আজিজুল

হারিয়ে যাওয়া মুখগুলোঃ প্রথম পর্ব

হারিয়ে যাওয়া মুখগুলোঃ প্রথম পর্ব
Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

স্কুলে আমার এক বন্ধু ছিলো, নাম তানভীর। সেদিন সে ছবিঘরে বলল, ‘আজিজ দোস্ত, স্কুলের সবার কথা তোর মনে আছে?’

আমার কিছু মনে নেই। তবু বেশ অভিনয় করে বললাম,’আছে’। সত্যি কথা বলতে কি, স্কুলের অধিকাংশ কথা আমি মনে রাখতে চাইনা। কিন্তু কিছু মুহূর্ত আজও নাড়া দিয়ে যায় অবিরাম। সেইসব স্মরনীয় মুহুর্তের সঙ্গীসাথীদের নিয়ে আজকের নিবেদন- প্রথম পর্ব

হারিয়ে যাওয়া মুখগুলো

-১-

রাশেদ। কান গুলো একটু বড়সড় ছিলো-অনেকটা হাওয়া ভবনের তারেক রহমানের মতন। আমি আর রাশেদ। যেন ক্লাসের দুই গব্বর সিং।

এক গব্বর সিং এর ঠেলায় গোটা গ্রাম আতংকে থাকতো- আর সেখানে মাত্র ৪৫ জন ছেলেপেলেদের মাঝে দুই দুইটা জিন্দা শয়তান-ভাবা যায়?

সবাই আমাদের ভীষন ভয় পেত। ক্লাসে কেউ আমাদের নামে বিচার দিলে মান-সন্মান-ইজ্জত কোনটাই নিয়ে বাড়ি যেতে পারতো না। কেমনে যে মাথায় তখন বুদ্ধি গিজ গিজ করতো-আর এখন একটা রিসার্চ পেপার লেখার সময় সে বুদ্ধিগুলোকে খুজেই পাইনা!

আমাদের কোন স্যার মারতে আসলেও বিপদে পড়তেন। আমরা প্যান্টে পাছার পেছনে প্রচুর চকের গুড়ো মাখিয়ে রাখতাম। কোন স্যার বেত দিয়ে মারলেই ধুমাধুম ধোয়া বেরুতো। গোটা ক্লাস ধোয়ায় ভরে যেত!

একদিন রাশেদ আর এলোনা। সেদিন থেকে আমি উপলব্ধি করলাম- একা মার খেতে ভীষন কষ্ট। শুনলাম সে ইংরেজী মিডিয়াম স্কুলে চলে গেছে। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের উপর এমন রাগ উঠলো সেদিন! যদি কোনদিন বিয়ে করি আর বাচ্চা হয়, ভুলেও ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াবোনা। বউ চাইলেও না। প্রয়োজনে ডিভোর্স খাবো- তাও ‘না’।

-২-

শাওন। আমার নামটা মোটেও পছন্দ ছিলোনা। নামটা শুনলেই কনফিউওশনে পড়ে যাওয়ার জোগাড়- ছেলে না মেয়ে।

তাই আমি ডাকতাম জাহিদুল। পুরো নাম জাহিদুল ইসলাম শাওন।

মানুষের সবার ভালো ও খারাপ গুন থাকে। মেধাতালিকায় ক্লাসের শেষ ছেলেগুলোর খারাপ গুন গুলোই সবাই গায়। আমিও যেহেতু এককালে তার সাথে মেধাতালিকায় শেষ থেকে প্রথম হবার জন্যে কম্পিটিশনে থাকতাম, তাই তার খারাপ গুন আমার কাছে গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল। তার ভালো গুন কেউ মনে রেখেছে কিনা জানিনা। কিন্তু আমি রেখেছিলাম, এখনো রাখি।

জাহিদুল এর হাতে লেখা ছিল খুব সুন্দর। আমাদের বাংলা পড়াতেন সোবহানস্যার। স্যার ক্লাসে এসে তাকে দিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে দিনের প্রথম লিখাটি লেখাতেন। আমি মুগ্ধ হয়ে তার লেখায় তাকিয়ে থাকতাম। আমার ছিলো কাকের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং মার্কা লেখা। মানুষের যা নাই- তা নিয়ে বেশ আফসোস করে। আমি তার ব্যাতিক্রম হবো কেনো?

