নীল নক্ষত্র

নির্বাক বসন্ত [মোট ২৫ পর্ব] পর্ব-৫

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

ঢাকায় যাবার দিন ঠিক হবার পর থেকেই নিশাতের মনটা বিষণ্ণ, কি জানি কি এক আশঙ্কা। শীতের শেষে প্রকৃতিও যেন নিশাতের মনের সাথে যোগ দিয়েছে। নিরুর বোন যুঁই এর সাথেও তেমন কথা জমে উঠে না, শিহাবের সাথেও খুব একটা দেখা সাক্ষাত নেই বললেই চলে। গাছের সবুজ পাতা সেই কবেই ঝরে গেছে মাঠ ঘাটের সবুজ তাজা ঘাস গুলিও যেন শুকিয়ে হলুদ বিবর্ণ হয়ে গেছে। বাঁশ ঝাড়ের পাতা গুলি ঝরে গিয়ে কাঠির মত দাঁড়িয়ে রয়েছে। চারি দিকেই কেমন যেন একটা শুকনো মলিন ভাব। সূর্য ডোবার আগে দিগন্তের রক্তিম আভার সাথে গরু বাছুরের পায়ের ধুলো, রাখালের পায়ের ধুলো, বাড়িতে বাড়িতে কলই গম মাড়ানোর ধুম। পিঁয়াজ খেতের ফুল গুলি শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে আসছে কখন যেন কৃষক এসে তুলে নিয়ে যাবে। বিলের ধারে সকাল বেলা বক পাখি ধ্যানে মগ্ন থাকছে না। রোদের তেজ যেন ক্রমেই বেড়ে চলেছে। তাহলে কি ওরাও নিশাতের মনের কথা বুঝতে পেরেছে?
যাবার আগে সন্ধ্যা বেলা শিহাবদের বাড়ি এলো। শিহাব বাড়ি নেই, যুঁই বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল কিরে, তোরা তাহলে কালই চলে যাবি? কখন যাবি, আয় ভিতরে আয়। আজ আমাদের খৈ বানিয়েছে, হাট থেকে বাবা দৈ এনেছে একটু খেয়ে যা। ভিতরে নিয়ে বসতে বলে রান্না ঘরের দিকে চলে গেল। দরজার পাশে এসে দাঁড়াল নিরু।
যুঁই একটু পরে এক হাতে দৈ খৈ এর পেয়ালা আর এক হাতে এক গ্লাস পানি এনে নিশাতের সামনে টেবিলে নামিয়ে রেখে বলল নে খা। আবার কবে আসবি না আসবি তার ঠিক নেই। তোদের বাড়িতে তাহলে কেউ থাকবে না সবাই চলে যাবি?
আর কে থাকবে বল?
বিষণ্ণ মনে যুঁই বলল বাবা মনে হয় আমাকে মানিকগঞ্জের কলেজে ভর্তি হতে দিবে না, কাজেই আমার পড়া শুনা বন্ধ। তুই কিন্তু বাবাকে বলে যাবি অন্তত তুই ঢাকায় যে কলেজে ভর্তি হবি শিহাবকেও যেন সেখানে ভর্তি হতে দেয়।
এসব কথার কিছু নিশাতের কানে ঢুকছে কিছু ঢুকছে না। তার মন রয়েছে দরজার ওপাশে। ও কি একটু ভিতরে আসতে পারছে না। মনে একটা সূক্ষ্ম অভিমান এসে ভর করল। কেন? এখন কি আমার ভিতরে যাওয়া সাজে? তাহলে যুঁই কি বলবে? তুমি একটু এ ঘরে আসতে পারছ না কেন? আর কিছু ভাবতে মন চাইল না। কোন রকম খৈ খেয়ে যুঁইকে বলল শিহাব এলে ওকে রাতে দেখা করতে বলবি। বলেই বের হয়ে বাড়ি চলে গেল।

পরদিন ওরা ঢাকায় চলে এলো। মিরপুর এলাকায়। বাবা যেভাবে ঠিকানা লিখে বলে দিয়েছিলেন সেই অনুযায়ী ঠিক ভাবে আসতে কোন অসুবিধা হয়নি। গাবতলি নেমে নতুন শহর বলে একটু ইতস্তত লাগছিল তবুও আসতে পেরেছে। নিশাত কলেজে ভর্তি হলো, ছোট ভাই বোনেরা স্কুলে।
কয়েক মাস থাকার পর মা এক দিন নিশাতের সাথে পরামর্শ করলেন, পরের বাড়িতে থেকে মাসে মাসে এত গুলি টাকা ভাড়া দিয়ে সংসার চালান কঠিন হয়ে যাচ্ছে। আমি ভাবছি যদি নিজেদের একটু জায়গা হত তাহলে যেমন তেমন একটু টিনের চাল বেধে থাকার ব্যবস্থা করতে পারলে এই ভাড়ার টাকা গুলি বেচে যেত।
তা হয় কিন্তু জমি কেনার এত টাকা পাবেন কোথায়?
