ফকির ইলিয়াস

আমার কিছু বাছাই কবিতা – ২

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

আমার কিছু বাছাই কবিতা – ২
———————————
গুহার দরিয়া থেকে ভাসে সূর্যমেঘ
————————————
তন্দ্রা টানেলে এসে এই রূপ অন্য গতি পায়।মূর্চ্ছনায়
নত হয় প্রতিবেশী বেহালা বাদক। আলগে মনের মায়া
জলছবি পরখ করে ,আর ব্যঞ্জন বেদনা নিয়ে সমুদ্রের
নিরিখে হারায়। যেতে হবে বহুদূর। বিশদ বনান্তরে যে
পথিক রেখে গেছে ছাপ, তার ছায়া মাড়িয়ে এই অভিবাসী
নদীদের গান শুনে রপ্ত করে নিতে হবে, না জানা বিকেলের
অভিভাষণ। যারা ঢেউসূত্র শিখে উজানের বিনম্র পাথরে
রেখেছিল হাত। বৈঠাডোরে নিজেদের ভবিষৎ জাগিয়ে
রেখে ঠিক তোমার মতোই লিখেছিল চিঠি, ‘খুব ভালো
আছি’। জীবনেরই ভালো থাকা হয়। আর মৃত চাঁদ শুধুই
বিরহ ছড়ায়, গুহায়। গুহার দরিয়া থেকে ভাসে সূর্যমেঘ।
ভোর হবে, এই সত্য অনির্বাণ জেনে তুমিও হাত রাখো
আমার হাতে।

তুমিতো সমুদ্র,তাই নাবিক আমি ,চন্দনা ঘোষ
নারীর বৃত্তে আঁকা পরাগের,অবনত প্রথম পুরুষ।

রতিদীর্ঘ রাত জাগে চেনা কোনো জলের ভেতরে
—————————————————–
বিস্ময়ে বিভোর হই। অনাগত রোদের কাঁপন এসে ডেকে নিয়ে যায়।
অবেলায় গান গেয়ে উঠে শরত শালিক। কেনো এমন বিভাজনে আছি,
কেনো ভুলনগরে গিয়ে খুঁজেছি মানবীর মাত্রামুখ- সেসব জিজ্ঞাসার
উত্তরে রেখে যাই পুষ্পপদাবলি। খালি হাতে এর আগেও ফিরে গেছে
অনেক পথিক। কেউ লিখে রাখেনি তাদের নাম। এভাবে আমার সত্তা ও
বিলুপ্ত হয়ে যাবে জানি। মাটির আড়ালে এইসব সুনসান নীরব পাথর আর
জলের ভেতরে। শুধু একাই জেগে থাকবে একটি রতিদীর্ঘ রাত স্তব্ধ মমতায়।

আর কিছু ফটক খুলে যাবে অনাগত পাখিদের জন্য। পালক ঝেড়ে তারা
এসে দাঁড়াবে কর্ণফুলি নদীর কিনারে। যেখানে একদিন অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে
থাকতেন আমার মা। আর নন্দিনী, – লালজবা পরা কিশোরী বোনটি আমার।

পথ অথবা পাখির মৃতদেহ
——————————–
লুজিয়ানা অংগরাজ্যের সড়কে যে পাখিগুলোর মৃতদেহ পড়ে আছে,
ওরা সবাই নিউইয়র্কে ছুটে আসতে চেয়েছিল। ব্রাজিল থেকে যে
পায়রাটি সুইডেনের স্টকহোম শহরে নতুন নিবাস গড়ার কথা তার
সতীর্থকে বলেছিল, আমি আঁতকে উঠেছি তার মৃতদেহ দেখেও।
আর আরকানসাস শহরের সেই প্রায় পাঁচ হাজার পাখির জন্য এই
অশুদ্ধ সূর্যতলে দাঁড়িয়ে লিখছি কবিতার শোকশব্দ গাঁথা।

মানুষের আতশবাজিতে শিউরে উঠেছে যে আকাশ, আমি তার
প্রতিনিধি কী না, তা জানার জন্য পৃথিবীর পরাক্রমশালীদের কাছে
বার বার চিঠি লিখেও ব্যর্থ হয়েছি। আমার ব্যর্থতা দেখে হেসে
উঠেছে সমুদ্র। বেদনায় মাছগুলো নীল হয়ে ভেসে উঠেছে ঠিক
আমার চোখের সামনেই।

একজন বিপন্ন পরিবেশবাদী আমার সামন দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে
বলেছেন, কবি ! আমাদের নিস্তার নেই। বৈদ্যুতিক খুঁটির মতোই
আমরা ক্রমশঃ হয়ে যাচ্ছি – কলুর বলদ !
যে বন আর পরিবেশজীবন আমরা ধারণ করতে পারি না, সেই
পরিমিত সবুজ আমাদেরকে কাছে টানবে আর কোন জনমে !

