শৈলী টাইপরাইটার

সুকুমার রায়ের নাটক: “ঝালাপালা”

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

জুড়ির গান
সখের প্রাণ গড়ের মাঠ
পড়ায় নাইকো মন
অতি ডেঁপো দুকান কাটা
কাউকে নাহি মানে
গুরুমশাই টিকিওয়ালা
জমিদারের বাড়ি
ছাত্র দুটি করেন পাঠ –
(সবাই) হচ্ছে জ্বালাতন !
ছাত্র দুটি বেজায় জ্যাঠা,
(সবাই) ধর ওদের কানে !
নিত্যি যাবেন ঝিঙেটোলা
(সেথা) আড্ডা জমে ভারি !

প্রথম দৃশ্য

পণ্ডিত। (স্বগত) রোজ ভাবি জমিদারমশাইকে বলে কয়ে তার বাড়িতেই একটা টোল বসাব।  তা, একটু নিরিবিলি যে কথাটা পাড়ব, সে আর হয়ে উঠল না । বলি ন্যায়শাস্ত্র যে পড়েনি সে মানুষ‌‌ই নয়- সে গরু, মর্কট !

[নেপথ্যে সংগীত]

এই !- আবার চলল ! এ এখন সারাদিন চলতে থাকবে ! গলা ত নয়, যেন ফাটা বাঁশ ! গানের তাড়ায় পাড়াসুদ্ধ লোক ত্রাহি ত্রাহি কচ্ছে- কাগটা পর্যন্ত ছাতে বসতে ভরসা পায় না, অথচ ভাবখানা এমনি, যেন গান শুনিয়ে আমাদের সাতচোদ্দং তিপ্পান্ন পুরুষ উদ্ধার করে দিচ্ছে ! আ মোলো যে-

[ঘটিরামের প্রবেশ]

এত দেরি হল কেন ? এতক্ষণ কী কচ্ছিলি ?

ঘটিরাম। আজকে শিগগির শিগগির ছুটি দিতে হবে !
পণ্ডিত। বটে ! অনেকদিন পিঠে কিছু পড়েনি বুঝি ! ছুটি কিসের ?
ঘটিরাম। তাও জানেন না ! ও পাড়ায় গানের মজলিস হবে যে ! বড় বড় ওস্তাদ-
পণ্ডিত। না, না, ছুটি পাবিনে- যা ! পড়ার সঙ্গে সম্পর্ক নেই, এসেই ছুটির খোঁজ-
ঘটিরাম। বাঃ ! ঝিঙেটোলার জমিদারবাবু আসবেন !
পণ্ডিত। লাট সাহেব এলেও যেতে পাবিনে।  কেষ্টা কোথায় ?
ঘটিরাম। জানিনে।  ডেকে আনব ? ওরে কেষ্ট।     [প্রস্থানোদ্যম]
পণ্ডিত। থাক্‌‌ থাক্‌‌ , ডাকতে হবে না।  ওখানে বসে পড়।
ঘটিরাম। ‘অল ওয়ার্ক্‌‌ অ্যান্‌‌ড্‌‌ নো প্লে মেকস জ্যাক এ ডাল বয়’- বালকদিগকে খেলিবার সুযোগ দেওয়া উচিত, কেননা, কেবল লেখাপড়া করিলে মনের স্ফুর্তি নষ্ট হয়। হ্যাঁ, হ্যাঁ, বালকদিগকে খেলিবার সুযোগ দেওয়া উচিত, কেননা, কেবল‌‌ই লেখাপড়া করিলে মনের স্ফুর্তি নষ্ট হয়- স্ফুর্তি সব মাটি ।  কেননা, কেবল‌‌ই লেখাপড়া মনের স্ফুর্তি নষ্ট হয়- এই আমাদের যেমন হয়েছে ।  কেননা-
পণ্ডিত। ও জায়গাটা পাঁচশোবার করে পড়তে হবেনা ।  তোর অন্য পড়া নেই ? -ঐ যে পুলিসটা যাচ্ছে, ওকে একটু ডাকা যাক্‌‌ । এই পাহারাওয়ালা – ইদিকে আও ।

[পুলিসের প্রবেশ]