কেন, গ্রামের বাড়িতে আমাদের এজমালি জমি গুলি আছে সেগুলি থেকে আমরা কি পাই ওগুলি বিক্রি করে দিলে যে টাকা আসবে তা দিয়ে হয়ে যাবে।
বেশ ভালো কথা, আব্বার সাথে আলাপ করে দেখেন কি বলে।
নিশাতের বাবা বিকেলে অফিস থেকে ফেরার পর হাত মুখ ধুয়ে চা নাস্তা খাবার সময় নিশাতের মা কথাটা তুললেন। শুনে সেও মোটা মুটি সম্মতি জানাল। এবার গ্রামের ওই সব টুকরা টুকরা জমি, পুকুর, বাগানের অংশ যেখানে যা ছিল সব বিক্রি হয়ে গেল। শুরু হলো ঢাকায় জমি খোজার পালা। এক সময় তাও হয়ে গেল। যেখানে ভাড়া থাকত তার কাছেই ছোট এক টুকরো জমি পেয়ে রেজিস্ট্রি ইত্যাদি যা করার তাও হয়ে গেল। নতুন জমিতে কোন রকম কাচা মাটির একটা দোচালা টিনের ঘর। পাশে বাঁশের বেড়ার চাল দেয়া রান্না ঘড় আর কাচা একটা টয়লেট বানানোর কাজ হয়ে গেল। এবার একটা শুভ দিন শুভ লগ্নে তারা নতুন বাড়িতে উঠে পরল। কাচা পাকা যাই হোক নিজেরতো! মাস শেষে ভাড়ার টাকা গুনতে হবে না। বাইরের দিকে আস্তে আস্তে বাঁশের বেড়া দিয়ে ভিতরে কিছু শাক সবজির বাগান করে নিলো। পাশেই একটু খোয়ারের মত করে কয়েকটা মুরগী। এইতো নিজের বাড়ি আর ভাড়া বাড়ির তফাত। এখন থেকে ভাড়াতো দিতে হয়ই না উপরন্তু কিছু শাক সবজী সহ ডিম মাংসের খরচও কমে গেল। যত ছোটই হোক আর যত সামান্যই হোক ঢাকা শহরে নিজের একটু খানি কুটিরের দাম যে কি তা হারে হারে বোঝা যাচ্ছে।
এক দিন সকালে কলেজে যাবার আগে নিশাত বাগানে সবজির যত্ন করছে এমন সময় একটু দূরে খোলা রাস্তায় নজর গেল। দেখল সবুজ শাড়ি পরা এক জন মহিলা আর তার সাথে বাচ্চা কোলে নীল কামিজ গায়ে এক মেয়ে এদিকে এগিয়ে আসছে। হঠাৎ চেনা চেনা মনে হলো। আরও একটু কাছে এলে দেখল নিরু আর তার বড় বোন বীণা আসছে। বীণা মাঝে মাঝেই আসে। কাছেই বাড়ি। পাশে যখন ভাড়া বাড়িতে থাকত তখনও এসেছে কয়েক বার। কিন্তু সেই আসা আর আজকের আসার মধ্যে কোথায় যেন একটু পার্থক্য মনে হলো নিশাতের কাছে। আজ যেন এক ভিন্ন সুর বেজে উঠল নিশাতের মনে।

