ফকির ইলিয়াস

আমার কিছু বাছাই কবিতা – ১

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

আমার কিছু বাছাই কবিতা
==================
ধান ও ধ্যানের তবক
——————————-
এখন আর জমা থাকে না কিছুই। খরচ হয়ে যায় সঞ্চয়ের
সুতো,রাতের রহস্য,আশ্বিনের অহংকার,আর পাড়ি দেয়া
ঘাটের ঘটনা। যে ভাবে স্রোতপাত হবার কথা ছিল সমুদ্রে,
তা,- না হবার কারণেই হয়তোবা এবার পুষ্ট হতে পারেনি
দক্ষিণের ফসল। ধানের দুরু দুরু ভয় তাড়িয়ে গেছে পাখির
পরাণ ও। তাই তারা উড়ে আসেনি উৎসের উত্তর থেকে।

আমি ধান ও ধ্যানের তবক সাজিয়ে রোল করা কাগজে করছি
সেই হিসেব নিকেশ। নির্ধারণ করছি,সমূহ জোয়ারের ভাগ্যফল।
কান্তিমান মুখের দু:খ দেখে পরখ করছি অনিমেষ আগুনের পরিচিতি।

কখনওই উজানে যাবার ইচ্ছে ছিল না। ভাটির ভবিষ্যত জেনে
ধ্যানকেও ডাকতে চেয়েছি কাছে। আর ধানের ধ্বনিতে মিশিয়ে
দিতে চেয়েছি তোমাকে ভালোবাসার নক্ষত্রতম উনবিংশ সুর।

ঝড়সমুদ্রের টানে
————————–
মায়া রেখে যাই , ঝড়ের সমস্ত শিকড় আর বিকেলের
পাথরসমগ্রের কাছে । ব্রিস্টল শহরের এই ধূলোকনা
উড়ে যায় আমার চোখ কাঁপিয়ে। এর আগে এখানে
কী হেঁটেছিল কেউ ! কোনো সবুজ শাড়ীর আঁচল
ছুঁয়েছিল এই লনঘেরা মাটিদানা ! আরেকটু এগিয়ে যাই।
একটুকরো প্রকান্ড ঢেউ এসে পাথরের দক্ষিণে রাখে
তার অন্তিম প্রণয় ।

তাকাবার সাহস নিয়ে আমি চোখ খুলি। সূর্য তখন এই
কল্ট স্টেট পার্কের পশ্চিমে রাখছে তার সারাদিনের
জমানো থালাবাসন। যারা বনভোজন সেরে ঘরে ফেরার
জন্য নিচ্ছে পেট্রোলের গন্ধ , তাদের অবসন্ন দেহ আবার
কোনো শূন্য উপগ্রহ ছুঁবে বলে তাকাচ্ছে আকাশের দিকে।

মানুষ রেখে যায় স্মৃতিমায়া ।
আমাকে ক্রয় করে নিচ্ছে যে সরাইখানা
সেও জানবে না এখানে ,
এই পাথর আর এই সাদা গোলাপের বুকে
আমার হাত পড়েছিল !

যন্ত্রস্থ যমুনার মুখ
—————————–
স্বকালকে সাজিয়ে রেখেছি বিদ্যুতপাথরে। চাইলেই ছুঁড়ে
দিতে পারি। আর পারি স্বীকার করে যেতে শান দেয়া চাঁদের
জনম। নিদ্রার নিমগাছ জড়িয়ে জেগে থাকা ভাদ্রের বিবরণ।
পারি আরো অনেক কিছুই। শোকের সংযোগ খুঁজে যে নদী
বয়ে যায় উজান, তার গতিপথ আটকে দিয়ে আমিও হতে
পারি ঝড়ের সমান। তাবৎ তীক্ষ্ণতার তিমিরে ঝলসানো মুখ
আর মৃত মুক্তোগুলোকে হাতে নিয়ে করতে পারি তাদেরও
ভাগ্য গণনা। গণক নই, তবুও দেখলেই চিনে নিতে পারি
বিশাল বৈরাগ্য ভরা পরবের প্রতিবেশী যন্ত্রস্থ যমুনার মুখ

মেঘলা মাঘের মুখ
—————————–
শুধু পদছাপ রেখে যাবার জন্য এসেছিলাম,
সেকথা আমি বলিনা। উত্তীর্ণ আকাশ ছুঁয়ে
অবনত হয় যে বর্ষার স্রোত ,আমি তার সতীর্থ
হয়ে ভাসিয়েছি চাঁদের ডিঙা। কিছুটা জল
আর প্রেমের প্রবল প্রতাপে হতে চেয়েছি
পরাক্রমশালী। রক্তিম রোদে বার বার দেখতে
চেয়েছি মেঘলা মাঘের মুখ ।

