মামুন ম. আজিজ

সময়

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page


জীবনের পরম শত্রুকে অবশেষে নির্ণয় করতে পেরেছে নাহিদ।
কোন মানুষ নয়। কোন বস্তু নয়। বিজ্ঞানীদের কাছে যার পরিচয় চতুর্থ ডাইমেনশন নামে। সেই সময়। সময়ই নাহিদের জীবনের একমাত্র শত্রু। পেছেনের জীবনে যত ভুল সব তার সেই সময়ের সাথে পরাজয়ের কারনেই। সঠিক সময়ে সঠিক কাজ সে করতে পারেনি কখনও। আজ তাই এত অপূর্ণতা।
আজ সে বুঝেছে সময়কে মুঠোয় বন্দী করতে পারলেই সফলতা। সে পারে নি । কখনই না। স্কুলের পরীক্ষাগুলোতে সে প্রশ্নের উত্তর জানার পরেও কখনই খাতায় তা সব লিখতে পারেনি। কখন অগোচরে সময় শেষ হয়ে যেত বুঝতেই পারতনা। সময়ের সাথে পেরে ওঠেনি  বলেই এত প্রচেষ্টা, এদ পড়াশুনার পরেও সে ভালো ছাত্র হয়ে উঠতে পারেনি কখনও। অথচ তার পড়াশুনা আর জ্ঞানের পরিধি তো কম নয়।
সিনেমা দেখার নেশা তেমন ছিল না। তবুও সেদিন বন্ধুর সাথে গিয়েছিল মধুমিতায়। ছবিটা অবশ্যই দেখার মত ছিল। ব্রেভহার্ট। অসাধারন একটা মুভি । মা’র হার্টফেলের সময়টা তখনই এলো। ঢাকা শহরের জ্যাম সেই সময়েই  অসহ্যের কিশোর পর্যায়ে অবতরণ করে ফেলেছে। মধুমিতা থেকে বেরিয়ে যখন ঢাকা শহরের সেই অসহ্য জ্যামের কিশোর কাল অতিক্রম করে বাসায় পৌঁছালো মাকে ততক্ষণে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। আবার সেই জ্যামের কিশোর কাল পেরিয়ে যখন হাসপাতালে পৌঁছালো ততক্ষণে মা পরকালকে বরণ করেছেন। বাবার উপর সেদিন খুব রাগ হয়েছিল। দ্বিতীয় বিয়ের খবরটাকে অসুস্থ প্রথম স্ত্রীকে বাবা আর দেয়ার সময় পেলোনা। কিন্তু বাবার সাথে যুদ্ধ করার সেই উপযুক্ত সময়টাও কাজে লাগাতে পারেনি নাহিদ সেদিন। উল্টো বাবার হাতে চড় খেতে হলো  ১৭ বছরের কিশোর নাহিদের । বাবা বকেছিলেন, কত বড় স্পর্ধা অসুস্থ মাকে ঘরে ফেলে সিনেমা দেখতে যাওয়া হয়। তারপর আবার একটা চড়। সেদিনের যে প্রতিবাদটা উচিৎ ছিল সেটা নাহিদ করেছিল আরও সাত বছর পর। তখন আর সময় ছিলনা। বাবা আর সৎ মাকে কিছু বলে আর তখন কোন ভাবান্তর ঘটানোর উপায় ছিলনা। উল্টো বাড়ি ছাড়তে হলো মাতৃহারা নাহিদ কে।
সেই ঘর ছাড়ল তাও যদি আরও সাতটি বছর আগেই ছাড়ত। সুন্দরী সৎ মায়ের তিল তিল অত্যাচার আর বেলাল্লাপনা সহ্য করত হতো না সাত সাত টি বছর। বাবাকে যখন জানিয়েছে সৎ মার নানান অশ্লীল অপকর্মের কথা সেটাও অসময় ছিল।  বাবা ততদিনে বায়াসড। শুনে তাই ক্ষেপেছেন উল্টো। ফল হয়েছে তেজ্যপুত্র খেতাব লাভ।
