তাহমিদুর রহমান

ধারাবাহিকঃ নিশিযাত্রা (পর্ব ১০)

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

দশ

ঘুম ভাঙ্গার পর থেকেই বাসি রজনীগন্ধাগুলোর দিকে তাকিয়ে রয়েছে বৈশাখী। বিবর্ণ রঙ ধারন করে শুকিয়ে নুয়ে পড়েছে সেগুলো যেন আগের দিনের কোন রাজা-বাদশাকে কুর্ণিশ করছে জড়সড় হয়ে। জানালা দিয়ে অল্প অল্প আলো এসে ঢুকেছে ঘরে, সেটা দিয়েই ঘরের ভিতর চারদিকে আবছা আবছা দেখা যায়। আসবাবপত্র তেমন নেই কিন্তু যা আছে খুব সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো। দুটি পোর্ট্রেটও ঝুলানো আছে দেয়ালে, একটিতে রবীন্দ্রনাথ আর অন্যটিতে কোন গ্রামের মেঠোপথ। ঘুম ভেঙ্গেই মেঠো পথটার দিকে তাকিয়ে তাকে সে। শুধুমাত্র এ সময়টায় সে কিছুটা বাঁচার তাগিদ অনুভব করে। সেই মেঠোপথ পেড়িয়ে এখন ওর মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে বাসি ফুলগুলো। সে একবার ভাবে ফুলগুলো আজই ফেলে দেওয়া দরকার আবার ভাবে কি লাভ, এমন কে আছে যার জন্যে প্রতিদিন তাজা ফুল সাজিয়ে রাখবে?

কাল রাত থেকেই বৈশাখীর শরীরটা খারাপ। আবহাওয়া পরিবর্তন হলেই হয় জ্বর আসে নাহলে ঠান্ডা লাগে তার। এখন জ্বর আর ঠান্ডা লাগার মধ্যবর্তী অবস্থা চলছে। ঠান্ডা লেগেছে, নাক বন্ধ হয়ে আছে; জ্বর আসি আসি করছে। সকাল দশটা বেজে গিয়েছে, তবু সে এখনো কাজে যায়নি; উঠি উঠি করেও দেরি করে ফেলে সে। ওর ফ্ল্যাটটিতে আরো দুজন মেয়ে থাকে, দুজনেই কি একটা কোম্পানীতে কাজ করে। তবে বৈশাখীর সাথে তাদের তেমন কোন পার্থক্য নেই। তবে বৈশাখী জেনেশুনে তো বিপথে যায়নি, পরিস্থিতি ওকে বাধ্য করেছে। এখন অবশ্য এসবে এসে যায় না তার, চিন্তাও করে না সে। জ্বর নিয়েই উঠে পড়ল সে। কোনমতে রাতের কাপড়টা পালটিয়ে এক টানে চুলটা বেঁধে বেড়িয়ে পড়ে সাড়ে দশটার দিকে। সকালবেলা কাজে যাবার সময় সে তেমন কোন সাজগোজ করে না। তবে ভ্যানিটি ব্যাগটাতে সাজগোজের সামগ্রী নিতে ভুলে না।

আজকের সকালটা মেঘলা, ঠান্ডা আবহাওয়া; তবে জোর দিয়ে বলা যায় না বৃষ্টি হবেই। এরকম আবহাওয়ায় বেশিরভাগ মানুষেরই মন খারাপ হয়ে যায়। বৈশাখীর অবশ্য মন টন বলে ব্যাপার স্যাপার নেই, কবেই কবর দিয়েছে সে মনকে। বৈশাখী বের হয়ে একটা রিক্সা নিয়ে নিল, গুলশান রিক্সাতেই যাওয়া যায় ওর বাসা থেকে। ওর বাসার সামনেই একটা সাদা কার দাঁড়িয়েছিল। প্রতিদিনই কতজন এভাবে গাড়ি পার্ক করে রাখে, বৈশাখী তেমন আমলে নেয় না। কিন্তু বৈশাখী লক্ষ্য করে না যে, তার রিক্সা চলার সাথে সাথে গাড়ীটিও চলা শুরু করে।

