কুলদা রায়

স্মৃতি তুমি ব্যাদোনা : সুনীলের কেউ কথা রাখেনি

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

(উৎসর্গ : সুজন চৌধুরী)

১…………………………………………………………………………………………………………………………….

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কেউ কথা রাখেনি খুব বিখ্যাত কবিতা। এই কবিতার মত জনপ্রিয় কবিতা বোধ হয় বাংলা ভাষায় আর দ্বিতীয়টি নেই। তিনি মারা যাওয়ার পরেও কবিতাটি অনেকে পড়বেন। এই কবিতাটির কারণেই সুনীল গাঙ্গুলী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় হয়েছিলেন। আর আমি কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়েছিলাম। ইতিহাস এরকম নির্মম। সে কাউকে ক্ষমা করে না।

২……………………………………………………………………………………………………………………………..

সুনীলের সেই সময় উপন্যাসটি আমার ভাল লেগেছিল। কিনেওছিলাম। দেশ থেকে আসার সময় সঙ্গে আনা হয়নি। তার একটি কবিতার বই আমি কিনেছিলাম বিদেশী কবিতার অনুবাদ। তিনি মার্কিন দেশের আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখক বৃত্তি নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে একটি বিদেশিনীর প্রেমে পড়েছিলেন। তার সঙ্গে কাটিয়ে কিছু বিদেশী কবিতা অনুবাদ করেছিলেন। বইটি এখনকার  বিখ্যাত রম্যলেখক  ব্যাচেলর সিনেমার স্টোরিরাইটার আনিসুল হক আমার কাছ থেকে মেরে দিয়েছিলেন। সেটা ময়মনসিংহের ঘটনা। কপিকবি এরশাদ তখনো জীবিত। আনিসুল হক  জানতেন বইটি চুরি করলে–তিনিও আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখক বৃত্তি পাবেন–সেখানে যেতে পারবেন। তিনি মার্কিন দেশের অই ছোট্ট গ্রামে গিয়েছিলেন। ফলে আমার বইটি ফেরত পাইনি। পেলে আমারও যাওয়ার সুযোগ ঘটতে পারত। আমার কপাল থেকে একটি বিদেশী প্রেমের সম্ভাবনারেখা মুছে গেছে।

৩……………………………………………………………………………………………………………………………..

সুনীলের কবিতা পড়ি ১৯৮১ সালের দিকে। আমার এনামূলদা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা বইটা ঢাকা থেকে কিনে এনেছিলেন।  তখন তিনি দীর্ঘদিন জেল খেটে এসেছেন। বেশ মোটাসোটা হয়ে গেছেন। এই ঘটনা থেকে অনুসিদ্ধান্ত টানা যায়–জেলখানা চিকন আলীদের জন্য মামাবাড়ি। গুরুর দয়ায় ঠেঁসে না গেলে মুষ্টিযোগে পুষ্টিভোগ নিশ্চিত। সেকালে থাকতাম রাস্তার পাশে একটি ঘরে একা একা। সে ঘরে একটি ছিটকিনি ছিল। তালা থাকার দরকার ছিল না।

সেকালে আমাকে কষ্টেসৃষ্টে কলেজেও যেতে হয়েছিল। তার মধ্যে একটি সম্পূর্ণ রঙ্গীন ঘটনা ছিল– আমি যখন কলেজে যাই তখন কেউ একজন আমার ঘরে এসে ঘুমায়। মা এরকম ধারণা করেছিল। ততদিনে আমার ঠাকুরদা কেটে পড়েছেন। আমার বিখ্যাত ঠাউম্মা ঠাকুরদার কথা না রেখেই একটু আগে গেছেন। বাবা কাজবাজে থাকার কারণে সময় পেত না। এই হেতু বাবা বলেছিল, তুই একটু খোঁজ খবর নিতে পারিস। লোকটা আসে। ঘুমিয়ে চলে যায়। কিন্তু কখনো কিছু খায় না। খিদে পেলে কি করে?

তখন খিদে ব্যাপারটি কার্লস মার্কস আর সুকান্ত ভট্টাচার্য ছেলেটি আমাদের মাথায় ষড়যন্ত্র গেঁথে দিতে শুরু করেছিলেন। এ কারণে  খিদে পেলে মাথায় যন্ত্রণা হত। এই যন্ত্রণার জন্য অই দাড়িঅলা লোক আর কিশোর ছেলেটিই  দায়ী। এর আগে আমাদের সত্যি সত্যি কোনো খিদে ছিল না। দিব্যি না খেয়ে কাটিয়ে দিতে পারতাম। তাইরে নাইরে করা যেত।

একদিন কলেজ ফাঁকি দিয়ে লোকটির নাগাল পেয়েছিলাম। তিনি আমার খাটে ঘুমিয়েছিলেন। মাথার নিচে একটি বই। নানা কায়দায় চেষ্টা চরিত্তির করে বইটির নাম পড়া গেল। বইটির নাম  সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা। সেখানে লেখা আছে–ভালবাসার পাশেই একটি অসুখ শুয়ে আছে। কি করে তাড়াই তাকে? তাড়ানো যাবে না। চিরকাল সঙ্গে থেকে যাবে। অসুখ ছড়াবে। মহাযন্ত্রণা। সেইকালে আঙ্গুলে অঙ্গুরি ছিল না।  থাকলে নিশ্চয়ই মহাযন্ত্রণার হাত থেকে খালাস পেতে অঙ্গুরিটি ঠোঁটে ছোঁয়াতাম। বিষপান করতে হত। একটি দীর্ঘদিন ঘুম দেওয়া যেত। ভাগ্যিস অঙ্গুরি ছিল না।

৪………………………………………………………………………………………………………………………….