বিশ্বে প্রতিনিয়ত কত কিছুই ঘটে যাচ্ছে তার সব কিছু মনের চোখে সব সময় ধরা পরে না। আবার অনেক কিছু আজ যে রকম মনে হয় সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথেই ভিন্ন জনের কাছে ভিন্ন ভাবে ধরা দেয়। সময়, কাল, স্থান ভেদে ভিন্ন রূপ ধারণ করে। এ ও ভালো। এক ধরনের বৈচিত্র্য। প্রকৃতি যেমন খেয়াল পাল্টায় ঋতু বদলায়  মানুষের মনও তেমন। আজকে যা ভালো লাগছে কাল তা আঁকড়ে ধরে রাখতে পারছে না। শুধু পার্থক্য এ টুক যে ঘড়ির কাটা মহা কালের সাথে মিলনের জন্য বার বার ঘুরেই চলেছে। দক্ষিণ মেরু থেকে অনেক বাতাস উত্তর মেরুর দিকে বয়ে গেছে। পৃথিবীতে অনেক ক্ষুধা তৈরি হয়েছে।
বীণা নিরুকে নিয়ে নিশাতদের বাড়িতে এসেছে। চাচির সাথে দেখা করার জন্য। গতকাল নিরু এসেছে গ্রামের বাড়ি থেকে। ওকেও সাথে করে নিয়ে এসেছে। নিরুর স্কুল বন্ধ হলেই একটা দিনও দেরি না করে সোজা বড় বোনের কাছে এসে কাটিয়ে যায়। নিরু গ্রাম থেকে আসার সময় এই এটা ওটা যা গ্রামের বাড়ি থেকে শহরে আনতে হয়, ক্ষেতের কিছু মটর শাক, ধনে পাতা, কলার মোচা, গাছের কিছু ফল মুল, কাচা আম, কিছু আম সত্ত্ব, নারকেলের লাড়ু, গাছের পাকা কুমড়োর মোরব্বা যা কিনা মা নিজে বানিয়েছে, কয়েকটা গাছ পাকা কত বেল। ঢাকা শহরে কি আর গাছ পাকা কত বেল পাওয়া যায়! যা  পায় সব জাগ দেয়া। যা খেয়ে বড় হয়েছে সেই ছোট বেলায় যা নিয়ে মন কষা কষি হয়েছে, যা নিয়ে ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখেছে সে দিন গুলির স্মৃতি কি মনে পরে না? সেই বাড়ির ঘাটের নয়তো চৌরাস্তার ছবি, সেই গন্ধ আবার পিছনে ফিরে দেখতে ইচ্ছে করে না? তাই আসার আগে মা পোটলা বেধে এগুলিও দিয়ে দেয়। বীণা আবার তাই কিছু চাচির জন্যে নিয়ে এসেছে। চাচীও ওগুলি পেয়ে বেশ খুশি।
মা সিঙ্গারা বানালেন, রান্না ঘরের পাশে পিঁড়িতে বসেই চা সিঙ্গারার পালা শেষ। মা বায়না ধরলেন নিরুকে নিয়ে এসেছিস আজ দুপুরে এখানে খেয়ে যাবি, কবির আসবে সেই সন্ধ্যায় কাজেই আর চিন্তা কি বাড়িতে ভাড়াটিয়ারা আছে। অকাট্য যুক্তি দেখালেও প্রথমে বীণা আপা একটু আমতা আমতা করে শেষ পর্যন্ত রাজী হয়ে গেল। নিশাতের মা রান্না ঘর থেকে বের হয়ে নিশাতকে একটা মুরগী বের করতে বলে কলেজে যাবার তাগিদ দিলেন। নিশাত আস্তে করে বলল আজ কলেজ বন্ধ।
বন্ধ! তখন যে বললি তাড়াতাড়ি যাবি!