বৈশাখী আকাশের দিকে তাকায়, আকাশটাও অভিমান করতে জানে কিন্তু সে অভিমান করাও ভুলে গিয়েছে। সেদিনের ঘটনার পর সে অনেকবার আত্নহত্যার চেষ্টা করেছে। প্রতিবার ভেবেছে, এবার সে আত্নহত্যা করেই ছাড়বে কিন্তু ওর মনের একটা অংশ সবসময় বাধা দিয়ে চলেছে। কেন যে করে, কে জানে? কি পাওয়ার আছে তার, এই পৃথিবীর কাছে সে আর কিছুই চায় না। এখনো সিলিং ফ্যান আছে, ছয়তলা বিল্ডিংয়ের ছাদ আছে, ঘুমের ওষুধ আছে; কোন একটাকে আলিঙ্গন করলেই হল। কত সহজ সে পথ, জানে বৈশাখী। তবু কেন যে এই বেঁচে থাকা? বেঁচে থাকা কি শুধুই সেইসব পুরুষের ক্ষুধা মিটিয়ে যাওয়া? এক একটা পুরুষের ক্ষুধা মিটিয়ে সে কি দীপককে খুঁজে চলে? না না সে দীপককে কিছুতেই মনে করতে চায় না। তবু কেন তাকে খুঁজে সে? প্রত্যেকটা পুরুষের মাঝে সে এক দীপকেই খুঁজে, হয়ত আবারো ভালবাসা পরীক্ষা করার জন্য নয়ত প্রতিশোধ। হ্যাঁ, প্রতিশোধই হবে; ভাবে বৈশাখী। জীবনে শুধু এই একটিই কাজ বাকি আছে তার।

মাঝে মাঝে পৃথিবীর কোন কিছুই সহ্য করতে পারে না বৈশাখী। এমনকি খুট করে কোথাও শব্দ হলেও ব্যথিত করে তাকে। তার জগতটাকে সে শব্দশূন্য করতে চাই। দরকার হলে সব মানুষগুলোকে বোবা-কালা করে দিতে হবে। তবু সে শব্দ চায় না, হাজার লোক দাঁড়িয়ে থাকবে নিঃশব্দ। কেউ কোন গান শুনবে না, কেউ কাউকে গান শুনাবে না। রাত্রিবেলা চারপাশের লোকজন যখন টিভি নিয়ে ব্যস্ত, তখন সে সত্যি ক্লান্তবোধ করে। বালিশটা এক কানে চেপে অন্য কান বিছানায় ঠেসে শুয়ে থাকে; তারপর একসময় ক্লান্তিকে হারিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। এখন রাস্তায় রিক্সার বেল, গাড়ির হর্ণ বৈশাখীকে অতিষ্ট করে তোলে। ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে মাথার স্কার্ফটা বের করে মাথায় দেয় সে।

ওর বাসার বাকি দুই মেয়ের অবশ্য তেমন বিকার নেই, যেন এইতো স্বাভাবিক। মাঝে মাঝে বৈশাখীদের ফ্ল্যাটেই রুম বন্দী হয়ে থাকে এই দুজন তাদের নিজ নিজ শয্যাসঙ্গী্র সাথে। বৈশাখী দুদিনের বেশি একজনকে শয্যাসংগী হিসেবে দেখেনি ওদের সাথে। রাতে যখন ও বাড়ি ফেরে তখন একবার হলেও ওদের শয্যাসংগীর সাথে দেখা হয়েই যায়। অনেকেরই চোখ পড়ে বৈশাখীর উপর, কাছে পেতে চায়। কিন্তু বাইরে এক পুরুষের ঘৃ্ন্য রূপ দেখে এসে সেদিনই অন্য কোন পুরুষের ঘৃ্ন্য রূপ দেখতে ইচ্ছা করে না বৈশাখীর। ওর ফ্ল্যাটের মেয়েগুলোও মাঝে মাঝে তাকে সাধাসাধি শুরু করে, “যা না, তোকে একটু চান্স দিচ্ছি; এই সুযোগে ড্রিংকসটা করে নেই।” বৈশাখী আপত্তি জানালে ওরা বিড় বিড় করে বলে, “মাগীর দেমাগ কত?” বৈশাখী ভেবে পায়না, এই উচ্চশিক্ষিত মেয়েগুলো কিভাবে এভাবে কথা বলে। সে নাহয় জীবনের বাঁকে নষ্ট হয়ে গিয়েছে, কিন্তু এরা?