সেটা অবশ্য ভালোই হয়েছিল। পুরাণ ঢাকায় ঢাকার বাইরের থেদকে আসা এক বন্ধুর সাথে মেসে উঠে গেলো। এমএ পরীক্ষা দেবার জন্য তার সাথে জগন্নাথে ভর্তিও হয়েছিল। কিন্তু না ব্যবসার ডাক এল । এম এ আর পড়া হলোনা। টিউশনি করে যে কটাকা জমিয়েছিল। তাই দিয়ে আরেক বন্ধুর সাথে নেমে পড়ল সেই নব্বই দশকের শেয়ার মার্কেটের এলোপাথাড়ি উত্থানের ব্যবসায়। প্রথমেই বেশ কটা দাও মেরে দিলো দুজন। রোদে পুরে , বৃষ্টিতে ভিজে মতিঝিলে দুপুরে খেয়ে না খেয়ে অল্প পুঁজি তাদের বেড়ে বহু গুন হয়ে গেলো। লোভ বাড়ল। দু বন্ধুতে লাগল গন্ডগোল। জোট ভেঙে গেলো। তারপর চলল দু’জনার একা একা ব্যবসা। বন্ধুটা সময়মতো কেনাবচো করে উঠে গেলো অর্থের অনেক উঁচু শিখরে। আর নাহিদ হারাল সব। সময় মত বেঁচা হলো না তার সব শেয়ার। মার্কেটের চরম পতন ঘটল। যে দরিদ্র ছিল , নাহিদ সেই দরিদ্রই রয়ে গেলো। মাঝখান থেকে হারাল এম এ পাশের সুযোগটা। আবার ভর্তি হতে চেয়েছিল। ততদিনে মন অনেক দূর্বল হয়ে গেছে। পারলনা।
শায়লাকে সে  হয়তো ভালবাসতই। সময় আর সময়ের অপূর্নতা পুরো বোঝার সুযোগ দেয়নি সে সত্য। চোখের সামনে শায়লা নামের মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেলো। বলাই  হলো না আর।  জানত মেয়েটাও তাকে অনেক ভালোবাসত। অনেক বুঝিয়েছে মেয়েটা তাকে। কিন্তু নাহিদ ই পারেনি মুখ ফুটে বলতে। ভেবেছিল বলবে। আরেকটু গুছিয়ে নিয়েই বলবে। কথা তো হয়ই। বন্ধুত্বটাও বেড়েছিল। সে কারনেই বিয়ের দাওয়াতটাও পেয়েছিল। কিন্তু মুখ ফুটে ভালোবাসার এজহার টা  তো করার সময় হয়নি। শায়লা শক্ত হয়ে বাস্তবটা মেনে নিয়ে সময় মতো আমেরিকা প্রবাসী সুবোধ পাত্রকেই বরণ করে নিল। ওরা কত সহজে সময়ের কাজ সময়ে করে ফেলে। পারে না কেবল নাহিদ। যদি পারত আজ তার শায়লার সাথে সুন্দর একটা সংসার হতো। একটা ফুটফুটে মেয়ে…ভাবতে গেলেই কষ্টগুলো জাপটে ধরে। কষ্টরাও সময় বোঝেনা।
অথচ এই তো মাত্র গতকালের ঘটনা। নারায়ণগঞ্জ  যাচ্ছিল। ওখানে এক বড় ফ্যাক্টরীর মালিকের সাথে দেখা করার কথা। এখন তার কাজই এমন। এজেন্ট সে একটা ব্যাংকের। ক্রেডিট কার্ড ক্লাইন্ট জোগাড় করে। জোগাড় করতে পারলে কমিশন। না পারলে খুব সামান্য বেতনটুকুই ভরসা। চলে না ঠিকমত। মাঝে মধ্যে দু একটা বড় ক্লাইন্ট জুটে যায়, তাও এক কালে বড়লোক বন্ধুদের বরাতে। সে সময়ের আয় টুকু জমিয়ে তার চলে অন্য সময়েও। মেস থেকে বের হবার সময় আকাশটা দেখলো একদম ঝকঝকা রোদেলা। ছোট ছাতাটা তাই ব্যাগে ঢুকিয়ে ব্যাগের ওজন বাড়ালো না। অথচ সাইনবোর্ডে যখন নামল ঝুম ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। কে জানে কোন সময় আসলে কি প্রয়োজন? সে জানে না। হয়তো অনেকেই জানে।  ওপাশে যাবার পরেও যদি বেরসিক বৃষ্টিটা নামত অন্তত নারায়নগঞ্জের বাসে চড়ে বসতে পারত। বৃষ্টিতে ভিজতে হতোনা। সময়টাও কাজে লাগতভ।  সময় কখনই কি তার সাথ দেবে না?
টং দোকানে দাঁিড়য়ে বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার বৃথা চেষ্টা করতে করতে হঠাৎ তার চোখ যায় খালি গায়ের এই বরজোর ১৩/১৪ বছর বয়সের ছেলে দুটোর দিকে। ঠিক সময়ে ঠিক কাজটিই করছে তারা। যে ক’টাকা  আসে তাই কমকি।  কে কাকে দেয় সে ক’টাকাই।