বলেছিলাম না কি! কি জানি ভুলে বলেছি মনে হয়। আচ্ছা থাক কলেজে আজ যেতে হবে না তার চেয়ে মুরগীর খাঁচার বেড়া গুলি জায়গায় জায়গায় ভেঙ্গে গেছে ওগুলি ঠিক করি কাজে লাগবে। মুরগী বেরিয়ে যায় ধরে আনতে আপনার কষ্ট হয়।
মা কি বুঝলেন তা নিশাত জানে না তবে মা আর চাপা চাপি করেননি। নিশাত একটা মুরগী বের করে পাশের বাড়ির কালামকে ডেকে জবাই করে মার হাতে এনে দিয়ে ঘর থেকে সাড়াশি গুনা তার এনে আবার লেগে গেল খোয়ার ঠিক করার জন্য। মন কাজে ছিল না। হাত দুটাই শুধু নেট বাধার কাজে উঠা নামা করছে। এক সময় পিছনে চেনা পায়ের শব্দ শুনে ফিরে দেখে নিরু এসে দাঁড়িয়ে তার মুরগীর খামার দেখছে। নিশাতকে পিছনে তাকাতে দেখে নিরু বলল বাহ বেশ সুন্দর! এক এক করে মুরগী গুলি গুনে দেখে বলল পনেরটা! নিশাত পিছনে তাকিয়ে বলল তুমি আবার এখানে কেন, যাও তোমার চাচীর কাছে গিয়ে বস। এ কথা শুনে নিরু আর একটা মুহূর্ত দেরি না করে চলে গেল। মনে বিষাদের করুন সুর বেজে উঠেছিল। সেদিন ঢাকায় আসার সময় একটু দেখা দিয়ে আসতে পারনি আজ আমি নিজে এসেছি কোথায় দুটি কথা বলবে তা না করে বলে কি না যাও চাচির কাছে যাও। আমি কি চাচীর কাছে এসেছি? আমি এসেছি শুধু তোমাকে একটু দেখতে। তুমি কেন বুঝলে না। নিশাত আবার পিছনে ফিরে ওকে দেখতে না পেয়ে কেমন যেন বিদিশা হয়ে গেল। এ কি করলাম যার জন্য কলেজে গেলাম না তাকে এ কি বললাম! কি হে নিশাত! তুমি কোন ধরনের মানুষ? এ যে তোমার প্রথম প্রেম তা কি বুঝতে পারছ না? ওদিকে নিরু এসে সেই যে চাচীর কাছে বসল যতক্ষণ ও বাড়িতে ছিল ততক্ষণ কারো সাথে আর একটি কথাও বলে নি।

সদ্য স্বাধীন দেশে সব জিনিস পত্রের দাম দিনকে দিন বেড়েই চলছে। প্রকৃতি তার রুদ্র রূপ মেলে দিচ্ছে। জীবন হয়ে উঠছে কঠিন থেকে কঠিনতর। নতুন দেশ, নতুন অর্থনীতি, শূন্য ভাণ্ডার আর তার সাথে অবাধ চাহিদা। চারিদিকে শুধু ক্ষুধা আর ক্ষুধা। বিরূপ পরিবেশ। এর মধ্যেই আবার প্রকৃতি নিয়ে এলো তার প্রচণ্ড হিংস্র মূর্তি। দেশে দেখা দিল বন্যা। এমনিই মানুষ সামাল দিতে পারছে না তার মধ্যে আবার এই দুর্যোগ। রেশন কার্ড নিয়ে নিশাত রাত তিনটায় রেশন দোকানে লাইনে দাঁড়াত, তবুও গিয়ে দেখত তার আগে আরও কয়েক জন এসে পরেছে। ঘুমে চোখ একা একাই বন্ধ হয়ে আসতে চাইত কিন্তু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি আর ঘুমানো যায়? তীর্থের কাকের মত চেয়ে থাকত কখন সূর্য উঠবে কখন নয়টা বাজবে, কখন দোকান খুলবে! এই রেশন নিয়ে বাড়ি গেলে মা রান্না করবে। ক্ষুধা নামক জীবের অদৃশ্য শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য