সেসময়ের কথা আজও কিছু কিছু মনে পড়ে বৈশাখীর। যখন দীপক ছিল, ভালবাসা ছিল, লজ্জা ছিল, স্বপ্ন ছিল, হারানোর ভয় ছিল, রোমাঞ্চ ছিল তখন বৈশাখীর পৃথিবীটাও সজীব সবুজে ভরে থাকত। ইচ্ছে হলেই দৌড় দিয়ে ভিজত বৃষ্টির জলে, বারান্দার গ্রীল ধরে রিমঝিম বৃষ্টি দেখা কিংবা গ্রামের বাড়িতে গিয়ে নদীতে ডুবস্নান। সেই ঘটনাটা ঘটার ঠিক আগে। সেদিনের পরেই তো মরে গিয়েছে সবকিছু। বৃষ্টির জল মরে গিয়েছে, বারান্দার গ্রীল মরে গিয়েছে এমনকি সেই নদীটাও মরে গিয়েছে; সাথে সাথে তার মনটাও মরে গিয়েছে। বাকি রয়েছে শুধু তার শরীরের খাঁচাটা, বৈশাখীর ভাষায় “পুরুষের খাদ্য”। নিজেকে নিজে বৈশাখী বলে, “পুরুষের খাদ্য কবে মরবি তুই, কবে তুই মরে শান্তি পেয়ে আমাকে শান্তি দিবি?”

বৈশাখী রাস্তার পাশে রিক্সা দাড় করিয়ে কিছু স্লাইস কেক কিনে নেয়। এমনিতেই দেরি হয়ে গিয়েছে, কাজ গিয়ে নাস্তা করে সে ম্যানেজারকে রাগিয়ে দিতে চায় না। বৈশাখী কেক কিনে রিক্সায় উঠতে যাবে ঠিক এসময় গাড়িটিকে আবার সে দেখে। এটা সেই গাড়িটাই না? ভাবে বৈশাখী। ড্রাইভিং সিটে একজন তরুন যুবক বসে আছে। দূর থেকে দেখে যুবকটিকে তারই বয়েসী মনে হয় বৈশাখীর। হয়ত যুবকটির গন্তব্যস্থলও সেদিকে যেদিকে সে যাচ্ছে, ভাবে বৈশাখী। সে রিক্সায় উঠে রিক্সাওয়ালাকে তাড়াতাড়ি যাবার জন্য তাগাদা জানায়।

গুলশান এলাকাটা একদিক দিয়ে খুব ভাল, কেউ কাউকে নিয়ে মাথা ঘামায় না। সবাই ছুটছে, গাড়ি ছুটছে, বাস ছুটছে, রিক্সাগুলো এক গলি থেকে আরেক গলি ছুটে চলেছে; বৈশাখীও ছুটে চলে। এই নিষ্প্রাণ দেহ নিয়ে কিভাবে ছুটে চলে, ভাবে সে। হয়ত এখানকার সমাজ ব্যবস্থা বড় বেশি আলগা, কখনো আঠালো আবার কখনো সুযোগ সন্ধানীও বটে। তবে এ শহরটাই ওকে বাঁচিয়ে রেখেছে, অনেক ভেবে বের করেছে সে। ওদের গ্রামে হলে কি বেঁচে থাকত পারত? তার কোন দোষ না থেকেও সমাজের প্রত্যেকটা সূঁচ এসে বিঁধত তাকে, তখন এই শরীরটাই তো দায়ী হত; সে নিজের শরীরকেই ঘৃ্না করে এখন। বহুদিন আগে গ্রামে ঘটে যাওয়া এক ঘটনার কথা মনে পড়ে তাঁর। পাটক্ষেতে সর্বস্ব হারানোর পর আত্নহত্যা করেছিল ওর বান্ধবী, ওর সাথেই পড়ত। সমাজের সেইসব মানুষকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ওর বান্ধবী বাঁচতে পারেনি, সেও পারত না। কিন্তু সে এখনো নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। এ শহরই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। কিসের জন্য? প্রতিশোধ? বৈশাখী হঠাতই শরীরে তীব্র জ্বালা অনুভব করে উঠে।