একদিন জাহিদুল  আমাকে বলল,’আইজ্যা (আমাকে সবাই আইজ্যা বলেই ডাকতো, কাছের কিছু বন্ধুরা এখনো তাই ডাকে, তবে ইদানিং তারা এ নামে ডাকতে ভয় পায়। আচ্ছা, আমি কি ইদানিং বাঘ-ভাল্লুক হয়ে গেলাম নাকি। সবাই মেপে মেপে কথা বলে কেন?) তোর হাতের লেখা দেখে বুঝা যায়, একসময় তোর হাতের লেখা খুব সুন্দর হবে-তুই দেখিস।’

কথাটা সে খুব কম সময়ের জন্যে একবারই বলেছিলো। আমি সেই কথা মন্ত্রমুগ্ধের মতন শুনেছিলাম। সেদিন থেকে নিজের উপর অগাধ বিশ্বাস জন্মেছিল। কে বলে ক্লাসের একেবারে খারাপ ছেলের কাছ থেকে কিছু শেখা যায়না?

-৩-

-নিসার!

-জি স্যার?

-এই,ফাজলামি করিস?

-কি বলেন স্যার?

খালি হাসতো! তাই স্যারেরা ভাবতো ও বুঝি ফাজলামি করে হাসছে। ওর আরেকভাই ছিল কাওসার। নিসার আর কাওসার এর কাজ ছিলো রোজ শুক্রবারে বন্ধের দিনে হাসার কম্পিটিশন করা।

এই চোয়াল ভাঙ্গা ছেলেটা ছিল আমার স্কুলের শেষ সময়ের বন্ধু। আমার আরেক বন্ধু ছিল ওই সময়- নাম নওশাদ। ওরো চোয়াল ভাঙ্গা। কিন্তু নওশাদকে দেখলে নায়ক নায়ক লাগতো। কলেজে পড়বার সময় শুনেছিলাম একদিন নওশাদ একটা প্রপোজাল পেয়েছিলো বাচ্চা মেয়ের কাছ থেকে (সম্ভবত ক্লাস সিক্সের মেয়ে)। বেচারী খুব কষ্ট পেয়েছিলো। এত মেয়ে থাকতে এই বাচ্চা মেয়ে কেন!

আমরা তিন বন্ধু আড্ডা দিতাম পলাশীর মোড়-বালুর মাঠ-লালবাগ-ঢাকা বোর্ড অফিস আর আউলা হল খ্যাত আহসানউল্লা হলে।

নিসার আর নওশাদ দুপুরে আমার বাসায় আসতো। আমাদের বাসায় বন্ধুদের আসাতে নিরুত্সাহিত করা হতো। তবুও এই দুই বন্ধু ভয়ে ভয়ে আমার বাসায় আসতো। কলোনীর নীচ থেকে দাড়োয়ানের ঘর থেকে বাসায় কল দিতো,’আজিজ-দোস্ত স্যার আছে?'( একমাত্র এই দুই বন্ধুই আমাকে আইজ্যা এর যায়গায় আজিজ ডাকতো)।

স্যার মানে আব্বা।

আমি যদি বলতাম ‘না নাই’, ওরা দুইজন তাহলে আমার বাসায় আসতো। যদি বলতাম, ‘আছে’। তাহলে ওরা দুইজন এক সাইকেলে একজনের কোলে আরেকজন বসে চুপি চুপি চলে যেত।