পুলিস । কেয়া বোল্‌‌তা বাবু ?
পণ্ডিত। আহা, এইটা দেখি একেবারে নিরক্ষর মুর্খ ! আরে, পাশের বাড়িমে একঠো গানের ওস্তাদ হায় নেই ? উস্‌‌কো একদম কাণ্ডাকাণ্ড জ্ঞান নেহি হায় – দিনরাত ভর কেবল সারে গামা ভাঁজতা হায় ।
পুলিস । কেয়া হোতা ?
পণ্ডিত। আরে, খেলে যা ! (সুর করিয়া) সারে গাগা মাপা ধানি ধানি এইসা করতা হায়-
পুলিস । হাম কেয়া করেগা বাবু- উ হামারা কাম নেহি ।
পণ্ডিত। নাঃ তোমার কাজ না ! মাইনে খাবে তুমি আর কাজ করবে বেচারাম তেলি !
পুলিস । হাঁ বাবু ।
পণ্ডিত। চেঁচাস কাঁহে ? ফের পূজার বকশিশ চায়গা ত এইসা উত্তম মধ্যম দেগা- থোঁতামুখ ভোঁতা কর দেগা ।
পুলিস । আরে, পাগলা হায়রে- পাগলা হায় !   [প্রস্থান]
পণ্ডিত। দেখ ! ছোঁড়াটার আর সারাশব্দ নেই ! ঘটে !
ঘটিরাম। অ্যাঁ-
পণ্ডিত। ‘অ্যাঁ’ কি রে বেয়াদব ? ‘আজ্ঞে’ বলতে পারিসনে ? আধঘণ্টা ধরে ‘অ্যাঁ’ করতে লেগেছে ! বলি, পড়ছিস না কেন ?
ঘটিরাম। হ্যাঁ, পড়ছিলাম ত !
পণ্ডিত। শুনতে পাই না কেন ? চেঁচিয়ে পড় !
ঘটিরাম। (চিৎ‌কার) অন্ধকারে চৌরাশিটা নরকের কুণ্ড
তাহাতে ডুবায়ে ধরে পাতকীর মুণ্ড-
পণ্ডিত। থাক্ থাক্‌‌- অত চেঁচাসনে- একেবারে কানের পোকা নড়িয়ে দিয়েছে ।

[কেষ্টার প্রবেশ]

কেষ্টা। লেখাপড়া করে যেই গাড়িচাপা পড়ে সেই ।  শুনলুম আজকে ও পাড়ায় গানের মজলিস হবে ।
পণ্ডিত। এতক্ষনে পড়তে এসেছিস ?
কেষ্টা। ‘ আই গো আপ্‌‌ , ইউ গো ডাউন ‘- সেই কখন এসেছি – এতক্ষন কত পড়ে ফেললাম ! ‘ আই গো আপ্‌‌ , ইউ গো ডাউন্‌‌ ‘-
পণ্ডিত। যা, যা, আমি যেন আর দেখিনি, কাল আসিস্‌‌ নি কেন ?
কেষ্টা। কালকে, কাল কি করে আসব ? ঝড় বৃষ্টি বজ্রাঘাত-
পণ্ডিত। ঝড় বৃষ্টি কিরে ? কাল ত দিব্যি পরিষ্কার ছিল !
কেষ্টা। আজ্ঞে, শুক্কুরবারের আকাশ, কিচ্ছু বিশ্বাস নেই কখন কি হয়ে পড়ে !
পণ্ডিত। বটে ! তোর বাড়ি কদ্দুর ?
কেষ্টা। আজ্ঞে, ঐ তালতলায়- ‘আই গো আপ্‌‌ , ইউ গো ডাউন্‌‌ -‘ মানে কি?
পণ্ডিত। ‘আই’- ‘আই’ কিনা চক্ষুঃ, ‘গো- গয়ে ওকারে গো গৌ গাবৌ গাবঃ, ইত্যমরঃ ‘আপ্’ কিনা আপঃ সলিলং বারি অর্থাৎ‌ জল- গরুর চক্ষে জল- অর্থাৎ‌ কিনা গরু কাঁদিতেছে- কেন কাঁদিতেছে- না উই গো ডাউন’, কিনা ‘উই’ অর্থাৎ‌ যাকে বলে উইপোকা- ‘গো ডাউন’, অর্থাৎ‌ গুদোমখানা- গুদোমঘরে উই ধরে আর কিছু রাখলে না- তাই না দেখে, ‘আই গো আপ্‌‌ ‘ গরু কেবলি কান্দিতেছে-

[ঘটির বিকট হাস্য]

পণ্ডিত। ঘটে !
ঘটিরাম। অ্যাঁ- না আজ্ঞে-
পণ্ডিত। ফের ওরকম বিটকেল শব্দ করবি ত পিটিয়ে সিধে করে দেব ।

[নিদ্রাচেষ্টা]