নিয়াজ প্রায় দিন সাতেক ধরে বৈশাখীকে ফলো করছে, এ জীবনে অনেক মেয়েকেই সে তার বাহুর মধ্যে নিয়েছে। কিন্তু এ মেয়েটার মধ্যে কি যেন আছে যা ওকে আকর্ষন করে। অন্য মেয়ের মত নয়, সে অন্যভাবে মেয়েটাকে পেতে চাই। নিয়াজ কি ভালবেসে ফেলল মেয়েটাকে? মনে মনে মুচকি হাসে নিয়াজ। ওর ফ্রেন্ডগুলো শুনলে নিশ্চিত “আনস্মার্ট” জাতীয় কিছু একটা গালি দিয়ে বসবে। ওর ফ্রেন্ডগুলো আবার লোকচক্ষুর আগোচরে লিফ টুগেদারও করছে, তবে এই কাজটা সে এখনো করতে পারেনি। ঢাকা শহরে তাদের তিন জায়গায় নিজস্ব বাড়ি আছে। বাড়িতে তো আর অপরিচিত মেয়ে রাখা যায় না তাই নিয়াজের এই ইচ্ছে অপূর্ণই থেকে গিয়েছে।

ঢাকা শহরে ধনী বলতে যা বুঝায় নিয়াজরা তাই। লং ড্রাইভে যাওয়া, রাতভর পার্টিতে নাচা; এসবই নিয়াজের প্রাত্যহিক জীবনের বেশিরভাগই ঘিরে রাখে। কিন্তু দিনসাতেক হল এই রুটিনে ছেদ পড়েছে, বৈশাখীকে দেখার পর থেকে। বৈশাখী যে শপিংমলের বিপনি বিতানে কাজ করে, একদিন বিকেলবেলা নিয়াজ গিয়েছিল সেখানে। তারপর থেকেই নিয়াজের সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেল। যেখানে যাই সেখানেই এই মেয়েটার মুখ ভেসে উঠে, আচ্ছা যন্তনায় পড়েছে নিয়াজ। তারপর সেই বিপনি বিতানের ম্যানেজারকে ম্যানেজ করে বৈশাখীর নাম ঠিকানা জোগাড় করে নিয়েছে। তারপর নিয়মিত রুটিন করে সকাল বেলা বৈশাখীর বাসা থেকে তার পিছু পিছু যাওয়া, বিপনি বিতানের আশে পাশে থেকে দূরে দাঁড়িয়ে তাকে লক্ষ্য করা। কিন্তু দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেলে সে কিছুক্ষনের জন্যে হারিয়ে ফেলে বৈশাখীকে, খুঁজে না পেয়ে ওর বাসার সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকে, রাতের দিকে বৈশাখী ফিরলে গাড়িতে বসেই তাকে লক্ষ্য করে; বাসায় বৈশাখী ঢুকে গেলে গাড়িটা নিয়ে চলে আসে। এরকম আর ভাল লাগছে না নিয়াজের, সে তো কোনদিন কাউকে এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেনি। তাহলে কেন এ লুকোচুরি খেলা, অজান্তে গিয়ারটা বাড়িয়ে দেয়; হুঙ্কার দিয়ে উঠে গাড়িটা। চমকে উঠে নড়েচড়ে বসে ও। নিয়াজ কিছুটা ধাতস্থ হলে গাড়ির এমপিথ্রিটা আরো জোড়ে ছেড়ে দেয়। ধাম ধাম শব্দে গাড়িটার পেছনটাতে বানিজ্য মেলা বসেছে মনে হয়।