সাইকেলটা ছিলো আমাদের তিনজনের শেয়ারে কেনা। ওই সাইকেলে করে আমরা পলাশী থেকে এলিফেন্ট রোডে রউফ স্যারের বাসায় পড়তে যেতাম। প্রাইভেট পড়বার সময়কাল মাত্র দুই মাস। যা কষ্ট হতো তিনজনের! একজন চালাতো আর সামনে পিছনে দুইজন বসতে হতো। কষ্ট করে যাবার পর স্যারের বাসার নিচে গিয়ে একটা ফান্টা খেতাম ভাগাভাগি করে। ফান্টা আমাদের তিনজনের পছন্দের ছিল, কিন্তু কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতাম,”কোক খাইছিরে দোস্ত”। কারন, ফান্টা কি ছেলেরা খায়? কেউ জানতে পারলে কী লজ্জা!

-৪-

উজ্জ্বল হোসেন। খুব একটা মনে নাই তার স্মৃতি। হারিয়ে যাওয়া মুখ সেই ক্লাস সেভেন থেকেই। দুইবার ফেল করেছিলো। ফলাফল স্কুল থেকে বহিস্কার। হাতের লিখা অসাধারন। হিন্দি অক্ষরও লিখতে জানতো! একদিন আমাকে বলল,’আইজ্যা, স্যারগো কথা শুইন্যা লাভ নাই। চল কবিতা লিখি ।’

সেই থেকে শুরু। আমি আর উজ্জ্বল সমানে কবিতা লিখতে থাকতাম।

একদিন মোল্লা স্যারকে নিয়ে কবিতা লিখছিলাম। স্যারের আসল নাম ছিল মঞ্জুরুল আহসান স্যার। বলা বাহুল্য-নামটা আমারই দেয়া।

স্যারের কাছে ধরা পড়ে গেলাম। সেই মাইর!!! আমি বিখ্যাত কবি হয়ে গেলাম। উজ্জ্বল তার আলো আমার কাছে দিয়ে হারিয়ে গেল!!

-৫-

আমার এক স্কুল বন্ধু ছিল-নাম মাসুম ইলাহি মোল্লা। আমি ডাকতাম মামবাচ্চু।

এই ছেলেটা ছিল এক নাম্বারের ফাজিল। কিন্তু আমার জিগার কি দোস্ত। এই জিগার কি দোস্ত হাসলে গালে টোল পড়তো। মাথায় শজারুর মতন খাড়া খাড়া চুল। স্কুলের বড় আপুরা তাকে ভীষন আদর করতো। ওর কোনদিন টিফিন আনতে হতোনা। কারন ওই যে, বড় আপুরা! আমিও তাই ওর সাথে সাথে থাকার চেষ্টা করতাম- ও দলে নিতোনা। তাও হাল ছাড়িনি সেসময়।

ক্লাস এইটে থাকতে আমাদের স্কুল ছেড়ে মামবাচ্চু অন্য স্কুলে চলে গেল।

আজ থেকে ঠিক চার বছর আগের এই দিনে তার সাথে দেখা হয়েছিল নিউমার্কেটে চশমার দোকানের সামনে। তার খাড়া খাড়া কদমকলি চুল আর ফোলা দুই গাল আর নাই। হাসির সময় তার গালের টোল দেখার জন্যে তাকে হাসানোর চেষ্টা করেছিলাম, পারিনাই। চরম বাস্তবতা ভর করেছিল সেদিন আমাদের মাঝে। শ্যামবর্ন ছেলেটা এখন কোথায় আছে-জানিনা।

ইদানিংকালে ছবিঘরে তাকে খুজি -কেন খুজি তাও জানিনা। 

(লিখিত: ১লা সেপ্টেম্বর, ২০১০)

-৬-

মাত্রই জানলাম খবটা। অামাদের সেই মামবাচ্চুকে ছবিঘরে খুজে লাভ নেই আর। মাসুম সড়ক দুর্ঘটনায় চলে গেছে অামাদের ছেড়ে।

(লিখিত: ২রা সেপ্টেম্বর, ২০১০)

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


11 Responses to হারিয়ে যাওয়া মুখগুলোঃ প্রথম পর্ব

You must be logged in to post a comment Login