বেড়ার ফাঁকা দিয়ে সব দেখতে পায়। নাদের আলী গ্রামের গরীব দুঃখীদের যাকাতের টাকা, কাপড় বিলিয়ে দেয় সমানভাবে। কাউকে কম বা বেশী দান তিনি করেন না। বরং বাড়ির পাশের রোমেচা বেগমকে পারলে একটু কমই দেন। কারনটা আর কেউ না জানলেও নাদের আলীর পুত্রবধু ইতিমধ্যে জেনে গিয়েছে। সেটা আর কোন কারন নয়, শুধু মাত্র রোমেচা বেগম যাকাতের টাকা নিয়ে শান্তিতে থাকলে নাদের আলীর বাড়িতে আর ঝিয়ের কাজ করবে না সেই ভয়ে।

রোমেচা বেগম মাতৃহীন একমাত্র কন্যা সন্তান। পিতা ছোলেমান সেখ শখ করে অল্প বয়সে বিবাহ দিয়ে নিজ বাড়িতেই মেয়ে জামাইকে ঘর বেঁধে দিয়েছিলেন সুখের আশায়। দুই বছরের পার না হতেই একাত্তরের যুদ্ধে গিয়ে রোমেচা বেগমের স্বামী কুব্বাত আলী নিখোজ হয়। যৌবন বয়সে স্বামী হারা হলেও ক্যান্সার আক্রান্ত পিতাকে ফেলে দ্বিতীয় বিবাহের পিড়িতে বসতে পারেনি রোমেচা বেগম। পৈত্রিক ভিটায় সামান্য কুড়েঘর ছাড়া আর কোন সম্পদ তার নেই। ক্যান্সার আক্রান্ত পিতার চিকিৎসার জন্য পৈত্রিক সকল সম্পত্তি নাদের আলীর নিকট বিক্রি করে চিকিৎসা করেও শেষ রক্ষা হয়নি ছোলেমান সেখের। পিতার মৃত্যুর পর থেকে ত্রিশ বৎসর যাবৎ নাদের আলীর বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে দিনাতিপাত তার। অসহায় রোমেচার ভাগ্য এখন নাদের আলীর পরিবারের হাতে। তাইতো রোমেচা বেগম স্বাভাবিক মৃত্যুর প্রতিক্ষায় প্রহর গুনে আর নাদের আলীর পরিবারে রান্না সহ ঝিয়ের কাজ করে।

আজ ঈদুল ফিতর। ঘুম থেকে উঠে গোসল সেরে ঈদের নতুন কাপড় পরে বাড়ির ছোট বড় সকলেই নাস্তার জন্য অপেক্ষা করছে। প্রতি ঈদে রোমেচা বেগম রকমারী নাস্তা তৈরী করে সকলকে চমকে দেয়। পরিবারের সদস্যরা তাই ঘুম থেকে উঠে রোমেচা বেগমের হাতে তৈরী মিষ্টি পায়েস খেতেই নাস্তার টেবিলে ছুটে আসে। কিন্তু অন্যবারের তুলনায় এবার নাস্তা তৈরীতে দেরী দেখে দু’একজন টিপ্পনি কাঁটতে শুরু করলো “মনে হয় রোমেচা আগে নিজে খেয়ে তারপর আমাদের খাওয়াবে”। অপেক্ষা করতে করতে একসময় নাদের আলী চিৎকার করে উঠলো “কি ব্যপার রোমেচা এবার যাকাত ফেৎরা বেশী পেয়ে কি জমিদার বনে গেলো নাকি?” এরপর আবার হাক ছাড়ে “ঈদের সকালটা হাসি মূখে মিষ্টি খাওয়ার রেওয়াজটা কি রোমেচার সহ্য হয়না নাকি?”

নাদের আলীর পুত্রবধু ছুটে যায় রন্ধনশালায়। না, নেই সেখানে কোন রান্নার আয়োজন। একে একে বাড়ির অন্য মহিলারাও ছুটে যায় সেখানে। ঘড়ির কাঁটায় তখন প্রায় আঁটটা বাজতে চলেছে। ঈদের জামাত সাড়ে আঁটটায়। বাড়ির মহিলারা অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করে ঘুমিয়েছে তাই সকালে বিছানা ছাড়তে হয়েছে দেরী। তারপর সবাই ঘুম থেকে উঠে হাত মুখ ধুয়ে গোসল সেরে পরেছে ঈদের নতুন শাড়ি। প্রতিদিন রোমেচা বেগম ভোরে উঠে সকালের নাস্তা তৈরী করে, তাই রান্নাঘরের দিকে কেউ লক্ষ্য করে না। নাদের আলীর চিৎকারে হুলুস্তুল বাড়ির লোকজন। যেন রোমেচা বেগমকে হাতের কাছে পেলে নাদের আলী আস্ত রাখবে না। বাড়ির কাজের ছেলে মন্টুকে পাঠায় রোমেচার খবর নিতে।

“আসুক আজ রোমেচা, ওর বেশী তেল হয়েছে, আজ ওর তেল কত হয়েছে দেখে নেব” বলে গর্জন করতে থাকে নাদের আলী। এমন সময় মন্টু মিয়া এসে খবর দেয় রোমেচা বেগম আর কখনো এ বাড়িতে কাজ করতে আসবে না। তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে নাদের আলী। হুংকার ছেড়ে বলে “মাগিকে খাইয়ে খাইয়ে বেশী তেল বানিয়ে দেয়েছিতো এখন কাজ করবে কেন, নতুন কোন নাং ধরবে”। মন্টু মিয়া গুমরে গুমরে কাঁদতে থাকে, মুখ বুজে নিজেকে ভাবে রোমেচা বেগমের যায়গায়। নাদের আলী মন্টু মিয়াকে ধমক দেয় “চুলের মুঠি ধরে টেনে আনতে পারলি না বুড়িটার?” হাউ-মাউ করে মন্টু মিয়া কেঁদে উঠে আর্তনাদ করে বলে “সেইডাও আর সম্ভব হবি না মামা, রোমচা নানী একলা ঘরে মৈরা রইছে”।

নির্বাক সকলে শুধু চেয়ে থাকে আর মন্টু মিয়ার কান্না দেখে। মন্টু মিয়ার চোখের জলে বুক ভেসে গেলেও বাড়ির আর কারো চোখ থেকে পড়ে না এক বিন্দু অশ্রু। দায়িত্ববোধ জাগে না মনে মৃতা রোমেচা বেগমের মরদেহের সৎকার করার। মুক্তিযুদ্ধে নিখোজ কুব্বাত আলীর অসহায় স্ত্রীর মৃত্যু খবর জানতেও পারে না স্বাধীন দেশের সুশীল নাগরিকেরা। নাদের আলীর পরিবারের সদস্যদের নিরব চোখে এখন শুধু একটাই প্রশ্ন “রোমেচার মতো আর একজন কাজের ঝি সহসা পাওয়া যাবেতো?”

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


4 Responses to রোমেচার মতো আর একজন কাজের ঝি সহসা পাওয়া যাবেতো?

You must be logged in to post a comment Login