লোকটি আমাকে দেখতে পেয়েছিলেন কিনা সেটা ঠিক নিশ্চিত নই। তবে বুঝতে পেরেছিলেন। তার ঘুম দেখে মনে হল– বহুদিন পরে একটু আরাম করে ঘুমোচ্ছেন। এই ঘুমটি তার দরকার।  জেলখানায় মানুষ ঘুমোতে পারে না। সে কারণে কুচ পরোয়া নেহি। ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই বলেছিলেন, ঘুম থেকে ওঠার পরে কথা বলব।

তিনি এনামূলদা। বাড়ি ফকিরকান্দি। ইত্যাদি। এরপরে এনামূলদা আমাদের বাড়িতেই লাঞ্চ সারতেন।

সেই এনামূলদা  কেউ কথা রাখেনি–কবিতাটা আমাদের ক্ষুদে শহরে জনে জনে পড়ে শুনিয়েছেন। শহরের মনে প্রাণে পেরেক মেরে কবিতাটি গেঁথে দিয়েছেন। ঝরে পড়ার সুযোগ নেই। কিছু  ব্যক্তিগত উদ্যোগে দেওয়াল লিখনও করা হয়েছিল। মাঝে মাঝে রঙিন পোস্টার। প্রেমপত্রের পরের পত্র। হাহাকার ধ্বনি। পড়ে শোনানোর মাঝপথেই এনামূলদা হু হু করে কানতেন। আমরা এনামুলদার দুঃখে কানতাম। এই দুঃখ ছিল সত্যি সত্যি অসহনীয়। আমাদের সকলের দুঃখে একদিন আমাদের মা সুনীলের বইটা চুলায় দিয়েছিল। কবিতার আগুনে পায়েস রান্না করেছিল। খেয়ে এনামূলদা বহুদিন পরে হেসেছিলেন।

চুলার আগুনে পুড়ে ছাই হলেও সুনীলের ঐ বইটির অনেক কবিতাই এনামুলদার মুখস্ত ছিল। তিনি নিয়মিত বই ছাড়াই লোকজনদের কেউ কথা রাখেনি শোনাতেন। আমাদের শহরের পানওয়ালা, আইসক্রিমওয়ালা এমন কি একজন হুজুর শ্রেণীর লোকও এই কবিতা গড়গড়িয়ে বলতে পারতেন। দোয়াদরুদও পড়া হত বলে রটনা ছিল। আর পাড় কমিউনিস্টদের জন্য এটা ছিল লাল ইস্তেহার। মাঝরাত্রিরে যেসব বিখ্যাত লোকজন পথ হারিয়ে ফেলত, তারা চিৎকার করে দূরন্ত ষাড়ের চোখে লাল কাপড় বেঁধে দেওয়ার প্যারাটি মোড়ে মোড়ে হেঁকে যেত–

‘ভালোবাসার জন্য আমি হাতের মুঠেয়ে প্রাণ নিয়েছি

দূরন্ত ষাঁড়ের চোখে বেঁধেছি লাল কাপড়

বিশ্বসংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনেছি ১০৮টা নীল পদ্ম’

এই পদ্মপালা শুনলে শিশুদের ঘুমানোর জন্য মাসিপিসিদের দরকার হত না। আমাদের সমাজসেবক হাবিবুর রহমান হাবিল মিয়া ভেবেছিলেন, তিনি কবিতাটির একটি মর্মর শিলালিপি শহরের বিদায়-পথে স্থাপন করবেন। তার অকস্মাৎ কথাস্মৃতি দশাপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে এই পরিকল্পনাটি শ্রুতিচিহ্ণ হিসাবে আছে। থাকবে আরও কিছুকাল।

এই কবিতাটি শোনার আগে আমাদের শহরের সবাই সবার কথা রাখত। এরপর কেউ আর কথা রাখতে পারেনি। পুরো দোজখখানা হয়ে গিয়েছিল। এই দুঃখে আমি শহরটি ছেড়ে চলে এসেছিলাম। এখন খবর পেয়েছি, এনামূলদাও পালিয়ে বেঁচেছেন। শুধু কবিতাটি আছে। আকাশে বাতাসে। জলে স্থলে। অন্তরীক্ষে। এখনো কবিতাটি কেউ কেউ পড়েন। আমার মা তার জন্য পায়েস রান্না করতে আগ্রহ বোধ করেন।

৫……………………………………………………………………………………………………………………………

অভিশাপ পর্ব : যারা এই লেখাটি পড়ছেন, যাদের এই কবিতাটি নিয়ে কিঞ্চিৎ অভিজ্ঞতা আছে–তারা যদি সেটা এখানে না লেখেন, তাহলে তাদের কথাও কেউ রাখবে না। ১০১% নিশ্চিত ভবিষ্যৎবানী। মনে রাখবেন। হু।

কেউ কথা রাখেনি : আবৃত্তির লিংক :

অনেক কবিতা পড়ার লিংক :

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


5 Responses to স্মৃতি তুমি ব্যাদোনা : সুনীলের কেউ কথা রাখেনি

You must be logged in to post a comment Login