কেষ্টা। পণ্ডিতমশাই, ও পণ্ডিতমশাই !
ঘটিরাম। ঘুমুচ্ছে? (ঠেলিয়া) ও পণ্ডিতমশাই ! কেষ্টা ডাকছে, কেষ্টা ডাকছে-
কেষ্টা। পণ্ডিতমশাই, এই জায়গাটা বুঝতে পারছি না ।
পণ্ডিত। হু!, দেখি নিয়ে আয়, কোন জায়গাটা- সব বলে দিতে হবে ! তোদের দিয়ে আর কিচ্ছু হবে না ! ‘ওয়ান্‌‌স্‌‌ আই মেট্‌‌ এ লেম্‌‌ ম্যান ইন এ স্ট্রিট নিয়ার মাই হাউস্‌‌ ‘ । ‘ওয়ান্‌‌স্‌‌ আই মেট্‌‌ এ লেম্‌‌ ম্যান্‌‌ ‘- কিনা একদা এক বাঘের গলায় হাড় ফুটিয়াছিল ।’ ‘ইন্‌‌ এ স্ট্রিট’- সে বিস্তর চেষ্টা করিল ‘নিয়ার মাই হাউস্‌‌ ‘- কিন্তু হাড় বাহির হই‌‌ল না । এই সোজা ইয়েটা বুঝতে পাল্‌‌লি না? (ঘটিরামের প্রতি) কিরে? পালাচ্ছিস যে !
ঘটিরাম। নাঃ, পালাচ্ছি না ত ! কেষ্টা এমনি গোলমাল কচ্ছে- কিচ্ছু আঁক কষতে পাচ্ছি না ।
পণ্ডিত। কি আঁক দেখি নিয়ে আয় ।
ঘটিরাম। আজ্ঞে এই যে ! এই চার সের আলুর দাম যদি দশ আনা হয় তবে আদ্‌‌ মোন পটলের দাম কত ?
পণ্ডিত। দেখি, চার সের আলু দশ আনা ত ! তবে আদ্‌‌ মোন পটল- আহা, আবার পটল এল কোত্থেকে ?
ঘটিরাম। তা তো জানি না, বোধ হয় পটলডাঙা থেকে ?
পণ্ডিত। দুৎ‌ ! একি একটা আঁক হতে পারে ? গাধা কোথাকার !
ঘটিরাম। তাই বলুন ! আমি কত যোগ করলাম, ভাগ করলাম, শেষটায় জি-সি-এম্‌‌ পর্যন্ত করলাম, কিছুতেই হচ্ছিল না। বড্ড শক্ত- না ?
পণ্ডিত। মেলা বকিস নে, যাঃ !
ঘটিরাম। যাব ? ছুটি ?
কেষ্টা। ছুটি- ছুটি- ছুটি-
পণ্ডিত। না, না, ছুটি টুটি হবে না ।
ঘটিরাম। হ্যাঁ ভাই, তুই সাক্ষী আছিস, বলেছে যা !
কেষ্টা। হ্যাঁরে, আমাদের কিন্তু দোষ নেই ।[প্রস্থান]
পণ্ডিত। দেখলে কাণ্ডটা ! এই সব হুজুকেই ত ছেলেগুলোকে মাটি করলে ! আর জমিদারমশাইয়ের আক্কেলটা দেখ – এখানে এসে অবধি দশভূতে তাকে পেয়ে বসেছে – দেখ দেখি, টাকা ওড়াবার জন্য শেষটায় কিনা গানের মজলিস ! ছ্যা ছ্যা ![প্রস্থান]
জুড়ির গান

সাবধান হয়ে সবে অবধান কর রে ।
ওহে শিষ্য গুণধর কোলাহল ছাড় রে ।।
(আহা) কেনা জানে চণ্ডীবাবু ঝিঙেটোলার জমিদার ।
(আহা) অনুরক্ত ভক্ত মোরা চরণে প্রণমি তার ।।
(ওসে) বিক্রমে বিক্রমাদিত্য সর্বশাস্ত্রে ধুরন্ধর ।
(আহা) সাক্ষাৎ‌ যেন দাতাকর্ণ দানব্রতে ভয়ঙ্কর ।।
(এরা) খাচ্ছে দাচ্ছে ফুর্তি কচ্ছে নিত্য তারি কল্যাণে ।
(সেথা) চব্বিশ ঘণ্টা মারছে আড্ডা বখশিশাদি সন্ধানে ।।
(সেথা) নিত্য নতুন হচ্ছে হল্লা লোকারণ্য মারাত্মক ।
(সেথা) বাদ্যের ঘটা খাদ্যের ঘটা অর্থের শ্রাদ্ধ অনর্থক ।।
(আহা) একজন বড্ড সাধাসিধে ভেদ করে না আত্মপর ।
(আর) টাকার লোভে বসে থাকে যত ব্যাটা স্বার্থপর ।।
(ওরে) পণ্ডিৎ‌মশাই ব্যস্ত বড্ড চণ্ডীবাবুর হিতার্থ ।
(দেখ) অন্নলুচি ধ্বংস করি কচ্ছেন সবায় কৃতার্থ ।।
(আহা) বিদ্যে জাহির কচ্ছে সবাই পোলাও কোর্মা ভোজনে ।
(দেখ) যত রাজ্যের নিষ্কম্মার দল বাড়ছে সবাই ওজনে ।।
(ওরে) অবিশ্রান্ত হুজুক নিত্য মুহূর্তেকো শান্তি নেই ।
(আজ) পঞ্চ বর্ষ অন্ত হৈল ক্ষান্ত দেবার নামটি নেই ।।
(ওরে) কস্মিনকালে শুনি নাই রে এমন কাণ্ডকারখানা ।
(ওই) খোসামুদে ভণ্ডগুলো আহ্লাদেতে আটখানা ।।
(আহা) পুষ্পচন্দন বৃষ্টি হবে চণ্ডীবাবুর মস্তকে ।
(দেখ) অক্ষয় পুণ্য সঞ্চয় হবে চিত্রগুপ্তের পুস্তকে ।।

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


3 Responses to সুকুমার রায়ের নাটক: “ঝালাপালা”

You must be logged in to post a comment Login