বৈশাখীর রিক্সাটা খুব ধীরে ধীরে এগুচ্ছে। ফলে নিয়াজও গাড়ি ওর স্বাভাবিক স্পিডে চালাতে পারছে না, এতে ওর অস্থিরতা আরো বেড়ে গিয়েছে। উশখুস করে কয়েকটা বাড়ি দিয়ে ফেলল গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে। রিক্সার সাথে নিয়াজের গাড়িটা এবার সমানুপাতে এগুতে থাকে। এসেই গেছে, গুলশানের গোলচত্বরটা সামনেই; ট্রাফিক সিগনালের সবুজ বাতি দেখা যাচ্ছে দূর থেকে। গলির শেষপ্রান্তে বৈশাখী রিক্সা থেকে নেমে হাঁটতে থাকে, মেইন রোডে রিক্সা যায় না। নিয়াজের গাড়িটা সিগনালের সামনে আসতেই সিগনালটা সবুজ থেকে লাল হয়ে গেল, নিয়াজ এবার মনে মনে আবৃত্তি করে কয়েকটা গালি বলল। গাড়ীতে বসেই সে বৈশাখীর ডান দিকটা দেখতে পাচ্ছে নিয়াজ। মুখে কোন প্রসাধনী নেই, তারপরও কিভাবে এত সুন্দর লাগে একজনকে; ভাবে নিয়াজ। ও যত মেয়ের সাথে মিশেছে তারা তো একটা মিনিটও সুগন্ধী প্রসাধনী ছাড়া কোথাও বেড়ুবে না। আর এ মেয়েটা প্রসাধনী সম্পর্কে এত উদাসীন। তাই বলেই কি এত সুন্দর লাগে মেয়েটাকে? শরীরের কাপড়টা এমনভাবে মেয়েটাকে জড়িয়ে রাখে যেন সহজেই মেয়েটার কমনীয় ভাবটা চোখে পড়ে।

সিগনালটা ছাড়িয়ে নিয়াজ যখন গাড়িটা শপিং মলের সামনে আসল তখন বৈশাখী কয়েক ধাপ সামনে হেঁটে যাচ্ছে। নিয়াজ গাড়ী থেকেই চিৎকার করে উঠে।

-এক্সকিউজ মি?

বৈশাখী ঘুরে তাকাল, আবার সেই গাড়িটা দেখতে পেল সে, গাড়িটার ভেতর থেকে যুবকটাকেও নামতে দেখল। বেশ ভাবুক চেহারা, পোশাক দারুন পরিপাটি কিন্তু চুলগুলো উস্কো খুস্কো; বোঝায় যায় কয়েকদিন ওখানে চিরুনী পড়েনি। বৈশাখীর তেমন ভাবান্তর হল না কিন্তু যখন দেখল যুবকটা একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থেকে ওর দিকে এগিয়ে আসতে থাকল তখন তার চোখের ভ্রু কুঁচকে গেল। পুরুষের লোভাতুর দৃষ্টি দেখলেই বৈশাখী খুব সহজেই এখন চিনতে পারে। কিন্তু যুবকটার চোখে সেরকম কোন লালসা নেই, বরং উদভ্রান্তের মত কিছু খোঁজার চেষ্টা করছে। বৈশাখী পিছন ফিরেও আবার ঘুরে তাকাল, তারও একটু কৌ্তহূল দেখা দিল আজ; কতদিন পর। তবে তা কিছুক্ষনের জন্যে। ততক্ষনে যুবকটাও এসে পড়েছে কাছে।

-তোমার নাম কি বৈশাখী?

বৈশাখী অবাক হল অপরিচিত মানুষের মুখে নিজের নাম শুনে। যুবকটাকে এবার জ্বরগ্রস্ত মনে হল তার। উত্তর দিল,

-হ্যাঁ। কেন?