যে হাত আকাশ বাজায়
—————————-
পল্লীবালার মতো অজানা গন্তব্যের দিকে ছুটে যায়
বর্ষার ভোর। সূর্যকণাগুলো পড়ে থাকে নিষ্প্রাণ। পড়ে
থাকে আমাদের সমন্ধসমগ্র বদলে যাবার সুদৃঢ় বাসনায়।
বাসনশিল্পের মগ্ন ধারণ ক্ষমতা নিয়ে লেখা পদ্যপত্র
আবার পড়ে শোনাই । জানি, শোনার সময় ও অনেকের
থাকেনা মাঝে মাঝে। সন্তর্পণে ভেসে যাওয়া জলছত্র আর
খসে পড়া ঘুমরেখাকে ও মনে রাখে না কেউ কেউ। অথচ
এ জনমে সবারই প্রেমের কাছে পরাজিত হবার কথা ছিল।

মৃতনদীর মতো মাটির কংকাল বুকে জেগে থাকে বসন্তবিকেল।
যে হাত আকাশ বাজায় , সেই দুটি হাত ছুঁবে বলে দূর থেকে
উড়ে আসে গ্রহের গাঙচিল। আমাদের সৌরভ্রমন সম্পন্ন হলে
তুমি এভাবেই পাখিজনম দিও,প্রিয় মাটি। আরেকবার উত্তীর্ণ
হতে চাই প্রবেশিকা , প্রেমের শাসন।

সন্ধ্যাস্বজন
—————-
বিকেলও দাঁড়িয়ে থাকে কোলে তোলে নিয়ে
সমগ্র কোলাহল। জিজ্ঞাসা করি ; কার কাছে
নিয়ে যাবে এই শব্দের ভেলা, ঘনসমুদ্রের উজানে
দেখি না তো কোনো মুখ । কোনো প্রতীক্ষার প্রদীপ;
উড়তে তো দেখি না আলোর সলতে ডানা।

উত্তর আসে বিকেলের পক্ষ থেকে। ‘তুমিও স্বার্থপর
হলে কবি !’

চমকে উঠি। আমি তো আজন্ম স্বার্থপরই ছিলাম !
এখনও আছি। শুধুই চেয়েছি ভালোবাসা। কামনার
শুভ্র উদ্যানে হলুদ গোলাপের কুঁড়ি দেখে, সাজিয়েছি
শুশ্রূষার উত্থান। কেবলই আওড়িয়েছি বুলি – ‘ আপনারে
লয়ে বিব্রত রহিতে আসিয়াছি আমি অবনী পরে !’

কী এক ক্রান্তিকালের বাহক আমি ! বিবর্তন চেয়েছি,
অথচ খুঁজিনি শিকড়বাঁকের গতিশব্দরূপ।

সূর্যও দাঁড়িয়ে থাকে, আমাকে জানাতে সান্ধ্যপ্রণাম।
আর বলে যায়; যাচ্ছি পশ্চিমে। তুমি পূর্বে থাকো কবি।
অথবা ফিরো উত্তরে। যেতে পারো দক্ষিণেও। হাতে নিয়ে
আলোর দক্ষিণা। যেভাবে স্বজনেরা ফিরে সপ্তাহের সওদা
শেষে,আর পরখ করে সবটুকু ছায়া লেনাদেনা ।

হাওরের দয়াল বাতাসে
—————————
তোমাকে প্রথম শনাক্ত করেছিল হাওরের দয়াল বাতাস। ঝড় জমে উঠার আগে মেঘবরণ কবিতা প্রদেশে, আরেকবার নেচেছিল ওড়নার আলো, রাত- আর পাশাপাশি চাঁদের ভাষা লিখে রেখেছিল অবিরাম, ঘোরলাগা প্রেমগুচ্ছ- নাম। আমিও সে রাতে, কেবল ছিলাম দর্শক সারিতে। চিনে রাখা কিংবা পরখ করে জেনে নেয়ার বিকল্প কৌশলকামী সুবোধ বালক! উৎসুক তারার আড়ালে দূরগামী গ্রহের বাসর, সাজাতে সাজাতে বারবার ভুলে গিয়েছিলাম সংগৃহীত ফুলগুলোর আদি পরিচয়।
তবে কি, স্মৃতিও দয়াপ্রবণ ভোরের খোঁজে বৈশাখে অবনত হয়? আর বসন্তে ঢেউ তোলে বুকে ও বনান্তে, উষ্ণায়নে দেখে নেয় পর্যটক রমণীর মুখ! ঋতুর নিদ্রাসুখ সেরে, যে চৈত্র ফিরেছিল ঘরে, সেও ডাক দেয় : হাওরের দয়াল বাতাসে,
তোমার চুলের ঝাপটা বারবার ঝড় হয়ে আসে।

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


9 Responses to আমার কিছু বাছাই কবিতা – ২

You must be logged in to post a comment Login