যারা আমার কবিতাগুলো পড়বে বলে সারিবদ্ধ
অঙ্গীকার করেছিল,তারা কেউই এই নদীতীরে
আর ফিরে আসেনি। না এসে ভালোই করেছে।
শব্দের শবদেহ পাহারা দিতে দিতে আমি যখন
ক্লান্তপ্রায় ,তখন দেখেছি গুনটানা মাঝিরা ঠিক
ধরাধরি করে অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে সেই শব
দেহগুলো। পাঁজরের চিহ্ন মুছে দিতে চরে কেউ
কেউ লাগিয়েছে সবুজ ঘাসচারা। আর আমার স্বপ্নেরা
বেঁচেছে ঘাস হয়ে, পুষ্প হয়ে।

শুধু পদছাপ রেখে যাবার জন্য এসেছিলাম,
সেকথা আমি বলিনা। যে পাখি ডানা ঝাপটায়
সুখের দরদে ,আমি তার সহযাত্রী হয়ে ভেসেছি
দৃশ্য-দৃশ্যান্তরে। কাঁটার কর্তৃত্ব মেনে গোলাপ
প্রশাখায় রেখেছি হাত। যারা ফিরে গেছে কিংবা
এই দিবালোক থেকে সরিয়ে নিয়েছে তাদের
ছবি, আমি তাদের নিয়েও লিখেছি আখ্যান।
মাঝে মাঝে লিখে যেতে হয় নামাবলী-দীপাবলী।

ঠিক পদছাপ রেখে যাবার জন্য এসেছিলাম
সেকথা আমি বলি না। দরোজার কড়ায় ভর
দুপুর জুড়ে বসেছিলো যে প্রজাপতি-
আমি তার ছবি আঁকতে চেয়েছি।
রঙের রাংতা দিয়ে মোড়ে রেখেছি
কয়েকটি ভোর,
প্রাণের বান্ধব সময়
যাবার আগে তোমার দু’হাতে তুলে দেবো বলে ,

যে তুমি আমার ভেতরে
মাঘে-মেঘে ঘটাও প্রলয়।

মেঘের যতিচন্দন
—————————
হাঁটতে হাঁটতেই বিগ্রহ চিনি। খুলে দিয়ে অন্যআকাশ দাঁড়াই
যাবতীয় রঙ এর বারান্দায়। ঝুলে আছে মেঘরঙ মন, উপবাস
পেরিয়ে বিযুক্ত বেদনা। সবকিছুই সঞ্চয় আমার। তা না হলে
এতো দিনে ভিটেহারা হতাম। খুব বেশী বৈভবী হবো তেমন
কোনো ইচ্ছে ও ছিল না কোনোকালে। তবুয়ো যতিচন্দন মেখে
নিজহাতে সাজিয়েছি আমার এই শব্দ সংসার। আপাততঃ দেবো
না কিছুই। শুধু নিয়ে যাবো। দেবে না ? সন্ধ্যাচূর্ণ , খড়িমাটি
মিশ্রিত নদীর কিনার ।

জলের ইকার
—————————
(কবি তমিজ উদদীন লোদী – সুজনেষু )

তামা ও তমার তারতম্য বুঝি। নিসর্গের তন্দ্রা দেখে নির্ণয় করি
তনুদের ঘুম। তন্তুর তাপ এসে ছুঁয়ে যায় যে প্রেমের শরীর,আমি
তার বাহু হয়ে নাড়ি হাত। আহা ! গ্রহণের সূর্য ; তুমিও হারিয়ে
গেলে রেশ থাকে আঁধার বিভার।পালকের পুষ্পগুলো উড়ে যায়
মহাকাশ ঘিরে। কখনও আয়নার আদলে , পাথরের পিতৃদেশে
দেখি নিজের মুখ। কিংবা বিবর্তনে, বৃষ্টির জ্যোতিষ্কে খুঁজি ধীর
কোনো জলের ইকার। আকার আর আবর্তের দিন।যেভাবে রূপ
রাগে গ্রন্থির বিধানে,নুয়ে থাকে মরমের কাল আর গ্রহাণু প্রবীণ ।

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


6 Responses to আমার কিছু বাছাই কবিতা – ১

You must be logged in to post a comment Login