প্লাস্টিকের চাউল যা সেদ্ধ হতে জ্বালানী খরচ হত অনেক, পোকা ধরা দুর্গন্ধে ভরা কিছু গম আর কিছু চিনি এই ছিল রেশন কার্ডে বরাদ্দ। তবুও নিরুপায় মানুষকে তাই খেতে হত। শাক সবজি, ডাল, মাছ এসব তো আর রেশনে পাওয়া যায় না। ওগুলি পাবার ব্যবস্থা আছে কিন্তু তা অন্য ভাবে। বাজারে ওসব পাওয়া যায় কিন্তু তা কেনার সামর্থ্য খুব কম লোকের হাতে। বাড়িটা করতে গিয়ে নিশাতের বাবা কিছু ঋণ করেছিল। গ্রামের জমি বিক্রির টাকায় হয়নি। অল্প কিছু ঋণ করতে হয়েছিল। সেই ঋণ শোধ করতে গিয়ে নিশাতের বাবাকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল। তার মধ্যে আবার ওদের পাঁচ ভাই বোনের লেখা পড়া।
ওই দুর্যোগের মধ্যেই মাছ ভাতের বাঙ্গালি তার চিরাচরিত অভ্যাস ছেড়ে খেতে শিখল গমের আটার রুটি। তাও আবার যারা দিচ্ছে তাদের অখাদ্য। আরও শিখল সরষের তেলের পরিবর্তে সয়াবিন তেলে রান্না। বুড়ি গঙ্গা আর তুরাগ নদী দিয়ে অনেক পানি বঙ্গোপসাগরে মিশেছে আবার সেই পানি সূর্যের তাপে বাষ্পায়িত হয়ে হিমালয়ে কিংবা কাঞ্চনজঙ্ঘা কিংবা মানস সরোবরে এসে জমেছে। এখান থেকে নদী বেয়ে আবার গেছে বঙ্গোপসাগরে। প্রকৃতি থেমে নেই। সে তার আপন গতিতে নিজ রূপে বয়েই চলছে। তার কোন তাড়া নেই, কোন অভাব নেই। আকাশের চন্দ্র সূর্য তারা নক্ষত্র রাজি সবই উদয় হয়েছে আবার অস্তও গেছে। বাতাস বয়ে গেছে সাথে করে কখনও উড়িয়ে নিয়েছে কিছু মেঘমালা, কখন শান্ত বেগে কখন অশান্ত ঝড়ের বেগে, কখন নিস্তব্ধ মৃদু বেগে।
এই ভাবেই ক্যালেন্ডারের পাতা একের পর এক উলটে গেছে। ঘড়ির কাটা ঘুরে ঘুরে ঋতুর পরিবর্তন এনেছে। যত্নে সাজানো বাগানের এবং অযত্নে বেড়ে উঠা ঝোপ ঝাঁরে বন ফুলের অনেক কলি ঝরে গেছে আবার তার জায়গায় নতুন কুড়ি এসেছে। এগুলিও কিছু আধো ফোটা অবস্থায় ঝরে গেছে, কিছু ফুটে তার সৌরভ ছড়িয়েছে আবার কিছু ঠাই পেয়েছে কারো সাজানো ঘরের ফুল দানিতে নয়ত কারো প্রিয়ার খোপায় তার হিসেব কে রেখেছে কে জানে! এই ভাবেই বয়ে চলেছে জীবন নদীর শান্ত অশান্ত স্রোত। কোনটা সাগরে মহা মিলনে মিলিত হয়েছে আবার কোনটা মাঝ পথেই শুকিয়ে গেছে। আবার কোনটা কিছু দূর এগিয়ে মাঝ পথে এসে স্তব্ধ হয়ে থমকে গেছে। এই ভাবে চলেছে, চলছে এবং মহাকালের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চলতেই থাকবে। তার পর এক দিন হবে সব কিছুর অবসান। কেউ নিজের ইচ্ছে মত নিজের বাগান সাজাতে পারেনি। সব কিছু যেন কোন অদৃশ্য এক ভাগ্য নামের রিমোট কন্ট্রোলের হাতের পুতুল হয়ে ডানে বামে সামনে পিছনে চলছে। কে কার খবর রাখে?