-তোমার কি কোন বয়ফ্রেন্ড আছে? বিশ্বাস কর, আমার সেরকম কোন গার্লফ্রেন্ড নেই।

হড়হড় করে কথাগুলো বলল যুবকটা। বৈশাখীর কিছুক্ষন সময় লাগল বুঝতে যে যুবকটা কি বলতে চাইছে। এই যুবকটা জানেও না যে কিভাবে প্রেম নিবেদন করতে হয়। মনেহয় তা কখনো করতেও হয়নি। বৈশাখী ঘুরে কথা না বলে শপিং মলের ভিতরে ঢুকে যায়, পিছন থেকে যুবকটা আবারো কিছু বলে; বৈশাখী কান দেয় না। তবে বৈশাখীর এই হেঁটে যাওয়ায় কোন ছন্দ উঠল কি? আজকাল প্রেম এমনি, না চিনেও প্রেম নিবেদন করা যায়, ভাবে বৈশাখী। তবে তার কেন জানি খারাপ লাগল না। নিজের কাজের জায়গায় এসে বৈশাখীর ঠোঁটে একটুখানি হাসি ঝিলিক দিয়ে উঠল। পাগল নাকি যুবকটা? ভালবাসে নাকি তাকে? মনের গহীনে কোথাও সুরটা নেচে উঠল কি তার? বিপনি বিতানের আউটার ওয়াল গ্লাস দিয়ে বানানো, পরিষ্কার দেখা যায় নিচে, বৈশাখী লুকিয়ে যুবকটিকে দেখার চেষ্টা করে। যুবকটা গাড়ির দিকে হেঁটে যাচ্ছে, গাড়ির দিকে পৌঁছে শপিং মলটার দিকে এমনভাবে তাকাল যে, বৈশাখীর মনে হলে সে বলছে, “দেখ, আমি আবার আসব”।

ঠিক সেইসময় বৈশাখীর পাশে ম্যানেজার এসে দাঁড়াল,

-কটা বাজে?

-এগারটা দশ।

-রোজ রোজ দেরি কর কেন বুঝি না। এরকম করলে কিভাবে চলবে?

-সরি শফিকদা। আজ শরীরটা খারাপ।

-প্রত্যেকদিন নতুন নতুন বাহানা দিবে না। জান, তোমার জন্যে সকালবেলাতেই কতগুলো কাষ্টমার ফিরে গিয়েছে। তোমাকে রেখে হচ্ছে না আমার।

-সরি শফিকদা, কাল থেকে আর হবে না।

-মনে থাকে যেন।

ম্যানেজার শফিক গজগজ করতে চলে যায়। প্রতিদিন সকালবেলা এসে ম্যানেজার শফিকের বকবক শুনে কাজ শুরু করে বৈশাখী। আজকের দিনটায় কিছু নতুন ঘটনা ঘটলেও শুরু হল সেই একইভাবে। কিছুক্ষন পর আবার তার যুবকটার কথা মনে পড়ে। যুবকটি সত্যিই তাকে ভালবাসে? যদি শুধু শরীরই চায় তবে ভালবাসায় জল ঢেলে প্রেমদেবীকে অপমান করা কেন? নাকি বড়লোকের বখে যাওয়া ছেলে কয়েকঘন্টা কাটাতে চাই তার সাথে? তাহলে এ ধরনের ছেলেদের তো লজ্জা করার কারন নেই। এভাবে সংকোচ প্রকাশ করার দরকার নেই। তবে এদের ভালবাসার মানে বুঝা আসলেই বেশ কষ্টকর, ভাবে বৈশাখি। সে এবার নিজেকে শাসন করে, কেন এত ভাবছে সেই যুবকটিকে নিয়ে; এত ভাবার কি আছে? ও জানেই তো, ওর জীবনের হাজারটা অতীত আছে কিন্তু কোন ভবিষ্যত নেই। এসময় কাশতে থাকে বৈশাখী, শরীরটা আসলেই বেশ খারাপ। আজ ছুটির পরেই বাসায় ফিরে যাবে বলে ঠিক করে, এ শরীর নিয়ে সে কোথাও যাবে না। বৈশাখী কেন জানি এ সিদ্ধান্ত নিয়ে স্বস্তিবোধ করে।

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


One Response to ধারাবাহিকঃ নিশিযাত্রা (পর্ব ১০)

You must be logged in to post a comment Login