দুটো ছাতা নিয়ে তারা দু’জন নেমেছে। নিজেরা ভিজছে কিন্তু বাস থেকে নামা যাত্রীদের কে রাস্তার ওপাশে ছাতা মাথায় দিয়ে পৌঁছে দিচ্ছে। বিনিময়ে চরম খুশি হয়ে কেউ কেউ ১০ টাকাও হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে ছেলে দুটোকে। ঐ বয়সে তাদের মাথায় এই বুদ্ধি এসেছে । এটাই তো সময়ের সাথে চলার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
এটা তার জন্য নিশ্চিত এক পরম শিক্ষা। কিন্তু কি কাজে আসবে এই শিক্ষা যদি না সময় মতো তার প্রয়োগই সে করতে না পারে। কবে , কবে হবে এই দুষ্টু সময় তার আপন হবে, হবে নিবীর বন্ধু? সে জানে না। কিন্তু আর না। এই নিয়তির শিক্ষা কে তার কাজে লাগাতেই হবে।
পরের দিন সারা সকাল সে এই নিয়ে ভেবেছে। চাকুরীটা ছেড়ে দেবে? কি হবে এই ঘোড়ারডিমের জব করে। কোন উন্নতি হবে না। এই দুস্থ অবস্থাতেই পরে থাকতে হবে তার চিরকাল। কিন্তু সময়ের কি সেটাই চাহিদা? সেখানেই সমস্যা তার। বুঝতে পারেনা। সময় কবে যে তার বন্ধু হবে? সে উদ্বিগ্ন হয়।
বিকেলে তন্বী দেখা করতে আসে। মেসের কাছেই একটা বড় ফাস্ট ফুডের দোকান আছে , সেখানে বসে দু’জন। এই মেয়েটার সাথে তার প্রেম হয়েছে বলা যাবে না। সময়ের সাথে শত্র“তা বাড়তে বাড়তে নাহিদ আজ প্রচন্ড ভীতু। কিন্তু মেয়েটা তার পিছু ছাড়েনি কখনও। ছাত্রী ছিল। প্রায় বছর দুয়েক পড়িয়েছে মেয়েটাকে। নিজে যতই খারাপ ফলাফল করুক। পড়ানোর ক্ষমতা নাহিদের ভালোই ছিল।  না হলে তার পড়ানোর গুনেই আজ তন্বী পড়ছে ঢাকা ভাসিটিতে  ইকোনোমিক্সের মত বিষয়ে।
তন্বী বুদ্ধিমতি মেয়ে। নাহিদের ভালো মানুষি রূপটা তাই তার চোখ এড়ায়নি। তন্বী ভনিতা করে না। সময়ের কাজ সময়ে সে করতে জানে। এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলে, তুমি আমাকে ভালোবাসো কি বাসো নাসে আমি আজও জানি না। কিন্তু আমি তো বাসি। আগামী শুক্রবার আমার বিয়ে। আমি ও বিয়ে করবো না। আমি তোমাকেই চাই। তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে, আজই , এক্ষুণি?
থমকে যায় নাহিদ। হাতে ধরা ফ্রেঞ্চ ফ্রাই নামের আলুর  টুকরো হাতেই জমে যায়। কল্পনায় সে দেখে বৃষ্টি পড়ছে। ঝুম বৃষ্টিতে দুটো ছেলে খালি গায়, ছেড়া প্যান্ট পড়নে।  অথচ তারা দু’জন সেই ঘন বৃষ্টিতে ছাতা নিয়ে যাত্রীদের বৃষ্টি হতে বাঁচিয়ে রাস্তা  পার করে দিচ্ছে। সেও সময়কে সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু বানাতে চায়। আর কোন ভুল নয়। তন্বীর হাতটা ধরে। বলে ওঠে,  চলো ।
(পুরানো লেখা)

thumbnails picture collected from

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


13 Responses to সময়

You must be logged in to post a comment Login