ছোট বেলা থেকে নিশাতের ইচ্ছে ছিল ইঞ্জিনিয়ার হবে, মস্ত ইঞ্জিনিয়ার। নিজ হাতে বানাবে নানা রকম ইঞ্জিন যা মানুষের কাজে লাগবে, মানুষের দৈনন্দিন জীবন সহজ করে দিবে। কিন্তু তার সে স্বপ্ন থমকে গেল কলেজে ইলেক্টিভ ম্যাথে এসে। নিশাত বাবার কাছ থেকে সাধারণ গণিত বেশ ভালো বুঝে নিয়েছিল কিন্তু ক্যালকুলাস, স্ট্যাটিস্টিকস, ডাইনামিকসের ধাক্কায় সব থেমে গেল। নিশাত তার মাথায় এগুলি জোড় করেও ঢুকাতে পারলো না। ওদিকে বাবার এমন সামর্থ্য নেই যে এ জন্য তাকে আলাদা প্রাইভেট টিউশনের খরচ যোগায়। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে বায়োলজি নিয়ে পড়ে ময়মনসিংহের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে এমন সিদ্ধান্ত নিলো। এতেও গবেষণার সুযোগ রয়েছে যথেষ্ট। কিন্তু কলেজ শেষ করে আর বেশি দূর এগুতে পারেনি। দেশের ক্রম বর্ধমান দুর্মূল্যের ফলে তার বাবা তাদের এই পাঁচ ভাই বোনের সংসার সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিল।
মানুষ মুখে যাই বলুক যতই বলুক দেশের জন্য দশের জন্য ভাবছে। আসলে তার কতটা সত্য তা নিশাত জানে না। নিশাত এখন ভাবছে আসলে এগুলি কিছু নয়। মানুষ ভাবে শুধু তার নিজেকে নিয়েই। সে তার নিজের চাহিদা, নিজের খেয়াল অভাব মেটাবে এটাই এক মাত্র উদ্দেশে। তার নিজের চাহিদা বাস্তব রূপ নিবে, মনে আত্ম তৃপ্তি পাবে, সাথে পাবে যশ প্রতিপত্তি, সম্মান আর সুখ। সুন্দরী শিক্ষিতা স্ত্রী, সাজানো বিলাস বহুল বাড়ি তাতে থাকবে ফুলের বাগান। আরাম আয়েশের যাবতীয় ব্যবস্থা। মালী, চাপরাশি ড্রাইভার সারাক্ষণ তাকে ঘিরে থাকবে। পাশে সুন্দরী স্ত্রী নিয়ে দামী গাড়িতে চলাফেরা করবে এমন অনেক কিছু। নিশাতও ভাবে এই যে আমি চাইছি আমাদের সংসারের বর্তমান অবস্থার উত্তরণ ঘটিয়ে সংসারের উন্নতি করবো, ভাই বোনদের নামী দামী স্কুল কলেজে পড়িয়ে উচ্চ শিক্ষিত করে তুলব, তাদের দামী পোশাক পরাব। সমাজে পাড়া প্রতিবেশীদের ঈর্ষার কারণ হবো তাদের চোখ ধাঁদিয়ে দিবো, সমাজের উন্নতি করবো দেশে বিদেশে নিজের খ্যাতি ছড়াবো তার মুলে কিন্তু ওই একই। নিজের স্বার্থ জড়ান রয়েছে।

মানুষ যতই বলুক তার অন্তর্নিহিত সারমর্ম সে নিজেই। নিজের পেটে ক্ষুধা রেখে কে কার জন্য কতটা পরতে পারে, কত দূর যেতে পারে? নিজের চলার শক্তি হারিয়ে কেউ বেশি দূর যেতে পারে না। এই হয়, এটাই স্বাভাবিক। মানুষের মনের খবর আমরা কতটা রাখতে পারি? এক জন আর এক জনের মনের কথা কতটা জানতে পারি? এক জনের সাথে আর এক জনের কতটা মিল থাকে? হয়তোবা তাই নয়ত কি জানি কেন নিশাতের মনে এক ঝড় বয়ে যাচ্ছে। হায়রে নিয়তি তোমার নিয়ন্ত্রণ ছাড়া কি মানুষ তার ইচ্ছে মত কিছুই করতে পারবে না? এই বিশ্ব সংসারে তুমিই কি রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে মানব জীবনের স্টিয়ারিং ঘোরাবে?
এই সব ভাবনা নিয়ে যখন নিশাত ক্ষত বিক্ষত তখন এক দিন সহপাঠী পাশে কল্যানপুরের বন্ধু হাবিব এসে জানাল, এই নিশাত, জাহাজে চাকরী করবি?
কি করে?
এই যে দেখ আমি কি নিয়ে এসেছি.
বলে একটা খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন বের করে দেখাল। নিশাত সেটা নিয়ে পড়ে দেখল. চট্টগ্রামের এক শিপিং এজেন্ট জেমস ফিনলে জাহাজের জন্য কিছু ডেক ক্যাডেট চেয়েছে। প্রথমে ক্যাডেট হিসেবে জয়েন করবে পরবর্তীতে জাহাজে কাজের অভিজ্ঞতা হলে নির্দিষ্ট সময় পর পর ইংল্যান্ডে গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে পরবর্তী উন্নত পদে উন্নীত হয়ে জাহাজের ক্যাপ্টেন পর্যন্ত হবার সুযোগ আছে।
দারুণ একটা খবর এনেছিস, বেশ ভালো করেছিস এটা এনে, তা তুই কি এপ্লাই করবি?
হ্যাঁ আমিও করবো।
তাহলে চল দুই জনে এক সাথেই করি। এক মাস যাবত কলেজ বন্ধ থাকবে কাজেই এর মধ্যে আর কোন ঝামেলা নেই।
যা যা কাগজ পত্র চেয়েছে সেগুলি যোগার করে বাবা মাকে না জানিয়ে নিশাত হাবিবের সাথে এপ্লিকেশন পাঠিয়ে দিল। কয়েক দিন পর ইন্টার্ভিউ লেটার এলো বাড়িতে। চট্টগ্রাম যেয়ে ইন্টার্ভিউ দিতে হবে এজন্য টাকার দরকার। এখন আর বাবাকে না জানালে চলছে না। বাবাকে জানাবার আগে মাকে জানাতে হবে। মা নিজেই যেন বাবাকে বলে। ওই দিন মাই জিগ্যেস করল তোর নামে এই চিঠি কিসের, কে দিয়েছে? নিশাত মাকে সব খুলে বুঝিয়ে বলল। সবার শেষে বাবাকে বলার জন্য অনুরোধ করল। মা ওই রাতে খাবার সময় বাবার সাথে এ নিয়ে আলাপ করতেই বাবাও রাজী হয়ে গেল। কবে যেতে হবে জানতে চাইলে নিশাত বলল আগামী সোমবার।
আচ্ছা ঠিক আছে।
[চলবে। এতক্ষণ নিশাতের সাথে নিরুর চায়ের নিমন্ত্রণের অপেক্ষায় থাকুন। ধন্যবাদ]

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


You must be logged in to post a comment Login